একটি ছিল বাঘের ছানা। নাম ছিল তাঁর বাঘু। দেখতে ছোট্ট অ্যাট্টুকুনি, যেন হলদে লাল তুলো দিয়ে গড়া পুতুলটি। গায়ে আবার ডোরাকাটা আঁকা কালো রঙে। দুটো নয় তিনটে নয়, ছানা এই একটিই। গায়ে তার বাঘ বাঘ গন্ধ হয়নি তেমন। ফোকলা মুখে মোটা টুকটুকে ঠোঁট, নাকের দুপাশে তিনটে তিনটে ছটা গোঁফ। মুখটা হাসি হাসি, নীল চোখ আর নরম নরম চারটি থাবা। লেজের কথা বলতে ভুলেছি, তাতেও হলদে কালো আলপনা। মোট কথা রূপের অন্ত নেই।
জঙ্গলের পর ঘন জঙ্গল, তারপর আরও ঘন জঙ্গল। তারপর নদী। নদীর ধারে পাহাড়। সেই পাহাড়ে গুহা। সেখানে তাঁর বাড়ি। থাকে বাঘু আর তাঁর মা। বাঘুর মা খুব যত্ন করে বাঘুকে চেটে চান করিয়ে কপালের পাশে নজর কাটানি ফোঁটা দিয়ে পেট ভরে দুধ টুধ খাইয়ে থাবড়ে ঘুম পাড়ালো। তারপর আদর করে কড়ে আঙুল কামড়ে লোম বিছানো বিছানাউ শুইয়ে রেখে গেল বাজার করতে। বাঘুর বাবা গেছে দূরের বনে চাকরি করতে।
আদর টাদর খেয়ে বড্ডো ঘুমিয়ে পড়েছে বাঘুটা। দুধ খেয়ে টুলটুল করছে মোটা মোটা পেটটা। দম নেবার তালে তালে উঠছে নামছে। নাক দিয়ে শব্দ হচ্ছে ভুর্র ভুর্র। মাঝে মাঝে নড়ে চড়ে এপাশ ওপাশ ফিরছে। আবার গোলগাপ্পা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। মাঝে মধ্যে কুঁ কুঁ শব্দ করে ভুরু কুঁচকোচ্ছে, ঘুম এই ভাঙে এই ভাঙে কিন্তু ভাঙছে না। আবার নাক ডাকছে ভুর্র ভুর্র। ঘুমোতে ঘুমোতে ঘুম গভীর হল। তারপর ঘুমিয়ে থাকা বাঘুটার মনের ভেতর থেকে আর একটা বাঘু বেরিয়ে এসে গোলাপি হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে চারপায়ে উঠে দাঁড়াল।
এটা হল মনের বাঘু। আসল বাঘু ঘুমোচ্ছে তো ঘুমোচ্ছেই। তাঁর নাক ডাকছে ভুর্র ভুর্র, টুলটুলে নাদুস পেট উঠছে আর নাবছে। মনের বাঘু টলতে টলতে গুহার বাইরে এসে দাঁড়াল। আবার একটা হাই তুলতেই আকাশের দিকে চোখ পড়েছে! কী নীল কী নীল! দেখে তো বাঘুটা অবাক! গুহার ভেতর তো আর আকাশ নেই। ঘুমিয়ে থাকা বাঘুটারও লেজের ডগায় সাদা ফুলটা নড়ল একটু, সেও খুব অবাক!
অন্ধকার থেকে আলোয় এসে হাঁচি পায়। তায় মাথা উঁচিয়ে আকাশ দেখতেই নাক সুর সুর করে। ফিঁচ করে হেঁচেই বেতাল হয়ে বাঘু লাউ গড়গড় কর গড়িয়ে গেল। গড়ানে জমিতে সবুজ ঘাস, কত রং বেরঙের ঘাসফুল, সব ফুরফুরে ডানা মেলে উড়তে লাগল। আর বাঘুটা তো গাল্লু গুল্লু, ওর মা আদর করে ডাকে গোলগাপ্পা! তাই গড়াতেই লাগল বাঘুটা। মোটা হলেও বাঘু হালকা পলকা। তাই ওর একটুও লাগল না। বরং নরম ঘাসে সুড়সুড়ি লেগে হাসি পেল ওর।
গড়াতে গড়াতে গড়াতে গড়াতে থামল এসে একটা পালকের বিছানায়। বাঘু আবার অবাক! ওর গায়ে গা লাগিয়ে সেখানে বসে আছে আরেক জন, ওরই মতো নরম সরম। এর গায়ে কিন্তু ডোড়া নেই। পালকের ওপর ফুলফুল ছিটের জামা। তারা দুটি গোল গোল চোখ আর ছোট্ট ভোঁতা একজোড়া ঠোঁট। বাঘুকে দেখে সেও ভারী অবাক। দুজনে দুজনকে শুঁকে চেটে, আর ল্যাজ নেড়ে খুব খুশি ওরা। মুখে অবশ্য কথা নেই কারো। বলবে কী, কথা ফোটেইনি ওদের। তবু খুব ভাব হয়ে গেল।
সারস মা গেছিল নদীর চড়ায় বাজার করতে। বাসায় ফিরে তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। ছিল একটা ছানা, গুনতিতে দুটো হল কী করে? তার আবার চোখে চশমা, কাছের জিনিস কম দেখে। ভালো করে শুঁকে যা বোঝার বুঝে গেল। তারপর বাঘুকে পুঁটলি বেঁধে গুহায় পৌছে ডানা জড়িয়ে অনেক আদর করে ফিরে গেল বাসায়।
বাঘু তো ঘুমিয়েই ছিল। ওর ইচ্ছে বাঘুটা একবার চেষ্টা করল সারস মায়ের মতো ডানা মেলে উড়তে। তারপর এক ডিগ্বাজি খেয়ে গুটি গুটি ঢুকে পড়ল ঘুমিয়ে থাকা বাঘুর ভেতর।
বাঘুর ঘুম চটে গিয়ে হাই তুলে চোখ মেলেই দেখল মা ফিরেছে। দেখেই তো খুব খিদে পেয়েছে বাঘুটার। মা এসে চেটে পুটে আদর করে পাশে শুতেই বাঘু চোখ বুজে চুক চুক করে দুধ খেতে লাগল। খেতে খেতে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ওর মা কিছু জানতেই পারল না।