আজ সকাল থেকেই অস্থির অস্থির লাগছে আপনার। খুশি খুশিও। অফিস থেকে কখন বের হবেন- এই ভাবনায় অফিসে বসেও আপনি অফিসে থাকতে পারেন না। উত্তেজনা হলে আপনার এমন হয়- বেশিক্ষণ এক জায়গায় স্থির থাকতে পারেন না, অস্থির লাগে। ঘরময় পায়চারি করে বেড়ান। পুরনো অভ্যাস। ছোটবেলা থেকে। মা হাসতেন। মা বলতেন।
আজকে আপনি হাফডে ছুটি নিয়ে রেখেছেন। যেন লাঞ্চের পরই উড়াল দিতে পারেন। অথচ আজ ঘড়ির কাটা নড়ছে না। আপনি অনর্থক আপনার বসের দরজার সামনে গিয়ে ঘুরে আসেন, ঘড়ি দেখেন, ঘাড় চুলকান। কিন্তু লাঞ্চ আওয়ার হচ্ছে না। আপনি বের হতে পারছেন না। এমন কি করতে পারছেন না অপেক্ষাও। অথচ এতদিন ধরে আপনি একমাত্র এই কাজটিই সবচেয়ে সুন্দরমতো করে এসেছেন। অপেক্ষা।
আজ পৌনিকা আসছে। আপনার প্রেমিকা। অন্য শহরে থাকে। তার কথা মনে হতেই আপনার মনে শ্রাবণী বাতাস। আকাশে জলের ঘ্রাণ। অথচ আপনার গলা শুকিয়ে আসে। মনে হয় কেউ আপনাকে আড়াল থেকে দেখছে। আপনি ডেস্কে রাখা ওয়াটার বোতল থেকে অল্প অল্প গলা ভেজান। বারবার। তারপর আবার।
পৌনিকার সাথে আপনার আলাপ। খুব বেশিদিন নয়। আবার নয় একেবারে অল্পদিনেরও। মাঝে মাঝে মনে হয় পৌনিকা আসার আগে তেমন কোনো স্মৃতি নেই- কিভাবে বেঁচে থাকতেন, সিগারেট খেতেন, ঘুম থেকে জেগে উঠতেন। মনে করার চেষ্টা করেন। কিছুই মনে পড়ে না। যেন পৌনিকাই একমাত্র বাস্তব। বাকীসব স্বপ্ন ছিলো। আবার মাঝে মাঝে উল্টোটা।
পৌনিকা। পৌনিকা।
আপনার মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে আপনি অফিসের ডেস্কে বসে আছেন। আপনার ভালো লাগে না কিছু। রাগ হয়। তারচেয়ে বেশি লাগে অসহায়। আপনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। আকাশে মেঘ ধরেছে। কালো হয়ে আসছে। তবে আপনার মনের চেয়ে বেশি না। অপেক্ষা করতে মোটেও ভালো লাগছে না আপনার। যদিও একটা সূক্ষ্ণ আনন্দও হচ্ছে। পৌনিকা আসছে। অপেক্ষা অপছন্দের হলেও একটা আনন্দদায়ক। অদ্ভুত।
এমন না যে আপনি বিশাল প্রেমিকপুরুষ- আপনারও অতীতে ঝামেলা আছে। এর আগেও প্রেমিকা ছিলো আপনার- অন্তত দুই-তিন, তাদের কারো কারো সাথে অনেক গভীরে গিয়েও খেলে এসেছেন। ভালোবাসা স্বর্গীয়-ফোর্গীয় এইসব কথায় আপনার তেমন আস্থা নেই। ছিলো না কোনোকালে। অথচ এই পৌনিকা মেয়েটা আপনাকে কেমন করে ফেলেছে। এখন আর অন্য কোনো নারী আপনাকে সেভাবে টানে না। বা তাদের মাঝেও আপনি পৌনিকাকে খুঁজে বেড়ান। অবাক হতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে আরো অবাক হন। বা উল্টোটা।
পৌনিকা। অদ্ভুত একটা মেয়ে। অদ্ভুত ও সুন্দর। ওর চোখের চাহনি, ওর কথা, মৃদু কিংবা ছলাৎ হাসি- সবকিছুতেই একটা শান্ত আর নরোম ব্যাপার আছে। অনেকটা পুকুরের মতো। আর পুকুরটা একটা শান্ত নদীর মতো। ছিপছিপে স্বচ্ছ শীতল জল। যাতে শরীর ডুবিয়ে বেশ অনেকটা পথ চুপঝুপ শব্দ তুলে নিশ্চিন্তে হাঁটা যায়। নিরিবিলি।
অথচ নারীদের আপনার বিশ্বস্ত কিছু মনে হয়নি খুব কখনোই। বরং আপনি আগের সব প্রেমেই হারানোর একটা তীব্র ভয় পেতেন। এবং সেই ভয় আপনার অবচেতনে একটা ফণা তুলে রাখতো সবসময়। নিজেকে আপনার অধিকাংশ সময়ই ব্যস্ত রাখতে হতো প্রেমিকাদের ব্যস্ত রাখতে। তবু স্বস্তি হতো না। এখানেই পৌনিকা আলাদা। একটা কলাপাতানরম মেয়ে। যাকে বড় বেশি নিজের মনে হয়। আর আপন। পৌনিকার জন্য আপনি মাঝে মাঝেই কৃতজ্ঞতা বোধ করেন। নিজের কাছে।
জীবনের একটা অসময় বর্ষাবাদল সময়ে পৌনিকার সাথে প্রথমবার কথা হয়েছিলো আপনার। তারপর কয়েকবার। তারপর একদিন সে যখন আপনাকে আলতো করে ফিসফিস করে বলেছিলো, মন খারাপ করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে; আর আপনার দুম করে মন ভালো হয়ে গিয়েছিলো। অথচ আপনি জানতেন কোনো কিছুই এত সহজে ঠিক হচ্ছে না।
ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে আর কখনোই বাবার ঘন জমাট কণ্ঠ শোনা যাবে না। এবং মায়ের ওষুধ ফুরিয়ে যাবে দ্রুত। অথচ চাকরি হচ্ছে না। ওদিকে টিউশন করে পাওয়া সামান্য কটা টাকা। সেটাকে টেনে সারামাস লম্বা করার অভ্যাসটা এত সহজে আপনার পিছু ছাড়ছে না। বরং মাসের শেষদিক এলেই অর্থকষ্টে কিডনি দুটো বাহুল্য মনে হবে। আরো অনেকদিন। আর কোনো কোনো মাঝরাতে নিঃশব্দে ডুকরে উঠলেও, চিলেকোঠার সেই এককামরার গুমোট ঘরটা, যেখানে ভীষণ একাকী অন্ধকার থাবা গেড়ে বসে থাকে সারাদিন, সবটুকুই নিঃশব্দে চুষে নেবে, কেউ জানতেও পারবে না।
অথচ পৌনিকা। খুব সহজেই ঢুকে পড়লো আপনার ভেতর। এবং এসেই সব বদলে দিলো। প্রথমেই একটা আলতো ভঙ্গিতে দু’হাতে বন্ধ জানালাটা খুলে দিলো। সাথে সাথেই এক পশলা ভোরের আলো ঢুকে পড়লো হুড়মুড়িয়ে। আপনি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন- আপনার মনের ভেতরেও এতবড় একটা কপাটওলা জানালা ছিলো, অথচ নিজেই জানতেন না। অদ্ভুত। তারপর দূরের শীতল বাতাস এসে আলতো হাত বুলিয়ে দিলে চুলে, মাথায়, বুকে; প্রচণ্ড এক দুপুরঘোরে আপনার চোখ জুড়িয়ে আসে। কিন্তু আপনি জেগে থাকতে চান। পৌনিকার পাশেপাশে।
কি মনসুর সাহেব? খুব জরুরি কাজ নাকি? একেবারে অস্থির হয়ে আছেন আজ।
আপনার বস আপনাকে খেয়াল করেন। আপনি কিছু উত্তর করেন না। হাসার চেষ্টা করেন। শুকনো।
মনসুর সাহেব, আপনি ইচ্ছে করলে লাঞ্চের আগেও চলে যেতে পারেন। এমনিতেও আর বেশি সময় নেই।
আপনি সংকোচ করেন। না বলতে চান। কিন্তু হারাতে চান না সুযোগটাও। পৌনিকার স্পষ্ট চেহারা আপনার মনে অস্পষ্টভাবে ভেসে ওঠে। তার নাকের পাশে ঘামের বিন্দু। চকচক করে। আপনি আর তেমন কিছু না ভেবেই মাথা নাড়েন। বসকে ধন্যবাদ জানান। কারণ ধন্যবাদ আমাদের অনেক কাজকে সহজ করে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে।
আপনি আপনার ডেস্কে ফিরে আসেন। ব্যাগ গোছান। হাত কাঁপে। কারণ আপনার বারবার মনে হচ্ছে- ঠিক বের হবার সময় ঝামেলা বাঁধবে কোনো। বস হয়ত ডেকে নিয়ে গম্ভীর মুখে কোনো জরুরি কাজ ধরিয়ে দেবে। আগে অনেকবার এমন হয়েছে। আপনার মনে মনে মন খারাপ হয়। অথচ তেমন কিছুই হয় না। বস ডাকে না। শুধু আপনি নেমে আসেন। সিঁড়ি বেয়ে। খোলা আকাশের নিচে।
বাইরে এসে দেখেন- একটা অলস দুপুরের গায়ে হেলান দিয়ে সকাল ঘুমিয়ে আছে। আপনার বুক ভরে আসে আনন্দে। মনে হয় পৃথিবীটা আসলে খুব একটা খারাপ জায়গা না। ফুসফুস ভর্তি করা টাটকা নিঃশ্বাস নিয়ে আপনি দ্রুত পা চালান। আপনার মনে শুধু পৌনিকা। অপেক্ষা করছে।
পৌনিকাকে অনেকদিন পর দেখলেন আপনি। সামনাসামনি। যেহেতু আপনারা দু’জন ভিন্ন শহরে থাকেন। এই প্রথম আপনার শহরে এলো সে। একটা এনজিওর কাজে। নিরক্ষর শিশুদের নিয়ে একটা সার্ভে। কাজ শেষেই চলে যাবে।
আপনারা বাইরে খাওয়াদাওয়া সারেন। আপনি আর পৌনিকা। এবং এরকম অন্যান্য দূরত্ববাজ প্রেমগুলোর মতোই আপনাদের মধ্যে প্রথম প্রথম একধরণের জড়তা কাজ করে। স্বাভাবিক। তবে সেটা কাটতেও বেশি একটা সময় নেয় না। আপনাদের হাতেরা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী খেলতে শুরু করে। বাধা পায় না। ধীরে ধীরে দুজনের নিঃশ্বাসই খানিকটা ঘন হয়ে এলে, তা বেয়ে বেয়ে আপনারা উপরে উঠতে থাকেন। লিফট দিয়ে। আপনার দুই কামরার ঘর। সাততলার ব্যালকনি। সুন্দর আকাশ দেখা যায়।
বাইরে নরোম আর আলসেগুড়ি রোদ নেমেছে। কিন্তু তা আপনাদের স্পর্শ করে না। আপনি ও পৌনিকা। বরং আপনার ঘরের শীতলতা। গরম নিঃশ্বাস। ফুলস্পিড ফ্যান। পায়ের কাছে নতজানু ভঙ্গিতে রোদের আলো, চাঁদের মতো। অথচ সেদিকে আপনাদের কারো খেয়াল করার মতো খেয়াল হয় না। আপনারা তখন ঠিক যেন এখানে নয়। বরং অন্য কোথাও। অন্য কোনোখানে। আপনি আর পৌনিকা। দুজন ভেসে চলেন।
জাহাজডুবিতে বেঁচে যাওয়া দক্ষ নাবিকের মতো যত্ন করে এগুচ্ছিলেন আপনি। সাগরে। পৌনিকা অল্প অল্প কাঁপছে। আর একটা নতুন মৃত্যুর মতো উষ্ণতা উঠে এসেছে আপনার গলার কাছে। যেন অনেক উঁচু থেকে লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু তারপর একসময় হঠাৎ খেয়াল করলেন- কিছু একটা ঠিক ঠিক নেই। বেঠিক। আপনি যেন একা একাই সংগ্রাম করছেন।
পায়ের নিচে সাগরের ঢেউ কখন থেমে শান্ত হয়ে গেছে। আর আপনি সেই স্থির, বিশাল জলরাশির উপর দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে একা। অথচ পৌনিকা। আপনার শরীরের নিচে। চোখ বুজে আছে। কিন্তু এখানে নেই, নেই আপনার সাথেও। হয়ত অন্য কোথাও। তার ঠোঁট কাঁপছে না। শক্ত হয়ে আছে। মুহূর্তের মাঝে আপনার কিছুক্ষণ আগের উষ্ণ তরল আনন্দ জমে গিয়ে কঠিন বরফে রূপ নেয়। জমাট শীতল।
কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না আপনি। অথচ না বুঝেই কুঁকড়ে যান। তাহলে আপনিই কি অপরাধী? পৌনিকাকে কোনোভাবে কষ্ট দিয়েছেন? না। সে পেয়েছে? আপনার কাছ থেকে? এই মুহূর্তে? আপনি জানেন না। নাকি ওর খুব একটা ইচ্ছে ছিলো না? জোর করেছেন? কই না তো, তেমন কিছু হওয়ার কথা না। অন্তত পৌনিকার সাথে। অন্তত আপনি। এই ব্যাপারে নিজের ওপর যথেষ্ট আস্থা আছে। তাহলে?
তুমি ঠিক আছো?
শোনা যায় এমন ফিসফিস স্বরে জিজ্ঞেস করেন আপনি।
পৌনিকা মাথা নাড়ে। ডানে-বায়ে। চোখবন্ধ। না, সে ঠিক নেই। এবার আপনি সত্যিকার অর্থেই ভয় পান। নিজেকে ছেঁড়া ঘুড়ির সুতোর মতো পৌনিকার ওপর থেকে তুলে বিছানার একপাশে গুটিয়ে রাখেন। একটু আগের বাতাসের সেই টান আর নেই। পৌনিকাও হাতের কাছে থাকা চাদর পেঁচিয়ে নেয়। অনিশ্চিত শঙ্কায় আপনার গলা কেঁপে যায়।
আমি… আমি কি কিছু করেছি?
বাইরে বিকেল। অথচ ঘরের এপাশটায় যেন সন্ধ্যে নেমে এসেছে। বাতি জ্বালানো হয়নি। সেই আবছায়া অন্ধকারে পৌনিকার মুখ দেখা যায় না। অস্পষ্ট। অথচ কথা ভেসে আসে। পৌনিকা বলে। ফিসফিস। অথচ স্পষ্ট।
আমার একটু সমস্যা আছে, জানো। আমি কখনো কখনো এরকম চুপ হয়ে যাই। থেমে যাই। আসলে ছোটবেলায় আমার সাথে খুব একটা বাজে ব্যাপার হয়েছিলো।
পৌনিকা থেমে বড় করে নিঃশ্বাস নেয়। যেন এতক্ষণ ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস ছিলো না।
এবার আপনি আশঙ্কা করেন। আপনার কান গরম হতে শুরু করে। প্রথমে মনে হয় আপনার খুব মন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বরং তা বদলে যায় একটা আদিম রাগে, কিংবা অস্থিরতায়। এবং সেটাও বেশিক্ষণ থাকে না। দখল করে নেয় একটা করুণ অসহায়ত্ব। আপনি দেখেন। একটা অতীত পাখি। মারা যাচ্ছে। আপনার সামনে।
পৌনিকা তখন একটা ঘোরের মাঝে। একটানা বলে চলে। একটা লোক। ওদের এলাকার। চেনে না ঠিক। সে তখন অনেক ছোট। লোকটা ওকে ডাকে। কেন? বুঝতে পারে না। ভাবতেও না- কি হতে চলেছে। খুব বেশি কিছু মনে নেই। শুধু একটা নির্জনমতো জঙ্গল ধরণের জায়গা। তারপর? কেউ ছিলো না। আশেপাশে। কেউ থাকে না।
পৌনিকা না কাঁদলেও আপনি তার নিঃশ্বাসে কান্নার শব্দ শুনতে পান। পাখিটা ডানা ঝাপটাচ্ছে। অথচ মৃত।
জানো, মাঝে মাঝে খুব অপরিচ্ছন্ন লাগে নিজেকে। গা ঘিন ঘিন করে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। গা ডলে ডলে সেই সময়টুকু শরীর থেকে উঠিয়ে ফেলতে চাই। কিন্তু সময়ের ক্ষত এতো সহজে শুকোয় না। মাঝে মাঝেই মনে হয় একটা চিৎকার দিয়ে কাঁদতে পারলে যেন কিছুটা আরাম হতো। চেষ্টা করি। লাভ হয় না। ওই লোকটা যেন আমার শরীরের সাথেই লেপ্টে আছে। তার চেহারা মনে নেই। অথচ স্পষ্ট দেখতে পাই। মুখ থেকে ভয়াবহ পানের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
আপনি চুপচাপ শোনেন।
কিন্তু পৌনিকা দ্রুতই সামলে নেয়। যেন সে এইমাত্র ঘুম ভেঙে জেগে উঠে কোনো আদিম গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কোনো সুপ্রাচীন সময় থেকে চুইয়ে চুইয়ে অন্ধকার জমে আছে যেখানে।
আমি খুব দুঃখিত আসলে। সমস্যাটা একান্তই আমার। অথচ সাথে কেউ থাকলে সে বেচারাও কষ্ট পাবে। ঐজন্যই খারাপ লাগাটা বেশি। সেতো আর এতো কিছু বুঝবে না। তুমিও নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছো। ঐ অবস্থায়… আমিও হয়ত হতাম। সরি আমি।
পৌনিকার শেষ কথাগুলো শুনে বাস্তবে ফেরেন আপনি। মৃতপ্রায় পাখির কাছ থেকে আপনার দুই কামরার ফ্ল্যাটে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। আপনার সামনে পৌনিকা। দেখা যায় না। তবে বোঝা যায়। সঙ্কোচে সংকুচিত। যতটুকু না তার প্রাচীন ইতিহাস, ট্রমা; তারচেয়ে অনেক বেশি আপনার জন্য। আপনাকে একলা সমুদ্রে রেখে নির্জীব হয়ে যাওয়ার অপরাধ বা দুঃখবোধ। পৃথিবী বড় নীল হয়ে আসে। আপনি সামনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অপলক। অন্ধকার বা পৌনিকা। অন্ধকার ও পৌনিকা।
তারপর আপনি বুকটা অনেকটা গভীর করে কাছে টেনে নেন পৌনিকাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করেন,
সব ঠিক হয়ে যাবে। এই যে আমি। এখন তো আছি।
পৌনিকা মাথা নাড়ে। আপনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
পৌনিকা আরো ঘন হয়ে আসে। আপনারা দুজন। কাছাকাছি। ডুবে যেতে থাকেন। আপনাদের নগ্ন শরীর। পরষ্পরকে আকড়ে ধরে রাখে। অথচ কোনো ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই। চুপচাপ সেই শান্ত সমুদ্রে আপনাদের মাঝে কয়েক বিন্দু অশ্রু ছাড়া কিছুই নেই। এবং সেগুলোও আপনার বুকে শুকিয়ে লবণ হয়ে যাচ্ছে।
আপনার একটা ফুরফুরে ভাব হয়। একটু আগের কুৎসিত অনুভূতিটা যেন বিদায় নিয়েছে জানালা গলে, সন্ধ্যার দিকে। কেমন হালকা লাগে। এই প্রথম আপনার মনে হয়, হ্যাঁ, এতোদিনে আপনি বোধহয় সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে পারলেন পৌনিকাকে। কিছুটা সুখ হলো।
পৌনিকা বুকে মুখ গুঁজে থাকে। আপনি তার এলোচুলে হাত বোলান। ফিসফিস করেন। আপনারা দু’জন। আপনার ভালো লাগে। মরে যাবার মতো ইচ্ছে হওয়ার মতো ভালো লাগে। পৌনিকাকে আপনি ভালোবাসেন।
কিন্তু যেটা আপনি কখনো জানবেন না যে, আপনার সেই থাইগ্লাস আঁটা জানালার পাশাপাশি আরো অনেক অনেক জানালা পেরিয়ে, গলি-রাস্তা-এলাকা ঘুরে এই শহরেরই অন্য আরেকটা এমনই জানালার পাশে একটি মেয়ে। জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। একটা ঝরে পড়া ফুলের মতো মলিন। কতইবা বয়স হবে তার। চৌদ্দ-পনেরো। কম-বেশি। নিঃশব্দে কাঁদছে।
আজ বিকেলে পড়তে যাওয়ার সময় বাসের ভীড়ে কেউ একজন তার বুকে হাত দিয়েছিলো। আর ফেরার সময় পাশে বসা নিরীহ চেহারার বুড়ো ভদ্রলোকটা সারাটা পথ ক্ষণে ক্ষণে তার উরুতে হাত বুলিয়েছে। অথচ গম্ভীর মুখে তাকিয়েছিলো অন্যদিকে। যেন এদিকে কোনো কিছুতে খেয়াল নেই। কিছু বলার চেষ্টা করেও সুবিধা হয়নি। এ-তো তবু হাত বোলাচ্ছে। ওইদিন একজন ভীড়ের মাঝে ওর কোমর খামচে ধরলো ভীষণ জোরে। ব্যথা পেয়েছিলো সে। কিন্তু লোকটা যে কী সুখ পেয়েছিলো অনেক ভেবেও বের করতে পারেনি মেয়েটা।
তাছাড়া কোথায় যাবে সে? ভীড়। এতো মানুষ। এতো পুরুষ। সারাটা পথ। বাড়ি ফিরে অনেকটা সময় নিয়ে স্নান করেছে। কিন্তু সেই স্পর্শগুলো ওঠেনি। একটা নীরব যন্ত্রণার মতো চেপে আছে। শরীর বাদ দিলে একজন মানুষের নিজের বলতে আর থাকেইবা কতটুকু? নিজের ওপরই তাই এখন মেয়েটার ভীষণ ঘেন্না হচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা করা যাচ্ছে না। পাশের ঘরেই ঘুমাচ্ছেন। বাবা।
হ্যাঁ, এর ঠিক ঠিক পাশের জানালায় উঁকি দিলে আপনি তার বাবাকে দেখতে পাবেন- একজন কাঁচাপাকা বৃদ্ধ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অথচ দুপুরের ঘুম তার এখনো ভাঙ্গেনি। বড় নিশ্চিন্ত ঘুম। দেখে মায়া লাগে। মাঝে মাঝে তার মুখটা ঘুমের মাঝেই হাসি হাসি হয়ে উঠছে।
বৃদ্ধ কোনো স্বপ্ন দেখছেন কীনা, কিংবা দেখলেও বছর অনেক আগে কোনো এক মফস্বলে থাকতে পাশের বাসার খুকীকে একলা জঙ্গলে ডেকে নেয়ার কথা তার মনে পড়ছিলো কীনা- আমরা ঠিক জানি না। জানতে পারি না।
অথচ পৃথিবী। পুড়ে যাচ্ছে। দ্রুত।