ছোট চাচু যেদিন পাখি হলেন

ছোট চাচু যেদিন পাখি হলেন

ছোট চাচু পাখি হয়ে গেছে। সাগর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে তার বাবার কাছে গেল, ‘বাবা, ছোট চাচু পাখি হয়ে গেছে।

সাগরের বাবা খানিকক্ষণ চোখ-মুখ কুঁচকে বসে রইলেন। তারপর তাঁর স্বভাবসুলভ হুংকার ছাড়লেন, ‘আহাম্মকটাকে পিটিয়ে ছাল-চামড়া সব তুলে দেওয়া দরকার। নতুন ভড়ং ধরেছে। একবার আমার সামনে পড়লে পিটিয়ে বাড়িছাড়া করব। পাস করে বসে আছে তিন বছর হলো। এখনো কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। এখন বাসায় বসে বসে যাত্রাপালা করছে।

সাগর ছোট চাচুর ঘরের দিকে দৌড়াতে লাগল। বাবার গর্জন শোনার কোনো মানে হয় না, ছোট চাচুর কাজ-কারবার দেখা দরকার।

ছোট চাচু পদ্মাসন করে বিছানায় বসে আছেন। সাগরকে দেখে বললেন, ‘বুঝলি রে ছোটু, পাখি হয়ে যাওয়া অনেক মজার। পৃথিবীর কোনো কিছু নিয়েই চিন্তা করতে হয় না।’সাগর কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা যে তোমাকে প্রতিদিন চাকরির কথা বলে, এখন তুমি কি আর চাকরির খোঁজে যাবে না?’

ছোট চাচু নীরবে হাসেন। পাখিদের শব্দ করে হাসতে হয় না। তারপর কিচিরমিচির করে বলেন, ‘পাখিদের আবার কিসের চাকরি! পাখির জীবন তোস্বাধীন, সারা দিন আকাশে উড়ে বেড়ানো।

সাগর বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে, ‘ছোট চাচু, আমিও কি পাখি হতে পারব?’

ছোট চাচু সাগরের মাথায় পাখির ডানার আলতো ছোঁয়ার মতো হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আগে কিছুদিন মানুষ থেকে পৃথিবীর নিয়মকানুনগুলো শিখে নে। এখন হঠাৎ করে পাখি হয়ে গেলে তো বিপদে পড়ে যাবি। তুই মনুষ্য সমাজেও টিকতে পারবি না, পাখি সমাজেও ঢুকতে পারবি না। যখন পড়াশোনা শেষ করে বড় হয়ে যাবি, তখন একদিন সবকিছুর ওপর বিরক্ত হয়ে তুই নিজেই পাখি হয়ে যাবি।’

সাগরের একটু মন খারাপ হয়। এখন পাখি হয়ে যেতে পারলে পড়াশোনা না করে থাকা যেত!

ছোট চাচু পদ্মাসন থেকে উঠলেন। সাগর ছোট চাচুর হাত ধরে বলে, ‘তুমি কি এখন উড়তে বের হচ্ছ? আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’

ছোট চাচু সাগরের হাতটা ছাড়িয়ে নেন, ‘না রে ব্যাটা। পাখিদের একা একাই উড়ে বেড়াতে হয়। পাখি সমাজে কাউকে সঙ্গে নিয়ে উড়ে বেড়ানোর নিয়ম নেই।’

ছোট চাচু রাস্তায় এসে একটা রিকশায় চেপে বসলেন। রিকশাওয়ালা অনেকক্ষণ রিকশা চালিয়ে ছোট চাচুকে বলল, ‘আপনেরে কই নামায়া দিমু, ছার?’ ছোট চাচু নীরবে হাসেন। তারপর কিচিরমিচিরকরে বলেন, ‘আপনার যেখানে ইচ্ছা নামিয়ে দেন। পাখিদের নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই।’

রিকশাওয়ালা একটু হকচকিয়ে গেল। দিনের শুরুতেই পাগলের পাল্লায় পড়ল নাকি! রিকশা থামিয়ে ছোট চাচুকে বলল, ‘ভাই, ভাড়াটা দিয়া আপনে রিকশা থেইকা নামেন।’ ছোট চাচু আবার হাসেন, ‘ভাড়া কোথায় পাব! আমি তো পাখি হয়ে গেছি। পাখিদের ব্যক্তিগত কোনো তহবিল থাকে না। পাখিদের টাকা-পয়সার দরকার নেই।’

এবার রিকশাওয়ালা রেগে যায়, ‘মশকরা করার আর জায়গা পাইলেন না! পাখি হইয়া গেলে আপনে রিকশায় উঠলেন ক্যান! উইড়া উইড়া যাইতে পারলেন না!’ ছোট চাচু রিকশাওয়ালাকে পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে শুরু করে, ‘পাখিদের রিকশায় উঠতে কোনো মানা নেই। পাখিরা যেকোনো যানবাহনে চড়তে পারে।’

রিকশাওয়ালা রাগে গজ গজ করতে থাকে। অনেক দিন ধরেই ছেলেমেয়েগুলো ঈদের নতুন জামার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করছে। কিছুতেই সে টাকা-পয়সা কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আজকে তো দিনের প্রথমেই পাগলের পাল্লায় পড়ে যাত্রাটাই মাটি হলো। হঠাৎ রিকশাওয়ালার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। তারপর নিজে নিজেই হাসতে হাসতে ভাবে, পাখি হয়ে যাওয়া তো আসলেই অসাধারণ একটা ব্যাপার! পাগলটা তার অনেক বড় উপকার করে দিয়েছে।মধ্যরাতে রিকশা জমা দিয়ে রিকশাওয়ালা বস্তির ছোট্ট ঘরটাতে ফিরে দেখতে পেল ছেলেমেয়েগুলো নতুন জামার জন্য তখনো জেগেবসে রয়েছে। বাবার হাত খালি দেখে বড় ছেলেটা কান্না কান্না গলায় বলল, ‘আইজকাও ঈদের জামা আনো নাই, বাপজান?’

রিকশাওয়ালা নীরবে হাসে, তারপর কিচিরমিচির করে বলে, ‘আমি তো পাখি হইয়া গেছি রে ব্যাটা! তোরাও পাখি হইয়া যা। পাখিদের ভাত-কাপড়ের দরকার হয় না। সারা দিন শুধু আকাশে উইড়া বেড়ানো, আর কুনো কাম নাই! গরিবের পাখি হওন ছাড়া আর কুনো উপায় নাই রে বাপ।’ ছেলেমেয়েগুলো অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। দুঃখে-দুর্দশায় তাদের বাপটা পাগল হয়ে গেল কি না, তারা বুঝতে পারে না।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত