খুলি আর তীর

খুলি আর তীর

ভারি মেঘ ঝুলে আছে লোহা-রঙা পাহাড়-চুড়োর ওপারে, আর সেখানে বজ চালাচ্ছে তার আলোর ছুরি। গুমগুম শব্দ ভেসে আসছে দূর উপত্যকার তুষার ধসের মতো… পাথুরে ঢালের ওপর মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে একা। একদম একা।

হোঁচট খাচ্ছে সে, চলছে জোর বৃষ্টিপাতের নিচে, সারা মুখ তার ক্ষতবিক্ষত। একটা ক্ষত হাঁ হয়ে আছে তার খুলির ওপর, গাল ফাঁক হয়ে দেখা যাচ্ছে চোয়ালের হাড়। এটাই শেষ। সে শেষ, শেষ তার দলের আর সবাই… তারা পরাজিত।

দূর পাইনের সারি যেন আকাশের গায়ে লাগিয়েছে এক গাঢ় ছোপ, ওই দিগন্ত একটা সীমানার চিহ্ন ধরে আছে। ওটার ওপারেই নিরাপত্তা, শত্রুদের আওতার বাইরের জীবন, যারা তাকে এখন মৃত বলে জানে। সে নিজেও জানে, এই ঝড় ঠেলে সে বেশি দূর এগোতে পারবে না। শিলা গুলিবর্ষণ করতে লাগল তার ঠেস দিয়ে থাকা পাথরটার ওপর, তাই মাঝে মাঝে পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও এগোল সে আবার।

হাল ছাড়ার মানুষ সে কখনোই ছিল না, কিন্তু এখন সে হাল ছেড়ে দিয়েছে। তারা তাকে মেরেছে, একে একে লড়াই করতে আসেনি, একসঙ্গে হামলে পড়েছে জনা বার। তাকে মেরেছে তারা মুঠো, গদা, আর বন্দুকের নল দিয়ে… এখন সে পরাজিত। হ্যাঁ, সে হাল ছেড়ে দেবে। তারা তাকে শিখিয়েছে, কিভাবে হাল ছেড়ে দিতে হয়।

পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মেঘ ঝুলে আছে গাঢ়-রঙা ট্যাপেস্ট্রির মতো। মানুষটা এগিয়েই চলল, যতক্ষণ না তার চোখে পড়ল একটা গুহামুখ। তারপর মানুষ যা বরাবর করে এসেছে তা-ই করল সে, আশ্রয় নিল সেই গুহার ভেতরে। যতই তাঁবু, বাড়ি আর প্রাসাদ থাকুক না কেন, কঠিনতম বিপদে মানুষ বরাবর গুহাতেই ফিরে এসেছে।

এখন আর বৃষ্টির ভয় নেই, কিন্তু গুহার ভেতরটা ঠাণ্ডা। কাঁপতে কাঁপতে সে জড়ো করল কিছু খড়ি আর ঝরা পাতা। তার ভেজা, কাদায় লেপটানো জীর্ণ কাপড়চোপড়ের মধ্যে পাওয়া গেল একটা দেয়াশলাই, আর সেই দেয়াশলাই থেকে আগুনের শিখা। পাতায় ধরা আগুন আঙুল বাড়িয়ে খুঁজতে লাগল তার উপযুক্ত খাবার।

খাবার সরবরাহ করল সে, ফলে তেজ সঞ্চয় করে আগুন ছড়াল উষ্ণতা। আরো কাছে গেল মানুষটা, সেই উষ্ণতা মেখে নিল তার দুই হাতে, শরীরে। আগুনের শিখা নেচে নেচে ছায়ার খেলা খেলতে লাগল গুহার কালো দেয়ালে, সেখানে আরো অনেক আলোর শিখা এঁকে রেখেছে তাদের স্মৃতিচিহ্ন… কত যুগ ধরে?

এবার সে শেষ। আর পেছন ফিরে কোনো লাভ নেই। শত্রুরা তার মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত, বন্ধুরাও এটাকে সত্য বলেই মেনে নেবে। সুতরাং সে এখন স্বাধীন। সে তার যথাসাধ্য করেছে, এখন সামান্য একটু বিশ্রাম, সামান্য সেরে ওঠা, তারপর পাইনমোড়া ওই পাহাড়-পারের সূর্যালোকে। তবে স্বাধীনতায়ও অনেক সময় তৃপ্তি থাকে না।

আবার জ্বালানি পেল সে, পেল প্রাচীন এক মৃত্পাত্র। পানি দিয়ে পাত্রটা পরিষ্কার করে, ভরে, সে রাখল আগুনের ওপর। তারপর জামার হাতা চিপে বৃষ্টির পানি ঝরিয়ে, গুটিসুটি মেরে রইল আগুন আর গুহার দেয়ালের মাঝখানে।

বৃষ্টির যেন কোনো শেষ নেই… গুহামুখে এসে ঝাপটা মারছে দমকা বাতাস, নিবু নিবু হয়ে যাচ্ছে আগুনের শিখা। ফেরার চিন্তা এখন পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাকে দেয়া হয়েছে সীমাহীন মার। পড়ে যাবার পরেও তারা লাথি চালিয়েছে। তার পাঁজরের হাড় ভেঙে দিয়েছে… ঠাণ্ডা সত্ত্বেও মাঝেসাঝেই ঝলসে ওঠা তীব্র একটা ব্যথা জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি।

নিশ্চল আর অসহায় হয়ে পড়ার অনেক পরেও তারা মার থামায়নি। কিন্তু সে এতই শক্ত, জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আরামটুকুও সে পায়নি। প্রত্যেকটি আঘাত

অনুভব করেছে সে, প্রত্যেকটা লাথি। মারতে মারতে মারতে মারতে নিজেরাই ক্লান্ত হবার পর চলে গেছে তারা।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নড়েনি, কেবল রাতের পদধ্বনি আর বৃষ্টি তাকে জাগিয়ে তুলেছে। সে নড়েছে, পেশিতে পেশিতে যন্ত্রণা, পাঁজরে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কেউ, খুলির ভেতরে কিসের যেন প্রচণ্ড লাফালাফি, কিন্তু তারপরেও কীভাবে যেন টিকে থেকেছে সে। হামাগুড়ি দিয়েছে, হেঁটেছে, টলমল করেছে, পড়ে গেছে। মূর্ছা গেছে সে, তারপর আবার সচেতনতা ফিরে পেয়েছে, হাঁ করে থেকেছে বৃষ্টির পানির নিচে, দৃষ্টি শূন্য।

এতক্ষণে বন্ধুরা তাকে মৃত হিসেবে ধরে নিয়েছে… সে মরেনি, কিন্তু ফিরেও সে যাবে না আর। এটা তাদের লড়াই, সবসময় তাদের লড়াই-ই ছিল। তাদের প্রত্যেকে লড়েছে বাড়ির জন্যে, হয়ত স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মার জন্যে। সে লড়েছে একটা নীতির জন্যে, আর লড়াই তার রক্তে রয়েছে বলে।

গরম পানি দিয়ে মাথা আর মুখ ধুঁয়ে ফেলল সে, ক্ষতগুলোর ব্যথা কমাল, যথাসম্ভব পরিষ্কার করল কাটা জায়গাগুলো। ভাল লাগল তার, গুহাকে মনে হলো আগের চেয়ে গরম। দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করতে লাগল সে। ধীরে ধীরে শান্তি নামল পেশিতে পেশিতে। কিছুক্ষণ পর আরো পানি গরম করে খেল সে কয়েক ঢোক।

বিদ্যুতের আলোয় দেখা গেল গুহার বাইরের গাছ, গুহামুখে ধূসর বৃষ্টি। আরো জ্বালানির দরকার। উঠে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল সে গুহার দূর অন্ধকারে, আরো খড়ি নিয়ে ফিরে এল আগুনের পাশে। আর তারপরেই সে পেল খুলিটা।

পোঁতা ছিল ওটা গুহার মেঝেতে। আলগা করার জন্যে যতই টানল সে, তত-ই অবাক হলো ওটার বিশালতায়। খুলিটা এক প্রকাণ্ড ভালুকের, নিঃসন্দেহে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের। খুলিটার আকার বলছে, জানোয়ারটার ওজন ছিল এক টনেরও বেশি।

আগুনের পাশে উবু হয়ে বসে পরীক্ষা করল সে খুলিটা। একটা চোখের কোটরে চকমকির একটা টুকরো। ওটাকে খুলল সে, সর্বশক্তি নিয়োগ করে। চমত্কারভাবে নির্মিত তীরের একটা মাথা।

এই তীর নিশ্চয় ভালুকটাকে খতম করেনি। অন্ধ করেছে, হ্যাঁ, রাগিয়ে তুলেছে জানোয়ারটাকে, কিন্তু শেষ করতে পারেনি। তবু ভালুকটা খতম হয়েছে। সম্ভবত পাথরের কুঠারের ঘায়ে, কারণ, খুলিতে একটা ফাটল আছে, কানের পাশের একটা হাড়ও ভাঙা।

আশেপাশে খুঁড়ে আরো কয়েকটা হাড় পেল সে। তার মধ্যে আঘাতের টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সামনের একটা পায়ের হাড়। আর তারপরেই সে খুঁজে পেল একটা পাথরের কুঠারের মাথা। কিন্তু কোথাও সে পেল না মানুষটার হাড়।

খুলির ভেতরে লাফালাফি আর পাঁজরের অসহ্য ব্যথা সত্ত্বেও উত্তেজনা অনুভব করল সে। গুহার ভেতরে, হাজার হাজার বছর আগে, একা একজন মানুষ অসম্ভবের বিরুদ্ধে করেছে এক মরণপণ লড়াই…এবং জয়ী হয়েছে।

কিসের জন্যে এই লড়াই? এত কঠিন লড়াইয়ের প্রয়োজন কি ছিল? আধা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভালুকটা, গুহামুখও খোলা ছিল, মানুষটা পালাতে পারত। লড়াইয়ের মাঝে সেই সুযোগ এসেছিল নিশ্চয়। তবু মানুষটা পালায়নি। লড়েছে সে আহত জানোয়ারটার অস্বাভাবিক শক্তির বিপক্ষে, সম্বল বলতে ছিল তার আদিম অস্ত্র আর মনুষ্যোচিত বুদ্ধি।

গুহার বাইরে আরো জ্বালানি খুঁজতে গিয়ে নিয়ে এল সে গাছের আস্ত একটা গুঁড়ি, আর কাজটা করতে গিয়ে হাঁপাতে লাগল যন্ত্রণায়। গুঁড়িটাকে রাখল আগুনের শিখা ছুঁয়ে, যেন সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানিতে পরিণত হয়ে ওঠা উষ্ণতা ছড়াতে পারে।

গুহার মেঝের গরম বালি খুঁড়ে শুয়ে পড়ল সে, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

তিন সপ্তাহ বাস করল সে গুহার ভেতরে, খেল বেরি আর বাদাম, সবসময় সচেতন রইল পাইনমোড়া পাহাড় বিষয়ে, পাশাপাশি মনে রাখল খুলি আর তীরের মাথাটার কথা। কাছে বা দূরে কোনও মানুষ চোখে পড়ল না তার… ওরা তাহলে খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়েছে।

শেষমেষ এল রওনা দেয়ার সময়। এখন সে যেতে পারে পাহাড়-পারের নিরাপত্তায়। স্বাভাবিক শস্তির অনেকটাই ফিরে এসেছে; ভাল লাগছে তার। চরম দুঃসময় শেষ হয়েছে জেনে হালকা লাগছে।

পরদিন দুপুরবেলা রোদে-পোড়া এক রাজপথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আবার সে হলো তার শত্রুদের মুখোমুখি।

‘আমরা ফিরে এসেছি,’ বলল সে শান্ত স্বরে। ‘থাকতে এসেছি আমরা। কয়েক সপ্তাহ আগে আমাকে তোমরা মেরেছ। আজও তোমরা আমাদের মারতে পার কিন্তু সেক্ষেত্রে তোমাদেরও ক’জন মারা যাবে। আর, আমরা আবার ফিরে আসব। সবসময় ফিরে ফিরে আসব।’

ধুলোয় ধূসর রাজপথে নীরবতা বিরাজ করল। তারপর সরে যেতে লাগল এক জন দু’জন করে লোক। তাদের নেতা তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি পাগল। পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছ।’ তারপর সে-ও চলে গেল। তাদের সামনের রাজপথটা এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা।

চোখে জয়ীর আলো জ্বালিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে রইল নীরব একদল মানুষ, আর ক্ষতবিক্ষত মুখের মানুষটা কি যেন একটা নিয়ে লোফালুফি করতে লাগল, যেটা চকচক করে উঠল একবার সূর্যের আলোয়।

‘ওটা কি?’ জানতে চাইল কে যেন।

‘তীর,’ জবাব দিল মানুষটা । ‘সে ফ একটা তীরের মাথা।’

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত