দাদীজান
লিখেছেন- তানজিনা তানিয়া
হঠাৎ এক ভোরে, ফজরের ওয়াক্তে দাদীজান অমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন। বরাবরের মত সেদিনও অামি ফজরের নামাজের জন্য দাদীজানকে ডেকে দিয়েছিলাম। দাদীজান অামাকে নামাজ পড়ার জন্য তাগেদা দিলেন। অামি বরাবরের মত ঘুমকাতুরে হয়ে শুয়ে রইলাম। অাবারো ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকাডাকিতে। দরজায় ধাক্কাচ্ছেন মা। অামি চোখ কচলাতে কচলাতে চোখ মেলে দেখি, দাদীজান এখনো সেজদায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি অাটটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাজে। দাদীজানের গায়ে অাস্তে করে হাত রাখতেই অামার কেমন খটকা লাগলো! দাদীজানকে সোজা করতে গিয়ে যখন বুঝলাম যে, উনি অার অামাদের মধ্যে নেই, তখনি অামি গগণ ফাঁটানো এক চিৎকার দিলাম। ততক্ষণে দরজার কাছে অনেক মানুষ সমবেত হয়ে গেছে। সবাই দরজা ধাক্কাধাক্কি করছে। অামি দরজা খুলে দিলাম। মুহুর্তেই এতক্ষণ অামাকে জমিদার পুত্র, দাদীর সাথে থেকে থেকে বদ হইতেছে বলতে থাকা অামার মা বিলাপ পেরে কান্না শুরু করলেন। ছোট কাকী, জ্যাঠীমাও মায়ের সাথে তাল মেলালেন। অামার বুক ফেঁটে কান্না অাসছিলো। কিন্তু কেন জানি অামি কাঁদতে পারছিলাম না। কান্নার দলাটা গলায় এসে অারও বিশালাকার এক দলা পাকিয়ে অাটকে যাচ্ছে। বার বার মনে পড়ছে, এইতো সকালেই দাদীজান অামাকে নামাজ না পড়ার জন্য বকাঝকা করতে করতে চৌকাঠে বসে বদনার পানি দিয়ে অজু করে নামাজে বসলেন। যদি জানতাম, এটাই দাদীজানের শেষ দিন হবে তাহলে দাদীজানকে জড়িয়ে ধরে একবার প্রাণ ভরে কেঁদে নিতাম। অামার দাদীজান অার কখনও অামার মাথায় তার ভাঁজ পড়া চামড়ার নরম হাত দিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে ঘুম পাড়াবে না ভাবতেই অামি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। মা এই সুযোগটা কাজে লাগালো। এতক্ষণ দাদীর পাশে বসে বিলাপ করছিলো। এখন দৌড়ে এসে অামার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে করতে বললো
-ওরে অামার মিতুলরে, বাপরে এখন ফজরেরও অাজান শুইনা কারে তুই ডাক দিবিরে।
মায়ের এহেন অাচরণে অামার অাবার কান্না থেমে গেলো। অামার মা- চাচীদের এই ন্যাকা কান্না অামার মোটেও ভাল লাগছে না। এই তো সেদিনের কথা, দাদীজান চেপা ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিল। মাকে সরাসরি বলতে সাহস পায়নি, তাই অামাকে বলেছিল। অামি মাকে গিয়ে বলতেই, মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো অার বললো
-বুড়ো বয়সে ভীমড়তি ধরেছে। গরুর মাংস রান্না করে রাখছি। তা না, উনি এখন চেপা ভর্তা দিয়ে খাবে….. । পারব না এখন অামি চেপা ভর্তা করতে । মাকে বললাম, মা অাস্তে বলো। দাদী শুনতে পাবেতো। মা অারও চেঁচিয়ে বললো
-শুনুক। অামি কি কাউকে ভয় পাই? অামি খেতে পড়তে দেই বলেইতো এখনও বেঁচে অাছে। উনার বড় ছেলে অার ছোট ছেলের বউ তো ফিরেও দেখে না একবার। যত জ্বালা হইছে অামার। তোর চাচী অার জ্যাঠীই ভাল করেছে। এই বেশুক্রিয়া মহিলার দায়ভাড় না নিয়ে। তিনবেলা গরম ভাত খেয়ে তেল হয়ে গেছে শরীরে। যখন তখন যা খুশি তা অাবদার করে বসে।
অামি অার মায়ের কাছে দাঁড়ালাম না। মেজাজ চড়ে গেলো। এটা ঠিক যে, জ্যাঠী অার ছোট চাচী দাদীকে খেতে পড়তে দেন না। ছোট চাচা বা জ্যাঠা মাঝে মাঝে লুকিয়ে দাদীজানকে কিছু ফল ফলাদি বা ভাল তরকারি দিয়ে যেতেন। উনাদের স্ত্রীরা অাবার দেখে গেলে ঝামেলা বেঁধে যাবে। ছোট চাচা অার জ্যাঠা চাকুরী করে, তাই বাড়ি থাকেনা। অামার বাবা বাড়ি থাকে বলে তিনিই বুড়ো মাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বিনিময়ে দাদার অবিভক্ত সাত কাঠা জমি বাবার চাষেই ছিল। এ নিয়েও অবশ্য কম মনোমালিন্য হয়নি বাবা চাচাদের মধ্যে। কিন্তু জমি যদি সবাই সমান ভাগ করে নিতে চায়, তাহলে দাদীজানকেও সবার সমান খাওয়াতে হবে বলে কেউ অার জমি ভাগ নিয়ে জোরাজুরি করতে পারেনি। দাদীজান মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে বলতেন
-তোরা জমিও সমান ভাগ করে নে, অার অামাকেও তিন টুকরো করে নে।
যাই হোক, সেদিন দাদীজানকে অামি অামার অানাড়ি হাতে চেপা ভর্তা করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। সে ভর্তা অামি মুখেও দিতে পারিনি; কিন্তু দাদীজান অামার এমন করে গরম ভাতের সাথে ভর্তা চটকিয়ে খাচ্ছিলেন, যেন অমৃত খাচ্ছেন। অামাকে দাদীজান সেদিন বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন অার প্রাণ ভরে দোয়া করেছিলেন অামার জন্য।
কিছুদিন অাগে জ্যাঠা যখন বাড়ি অাসার সময় অাঙ্গুর নিয়ে এসেছিলেন, সেই অাঙ্গুর লুকিয়ে দাদীজানকে দেয়ার সময় জ্যাঠার ছোট ছেলে নিরাজ দেখে ফেলেছিল। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে এ কথা বলে দিলো। অার তখনি জ্যাঠীর চিৎকার চেঁচামেচি শুনা যায়। অামার সংসারে কাজ করি অামি অার অামার চোখের অাড়ালে জিনিস চলে যায় অন্যঘরে। কেন? অামি কি বুড়ির জমির ধান চাল খাই? তার যে ছেলে জমিজমা খায়, সে ছেলে অাঙ্গুর কিনে খাওয়াতে পারেনা?
অামি প্রচুর রাগী একটা ছেলে। জ্যাঠীর কথাগুলো সহ্য হয়নি অামার। অামি অাঙ্গুরগুলো জ্যাঠীর সামনে গিয়ে রেখে এসেছিলাম। এর জন্য অামাকে অাবার বেয়াদব উপাধি পেতে হয়েছে। তাও অাবার অামার নিজের জ্যাঠার কাছ থেকে। সেদিনই অামি অামার মাটির ব্যাংক ভেঙে দাদীজানের জন্য অাঙ্গুর কিনে এনেছিলাম।
প্রতি ঈদে জ্যাঠা অার ছোট চাচা দাদীজানকে একটা করে শাড়ী কাপড় দিতেন। সেই বার ইদে ছোট চাচী অামার সাথে শপিংএ গিয়েছিল। উনি বয়স্ক মানুষের একটা দামী শাড়ী কাপড় কিনেন। অামি মনে করেছিলাম, সেটা বুঝি দাদীজানের জন্য কিনেছে। ছোট চাচীকে তখন অামার কি যে ভালো লেগেছিল! কিন্তু পরে শুনলাম, ওটা নাকি উনি উনার নিজের মায়ের জন্য কিনেছেন। অার বেশী দাম দিয়ে একটা শাড়ী কেনার জন্য সেই ঈদে দাদীজানের জন্য অার শাড়ী কাপড় কিনতে পারেন নি ছোট চাচী। উনার ভাষ্যমতে, বাবা অার জ্যাঠা তো একটা করে শাড়ী কাপড় কিনবেনই দাদীর জন্য। বুড়ো মানুষ, এতো শাড়ী দিয়ে কি করবে? তাই অার উনি কিনেন নিই। সামনের বছর উনি দাদীজানকে ভাল দেখে একটা দামী শাড়ী কাপড় কিনে দিবেন বলেও প্রতিজ্ঞা করেন।
জ্যাঠার অাবার অায় রুজি ভাল। প্রতি বছর ঈদে তিনি যাকাতের কাপড় বিলি করেন। এলাকায় উনার অনেক নাম ডাক দান দক্ষিণার জন্য। শুনা যায়, জ্যাঠা নাকি অবসরে এসে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করবেন। তাই এখন থেকেই লোকদের দেয়া, খাওয়ানো শুরু করেছে। ঈদের অাগের দিন রাতে জ্যাঠা অনেক কাপড় অার লুঙ্গি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। এত এত শপিং করার জন্য উনি দাদীজানের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। সকালে উঠে উনি চুকচুক করে অাফসোস করতে থাকলেন। জ্যাঠী জ্যাঠাকে ধমক দিয়ে বলেন
-এত অাফসোসের কি অাছে? যাকাতের কাপড়গুলো থেকে একটা দিয়ে দিলেইতো হয়।
মুহুর্তেই জ্যাঠার মুখে হাসি ফুঁটে উঠে। অার তিনি জ্যাঠীর প্রশংসা করতে করতে বলেন,
“তুমি অামায় বাঁচালে গো”
বাবাকে গিয়ে অামি বললাম, বাবা দাদীজানের জন্য কেউ ঈদে একটা কাপড়ও অানে নিই। তুমি দাদীজানের জন্য যে কাপড়টা এনেছ ওটা দিয়েই এবার দাদীজানের ঈদ পালন হবে।বাবা অামার কথা শুনে থমকে গেলেন। কেমন যেন কাচুমাচু হয়ে গেলেন। বুঝলাম, কিছু একটা সমস্যা অাছে। অামি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা অামতা অামতা করে বললেন
-বাবা মিতুল, অামিতো ভেবেছি বড় ভাই অার সিরাজ(ছোট চাচার নাম) মায়ের জন্য কাপড় অানবেনই, তাই অার অামি কিনি নিই।
-কিন্তু অামি যে দেখলাম, তুমি দুটো শাড়ী কাপড় এনেছ?
-হ্যাঁ এনেছি। কিন্তু দুটোই তো তোর মায়ের জন্য। দুটোই বেশ দামী শাড়ী। তোর মা কি তোর দাদীকে একটা দিবে? অার তোর দাদী বুড়ো মানুষ, সে এত দামী শাড়ী দিয়ে কী করবে? অার তার তো ট্রাংকে বেশ কয়টা শাড়ী কাপড় অাছে। বুড়ো মানুষের অার নতুন শাড়ীরই বা প্রয়োজন কি অত?
সেই ঈদে অামিও অার নতুন জামা পড়ি নি। বাবা অামাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে কৌশলে এড়িয়ে গেছি।
অাজ দাদীজান মারা গেছেন। সবাই কতক্ষণ খুব লোক দেখানো কাঁদা কাঁদলো। তারপর দাদীর দাফনের কাজ শেষ করে তাকে মাটির বিছানায় শুইয়ে অাসলো। কবর দেয়ার পর পরই দাদীজানের সোনার গহনাগুলোর খোঁজে অামার মা চাচীরা ঘর তন্ন তন্ন করে ফেলছে। অামার বাবা-চাচারা তিন ভাই মিলে জমির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কথা বলছেন উঠোনে চেয়ার পেতে। অামি অাড়াল থেকে এদের মুখে এক দলা থুতু ছিটালাম। ঘৃনার থুতু।