ধীরে ধীরে চোখ খুলল মধু। না, কোন ব্যথা তো নেই, শুধু একটা বোদা ভাব। একটু একটু করে চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হচ্ছে। চোখে পড়ছে ছোট ঘর, হাল্কা নরমসরম আলো,অফ হোয়াইট সিলিং, পিচ-সবুজ দেয়াল, হালকা নীল পর্দা। ও শুয়ে আছে একটি খাটে, লোহার খাট, ধপধপে সাদা চাদর- যেমনটি একটা হাসপাতালে থাকে। তাহলে কি ও কোন হাসপাতালে আছে? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাথার কাছে কোন ছোট র্যাক বা টেবিল নেই যাতে ওষুধের শিশি, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লেখা কোন চার্ট এসব থাকে। নাঃ, বিছানার কাছে কোন পাইপ, হুক থেকে ঝোলান স্যালাইন বা গ্লুকোজের বোতল – ওসব কিস্যু নেই। তাহলে ? তাহলে ও এল কোথায়? আরে, হাসপাতাল হলে অন্ততঃ একজন নার্স বা নিদেনপক্ষএ ওয়ার্ডবয় তো দেখা যাবে।
ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ল আরও সারি সারি পাতা গোটা দশেক খাট। কিন্তু সব খালি। একটাও রুগি নেই। তাহলে কি এটা হাসপাতাল নয়? তবে? মধুর মাথা ঝিমঝিম করে।
ও এখানে কতক্ষণ আছে? মানে কতদিন হল? আর এল কী করে? কে আনল? আজ কী তারিখ? কিছু বোঝার উপায় নেই; না আছে কোন খবরের কাগজ, না কোন লোক, কাকে জিগ্যেস করবে? দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডারও নেই। এটা কেমনধারা হাসপাতাল?
মধু আগে কখনও হাসপাতালে যায়নি। তবে এত বড় হতে হতে শুনে শুনে খানিকটে আবছামত ধারণা হয়েছে। বাবা যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, অনেকদিন ছিল তখন ও ছিল অনেক ছোট। তাই ওকে যেতে দেওয়া হয়নি। খালি একটা কাচে ঢাকা গাড়ি করে বাবাকে যখন বাড়ি নিয়ে এসেছিল সেটা ওর মনে আছে। মা খুব কাঁদেনি। থম মেরে বসেছিল। সবাই ফিসফিস করছিল কী করে কাঁদানো যায়!
ও বুঝতে পারছিল না মাকে কেন কাঁদতে হবে? বাবার ঘুম ভেঙে যাবে না? শেষে বড়পিসি এসে মায়ের হাত জোর করে টেনে ধরে হাতের শাঁখা-চুড়ি খুলে নিয়ে বাড়ির উঠোনে আছড়ে আছড়ে ভাঙল। তখন মা ডুকরে উঠল। কিন্তু যখন পাড়ার সবাই মিলে বাবাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল তখন মা মুখের চেহারা শক্ত করে বলল, “মধুরে ছাইড়্যা দ্যান। অ ছুটু, অরে শ্মশানে যাইতে অইব না।”
মা? মা এখন কোথায়? মাকে কেন দেখা যাচ্ছে না? একটা অজানা শিরশিরানি ভয় আস্তে আস্তে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। কিছু মনে পড়ছে না। ওর কী হয়েছিল? মাথা ঝাঁকিয়ে ও আবার ভাবার চেষ্টা করে।
হ্যাঁ, এবার একটু একটু মনে পড়ছে। কিছু টুকরো টুকরো ছাড়া ছাড়া ছবির মত।
ও ওর পুরনো বাইকটা নিয়ে রোজকার মত কাজে বেরিয়েছিল। ডেলিভারি ব্যাগটা পিঠে স্ট্র্যাপ দিয়ে আঁটা। ঘেমো গরমওলা এক বিচ্ছিরি দিন। ওর জামা ভিজে পিঠে সেঁটে গেছে। হ্যাঁ, ওর গাড়ির স্পিড অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই ছিল, তার কারণ আছে।
হঠাৎ একদল স্কুল ফেরত কলকল করা কচিকাঁচার দল একেবারে সোজা রাস্তার মাঝখান দিয়ে পার হচ্ছে। ও ব্রেক চেপে গিয়ার বদলে সামলে নিল। আবার গতি বাড়াল, কিন্তু ওদের এই মফঃস্বলী শহরে রাস্তাগুলো তেমন সুবিধের নয়। মাত্র বর্ষা বিদায় নিয়েছে। খানাখন্দগুলোর মেরামতি এখনও শুরু হয়নি। ও স্টেশন পাড়ার মার্কেট কমপ্লেক্স পেরিয়ে গিয়ে বাঁদিকে মুড়েছে কি সামনে এক বয়স্ক মহিলা হাতে বাজারের ভরা থলি। কোত্থেকে যে উদয় হলেন, একেবারে ওর মার্ডগার্ডের সামনে। ও প্রাণপণে স্টিয়ারিং ঘোরায়। একটা চিৎকার! পিঠের দিকে একটা তীব্র যন্ত্রণা! ব্যস, সব অন্ধকার।
আরও কিছু টুকরো টুকরো ছবি।
হ্যাঁ, এবার ভালই মনে পড়ছে। মনে পড়েছে ও কে, কী করে সব।
ও হ্ল মধুসুদন ক্লডিয়াস। একটা রোগাপটকা বছর কুড়ির ছেলে, ছত্তিশগড়ের হাওড়া-মুম্বাই লাইনের চাঁপা জংশনের কাছে ক্রিশ্চান পাড়ায় একটি অ্যাসবেস্টসের ছাদওলা এককামরার কোয়ার্টারে বিধবা মায়ের সঙ্গে থাকে। ধর্মে প্রটেস্ট্যান্ট, কিন্তু ও নিয়ম করে চার্চে যাওয়ার বান্দা নয়।
হ্যাঁ, ও এক স্মল-টাউন বয় যে নিজের চাকরিটাকে—যাতে মাত্র দু’মাস আগে জয়েন করেছে—প্রাণপণে বাঁচাতে চাইছে। চাকরিটা ঠিক বলার মত নয়, বিশেষ করে মাইনেপত্তর। দেখতে গেলে ওর ডিউটি যা সেটা একটা কুড়ি বছরের জোয়ান ছেলের খুব একটা ভাল লাগার কথা নয়। তা হল চার কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে বাড়িতে বাড়িতে ডাক বা কিছু কনসাইনমেন্টের প্যাকেট পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু কী আশ্চর্য! এই একঘেয়ে কাজটাও ওর ভাল লেগে গেছে। কেন? ও নিজেও ঠিক জানে না।
কিন্তু মালিক খুশি নয়। এই ক্যুরিয়ার সার্ভিস বছর খানিক হ্ল শুরু হয়েছে। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে, “এইসব কেরেস্তান ছোকরাদের নেওয়াই ভুল। এরা সব আলসে আর আড্ডাবাজ।”
একেই ব্যবসার হাল খাস্তা, তায় এইসব ডেলিভারি বয় হল বোঝার উপর শাকের আঁটি। আরও তিনজন কর্মচারি আছে বটে, কিন্তু মালিকের হিসেবে মধু হ্ল সবচেয়ে ওঁচা।
“তোর মত গবেটকে কেন যে মরতে কাজে লাগালাম! দু’মাসেই এতগুলো কমপ্লেন? চারটে ভুল ঠিকানায় ডেলিভারি তো তিনটের অ্যাকনলেজমেন্ট হারিয়ে ফেলা? আর দু’বার বাড়তি চার্জ ঠোকা!”
“বস, ওটা আমার দোষ ছিল না। সেন্ডার আপিস থেকেই প্যাকেটের গায়ে ভুল লেবেল লাগানো ছিল, তো আমি কী করব?”
“ আচ্ছা, তুমি সাধুপুরুষ? ঠিকানায় একটু এদিক ওদিক, কিন্তু টেলিফোন নম্বর ? সেটা দিয়েও তো ভেরিফাই করা যেত, তা তুমি করবে না। তোমার সম্মানে লাগে! আর অ্যাকনলেজমেন্ট হারিয়ে ফেলা? এটা নিয়ে কী বলবেন শুনি? আসলে তুমি হচ্ছ কুঁড়ের হদ্দ। এবার আমাকে রেহাই দাও। ফিরে যাও তোমাদের ওই চায়ের দোকানের ঠেকে; গিয়ে রাজা-উজির মারতে থাক। এর বেশি তোমার এলেম নেই। তোমার মত ছেলেদের ভরসায় থাকলে আমার ব্যবসা লাটে উঠল বলে। পাক্কা উঠবে, আজ নয় কাল।”
“বস, এটা একটু বেশি হয়ে গেল। আমি কি কিছুই করি নি? ছ’জন নতুন ক্লায়েন্ট এ্নেছি, মাত্র দু’মাসে। ভেবে দেখুন।”
“মাত্তর ছ’জন, তার এত চোপা! আরে ওদের মধ্যে দু’জন তো এমনিতেই এসে যেত। কারণ, ওদের আগের বাঁধা ক্যুরিয়ার কোম্পানি এ শহর থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে। তাছাড়া ওদের চার্জও একটু হাই ছিল। এতে তোর কীসের কেরামতি?”
“না বস, আরও অনেক সার্ভিস দেনেওলা আছে। ওরা এসেছে আমার জন্যে। ওদের হেড বেয়ারারা আমার চায়ের দোকানের বন্ধু।”
“বাতেলাবাজি ছাড়, ঢের হয়েছে। কাল থেকে যেদিন কোন কমপ্লেন আসবে সেদিনই তোর হিসেব করে দেব। এই তোর লাস্ট লাইফ লাইন, বুঝলি?”
মধু আর কথা বাড়ায়নি। একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে না খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। মা খাবার নিয়ে সাধলে কাঠ কাঠ ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিল, “শরীর ভাল নেই।”
সেদিন রাত্তিরে ঘুম হয় নি। চাকরি গেলে খাবে কী? বাড়িভাড়া আর ইলেক্ট্রিসিটি বিল কী করে চোকাবে? মার পেনশানের ক’টা টাকায় তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।
ও ক্রিকেট ভাল খেলত; ছোটবেলা থেকেই। রেলের মাঠে প্র্যাকটিস করত, ক্লাব কোচিংয়েও নিয়মিত যেত। সবাই ধরে নিয়েছিল যে স্পোর্টস কোটায় রেলের চাকরি ওর কপালে নাচছে। কিন্তু সেটা যে তুর্কি নাচ হবে তা বুঝতে দুটো বছর লেগে গেল। অনেক সুকতলা খসিয়ে দেখল সবসময় আড়াল থেকে একজন নেপো এসে দই খেয়ে যায়। তবে ওর কপালের পুরোটাই তেঁতুলগোলা নয়। ওর ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ফোন করে দেওয়ায় দু’মাস আগে এই চাকরিটা পেয়েছে। এর মধ্যেই ব্যাটা যাই যাই করছে।
সে যাই হোক, ওর কষ্টের আসল কারণ একটু আলাদা। এটা ওর কাছে হঠাৎ ধরা পড়ল আর ও অবাক হয়ে গেল। বুঝতে পারল যে এই কাজটাকে ও খুব ভালবাসে; রোজ অপেক্ষা করে থাকে কখন তৈরি হয়ে ব্যাগ পিঠে বাইকে চড়ে বসবে। রোজ কড়া নাড়বে কোন নতুন দরজায়, চোখে প্রশ্ন নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে কোন নতুন মুখ। ঝোড়ো কাকের মত চেহারার কোন বিরক্তবাবু, দয়ালু মুখের বয়স্ক মাসিমা, রাগী তরুণ বা নিষ্পাপ মুখশ্রীর কিশোরী—অজস্র মুখের মিছিল।
ঘর থেকে বেরনোর সময় ও কল্পনা করে আজ প্রথম বাড়িতে দরজাটা কে খুলবে। অধিকাংশ দিন পায় একেবারে কেজো ঠান্ডা ব্যবহার। কিন্তু কেউ কেউ , হাজারে একজন, হেসে কথা বলে, একগ্লাস জল দেয়; আর সেই প্রসন্ন মুখ আদমের না হয়ে ঈভের স্বগোত্রের হলে? গোটা দিনটার মানে বদলে যায়। মালিকের খোঁচা দিয়ে কথা বলা গায়ে লাগে না।
এখন এই হাড়কেপ্পন ভোঁদাগোছের বস ওকে দরজা দেখিয়ে দেবে বলে প্রায় স্থির করে ফেলেছে। একের পর এক বিষাক্ত লেগ কাটার। অপেক্ষা করছে কখন বল ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপ বা কিপারের হাতে যায়। ঘোর অন্যায়! মাতা মেরি নিশ্চয় দেখছেন। তবে ওকেও এখন থেকে খুব সাবধানে ব্যাট করতে হবে। আর কোন কমপ্লেন হলে চলবে না। চৌকস হতে হবে।
দিনটা ভালই শুরু হয়েছিল। প্রথম ঘন্টাতেই দুটো ডেলিভারি, বেশ সাবধানে । আর দু’জায়গাতেই হাসিমুখে ‘থ্যাংক ইউ’ পেল। আর কী আশ্চর্য, ধন্যবাদদাতাদের একজন স্কুলের মেয়ে, অবাঙালি। ওর বার্থডে ড্রেস, বিদেশি ব্র্যান্ডের। অ্যামাজনের সৌজন্যে মধু গিয়ে ডেলিভারি দিল। মেয়েটি চিনেমাটির প্লেটে করে দুটো লাড্ডু ও একগ্লাস জল দিয়ে বলল, “লিজিয়ে ভাইয়া! বার্থ ডে কী মিঠাই।”
মধুর খুব লজ্জা করছিল। তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে গিয়ে বিষম খেয়েটেয়ে একশা।
তখন থেকেই ওর মনটা একদম হলিউড-জলিগুড হয়ে গেছল।
এতক্ষণে সব স্পষ্ট মনে পড়ছে। ওই ফিলিং গুড মন নিয়ে অ্যাক্সিলেটরে চাপ বাড়িয়ে শার্প টার্ন নেওয়ার সময় কোত্থেকে যে ওই থলিহাতে মাসিমা একেবারে ফ্রন্ট হুইলের সামনে এসে পড়লেন! ও ঠিকই কাটিয়ে ছিল, কিন্তু হলিউড-জলিগুড মন খেয়াল করেনি যে একটা মালভর্তি ট্রাক বিপজ্জনকভাবে ওকে ওভারটেক করছে।
ও এবার পুরোপুরি জেগে উঠেছে। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে, অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসছে , কোনটার উত্তর ওর জানা নেই।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে? কে নিয়ে এসেছে? মা কোথায়? ওর কী হয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট? এটা কীরকম হাসপাতাল? এখানকার খরচা কে মেটাবে?
মাথার ভেতরে জমে থাকা ঘন কুয়াশা আস্তে আস্তে পাতলা হচ্ছে; কিন্তু বড্ড ধীর লয়ে। ও খাট ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করল, পারল না। হতাশ হয়ে দেখল ওর হাত-পা কেমন যেন বিছানার সঙ্গে সেঁটে আছে। এবার ও সত্যি সত্যি ভয় পেল। এর মানে কী?
মরিয়া হয়ে চিৎকার ! মানে চিৎকারের চেষ্টা আর কি। কিছু একটা হল। কী? ওর অস্পষ্ট চাপা শব্দের অভিঘাতে ওই শান্ত নিঃশব্দ শূন্যতার মাঝে কোন ঢেউ ঊঠল। কোথাও একটা দরজা খুলল। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস। তারপর একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর ওকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চাইল যে ওকে এখন এই অবস্থায় থাকতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে ওর ভালোর জন্যেই এটা করা হয়েছে।
কিন্তু এই কথা শুনে ওর মন শান্ত হল না। ও এই অর্থহীন দুনিয়ার মানে বুঝতে চায়। তাই প্রশ্ন করতেই হবে।
“এ জায়গাটার নাম কী?”
উত্তর এল প্রায় প্রতিধ্বনির মত, “কোন নাম নেই।”
“উঃ! আজকে কত তারিখ? কী বার? এখন সকাল না বিকেল?”
“এখানে এইসব প্রশ্ন অর্থহীন।”
“কী যা তা! আরে ক’টা বাজে তো বলবে?”
“বললাম তো, এখানে সময় অনন্ত।”
“জীশাস, আর ইয়ু ম্যাড? দেয়ালঘড়ির কাঁটা দুটো দেখে বল, ক’টা বাজে ।”
“এখানে দেয়ালে কোন ঘড়ি থাকে না, নিজেই দেখে নাও।”
ও চমকে ঘাড় ঘোরায়। হা হা করছে নিঃস্ব দেওয়াল। কোন ঘড়ির চিহ্ন মাত্র নেই।
মধু নিজের চেতনাকে সুস্থ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
“লাস্ট কোশ্চেন। আমাকে এখানে কে নিয়ে এল?”
“তোমারই অতীতের কর্মফল।”
আবার কুয়াশার মেঘ । ধোঁয়া ধোঁয়া। এক ঘন অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে ও শুনতে পেল একসঙ্গে অনেকগুলো দেয়ালঘড়ির বেজে ওঠার মিঠে শব্দ। বারোটা বাজছে।