জেলের শান্তিময় জীবন ও এক দূরদর্শী পরামর্শদাতা

জেলের শান্তিময় জীবন ও এক দূরদর্শী পরামর্শদাতা

ছুটির দিনের এক সুন্দর সকাল। নীল আকাশে ঝকমক করছে সূর্য। সে সময় আফ্রিকান এক জেলেপল্লির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মস্ত বড় এক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরামর্শক (ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট)। তীরে সবেমাত্র এক জেলে-নৌকা ভিড়েছে। আগ্রহী হয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। অল্প কয়েকটা মাছ সূর্যের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। মাছের পরিমাণ দেখে পরামর্শক জেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই কয়েকটা মাছ ধরতে তোমার কত সময় লেগেছে?’
জেলে উত্তর দেয়, ‘খুব বেশি সময় লাগেনি।’
পরামর্শক অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি তাহলে আরও বেশি সময় লাগিয়ে বেশি বেশি করে মাছ ধরো না কেন?’
জেলে কারণ ব্যাখ্যা করে, ‘আসলে এই কয়েকটা মাছই আমার এবং আমার পরিবারের জন্য যথেষ্ট। এর চেয়েবেশি প্রয়োজন তো নাই আমার।’
‘মাছ ধরা ছাড়া বাকি সময়টা কীভাবে কাটাও তুমি?’ পরামর্শকের জিজ্ঞাসা।
‘রাত একটু গভীর হলেই ঘুমাতে যাই। সকাল সকাল উঠে অল্প কয়েকটা মাছ ধরি। তারপর এসে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলি, আর বিকেলে নারকেলগাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ শুয়ে বসে থাকি, ঘুমাই। সন্ধ্যা নামলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে বাজারে যাই, একটু পান-টান করি, ড্রাম বাজাই, গান গাই, রাত একটু গভীর হলে হল্লা করতে করতে বাড়ি ফিরি। এসব মিলিয়েই সুখী আর পরিপূর্ণ একটা জীবন কাটাই আমি।’
পরামর্শক বেশ অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘দেখো, হার্ভার্ড নামক একটা বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ডিগ্রিধারী আমি। চাকরি করি একটা বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে। আমার মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে বেশ সাহায্য করতে পারব। সবকিছুর মূলে আসলে পরিশ্রম। তোমার আরও বেশি সময় নিয়ে মাছ ধরা উচিত, পারলে সারা দিন। এর ফলে যা হবে, তুমি তোমার পরিবারের প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ বিক্রি করে দিতে পারবে। মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে তুমি এখনকার চেয়ে বড় দেখে একটা নৌকা কিনবে। প্রথমে একটা নৌকা, তারপর দুইটা, তারপর তিনটা। এভাবে তুমি একদিন অনেকগুলো নৌকার মালিক হবে।
মহাজন-দালালদের বাদ দিয়ে তুমি তখন নিজেই সরাসরি মাছ প্রক্রিয়াজাত কারখানার সঙ্গে দরদাম করে মাছ বিক্রি করবে। এরপর চাইলে নিজেই একটি কারখানা দিতে পারবে। তখন তুমি অনেক টাকার মালিক। সুযোগ বুঝে তুমি একদিন ছোট্ট এই গ্রামটি ছেড়ে চলে যেতে পারবে শহরে, ভাগ্য ভালো থাকলে ইংল্যান্ডে। সেখান থেকেই তখন তুমি পরিচালনা করতে পারবে তোমার ব্যবসা।’
‘কত দিনের মামলা এটা?’ জেলের কণ্ঠে কৌতূহল।
‘এই ধরো, ১০ বছর। ২০ বছরও লাগতে পারে।’
‘এরপর কী হবে?’ জেলের কৌতূহল বাড়ছেই।
‘তারপর? আরে, এরপরই তো আসল ঘটনা ঘটবে। মজা পাবে তুমি নিশ্চিত।’ হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত পরামর্শকের, ‘ব্যবসা যখন তোমার সত্যিই বড় হবে, তুমি তখন তোমার প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়তে শুরু করবে বাজারে, দেখতে দেখতে কোটিপতি!’
‘আচ্ছা, আচ্ছা! কোটিপতি! সত্যি! এরপর কী হবে?’ উৎসাহে টগবগ করতে করতে জানতে চায় জেলে।
‘এরপর তুমি তোমার এই বিশাল ব্যবসা থেকে অবসর নেবে একদিন, ইচ্ছে হলে চলে যাবে নীল সাগরের ধারে জীবনের বাকি দিনগুলো আনন্দে কাটানোর জন্য। সেখানে বানাবে এক বাগানবাড়ি। চাইলেই অনেক রাত করে ঘুমাতে যেতে পারবে, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনির সঙ্গে খেলাধুলা আর গল্পগুজব করে সময় কাটাবে, তাদের নিয়ে মাছ ধরতে যাবে সাগরে, পড়ন্ত বিকেলে ঘুমিয়ে পড়বে নারকেলগাছের ছায়ায়, সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে কম্যুনিটি ক্লাবে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবে, পান করবে, গান-বাজনা করে হল্লা করে বাড়ি ফিরবে গভীর রাতে…।’
‘দূর, আমি তো এখন সেটাই করছি।’ স্পষ্টতই হতাশ কণ্ঠে উত্তর দিয়ে নিজের পথ ধরল জেলে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত