ডাইনোসরের ডিম

ডাইনোসরের ডিম

মন মেজাজটা হঠাৎ বিশ্রী রকমের খারাপ হয়ে গেল অনাথবাবুর। বনমালি ঘোষ লেনের জয়দূর্গা জুটমিলের অ্যাসিটেন্ট বিলবাবু অনাথবন্ধু সামন্ত যাকে বলে সত্যিকারের একজন নির্বিরোধী ভালোমানুষ। কখনও কারও সাতপাঁচে থাকেন না। আজ প্রায় পঁচিশ বছর ওই একই পোস্টে পড়ে রয়েছেন। একটা উন্নতিও হয়নি। সে জন্য আক্ষেপ নেই। যা মাইনে পান তাতে। সংসার চলে যায়। সংসার বলতে অবশ্য স্ত্রী আর পৈতৃক ছোট বাড়িখানা। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন বছর পাঁচেক হল। ঝাড়া হাত-পা। থাকেন অফিসের কাছেই অক্রূর দত্ত লেনে। মিনিট পনেরোর পথ। হেঁটেই চলে আসেন। অফিসে পৌঁছেই ঢকঢক  করে দু’গ্লাস জল খেয়ে সেই যে খাতাপত্র খুলে বসেন, একটায় টিফিনের আগে আর মুখ তোলার সময় পান না।

অনাথবাবুর বাতিক শুধু একটাই, বই পড়া। বলতে গেলে বইয়ের পোকা তিনি। প্রচুর বইপত্র পড়েন। মনেও রাখতে পারেন। দু’তিনটে বড় লাইব্রেরির লাইফ মেম্বার। এসব খবর অবশ্য অফিসের কেউ জানে না। অফিসে তো আর বই পড়েন না। বলেননিও কাউকে।

এহেন অনাথবাবু অফিসসুদ্ধ সকলের রসিকতার পাত্র। সমসাময়িক যারা তাঁরা তো আছেনই, ইদানীং নতুন ছেলে ছোকরা যারা আসছে তারা আরও এক কাঠি উপরে। আসলে প্রায় সব অফিসেই এমন এক-আধজন ব্যক্তি থাকেন, যাকে নিয়ে হাসিঠাট্টায় একটু মজে থাকা যায়। অফিসের একঘেয়েমি কিছুটা হলেও কাটে। অনাথবাবুর দূর্ভাগ্য, জয়দূর্গা জুটমিলের অফিসে কী করে তিনিই সেই ব্যক্তি বনে গেছেন। এমনিতেই একটু মুখচোরা মানুষ। একবার কথা বলতে গেলে দু’বার গলা ঝেড়ে নিতে হয়। জোর গলায় প্রতিবাদ করতে পারেন না। শুধু ভিতরে-ভিতরে ভীষন কষ্ট পান। নেহাত কাজের কথা ছাড়া অন্য কথা খুব কমই বলেন। বলতে গেলেই বিপদ বাড়ে। এই তো দিন কয়েক আগে টিফিন আওয়ারে খুব জমাট আসর বসে গিয়েছিল অফিসে। সদ্য ভারতীয় ভূস্থানিক উপগ্রহ ‘অ্যাপল্‌’কে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে, চারপাশে তাই নিয়ে আলোচনা। নুটু চক্রবর্ত্তী আসরের মধ্যমণি। কোনও একটা দৈনিক পত্রিকায় অ্যাপল্‌-এর ব্যাপারটা সদ্য পড়ে এসেছেন ভদ্রলোক।

নুটুবাবু হাত-পা নেড়ে সবাইকে বোঝাচ্ছিলেন। কাছেই বসে ছিলেন অনাথবাবু। অবশ্য আলোচনায় তিনি যোগদান করেননি। কোনও কথাও বলেননি এতক্ষণ। কিন্তু নুটুবাবু যেই বললেন, বৃত্তাকার কক্ষপথে উপগ্রহটির গতিবেগ নিয়ন্ত্রিত করে পৃথিবীর অক্ষীয় আবর্তনের সঙ্গে এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে আসা হবে যে, অ্যাপল্‌ ঠিক নাগপুরের আকাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। তখনই একটু উস্‌খুস করে উঠলেন অনাথবাবু, এঃ, নুটুটা ঠিকই বলছিল এতক্ষণ। সব গুবলেট করে ফেলল এবার। ‘অ্যাপল্‌’কে ভূসমলয় কক্ষপথে স্থাপন করতে গেলে নাগপুর কেন, ভারতবর্ষের আকাশেই রাখা যাবে না। কারণ বিষুব রেখা ভারতবর্ষের উপর দিয়ে যায়নি। কোনও কৃত্রিম উপগ্রহকে ভূসমলয় কক্ষপথে স্থাপন করতে হলে তাকে অবশ্যই বিষুব রেখার উপর রাখতে হবে। তাই অ্যাপল্‌ নয়, অ্যাপল্‌-এর অ্যান্টেনাটাই শুধু তাক করা থাকবে নাগপুরের দিকে। আসল উপগ্রহটির স্থান হবে আরও দক্ষিণ-পূবে, ভারতবর্ষের বাইরে সুমাত্রার আকাশে।

তা সেই ভুলটাই তিনি ধরিয়ে দিতে গিয়েছিলেন। ব্যাস, আর দেখতে হল না। হঠাৎ বাধা পেয়ে নুটুবাবু হাত-পা নাড়া থামিয়ে দারুণ বিরক্ত হয়ে দু’চোখ বিস্ফারিত করে এমনভাবে তাকালেন যে, ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন তিনি।

নুটুবাবু বললেন, ‘কী কান্ড বলো দেখি! আমাদের অনাথ যে আবার ইতিমধ্যে অ্যাপল্‌-এর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ বনে বসে আছে, সে খবর তো জানা ছিল না! তা বলো হে অনাথ, ইসরোর ডিরেক্টরদের সঙ্গে যখন মিটিংটা সেরেই এসেছে, তখন বলেই ফেল আসল ব্যাপারটা।’

নুটুবাবুর কথায় সবাই হো-হো করে হেসে উঠে এমনভাবে অনাথবাবুর দিকে তাকালেন যে, ভিতরে গুলিয়ে গেল সব। মুখ-টুখ লাল হয়ে উঠল। যা বলতে যাচ্ছিলেন কিছুই আর বলা হল না। কোনওক্রমে পালিয়ে বাঁচলেন।

কিন্তু আজকের ব্যাপারটা একেবারে মাত্রা ছাড়া। গতকাল বিশ্বকর্মা পুজো গেছে। আজ ভাসান। নীচে তারই তোড়জোড় চলছে। প্রায় ছুটির আমেজ। অনাথবাবু অবশ্য যথারীতি টেবিলে কাজে ব্যাস্ত। এমন সময় জনাকয়েক ছোকরা হন্তদন্ত হয়ে হাজির। দলের পুরোভাগে পান্ডা গদাই বোস। ‘সেকী অনাথদা, আপনি এখানে বসে! এদিকে পুজো কমিটির পয়সায় নীচে সবাই শরবত খাচ্ছে!’ আন্তরিক গলা গদাই বোসের।

খবরটা অনাথবাবুর জানা ছিল না। আর জানা থাকলেও যেতেন না নীচের ওই হই-হট্টগোলের ভিতর। বললেন, ‘না-না, ওসবের দরকার নেই ভাই। তোমরাই খাও।’

কিন্তু ছেলের দল শুনল না। এক সঙ্গে হইহই করে উঠল, ‘তা বললে কি হয় অনাথদা। সবাই খাচ্ছে। দাঁড়ান, আপনার জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

সাধাসিধে মানুষ অনাথবাবু। গোড়ায় ছেলেদের হঠাৎ এত আন্তরিকতায় এতটুকু সন্দেহ করেননি। তাই একটু পরেই গদাই বোসের দলবল যখন ক্যান্টিনের মস্ত জগ আর গ্লাস হাতে ফিরে এল, ব্যাপারটা খোলা মনেই নিলেন। বড় কাচের গ্লাসটা ভরতি করে একজন এগিয়ে দিল অনাথবাবুর সামনে। উপরে বরফের টুকরো ভাসছে। ঘোলের শরবত কিনা বুঝতে পারলেন না। তবে রং কতকটা সেই রকম। ভুরভুর করছে জাফরানের গন্ধ। গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন তিনি। স্বাদ মন্দ নয়। সবটাই খেয়ে ফেললেন। খালি গ্লাসটা টেবিলে রাখতেই ছেলেরা হইহই করে উঠল। ‘আর এক গ্লাস দেই অনাথদা।’

না- না করে বাধা দিতে গেলেন অনাথবাবু। তার মধ্যেই ভরতি হয়ে গেছে গ্লাস। এঁটো গ্লাস। না খেলে ফেলা যাবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অগত্যা খেয়েই ফেললেন। ছেলেরা হইহই করে চলে গেল।

কিছুক্ষনের মধ্যেই গোটা অফিসে রাষ্ট্র হয়ে গেল ব্যাপারটা। খানিক বাদেই এলেন নটু চক্রবর্তী। চোখ কপাল তুলে বললেন, ‘তোমার যে এসব গুণও রয়েছে, সে তো জানতুম না অনাথ! ধন্যি বটে তুমি।’

অনাথবাবু ইতিমধ্যে নিজেও কিছুটা টের পাচ্ছিলেন। শরবতটা খাওয়ার পর থেকেই শরীরটা কেমন গুলোচ্ছে। থতমত খেয়ে বললেন, ‘কেন! কী হয়েছে নুটু?’

‘কী হয়েছে মানে! স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানানো ওই বাঘা সিদ্ধি পুরো দু’গ্লাস ফুঁকে দিয়ে এখন বলছে, কী হয়েছে? যাকগে, ছেলেদের সঙ্গে ভাসানে যাচ্ছ বুঝি?’

অনাথবাবুর মনের অবস্থা এরপর কী হল সে তো আগেই বলেছি। কিছুক্ষন গুম হয়ে রইলেন। শরীরের ভিতরে একটা অস্বস্তি তো আগেই টের পাচ্ছিলেন। এবার কারণটা জানতে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সিদ্ধি তিনি আগে কোনও দিনই খাননি। মনে হচ্ছিল, যে কোনও সময় হয়তো বমি করে ফেলবেন। করলে হয়তো ভালই হত। বাথরুমে গিয়ে খানিক চেষ্টাও করলেন। হল না। ইতিমধ্যে আর এক ব্যাপার, দফায় দফায় অফিসের সবাই খোঁজ নিতে আসছে। অনাথবাবুর মনে হল পাঁড়ের দোকানের কড়া এক গ্লাস চা পেটে পড়লে অস্বস্তিটা হয়তো কমতে পারে। এদের হাত থেকেও একটু রেহাই পাওয়া যায়। অনাথাবাবু এক ফাঁকে টুক করে বের হয়ে পড়লেন অফিস থেকে। টেবিলের উপর ফাইল, খাতাপত্তর সব খোলাই পড়ে রইল।

অফিস থেকে সামান্য এগিয়ে সরু একটা গলি। ঠিক মুখেই গোবিন্দ পাঁড়ের চায়ের দোকান। সামনে ফুটপাতে খদ্দেরের বসার জণ্য গোটা কয়েক নড়েবড়ে বেঞ্চ পাতা। বিশেষ ভিড় নেই আজ। বেঞ্চের একধারে বসে বেশ কড়া করে এক কাপ চা দিতে বললেন অনাথবাবু। উনুনের ধারে বসে বিশাল বপু গোবিন্দ পাঁড়ে। সামনে মস্ত পেতলের মস্ত মগ ভরতি চা আর ভাঁড়। কিন্তু সে চা সাধারণ খদ্দেরের জন্য। পুরোনো খদ্দের অনাথবাবুর কড়া চায়ের মাত্রা জানা আছে পাঁড়েজির। আলাদা করে তৈরি করতে হবে। দেরি হবে একটু। তা হোক। অনাথবাবুরও তাড়া নেই।

দোকানের সামনেই বড় একটা নিমগাছ। নীচে মস্ত দুটো গোলাকৃতি পাথর। এক একটার ওজন দেড়-শো কেজির কম নয়। জিনিস দুটো আগে এখানে ছিল না। মাস কয়েক আগে সি.এম.ডি-এর লোকেরা রাস্তা খুঁড়ে পাইপ বসাতে গিয়ে মাটির নীচ থেকে পাথর দুটো তোলে। সেই থেকে ওখানে পড়ে রয়েছে। ভিড়ের সময় বেঞ্চে ভরতি হয়ে গেল কেউ-কেউ পাথর দুটোর উপরেও বসে। অনাথবাবু আজকেও দেখলেন, দু’জন সেই পাথর দুটোর উপর জাঁকিয়ে বসে চা খেতে-খেতে গল্প করছে। দু’জনেই মুখ চেনা। কাছেই এক অফিসে চাকরি করে। অনুচ্চ স্বরে যে বিষয়টি নিয়ে দু’জন কথা বলছিল সেটা কানে আসতেই একটু মুচকি হাসলেন তিনি। ফ্রান্সের কোনও এক গণ্ডগ্রামে একজন ভূতাত্ত্বিক কয়েক জোড়া ডাইনোসরের ডিম কুড়িয়ে পেয়েছেন। কাগজে বেরিয়েছে সেই খবর। আলোচনা সেই বিষয়ে। ওদের কথাবার্তার যে দু’চার টুকরো অনাথবাবুর কানে আসছিল তাতে বুঝতে পারছিলেন, দু’জনের কারোরই ফসিল সম্বন্ধে কোনও ধারনাই নেই। আসলে ভূতাত্ত্বিক যা কুড়িয়ে পেয়েছেন তা ডিমের ফসিল, এখন পাথরেরই নামান্তর। কয়েক কোটি বছর আগে অবশ্য সেগুলো ডাইনোসরের ডিমই ছিল। কোনও মৃত প্রাণী বা কোনও জৈব বস্তুর পক্ষেই এত বছর টিকে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু মৃত প্রাণীর দেহে পচন ধরার আগেই যদি কোনও কারণে সেটা সামুদ্রিক নরম পলমাটি বা বালিতে চাপা পড়ে যায় তাহলে সেগুলো মৃত প্রাণীর দেহের অসংখ্য ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে শুরু করে তখন বালি আর খনিজ পদার্থ সেই শূন্য স্থান পূর্ন করতে লেগে যায়। ফলে অচিরে মৃতদেহটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেলেও এই মাটি, বালি প্রভৃতিই সেই মৃত দেহের আকার পেয়ে যায়। তারপর ধীরে-ধীরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে গোটা জিনিসটি পাথরে পরিণত হয়। এরই নাম ফসিল।

ইতিমধ্যে চা এসে গেছে। অল্প-অল্প করে কাপে চুমুক দিতে লাগলেন অনাথবাবু। নিমগাছের নীচে দুই ভদ্রলোকের আলোচনা তখন চলে গেছে সিনেমায়। বিষয়টি যে অপ্রাসঙ্গিক নয় বুঝতে বিলম্ব হল না অনাথবাবুর। গোবিন্দ পাঁড়ের দোকানের পাশে দেয়ালে সিনেমার বেশ বড় একটা রঙিন পোস্টার সাঁটা। এতক্ষন নজরে পড়েনি। বিশাল আকৃতির এক হিংস্র ডাইনোসরের সঙ্গে পাথরের ফলা লাগানো বর্শা হাতে অসম লড়াইয়ে ব্যস্ত এক দল আদিম মানুষ। ডাইনোসরের ডিমের প্রসঙ্গ ওঠার মূলে যে এই পোস্টারটাই, বুঝতে বিলম্ব হয় না। প্রাণীটি অবশ্য ডাইনোসর গোত্রের হলেও বিজ্ঞানের পরিভাষায় ওটার নাম ‘অ্যালোসরাস’। মেসোজোয়িক অধিযুগের মধ্য পর্ব জুরাসিক যুগের এক হিংস্র মাংসাশী ডাইনোসর। বেশ পুরানো ফিল্‌ম। প্রথম যেবার কলকাতায় আসে, সেই সময় দেখেছিলেন। বেশ ভাল লেগেছিল। ছবিতে অবশ্য ইতিহাসকে যথাযাথ মানা হয়নি। অতিকায় ডাইনোসরের দল পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করে গেছে মেসোজোয়িক অধিযুগে, যে যুগ শেষে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে অতিকায় ডাইনোসরের দল বিলুপ্ত হয়ে যায় পৃথিবী থেকে। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব তারও অনেক পরে। আজ থেকে মাত্র কয়েক লক্ষ বছর আগে। সুতরাং হিংস্র ডাইনোসরের সঙ্গে  আদিম মানুষের লড়াই একেবারেই সম্ভব নয়। অবাস্তব ব্যাপার। অবশ্য এই অসংগতিটুকু বাদ দিলে ছবিটা বেশ ভালই। রোমাঞ্চকর। আর একবার দেখলে মন্দ হয় না। আজকেই যাবেন নাকি? হলটা কাছেই। ঘড়ির দিকে তাকালেন অনাথবাবু। পাঁচটায় শো। মেরে দেওয়া যায়। অফিসে আজ যা অবস্থা, একটু আগেভাগে বেরোলে ক্ষতি নেই কিছু। বরং মঙ্গলই বলতে হবে। কিন্তু শরীরটা যে বিশেষ জুত লাগছে না। ভেবেছিলেন, চা খেলে অস্বস্তিটা কমবে। কিন্তু শরীরটা আরও যেন গুলোচ্ছে। মাথাটাও কেমন ঝিমঝিম করছে এখন। চা-টা না খেলেই যেন ভাল হত। আধ খাওয়া গ্লাসটা পাশে নামিয়ে রাখলেন তিনি।

চোখের পাতা ক্রমশ ভারি হয়ে আসতে চাইছে। সিদ্ধির ঘোর সন্দেহ নেই। কিন্তু হার মানবেন না অনাথবাবু। বসে থাকলে ঘোরটা আরও বাড়বে। বরং একটু হেঁটেই আসা যাক। অনাথবাবু উঠে হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু চোখের পাতা দুটো সত্যিই যে আর মেলে রাখা যাচ্ছে না। যাকগে, চোখ বন্ধ করে হাঁটলেই বা ক্ষতি কী। সত্যি সত্যি অনাথবাবু এবার চোখ বন্ধ করেই হাঁটতে লাগলেন। দিব্যি কয়েক মিনিট হাঁটলেনও। মানুষজন, গাড়ি-ঘোড়া কোনও কিছুতেই বাধা পেলেন না। অবশ্য মানুষজন, গাড়ি-ঘোড়ার কোনও শব্দও তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন না। আচমকা কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সব। হয়তো ওই ভাবেই আরও কিছুক্ষণ হাঁটতেন। কিন্তু পায়ের নীচে হঠাৎ ভেজা প্যাচপেচে কাদা জড়িয়ে যেতে চোখ মেলে ভীষণ চমকে উঠলেন অনাথাবাবু। এ কোথায় এসে পৌঁছেছেন তিনি!

এত বছর ধরে এখানে আছেন, এমন জলা ধারেকাছে কোনও দিন দেখেননি। কতটুকু সময়ই বা হেঁটেছেন। বড় জোর মিনিট তিনেক। তাও চোখ বন্ধ করে। এর মধ্যে বনমালি ঘোষ লেনের পাঁড়েজির দোকান থেকে কতদূর আর আসা সম্ভব? অনাথবাবু দেখেতে পেলেন, একটা বিশাল জলার সামনে  তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। জলা না বলে তাকে হ্রদ বলাই ভাল। সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। তীরের দিকে জল থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে অসংখ্য গাছগাছালি। একই ধরণের গাছপালা ডাঙাতেও অনেক দেখতে পেলেন তিনি। বিশাল আকৃতির এমন অদ্ভুত গাছ জীবনে কখনও দেখেননি। দেখতে কতকটা ফার্ণের মতো। কিন্তু ফার্ণ কখনও তাল গাছের মতো লম্বা হয়! চারপাশটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ, থমথমে। কেমন ভিজে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। বোধহয় খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। মেঘলা আকাশ। অনাথবাবু চারপাশে চোখ ফেরালেন। রৌদ্রের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও। অথচ একটু আগেও চারপাশটা শুকনো খটখটেই ছিল। মাসটা আশ্বিন হলেও দিন পনেরোর মধ্যে এ তল্লাটে বৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করতে পারলেন না। বেলা তিনটের সময়েও পড়ন্ত রোদের তেজ পাঁড়েজির চায়ের দোকানে আসার সময়েও টের পাচ্ছিলেন। তাড়াহুড়োয় অফিস থেকে ছাতাটা নিয়ে বেরোননি বলে আপশোস হচ্ছিল তখন।

অনাথবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল নেশার ঝোঁকে স্বপ্ন দেখছেন না তো! ব্যাপারটা মনে হতে গা ঝাড়া দিলেন। নাহ্‌, এই তো দিব্যি জেগেই রয়েছেন। গালে চিমটি কাটলেন। ব্যথাটা ভালই টের পেলেন। অনাথবাবু পিছন ফিরলেন এবার। ভিজে মাটিতে পরিষ্কার তাঁর চটি-পরা পায়ের দাগ। অর্থাৎ, এতক্ষন তিনি এই জলার পার ধরেই হেঁটে এসেছেন। এবার সত্যিই একটু ঘাবড়ে গেলেন তিনি। এ কোথায় এসে পৌঁছোলেন? কলকাতায় তাঁর সেই পরিচিত পরিবেশ এখান থেকে কত দূর? ঘাবড়ে গেলেও বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেননি। ভেবে দেখলেন, পায়ের ছাপ যখন দেখা যাচ্ছে, তখন ওই ছাপ ধরেই হয়তো ফিরে যাওয়া সম্ভব। বেশিক্ষন তো আর হাঁটেননি। তৎক্ষনাৎ উলটো দিকে পায়ের ছাপ ধরে দ্রুত পা চালালেন তিনি।

একটু ঘাবড়ে গেলেও পরিস্থিতির বিপজ্জনক দিকটা তখনও কিছুমাত্র আঁচ করতে পারেননি অনাথবাবু। সেটা বুঝলেন একটু পরেই। বোধহয় কয়েক পা-ও এগোননি, হঠাৎ মাথার উপরে বিকট এক তীক্ষ্ণ আওয়াজ সেই নিস্তব্ধ পরিবেশ মুহূর্তে ভেঙে চুরমার করে দিল।

-কাঁ-আঁ-আঁ।

ভীষন চমকে ঘাড় তুলে অনাথবাবু যা দেখলেন তাতে তাঁর বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। একটা বিশাল আকৃতির পাখি তাঁকে লক্ষ্য করে ছোঁ মেরেছে। কতকটা বাদুড়ের মতো দেখতে। তবে পাখির মতো মস্ত ছুঁচলো ঠোঁট। ভিতরে ঝকঝকে দু’সার তীক্ষ্ণ দাঁত। প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাখি  টেরোড্যাকটিলকে চিনতে এবার আর ভুল হলনা তাঁর।

বিশাল হিংস্র পাখিটার হাত থেকে বাঁচতে আজান্তেই ছুটতে শুরু করলেন তিনি। কিন্তু কয়েক পা যেতেই কাদায় পা হড়কে চিতপাত হয়ে পড়ে গেলেন। আর সেই মূহুর্তেই টেরোড্যাকটিলটা লক্ষ্যচ্যুত হয়ে তাঁর মাত্র হাত খানেক উপর দিয়ে উড়ে গেল। প্রায় দৈবক্রমে রক্ষা পেয়ে গেলেন।

পরিস্থিতিটা বুঝে নিতে এবার আর কিছুমাত্র বিলম্ব হল না অনাথবাবুর। যে কোনোভাবেই হোক তিনি কয়েক কোটি বছর পিছিয়ে আদিম প্রাগৈতিহাসিক যুগে চলে এসেছেন। হিংস্র টেরোড্যাকটিলটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে উড়ে গেছে বটে, তবে যে কোনও মুহূর্তেই আবার ফিরে আসতে পারে। তাছাড়া এমন জীব আশপাশে আরও কত রয়েছে কে জানে। খোলা আকাশের নীচে এভাবে বেশিক্ষন থাকা ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন অনাথবাবু। চারপাশে তাকালেন। কাছাকাছি পাহাড় বা ওই জাতীয় কিছু নেই যে, তাঁর একটা আড়াল খুঁজে আত্মরক্ষা করবেন। পলমাটির দেশ বাংলার এই কলকাতায় পাহাড় পর্বত কস্মিনকালেও যে ছিল না, সে কথা মনে পড়তে এই বিপদের মধ্যেও না হেসে পারলেন না। অগত্যা একটু দূরে একটা ঝোপ দেখতে পেয়ে সেই দিকে ছুটতে শুরু করলেন।

পড়ি কী মরি করে এক দৌড়ে ঝোপের কাছে পৌছে গেলেন অনাথাবাবু। কিন্তু প্রাণের দায়ে হুড়মুড় করে ঝোপের ভিতর ঢুকতে গিয়ে ঘটল আর এক বিপত্তি। কীসে যেন হোঁচট খেয়ে ফের কাদার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। সারা শরীরে কাদা মেখে কোনোক্রমে কাতরাতে কাতরাতে উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলেন, ঠিক ঝোপের সামনেই কাদার উপর ছোপ ধরা ধপধপে সাদা গোলাকৃতি দুটো পেল্লায় সাইজের পাথর পড়ে আছে। দুটো পাথরেরই প্রায় অর্ধেকের উপর নরম মাটিতে বসে গেছে। এই পাথরেই তিনি হোঁচট খেয়েছেন। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগার ছাল অনেকটাই উঠে গেছে। চটিটাও ছিটকে গেছে কোথায়। টেরোড্যাকটিলটা আবার কখন উড়ে আসে ঠিক নেই। সময় নষ্ট না করে অনাথবাবু সেই অবস্থায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঝোপের ভিতর ঢুকে পড়লেন। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তবু একটু হলেও নিশ্চিন্ত বোধ হতে দ্রুত চারপাশে চোখ বোলালেন তিনি।

অচেনা কতকগুলো গাছপালার বেশ বড় একটা ঝোপ। ভিতরে অনেকটা জায়গা। গোড়ায় বিশেষ খেয়াল করেননি। ভাল করে দেখতে গিয়ে এবার বেশ ঘাবড়ে গেলেন অনাথবাবু। ঝোপটার যা অবস্থা, বুঝতে অসুবিধা হয় না খানিক আগে প্রায় একটা ঝড় বয়ে গেছে এখানে। অনেক গাছ দুমড়ে-মুচড়ে রয়েছে। অজস্র কাঁচা পাতা কাদার উপর ছিটিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থা। ব্যাপারটা কী হতে পারে, ভাল করে লক্ষ্য করতে গিয়ে যা বুঝলেন, তাতে ঘাবড়ে গেলেন আরও। চারপাশে কাদায় বিরাট-বিরাট পায়ের ছাপ। দেখেই বোঝা যায় অল্প কিছুক্ষণ আগের। বুঝতে বিলম্ব হল না, খানিক আগে বিশাল এক প্রাণী দাপিয়ে গেছে এখানে।

বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন অনাথবাবু। এখুনি অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়া উচিত। কিন্তু একটু আগে হিংস্র টেরোড্যাকটিলটার কথা ভেবে ব্যাপারটা বাতিল করে দিলেন তিনি। সন্ধের আগে বাইরে বেরনো কিছুতেই ঠিক হবে না। আলোর যা অবস্থা তাতে সন্ধে নামতেও দেরি নেই খুব। কিন্তু সন্ধের পরেই বা তিনি যাবেন কোথায়? যা মেঘলা দিন, পূর্ণিমার দিন কয়েক বাকি থাকলেও চাঁদের ছিঁটেফোঁটা আলোও মিলবে কিনা সন্দেহ। সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে হিংস্র শ্বাপদসংকুল এই রাজ্যে তিনি পালাবেনই বা কোথায়? ভাবতে গিয়ে পা থেকে মাথার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত ঠান্ডা হয়ে এল অনাথবাবুর। হায় ভগবান! এ আবার কী বিষম ফ্যাসাদে পড়লেন তিনি!

ঝোপের ভিতর ওইভাবে কতক্ষন বসে ছিলেন হিসেব করেননি অনাথবাবু। বোধহয় ঘন্টা দেড়েক হবে। আলোর অবস্থা দেখে যেমন ভেবেছিলেন তা নয়। সন্ধে নামেনি। আলো প্রায় তেমনই রয়েছে। আকাশ পাতাল ভাবছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন, অনেক দূরে জলার ওপর দিয়ে কিছু একটা এগিয়ে আসছে।

সামান্য মাইনাস পাওয়ার অনাথাবাবুর। চশমা থাকলেও তেমন ব্যবহার করেন না। আজও নিয়ে বেরোননি। প্রথমে তাই ঠিক চিনতে পারেননি। কিন্তু আরও কাছে আসতে বুঝতে পারলেন, একটা হিংস্র ডাইনোসরের মাথা জলের উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে। সাঁতরে নয় হেঁটেই আসছে প্রাণীটা। কারণ যতই পাড়ের দিকে আসছে ততই উঁচু হচ্ছে মাথাটা।

আতঙ্কে ঝোপের ভিতর আরও খানিকটা সেঁধিয়ে গেলেন অনাথবাবু। দেখতে-দেখতে বিশাল ডাইনোসরটা জলার পাড়ে উঠে এল। পূর্ন বয়স্ক গোটা চারেক হাতিকে একটার পিঠে আর একটা দাঁড় করালে যেমন হয় তেমন বিশাল আকার। নরম মাটিতে পায়ের অনেকটাই বসে যাচ্ছে। কিন্তু পিছনের বিশাল দুই পা আর লেজে ভর দিয়ে অন্তত দশ-বারো টন ওজনের বিশাল প্রাণীটা বেশ স্বচ্ছন্দেই হেঁটে আসছে। হাঁ করা মস্ত মুখের ভিতর ধারালো ছুরির মতো একরাশ তীক্ষ্ণ দাঁত ঝকমক করছে। তীক্ষ্ণ নখওয়ালা সামনের থাবা দুটো বুকের কাছে ভাঁজ করা। সোঁ-সোঁ করে হাপরের মতো নিঃশ্বাসের শব্দ দূর থেকেও বেশ শোনা যাচ্ছে। প্রাগৈতিহাসিক ক্রিটেশাস যুগের সবচেয়ে বিশালাকার মাংসাশী ডাইনোসর, টিরানোসরাস রেক্স।

নিজের অজান্তেই ঝোপের ভিতর আরও কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন অনাথাবাবু। কিন্তু একী! ডাইনোসরটা যে থপ-থপ শব্দে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে! হঠাৎ যেন মাথার ভিতর প্রবল একটা বৈদ্যুতিক শক খেলেন তিনি। এই প্রাণীটাই কি তবে খানিক আগে ঝোপটা তছনছ করে গেছে? আর ঝোপের সামনে সাদা ওই মস্ত পাথর দুটো! ওগুলো সত্যিই কি পাথর? অমন গোলাকার মসৃণ পাথর এই পলিমাটির দেশ দক্ষিণ বাংলায় আসবেই বা কেমন করে? পাহাড় পর্বত ধারেকাছেও নেই কোথাও। তবে ও দুটো কি আদপে পাথরই নয়? ডাইনোসরটার ডিম? তিনি উলটে পড়ছিলেন এক জোড়া ডাইনোসরের ডিমে হোঁচট খেয়ে! অনাথবাবু আর কিছু ভাবতে পারলেন না। পড়িমরি করে ঝোপ থেকে বেরিয়ে কাদা ভেঙে উলটো দিকে প্রায় উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করলেন।

গোবিন্দ পাঁড়ের চায়ের দোকান থেকে ঠিক মিনিট খানেক এগিয়ে বনমালি ঘোষ লেনের বাদিকে রূপচাঁদ দত্ত ফার্স্ট লেন। অনাথবাবু হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তিনি ওই রূপচাঁদ দত্ত ফার্স্ট লেন ধরে ছুটছেন। প্রায় উর্ধ্বশ্বাসে। পরনের ধুতি পাঞ্জাবি জল কাদায় মাখামাখি। ডান পায়ের চটিজোড়া নেই। বুড়ো আঙুলের ডগায় রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। গভীর রাত। রাস্তায় জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। রাস্তার বাতিগুলো শুধু জ্বলছে।

ব্যাপারটা খেয়াল হতে ভীষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন অনাথবাবু। দৌড়ের বেগ না কমিয়ে ভয়ে-ভয়ে পিছন ফিরে একবার তাকালেন। নাহ্‌, সেই বিশাল জলা বা ডাইনোসর, কিচ্ছু নেই কোথাও। পরিচিত রূপচাঁদ দত্ত ফার্স্ট লেনই বটে। তবে কী এতক্ষণ তিনি সিদ্ধির ঘোরে মজে ছিলেন? নাকি স্বপ্ন দেখছিলেন? জামা-কাপড়ের এ কী দুরবস্থা! ছি-ছি! থমকে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতের ঘড়ির দিকে তাকালেন। তিনটে কুড়ি বেজে বন্ধ হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ বেশ কয়েক ঘন্টা তিনি নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলেন। ভাগ্যিস, রাস্তার পাহারাদার পুলিশ-টুলিস কেউ নেই। চোখে পড়লে এতক্ষণে নির্ঘাত ঘা কতক দিয়ে সোজা থানায় চালান করে দিত।

অক্রুর দত্ত লেনে অনাথাবাবুর বাড়ি মিনিট পনেরোর পথ। ভয়ে-ভয়ে এই পথটুকু পুলিশের নজর এড়িয়ে কোনও গতিকে বাড়ির দরজায় পৌছে কড়া নাড়লেন। বার কয়েক নাড়াবার পর ভিতর থেকে সাড়া মিলল। একটু বাদেই দরজা খুলে গেল। অনাথবাবু দেখলেন, দরজার ওধারে দাঁড়িয়ে মেয়ে রমলা। মেয়ে জামাই ধানবাদে থাকে। বোধহয় আজ বিকেলেই এসেছে। বিবাহিতা মেয়ের সামনে হঠাৎ এ অবস্থায় পড়ে যেতে ভীষন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন তিনি। কিছু একটা কৈফিয়ত দিতে যাচ্ছিলেন। তাঁর আগেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রমলা, ‘তোমার এ কী অবস্থা হয়েছে বাবা! এতদিন ছিলে কোথায়?’

অনাথাবাবুর জানার কথা নয় যে, ইতিমধ্যে তাঁকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজন তো বটেই, অফিসেও ঝড় বয়ে গেছে। থানা-পুলিশ। সমস্ত জায়গায় খোঁজখবর। দৈনিক কাগজে নিরুদ্দেশের কলমে বিজ্ঞাপন, কিছুই বাকি নেই। একজন সুস্থ সবল মানুষ যদি হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, তাহলে যা ঘটে তাই। জামাই মেয়ে তো বটেই, খোদ বেয়াই মশাই পর্যন্ত এসে পড়েছেন। সেই রাত্তিরে সবাই প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল অনাথবাবুর চারপাশে।

সন্তোষজনক কোনও জবাবই দিতে পারলেন না অনাথবাবু। পারবার কথাও নয়। গত বারো তারিখ সকালে যথারীতি বাড়ি থেকে অফিসে গিয়েছিলেন। আর আজ একুশ তারিখ রাত আড়াইটে। অর্থাৎ ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে পুরো নয়টি দিন। এই নয়টি দিনে হিসেব কী করে মেলাবেন তিনি? দু’গ্লাস সিদ্ধির ঘোরে বেঁহুশ হয়ে নয় দিন কলকাতায় নিজের পাড়ার রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেন, অথচ কারো নজরে পড়লেন না, এট কি বিশ্বাসযোগ্য? তাহলে পার্থিব পুরো নয়টি দিন কী করে মাত্র কয়েক ঘন্টায় উবে গেল তাঁর জীবন থেকে? তবে কি তিনি যেটাকে নেশার নিছক দুঃস্বপ্ন বলে ভাবছেন তা নয়?

মাস কয়েক আগে একটা বই পড়েছিলেন অনাথাবাবু। ‘দি টাইম টানেল’। বইটাকে তখন নিছক গাঁজাখুরি বলেই মনে হয়েছিল। সময়ের মধ্যেও নাকি কখনও ফাটল ধরে। তৈরি হয় মস্ত এক সুড়ঙ্গের। সময়ের এই ফাটলের ব্যাপারটা ওদেশের অনেকেই এখন আর উড়িয়ে দিচ্ছেন না। মহাকাশে বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের রহস্যজনক কণিকার সন্ধান পাচ্ছেন। এদের কোনোটার প্রভাবেই নাকি হঠাৎ সময়ের সেই ফাটলের মুখটা খুলে যায়। তখন সেই সুড়ঙ্গের ভিতর গিয়ে পড়লে সময়ের বাধা অতিক্রম করে মূহুর্তে যেমন লক্ষ বছর এগিয়ে যাওয়া যায়, তেমন পিছিয়েও যাওয়া যায়। অনাথবাবুর কেমন যেন মনে হচ্ছিল, সম্ভবত এমনই এক সুড়ঙ্গের মধ্যে পড়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন কয়েক কোটি বছর আগের পৃথিবীতে। আর এর মধ্যেই পৃথিবীতে পেরিয়ে গেছে পুরো নয়টি দিন।

দিন দুয়েক পরে অফিসে জয়েন করলেন অনাথবাবু। সন্দেহের কথাটা কাউকেই আর বলেননি। মোটামুটি একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প ফেঁদে আশ্বস্ত করেছেন সবাইকে। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে অফিসের অনেকেই অবশ্য বাড়িতে দেখা করে গেছে। সিদ্ধির ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত থাকায় সবচেয়ে অপ্রস্তুত হয়েছে গদাই বোসের দলবল। অনাথবাবুর খোঁজে এ পর্যন্ত চেষ্টার কোনও ত্রুটি করেনি ওরা। অফিসে পৌঁছোতে গদাই বোস কাঁচুমাচু মুখে আর এক দফা ক্ষমা-টমা চেয়ে গেল। অনাথবাবু অবশ্য গদাই বোসকে আগেই ক্ষমা করে দিয়েছেন। ওর ওই সিদ্ধির দৌলতে যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন, তাঁর দাম অনেক বেশি।

টিফিনের খানিক আগে এক ফাঁকে টুক করে বেরিয়ে পড়লেন অনাথবাবু। সোজা গোবিন্দ পাঁড়ের চায়ের দোকান। পাঁড়েজি তাকে দেখেই হইহই করে উঠল, ‘বাবু আপ! আসেন-আসেন। লেকিন ওই দিন বহুত ডর লাগাইয়ে দিয়েছিলেন।’

এই কথাটা শোনবার জন্যই ছটফট করছিলেন অনাথবাবু। বললেন, ‘কেন বলো দেখি পাঁড়েজি?’

গোবিন্দ পাঁড়ে তখনও হাঁ করে অনাথবাবুকে দেখছিল। একটু ইতস্তত করে চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘কী জানি বাবু। উমর ভি হইল তো। আঁখ কা গোলমাল ভি হইতে পারে। হামি তো আপনের দিকে তখন তাকাইয়ে ছিলম। হঠাৎ দেখলাম কী আর নাই। বিলকুল ভানুমতী কা ভেলকি! বহুত ডর লাগিয়ে গেল। আপনের অফিস থিকে খোঁজখপর করতে আইল, লেকিন বুলতে পারলম না।’

মুখে সামান্য অবিশ্বাসের হাসি ফুটিয়ে অনাথবাবু বললেন, ‘সেদিন হঠাৎ একটা বিশেষ দরকারে চলে গিয়েছিলাম। একেবারে কলকাতার বাইরে। কদিনের মধ্যে আর ফিরতে পারিনি। সে যাকগে, তোমার চোখটা একটু দেখিয়ে নিও পাঁড়েজি। আর সেদিনের চায়ের দামটা রাখো।’ তারপর হঠাৎই যেন নিমগাছটার তলায় চোখ পড়েছে, এমন ভাব করে বললেন, ‘হ্যাঁ পাঁড়েজি, তোমার নিমগাছতলার ওই গোল পাথর জোড়া ঠিক কোত্থেকে বেরিয়েছিল বলো দেখি?’

‘ওহি পাত্থর!’ হঠাৎ এই প্রশ্নে একটু যেন অবাক হল পাঁড়েজি। ‘ওহি পাত্থর তো সি.এম.ডি’কা (সি.এম.ডি.এ) আদমি রূপচাঁদ দত্ত ফরেস্ট লেন সে উঠাইয়ে ইখানে ফেলিয়ে গেল। লেকিন কেনো বোলেন তো?’

‘না , এমনি পাঁড়েজি।’ একটু মুচকি হাসলেন অনাথবাবু। স্টিকিং প্লাস্টারে মোড়া ডান পায়ের ছড়ে যাওয়া বুড়ো আঙুলের ডগার দিকে একবার তাকালেন। পাথর দুটো যে সেই ডাইনোসরের ডিম দুটোর ফসিল সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু সে কথা পাঁড়েজি কেন, কাউকেই বলতে পারবেন না তিনি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত