লুপ্তপ্রায় প্রজাতি ও পিতা-পিতৃব্যদের সাবধানবাণী

লুপ্তপ্রায় প্রজাতি ও পিতা-পিতৃব্যদের সাবধানবাণী

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা হাড্ডি খিজির শূন্যে পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে আমাকেও ডাকে- আহেন! এট্টু জলদি করেন! পাও দুইখান মনে লয় ইস্ক্রুপ মাইরা মাটির লগে ফিট কইরা দিছেন!

খিজিরের তাড়া, নিরন্তর তাড়াও আমাদের পাগুলোকে এখন স্থবিরতা থেকে মুক্তি দিতে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হয়ে চলেছে। গতিব্যর্থতা কি আমাদের জিনবৈশিষ্ট্য?

খিজির বিরক্ত হয়ে বলে- তাইলে হালায় বইয়া বইয়া খোয়াব দ্যাখেন! আমি যাইগা।

খিজিরের তাড়া আছে। কারণ সে জানে যে সে কোথায় যাবে।

কিন্তু আমি কি আর অত সহজে নড়তে পারি? নাকি খিজিরের কথামতো সঙ্গে সঙ্গে দৌড় লাগানো আমার সাজে? আমি তো পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজি, ফ্যানের বাতাস ছাড়া গরমের দিনে ঘুমাতে পারি না, ঠান্ডা কোকাকোলা খেতে পছন্দ করি এবং মাঝে মাঝে খাই, বাংলাদেশ দলের ক্রিকেট খেলা থাকলে ঐদিন অন্য কাজ ভালো লাগে না, প্যালেস্টাইনের ওপর ইহুদি হামলায় নিদারুণ মনঃক্ষুণœ হই এবং কেজিতে দুই-পাঁচটাকা বেশি দিয়ে হলেও চিকন চালের ভাত খাই। আমা হেন মানুষ কি আর হাড্ডি খিজিরের কথায় হুটহাট বেরিয়ে পড়তে পারে? আমি বরং তাক থেকে বই নামিয়ে পড়তে শুরু করি। বই পড়া মানে হলো জ্ঞানঅর্জন। আর জ্ঞানঅর্জন হলে কোথায় যাওয়া উচিত তা বোঝা যায় এবং পদযাত্রার একটা মানচিত্রও পাওয়া যেতে পারে।

খিজির আবার বলে- আরে কিসব কিতাব-উতাব পড়বার লাগছেন! মিছিল তো দূরে চইলা যাইতাছে!

যাক। মিছিল আর কতদূরে যাবে! তাছাড়া মিছিলে গেলেই তো শুধু হলো না, মিছিলের গতিপথ বলে দিতে হবে না? বলে দেবার লোক লাগবে না? গতিপথ বলে দেবার লোক না থাকলে মিছিল তো সোজা গিয়ে ধাক্কা খাবে পাথুরে দেয়ালে কিংবা ঝপাৎ করে পড়বে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে।

তাছাড়া মিছিলে গিয়ে হবেটা কী?

আমাদের তো শেখানো হয়েছে যে পুঁজিবাদই মানবজাতির অনিবার্য নিয়তি। জানানো হয়েছে মানুষের ওপর মানুষের শোষণ চলতেই থাকবে। অনাহার অপুষ্টি অশিক্ষা অবর্ণনীয় দারিদ্র্য আর বিপরীতে সম্পদের পাহাড় হচ্ছে মানবজাতির অনিবার্য বিধিলিপি। বিশ্বায়নের নামে গোটা পৃথিবীটাকে ভাগ করে নেবে কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি। মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র তা বাহুল্য বিবেচিত হবে। অধিপতি শ্রেণী যাকে সংস্কৃতি বলবে তাকেই মেনে নিতে হবে নিজেদের সংস্কৃতি বলে। আমাদের নারীদের লাবণ্য, শিশুদের পুষ্টি, প্রৌঢ়-বৃদ্ধদের প্রশান্তি, যৌবনের সৃষ্টিশীলতা- সবকিছু চিরস্থায়ী দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকবে চিরকালের জন্য।

আমাদের শেখানো হয়েছে যে এই অসাম্য থেকে মুক্তির কোনো উপায় মানবসমাজের নেই। এমনকি মুক্তির চিন্তা করাটাও অন্যায়। শেখানো হয়েছে যে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই, প্রতিবাদ করতে গেলেই বরং আরো চেপে বসবে অত্যাচারের বজ্রমুষ্টি। বিনীত প্রার্থনা জানাতে হবে। নম্র প্রার্থনায় নতজানু হলে হয়তো কিছুটা ছাড় পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সবাই না পাক, অন্তত কেউ কেউ পাবে। যেমন তফসিলিদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে মন্ত্রী পর্যন্ত বানানো হয়, সাঁওতালদের মধ্য থেকে কোনো কোনো আলফ্রেড হেমব্রমকে যেমন ম্যাজিষ্ট্রেট বানানো হয়। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গেলেই তাকে মরতে হবে আলফ্রেড সরেনের মতো, কিংবা নিখোঁজ হয়ে যেতে হবে কল্পনা চাকমার মতো।

তারচেয়ে বই পড়তে পড়তে একটু অতীত থেকে ঘুরেও আসা যায়।

জলকলের ডানপাশ দিয়ে আয়ুব খানের বানানো ষাট-ফুটি পিচপাথরের রাস্তা দূরের জেলার দিকে রওনা দিয়ে ঠিক উপজেলা পরিষদের তোরণের সামনে মিলেছে পাগলা রাজার রাস্তার সাথে। পাগলা রাজার রাস্তা লম্বালম্বিভাবে অবশ্য বেশি বড় নয়, তবে বিস্তারে আয়ুব খানের রাস্তার সাথে ভালোভাবেই পাল্লা দেয়। জনশ্রুতি, এই রাস্তায় নাকি রাজার ছয় হাতি পাশাপাশি হাঁটত মাহুতের তত্ত্বাবধানে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে। শহরের ঘোষপাড়ার প্রতিষ্ঠাতা আদি ঘোষের ঘি খাঁটি না ভেজাল মেশানো তা নির্ণয় করেছিল রাজার কোনো এক হাতিই। খাঁটি ঘি নাকি পুং জননাঙ্গে মালিশ করার সঙ্গে সঙ্গে হাতি পেচ্ছাপ করে দেয়। এটা নাকি হাতিসমাজের এক মহান বৈশিষ্ট্য। তো খাঁটি ঘি তৈরির সুবাদে হাতির পেচ্ছাপ করায় রাজা প্রীত হয়ে নিজে রাজবাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঘি পারিতোষিকসহ সংগ্রহ করার পাশাপাশি নারদ নদের দক্ষিণ পাড়ে ঘোষপাড়া প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়েছিলেন। রাজার রাস্তায় এখন হাতির চলাচল থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তবে মনুষ্য চলাচল এখনো একটি প্রবহমান বাস্তবতা। পাগলা রাজার রাস্তার দু’ধারে শিরিষ গাছের সারি। হাঁটতে গেলে যদি মৃদুমন্দ বাতাস থাকে তাহলে শিরিষসঙ্গীত শোনা যেত নিশ্চিত। যেত, বলার কারণ এখন আর ঐ শিরিষ গাছগুলি নেই। স্বাধীনতার ঘোষক দাবিদার যখন প্রথম মিলিটারি আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন, তিনি নাকি পাগলা রাজার রাস্তা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদ্যোগের চিহ্নস্বরূপ কাটা হয় শিরিষবৃক্ষগুলি। বাকি কাজ আর এগোয়নি। ফলে পাগলা রাজার রাস্তা ধরে হাঁটতে গেলেও আমাদের প্রাকযৌবন আর শিরিষের শিরশির ধ্বনিতে মোহিত হবার সুযোগ পেত না। উপজেলা পরিষদ থেকে দক্ষিণ দিকে রওনা দিয়ে জলকলের বামপাশ দিয়ে হর্টিকালচার প্রজেক্ট পেরিয়ে ডোমপাড়া মাঠের কালভার্ট পর্যন্ত পৌঁছুতেই শেষ হয়ে যায়। কালভার্ট থেকে সরু ইট-কংক্রিটের আধুনিক রাস্তা। রাস্তার দুইধারে বনলতা বালিকা বিদ্যালয়, সমবায় বিভাগের অফিস, রাজা প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয় যা এখন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, নতুন নতুন বসতবাড়ি, ফার্নিচারের কারখানা, বরফকল, নগরবাসীর মননচর্চার চিহ্ন হিসাবে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পাশে ডাঃ কায়েসউদ্দিনের বিষণ্ন হোমিওপ্যাথির দোকান; সেখানেই আমি জীবনে প্রথম একজন কমিউনিস্টকে চাক্ষুষ করি দৈনিক সংবাদ পাঠরত অবস্থায়।

তখন দৈনিক ইত্তেফাকের রমরমা। বাড়িতে পেপার রাখা হবে, এতখানি জাতে তখনো ওঠেনি আমাদের পরিবার। এখনো নয়। পাড়াতে চায়ের দোকান দুইটি। একজনের নাম নবাব আলি, অন্যজনের নাম বাবু মিয়া। রাজ-রাজড়ার শহরে একজন নবাব অন্যজন বাবু। তারা উভয়েই কিছুটা মরমিয়া ধরনের। বুঝে ফেলেছিল চায়ের দোকান চালিয়ে তাদের সংসারের অবস্থা আর যাই হোক, রমরমা হয়ে উঠবে না। তাই দোকান চালালেও তাদের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব। দুই দোকানেই একজন করে ছোকরা কর্মচারি। তারাই চা বানায়, কাপ মাজে, মাটি আর শিক দিয়ে তৈরি চুলায় দৈলা গুঁজে দেয়। বাবু আর নবাব মোটামুটি খদ্দেরদের কাছ থেকে পয়সাকড়ি বুঝে নেয় আর বাকি-টাকির হিসাব রাখে। তো দুই দোকানেই দৈনিক ইত্তেফাক। কিছুদিন রাজনীতি করা পাড়ার স্বনামখ্যাত জুয়াড়ি সিরাজুল চাচা আমাদের সেই সেভেন-এইটে পড়া বয়সেই বুঝিয়ে দিয়েছিল পেপারের শাঁস হচ্ছে তার উপসম্পাদকীয় কলাম। তখন উপসম্পাদকীয় লেখে স্পষ্টভাষী, লুব্ধক, সুহৃদ প্রভৃতি নামের আড়ালে অতি জ্ঞানী ব্যক্তিরা। বিভিন্ন বিষয়ে লেখা হয় উপসম্পাদকীয়। কিন্তু একটি বিষয় থাকবেই। তা হচ্ছে কমিউনিস্টদের গালি দেওয়া। সেইসঙ্গে বোঝানোর চেষ্টা করা যে, কমিউনিস্টরা হচ্ছে ভয়ানক মানুষ, দেশের এবং জাতির ধ্বংসই কমিউনিস্টদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, এমনকি মিলিটারিও ভয় পায় কমিউনিস্টদের।

সিরাজুল চাচার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমাদের শহরে কমিউনিস্ট আছে কি না। উনি নাম বলেছিলেন। এবং ঘটনাক্রমে একদিন হোমিওপ্যাথির দোকানে বসে থাকা কমিউনিস্টকে দেখিয়েও দিলেন।

আমি তো থ!

এই লোক নাকি ভংয়কর!

নিরীহ গোবেচারা গোছের মানুষ, মাঝারি উচ্চতা, বয়স প্রৌঢ়ত্ব ছুঁয়েছে, মুখে সরলতার ছাপ, হেসে হেসে গল্প করছে ডাক্তারের দোকানের বেঞ্চিতে বসে থাকা আরও জনা তিনেক লোকের সঙ্গে। হাতে দৈনিক সংবাদ।

প্রাকতারুণ্যের ঐ বয়সে, ঐদিনই আমি বুঝে গেলাম যে, কোনো একটি মিথ্যার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। হয় ঐ কমিউনিস্ট লোকটি মিথ্যা; না হয় দৈনিক ইত্তেফাক মিথ্যা।

কারণ কয়েকদিন আগেই, যখন পাগলা রাজার রাস্তার শিরিষবৃক্ষনিধনপর্ব চলছিল, ঐ লোকটাকে দেখেছিলাম বৃক্ষনিধনের প্রতিবাদে বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে। বৃক্ষের প্রতিও যাদের এত ভালোবাসা তারা মানবজাতির এতবড় দুশমন হয় কিভাবে?

ঐ লোক থেকে দূড়ে থাকিস! সিরাজুল কাকা তো বলেই, আব্বাও সতর্ক করে দেয়।

আমাদের ব্যাচের ছয়জনের তখন টার্গেটই হয়ে যায় ঐ লোকের কাছে যাওয়া। এমনকি যে আসাদ গত দুইমাস ধরে পড়াশুনা শিকেয় তুলে শুধু ডিসি অফিসের নাজির কুতুবউদ্দিনের মেয়ে নার্গিসকে একনজর দেখার জন্য এবং তাকে নিজেকে দেখানোর জন্য দিনে অন্তত চারপাক মারে হেমাঙ্গিনী ব্রিজ টু চাঁদমারি মাঠ পর্যন্ত, সেই আসাদও এই প্রথম নার্গিসভিন্ন অন্য কোনো বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

ঐ লোকের কাছে ভিড়লে অসুবিধা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তরে বহুদর্শী  গৃহঅন্তপ্রাণ বাপ-চাচারা বলে যে- ঐ লোকের কাছে গেলে সে তোদেরও কমিউনিস্ট বানিয়ে ছাড়বে। আর কমিউনিস্ট হলে তার ইহকাল-পরকাল শেষ!

সর্বনাশ! এমন একটা বিপজ্জনক মানুষকে এই লোকালয়ে বাস করতে দেয় কেন শহরের মানুষ?

দেয়! কারণ গণতন্ত্রের দেশ তো। কাউকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া যায় না। তবে নজর রাখা হয়। খুব কড়া নজর। এই শহরে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের অন্তত অর্ধেক গোয়েন্দাকেই রাখা হয়েছে শুধু এই একটা লোককে ছায়া হয়ে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। তাই অন্যদিকে নজরই দিতে পারে না গোয়েন্দা বিভাগ। সেই কারণেই তো শহরে চুরি-ডাকাতি আর স্মাগলিং-এর রমরমা অবস্থা।

আমরা কমিউনিস্টের প্রতি এতই আকর্ষিত বোধ করি যে তার কাছে ঘেঁষবার জন্য আমাদের মগজের মধ্যে পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে অবিরাম।

প্রথমে পরিকল্পনা করা হলো, তার ছেলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা হবে। কিন্তু তার ছেলে থাকলে তো! বিয়েই করে নি লোকটা।

আমাদের অন্য পরিকল্পনাগুলিও কাজে আসে না। তখন আমরা আবার ধরি সেই সিরাজুল কাকাকেই। কিন্তু রাজি করাতে পারি না। উল্টো সিরাজুল কাকা আমাদের যে গল্প শোনায়, তা শুনে আমরা তো থ। এই জেলার প্রধান সরকারি নেতা, যে এখন জেলার হর্তাকর্তাবিধাতা, সেই নেতাও নাকি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে এই কমিউনিস্টেরই শিষ্য ছিল। কাজেই সবার চেয়ে সে-ই সবচেয়ে ভালো জানে এই লোক কতখানি বিপজ্জনক। পরিস্থিতি আঁচ করতেও তার কোনো জুড়ি নেই। রাজনীতির সবচেয়ে ভালো গুরুর কাছে শিক্ষা পেয়েছে যে। সেই নেতার একটি গল্প শোনায় সিরাজুল কাকা। সেই গল্প শুনে আমরা এতই ভয় পেয়ে যাই যে ভয়ে আমাদের হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে চায়। ফলে আমাদের আর কমিউনিস্টের কাছে যাওয়া হয় নি। এবং সেই থেকেই মিছিলে যেতে আমাদের এত দ্বিধা এবং ভীতি। নতুন শতকের নবম বছরে গল্পটি হয় এইরকম-

 

নেতার দরজায় এমন ভিড় সবসময়েই থাকে। সব জায়গাতেই মাছি ওড়ে। কিন্তু যেখানে মাছির দল থকথকে হয়ে জমে থাকে, বুঝতে হবে সেখানে গুড়-চিনির শিরা আছে। তার দরজাতেও গুড়-চিনি আছে। ক্ষমতার গুড়-চিনি। তিনি যখন বাড়িতে ঢোকেন বা বাড়ি থেকে বের হন, কখনো গেটের জটলার দিকে তাকান না। কিন্তু জটলা আছে টের পান। জটলা আছে দেখে একধরনের তৃপ্তিও পান। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গাড়ির কাচে স্লামালেকুম স্যার, আদাব স্যার, নমস্কার স্যার- জাতীয় শব্দ এসে বাড়ি খায়। তিনি কখনো না তাকিয়ে হাত তোলেন, কখনো শুধু একটু মাথা ঝাঁকান, কখনো কানে মোবাইল চেপে ধরে ভুশ করে বেরিয়ে যান।

গেটের জটলা থেকে তার তদবির-ঘরে পৌঁছুতে অনেকেরই বেশ সময় লাগে। তবে কেউ কেউ ঠিকই লেগে থেকে সুযোগ করে নিতে পারে। যেমন আজকের ছেলেটি পেরেছে। ছেলেটিকে দেখে বাহ্যিকভাবে তার ভুঁরু একচুলও কাঁপে নি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি সত্যিই একটু টাল খেয়ে গেছেন। দুইদিন ধরেই খাচ্ছেন। গেটের সামনে কৃপাপ্রার্থীর জটলায় ছেলেটিকে তিনি আগেই দেখতে পেয়েছেন। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠেছিলেন। এ কাকে দেখছেন তিনি! এত চেনা চেনা লাগছে কেন!

গেট থেকে তাঁর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে ছেলেটির তিনদিন লেগেছে। তাকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেন তিনি। নাহ্ একে তিনি দেখেন নি। কিন্তু তারপরেই চমকে উঠলেন ভয়ঙ্করভাবে। আরে এ তো তিনি! তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি নিজে! এ কীভাবে সম্ভব! মাথাটার তখন একবার চক্কোর দিয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এবং তখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করে তার ভেতরের অপরিসীম অভিযোজন-ক্ষমতা, যা তাকে এতদূর এনেছে। ফলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেন তিনি। বুঝতে পারেন, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তিনি নিজে নন, অন্য আরেকজন মানুষ। আরেকজন যুবক। তার মধ্যে তিনি শুধু নিজের অতীতের একটুখানি ছায়া দেখতে পেয়েছেন। তার তিরিশ বছর আগের অতীত, যখন তিনি বিপ্ল¬বী রাজনীতি করতেন।

কী সমস্যা তোমার?

আমার একটি চারিত্রিক সনদপত্র দরকার।

তার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে কথাগুলি বলল ছেলেটি। তিনিও এমনভাবেই কথা বলতেন সেইসময়। বিনয়ের আতিশয্য নেই, কৃপাপ্রার্থীর কুণ্ঠা নেই, তেমনই নেই অভব্যতাও।

ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট কেন? চাকরি চাই?

ছেলেটা কোনো উত্তর দেয় না। শুধু মৃদু হাসে।

দিন তিনেক না কামানো গালে ঘন হয়ে গজিয়ে ওঠা কচি ধানচারার মতো দাড়ি। জিন্সের প্যান্টের ওপর খাদির পাঞ্জাবি অপরিষ্কার না হলেও ইস্ত্রিবিহীন। তাকে ডাকছে তিরিশ বছর আগের দিনগুলি। কিন্তু তার সেই অভিযোজন-ক্ষমতা এখনও ক্রিয়াশীল। এবং অচিরেই তা তাকে ফের বর্তমানে ফিরিয়ে আনতে পারে। তিনি তার এখনকার মনোভঙ্গি এবং বাচনভঙ্গি ফেরত পান।

কিন্তু আমি তোমাকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেব কীভাবে? আমি তো তোমাকে চিনিই না। তুমি রাষ্ট্রবিরোধী বা গণবিরোধী কোনো কাজে জড়িত কি না আমি জানব কীভাবে?

ছেলেটা কয়েক মুহূর্ত ভাবল। তার চোখের দিকে আরও একবার তাকাল সোজাসুজি। একটু নিমীলিত হয়ে এলো তার চোখের পাতা। যখন কথা বলল, কণ্ঠস্বর মন্দ্র, গাঢ়, স্তোত্রপাঠের মতো সুগভীর- আমি শপথ করে বলছি যে পৃথিবীর কোনো অন্যায় হত্যাকা-ে আমার কোনো অংশগ্রহণ নেই! ডফলিস্তিনি নারী-শিশু ও স্বাধীনতাযোদ্ধাদের ওপর যুগ যুগ ধরে যে গুলিবর্ষণ চলছে, আমি তাতে অংশ নেই নি। অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে যেদিন থেকে ইরাকের শিশুদের দুধ ও পুষ্টি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, সেদিন থেকে ভাতের লোকমা মুখে তুলতে আমি অপরাধবোধে আক্রান্ত হই। নেলসন ম্যান্ডেলা যতদিন কারারুদ্ধ ছিলেন, আমি ততদিন নিজেকেও বন্দি ভেবেছি। কবি বেঞ্জামিন মলয়েজের ফাঁসির দিনকে আমি শোকদিবস হিসাবে পালন করি প্রতিবছর। আমেরিকার ছোঁড়া কুহকী ক্লাস্টার বোমাকে চকোলেট ভেবে হাতে তুলে নিয়ে রক্তাক্ত হয় যে আফগান শিশুরা, তাদের সাথে আমিও রক্তাক্ত হই প্রতিনিয়ত। বসনিয়ার গণহত্যা ও নারীধর্ষণের জন্য আমি প্রতিদিন ক্ষমাপ্রার্থনা করেছি আমার সহোদরাদের কাছে। আমি শপথ করে বলছি যারা ফুলবাড়িতে গুলি চালিয়েছে, রক্ত ঝরিয়েছে কানসাটে, তাদের সঙ্গে আমি ছিলাম না। আপনি বিশ্বাস করুন, প্রতিদিন আমাদের দেশে যত কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়, যে দুর্নীতির কারণে আমাদের পুরুষরা জীবিকাহীন, নারীরা লাবণ্যহীন, শিশুরা পুষ্টিহীন সেইসব দুর্নীতির সাথে আমার কোনো সংস্রব নেই। আমি শপথ করে বলছি…

যুবক বলেই চলেছে। তার কণ্ঠস্বরে পুরো ঘরে নেমে এসেছে স্তব্ধতা। কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর খসখস করে লিখলেন- এই যুবক আমাদের রাষ্ট্র ও আমাদের বিন্যাসিত সমাজের জন্য খুবই বিপজ্জনক। তাকে রাষ্ট্রের কোনো কাজে কোনোদিন নিয়োগ দেওয়া চলবে না।

কারণ, সিরাজুল কাকা মনে করিয়ে দেয়, নেতার মনে হয়েছে, ছেলেটির মধ্যে তার পুরনো গুরুর ছায়া। গুরু এখনো, এমন বিরূপ এবং প্রতিকূল সময়েও, মাঝেমাঝে বানিয়ে ফেলতে পারে এখনকার স্থিতাবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ এমন একজন-দুইজন বিপজ্জনক তরুণ কিংবা যুবক!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত