টারজানকে ক্ষণজন্মাই বলা চলে। জন্মের পরই তার সে কী কান্না! তার জন্ম-সংবাদ প্রতিবেশীদের জানাতে যেতে হয়নি। তারাই হঠাৎ মোড়ল বাড়িতে কী ঘটল, দেখতে ছুটে আসে। ভেবেছিল, হয়ত কোন লাঠালাঠি-মারামারি হচ্ছে।তাই এত হট্টগোল, চিল-চিৎকার! মোড়লের নবজাতক তখন পর্যন্ত আস্তে কাঁদছিল। কয়েকজন পড়শি যখন মোড়লের বাড়ির উঠোনে গিয়ে পৌঁছেছে, সেই মূহুর্তে তার কান্না চরমে ওঠে। যারা ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল তারা উলটে চোঁ-চোঁ দৌড় দেয়। যারা ঢুকে পড়েছিল তারা ছুটে বের হতে পথ পায় না!একসাথে সদর দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে উলটে পড়ে।
যারা ওই একটুক্ষণের জন্য মোড়ল পো-র গলা শুনে ফেলেছিল, তাদের নাকি তিনদিন কানে তালা লেগেছিল! আর বুড়ো বাসুদেব কৈবর্ত…।সে বেচারা কার ধাক্কায় উলটে পড়ে চৌকাঠে।তার পায়ের হাড়ের খিল সরে যায়। সে আর ছুটে পালাতে পারে না। ফলে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সে প্রায় মিনিট খানেক মোড়লের নবজাতকের গলা শুনে ফেলে।তার ফলে তাকে কালা দুর্নাম নিয়ে বাকি জীবন কাটানো শুরু করতে হয়।পা সেরে যায়। কিন্তু কান সারে না!
কিন্তু কী আশ্চর্য, এতে কিন্তু নিতাই মোড়ল বা তার স্ত্রীর তেমন কিছু হল না।অবশ্য রাবণের সাথে শূর্পনখার মিল থাকবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। একই পরিবারের ব্যাপার, হয়ত কোন জিন ঘটিত সুযোগ-সুবিধা নিতাই আর তার বউ পেয়ে থাকবে।তবে পাড়া প্রতিবেশীদের দূর্ভোগের অন্ত ছিল না।সে কাঁদতে শুরু করলে যে যার বাড়ি ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে যেত।বুড়ো-বুড়িরা যারা ছুটোছুটি করতে পারত না তেমন, তারা ঝটপট জানলা-দরোজার খিল-কপাট এঁটে দিত।কানে আঙুল গুঁজে অপেক্ষা করত মোড়ল পো-র কান্না থামার।
মোড়ল পো-র জন্মের তিনদিন পরই ছিল পাশের গাঁ-এ গঞ্জের সাপ্তাহিক হাট।কুমারপুরের জয়নাল শেখ সবজি কিনছিল পহলান গ্রামের ব্যবসায়ী রেজাক খাঁ-র দোকানে। বেগুন ওজন করতে করতে রেজাক শুধোয়, ‘হ্যাঁগো, তোমাদের গাঁয়ে সরকার নাকি বিলেত থেকে কী একটা মিশিন লিয়ে এসছে শুনলুম…’
জয়নাল আকাশ থেকে পড়ে। ‘মিশিন? কী বলো হে! গরমেন্ট শহর থাকতে ওই পোড়া গাঁয়ে কল বসাতে আসবে!’
‘না, গঞ্জের লোক সেরকমই তো বলাবলি করছে, শুনলুম…।এই রেতের দিকে আমরাও কেমন যেন একটা আওয়াজ পাই…এক কোশ দূরেও কানে কেমন যেন তালা লেগে যায়…সব্বাই বলাবলি করছে, নিশ্চয় বিলিতি মেশিন, নইলে কক্ষণও এত আওয়াজ হবে নাই…’
মোমরেজ পুর এর হাবল সেন বেগুন বাছা থামিয়ে বলে, ‘দাদা লুকোলে কী হবে, নিশ্চয় বিলিতি মেশিন…আমরাও রেতের দিকে কেমন যেন একটা আওয়াজ পাই…’
জয়নাল প্রসঙ্গটা আলাদা ভাবে উত্থাপিত হওয়ায় ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।জিগ্যেস করে, ‘কেমন আওয়াজ বল দিকি…’
‘কী বলব? ঠিক এক কথায় বোঝান যাবে না…।এই ধরো, শতেক লোক চেঁচালে যেমন হয়…হাজার বোম ফুটলে যেমন হয়…কিম্বা লক্ষ ঝিঁঝিঁ ডাকলে যেমন হয়…’
তবু জয়নাল বুঝতে পারে না।
‘এই ধরো, ভুতের অট্টহাস্য যেমন…শাঁকচুন্নীর কান্না যেমন…সব একসাথে মেশালে ঠিক যেমনটি হয়…’
এবার মুখে হাসি ফোটে জয়নালের।শব্দের ধরন দেখে ‘বিলিতি মেশিন’টা আদতে যে কী, বুঝতে বাকি থাকে না! এইভাবে নিতাই মোড়লের নবজাতকের কথা লোকমুখে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
নিতাই বেশ গরিব ছিল। ছেলের চেহারা আর গলার আওয়াজ দেখে লোকে তার নাম দিল টারজান। টারজান বড় হতে নিতাই এর আর দারিদ্র্য রইল না।তার মানে এই নয়, ব্যাটা বড় হয়ে খেটে-খুটে তার বাপের অভাব মোচন করল। টারজান যত বড় হতে লাগল তার গলা তত খোলতাই হতে লাগল।আর সেই নিয়ে শুরু হয়ে গেল এক নতুন খেলা।
কুমারপুর গ্রামের উত্তরে ছিল কায়েতদের বাস।দক্ষিণে বাস করত উগ্রক্ষত্রিয়রা।পাড়ায় পাড়ায় সদ্ভাব মোটেই ছিল না।রেষারেষি এমন ছিল যে, এরা যেদিন রাত্রে যাত্রা-পালার আসর বসাত ওরা সেদিনই কবি গানের লড়াই না বসিয়ে পারত না। নিজের নাক যাক, কিন্তু পরের যাত্রাভঙ্গ যেন অবশ্যই হয়। আর এমন যুদ্ধে উত্তর পাড়া বরাবরই হেরে যেত। কারণ উগ্রক্ষত্রিয়দের ছিল টাকার জোর।তারা দারুণ সব আকর্ষণীয় জিনিসের আয়োজন করত। ফলে পাড়ার প্রেস্টিজ ফেলে উত্তর পাড়ার ছেলে ছোকরাদের অনেকে লুকিয়ে চলে যেত দক্ষিণ পাড়ার মোচ্ছব দেখতে।ফলে উত্তর পাড়ার দাদাদের মাথা হেঁট হত।কিন্তু সেই ট্রাডিশানও একদিন পালটে গেল।উত্তর পাড়ার লোকেরা অনায়াসে দক্ষিণ পাড়ার সব অনুষ্ঠান ভন্ডুল করে দিতে লাগল!
পদ্ধতিটা আবিষ্কৃত হল অদ্ভুতভাবে। দক্ষিণ পাড়ার দাদারা কালিপুজো উপলক্ষে সেবার একটা বড়সড় যাত্রা দলকে বায়না করল।বিখ্যাত দল। শুধু গরু-মোষের গাড়িই দশ-বারো খানা!তারা যাত্রাগানের একদিন পূর্বেই এসে হাজির হল গ্রামে। তাদের লট-বহর দেখে উত্তর পাড়া তড়িঘড়ি একটা কবিগানের আসরের আয়োজন করল বটে, কিন্তু বুঝতে পারল হালে পানি পাওয়া যাবে না…।
দর্শক-শ্রোতার সংখ্যায় বারবার হেরে যাবার হাত থেকে বাঁচার উপায় বাতলাতে বসল সবাই।বয়স্করা এক একজন এক একরকম পন্থার কথা তুলছে। এমন সময়ই হঠাৎ করে এক ছোকরার মাথায় খেলে যায় বুদ্ধিটা!
সন্ধ্যে তখন গাঢ় হচ্ছে দক্ষিণ পাড়ায়।ছেলে-বুড়ো সবার ভিড়ে ভরে গেছে মাঠ।ভিনদেশি যাত্রা দলের পালাগনে মজে গেছে সারা পাড়া।ফার্স্ট সিন পড়তেই সবাই তখন মাথা নাড়ছে ‘আহা-আহা’ করে।তখন চাদর মুড়ি দিয়ে গুটি গুটি করে উত্তর পাড়া থেকে দক্ষিণ পাড়ায় দিকে হেঁটে চলেছে বারো বছরের এক কিশোর।
চাদর মুড়ি দিয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে সে খানিক যাত্রা পালা শুনল।কিন্তু দ্বিতীয় সিন পড়ার আগেই সে চাদর থেকে বের করল মুখ।তারপর কথামত কাজ! সে শুরু করে দিলে গলা ছেড়ে তার নিজস্ব গান! আর কেউ নয়, সে দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা নিতাই মোড়লের ছেলে টারজান।
এর ফলে হল কী, উত্তর পাড়ার ছেলেরা যাতে হুজ্জুতি করে অনুষ্ঠান পন্ড না করতে পারে, তার জন্য দক্ষিণ পাড়ার কিছু ছেলে, যারা লাঠি-সোঁটা নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল, তারা জ্ঞানশূন্য হয়ে কে কোন দিকে পালাল! উৎসাহী শ্রোতারা মাথা নাড়া বন্ধ করে চম্পট দিল মাঠ ছেড়ে! আর যাত্রা দলের শিল্পীরা, গাঁয়ে ডাকাত পড়েছে ভেবে, রাতের আঁধারে মাঠ ভেঙ্গে কে কোন দিকে ছুটল!
তখনকার দিনে বহু গ্রামে ওই রকম পাড়ায়-পাড়ায় রেষারেষি ছিল।তাদের কানেও গিয়ে পৌঁছল কুমারপুরের নিতাই মোড়লের ছেলে টারজানের কথা।তারা অন্য পাড়ার অনুষ্ঠান পন্ড করার জন্য টারজানকে নিতে এল হায়ার করে। সুযোগ বুঝে নিতাই মোড়লও দাম হাঁকতে লাগল!এক একটি সন্ধ্যার জন্য, বাপ-ব্যাটার রাতের রুটি, খাসির মাংস, দুধের ক্ষীর ছাড়াও নগদ দিতে হত! তবেই টারজানকে পাওয়া যেত!
এদিকে মোড়ল পো-র বুদ্ধি-শুদ্ধি খুব একটা না থাকলেও সে কিন্তু নিজের কদর বুঝল। বলা ভাল, গলার কদর বুঝল! হয়ত কেউ নিজের শশা ক্ষেতে কাজ করছে আপনমনে।কেউ খন্তা দিয়ে মাটি আলগা করছে, কিংবা চারার গোড়ায় দিচ্ছে সার…।ক্ষেত জুড়ে ফলন্ত শশার বাহার।এমন সময় টারজান গিয়ে হামলা করল!আর কিছু নয়, আলের মাথায় দাঁড়িয়ে হেড়ে গলায় একটা গান জুড়ে দিলে। চাষি খন্তা ফেলে মারলে দৌড়।লেবাররা কে কোথায় ভেগে গেল…।
জমি থেকে চাষি ভেগে যেতেই মোড়ল পো গান থামিয়ে দিলে।চাষি তখন দূরে দাঁড়িয়ে কাক-তাড়ুয়ার মত কাঁপছে।আর বলছে, ‘শশা খাবি বাবা…নিবি তো নে না দু’টো…নে…’
বলা বাহুল্য, দু’টোর বদলে দশটা না নিয়ে মোড়লের ব্যাটা নড়ত না…। ঠিক এই কারণের জন্যই সবাই তাকে সমীহ করে চলত। সেও চাহিদা মত কলাটা-মুলোটা পেত!
নিতাই মোড়লের বাড়ির পাশেই ছিল নরহরি মোড়লের মুদির দোকান। নিতাই এর ফ্যামিলি সেখানে মাস-কাবারির হিসাবে ধার-বাকিতে মাল নিত।একদিন হয়েছে কী, নরহরি মোড়ল সেসময় দোকানে ছিল না।মাল দিচ্ছিল তার ছোট ব্যাটা হাবু। হাবু আবার একটু মাথা মোটা।সে এক দোকান লোকের সামনে বলে ফেললে, ‘কাকু, আপনার অনেক টাকা বাকি, দোব দোব করে দিচ্ছেন না।কিছু শোধ না হলে, বাবা বলেছে, আর ধারে মাল হবে না…’
নিতাই অপমানিত হয়ে ফিরে গেল।নিতাই এর গিন্নি করলে কি ছেলেকে পাঠিয়ে দিলে দোকানে।এবার বোঝ মজা!
টারজান দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের কথামত জোর গলায় একটা গান ধরে ফেলল।ফলে হল কী, খদ্দেররা তেলের বয়াম, চালের ধামা, নূনের কৌটো ফেলে যে যে দিকে পারল ছুটে পালালো…।আর নরহরি মোড়লের ছোটছেলে দোকানের মধ্যেই ভিরমি খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল!সে এক হুলুস্থুলু কান্ড!
শেষে কোত্থেকে ছুটে এল নরহরি মোড়ল।নিতাই এর হাতে ধরল। সেদিনের সব মাল বিনাপয়সায় দিয়ে তবে তাকে সন্তুষ্ট করল…
এই ঘটনার কিছুদিন পর নিতাই গেছে গঞ্জের বাজার পহলান-এ বাজার করতে।ফুল-কপির দাম নিয়ে আনাজ দোকানি বেজায় তর্ক জুড়ল তার সাথে।
-যান যান, এক টাকায় কানা বেগুন মিলবে, বাঁধা কপি নয়…
-আমি বাজার-হাট করে করে চুল পাকিয়ে ফেল্লাম হে…
ছোকরা দোকানদারও কথার তোড়ে বলে দিলে, ‘আনাজ বেচে বেচে আমারও চুল পেকে গেল।কেনার মুরোদ নেই তো খাবার শখ কেন?
-কী! যত বড় মুখ নয়, ততবড় কথা! তোমার কী করতে পারি জানো? রাগে কাঁপতে থাকে নিতাই মোড়ল। সে এতক্ষণ ভাবছিল তার পরিচয় জেনেও তার সাথে তর্কের মুর্খামি কে করে! যেই শুনল সে কুমারপুরের লোক ব্যাপারীর মুখ কিছুটা শুকোলো। কুমারপুর এর লোকদের কে না জানে! সেবার তাদের গাঁয়ের অমন সোন্দর যাত্রা পালাটা ভন্ডুল করে দিলে!
নিতাই এবার স্মিত হেসে বললে, ‘আমিই নিতাই মন্ডল, টারজানের বাবা।’
ব্যাপারী ততক্ষণে নিজের আহাম্মকি বুঝতে পেরেছে। তার আশপাশের দু’একজন হাটুরে দোকানদারও উঠে এসেছে। তারা ঝটপট কয়েকটা কপি ভরে দিলে নিতাই এর ব্যাগে!কাষ্ঠ হাসি মুখে ফুটিয়ে বললে, ‘ছোকরা ছেলে…মোড়লমশাই… না বুঝে হয়ত একটু মজা করে ফেলেছে…। আপনি কুমারপুরের নিতাই মোড়ল সেটা আগে বলবেন তো…’
টারজানকে তার ইস্কুলের মাস্টারেরা কেউ পড়া ধরা বা মারধরের মত বোকামো করত না।তবে একবার এক নতুন স্যার কিছু না জেনে তাকে পড়া ধরল। তারপর পড়া বলতে না পারার কারণে তাকে মারধরের মত অপকর্মটিও করে বসল!
ফলে হল কী, মোড়লের পো মনের দুঃখে মিনিটখানেক কাঁদল। সেদিন আর ইস্কুল হল না।আর হবেই বা কী করে! টারজানের কান্না যখন থামাল, তখন ইস্কুল খাঁ-খাঁ করছে!আর নতুন মাস্টার? ক্লাসের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে!
টারজান পড়াশোনায় তেমন সুবিধা করতে পারছিল না।অথচ কায়েত পাড়ার নিয়তিশ্বর পড়াশোনায় কত এগিয়ে।টারজান তাই একদিন নিয়তির কাছ থেকে একটা বই নিলে।তারপর পড়ে গেল পুজোর ছুটি।বেশ কয়েকদিন কেটে গেল টারজান বই ফেরৎ দেবার নাম করল না।তখন নিয়তি নিজেই গেল বই আনতে।নিয়তিকে যেই না দেখা জানলা দিয়ে, অমনি টারজান চিল চিৎকার করে একটা বেসুরো গান ধরে ফেলল!নিয়তি সেবার ছুটে পালিয়ে কোন রকমে জান বাঁচাল।ছুটির পর ইস্কুল খুলল, কিন্তু বেচারা নিয়তি ভয়ে বইখানা আর ফেরৎ চাইতে পারল না।ফের যদি গান শুনিয়ে দেয়!
অনেকবছর ঘষে-মেজে, এক এক ক্লাশে দু’-তিন বার করে ফেল মেরে পড়া ছেড়ে দিল টারজান।পড়াশোনায় যখন তেমন কিছু হল না, সে ভাবল কবি হই।বেশ কিছুদিন সে কবিতা চর্চা করল।বেশ কিছু কবিতা সে ডাক যোগে পাঠাল, বড় কাগজের অফিসে।বহুদিন কেটে গেল, কিন্তু একটা লেখাও ছেপে বেরল না।তখন সে শহরে গেল, এক পত্রিকার অফিসে।সম্পাদকের সাথে দেখা করতে।
ভরদুপুরে টারজান যখন তাঁর অফিসে পৌঁছাল, তখন সম্পাদক মশাই তাঁর টেবিলের নিচে পড়ে যাওয়া একটা কাগজকে তোলার চেষ্টা করছিলেন। টারজান দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার নমস্কার!’
সম্পাদক ভদ্রলোক ভাবলেন ছাদের চাঁঙড় খসে বুঝি তার টেবিলে পড়ল!তিনি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলেন।সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা টেবিলের কোণায় ঠুকে গেল জোরসে।মাথা তুলে দেখলেন, না সেরকম কিছু ঘটেনি।বরং দরজায় দাঁড়িয়ে একটা উটকো লোক।উঠতি কবিরা তো প্রায়ই জ্বালাতে আসে!
সম্পাদক মশাই আঘাতের স্থানে হাত বুলোতে বুলোতে বাজখাঁই গলায় বললেন, ‘কী চাই? বাইরে যান।কবিতা-ফবিতা এখন দেখার সময় নেই…’ টারজান বাস্তবিকই কয়েকটা কবিতা নিয়ে এসছিল।যখন দেখল উদ্দেশ্য সিদ্ধি হল না, সে নিচে নেমে এল। একতলায়, পত্রিকার প্রেসরুমে।তার মনে খেলে গেল দুষ্ট বুদ্ধি।সে চিৎকার করে বেসুরো গলায় একটা গান জুড়ে দিলে!
ফলে হল কী, কম্পোজিটর লেটার-ফেটার ফেলে পালালে।তার গায়ে লেগে উলটে গেল টাইপ-কেস।ছিটকে পড়ল সব কম্পোজিং স্টিক।প্রুফ রিডার শর্টকাটে দরজায় পৌঁছাতে গিয়ে উলটে দিল গ্যালি, খান কতেক চেয়ার-টেবিল।এক কোণে এক দপ্তরি এসে নতুন সংখ্যা বাঁধাই করছিল।সে নিজের হাতে ছুঁচ চালিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল! ওই ঘটনার জেরে নাকি, ওই পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশও বন্ধ ছিল!
টারজান গ্রামে ফিরে এল। সে দেখল তার পড়াশোনায় তেমন কিছু হল না।কবিতা চর্চা করেও ধাক্কা খেতে হল!কোন মাস্টারি বা পন্ডিতিও তার দ্বারা হবে না। তখন সে ভাবলে একজন বড় গায়ক হব।যেই ভাবা সেই কাজ।রাতের দ্বিতীয় প্রহরে সে গিয়ে দাঁড়ালে বাড়ির উঠোনে।ফটফটে চাঁদের আলোকে স্বাক্ষী রেখে সে শুরু করলে তার গায়কি জীবন।শুরু করলে গলা সাধা! মনপ্রাণ ঢেলে সে গেয়ে যেতে লাগল একের পর এক তার প্রিয় গান…
ফলে হল কী, এতদিনেও কষ্ট-সৃষ্টে, ভিটের মায়া ত্যাগ করতে না পেরে গাঁয়ের ভিতর রয়ে গেছিল যেসব কাক-পক্ষী, সেই রাতে তারা উড়ে পালালো। হঠাৎ কী যে ঘটে গেল তারা বুঝতে পারল না।কিন্তু বুঝতে পারল জান বাঁচাতে গেলে এই গ্রামের বাসা ছেড়ে পালাতে হবে।টারজান তখন দরদ ঢেলে গেয়ে চলেছে তার প্রিয় সব গান, আর গ্রামের শেষ চড়ুইটি উড়ে যাচ্ছে তখন অন্য গ্রামে, অন্য কোথাও বাসার খোঁজে…