বান্ধবীর স্বামীর সঙ্গে আজ আমার বিয়ে, পরিষ্কার আয়নাতে চেহারাবন্দি হয়ে আছে আমার,অপলক দৃষ্টিতে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছি। জীবনের সব থেকে কঠিন পরিস্থিতিতে চোখ দুটো নিজের মাঝে হন্যে হয়ে দুটি প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আমি কি কারো হক কেড়ে নিচ্ছি?
নাকি কারো হক কে আজীবনের জন্য নিজের কাছে গচ্ছিত রাখছি?
এই দুটো প্রশ্ন আমাকে পুরো সময় জুড়ে অস্বস্তির কারাগারে তিল তিল করে পিষিয়ে মারছে ।
আর যে বেশী সময় নেই, কিছুক্ষণ পরেই নিজের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চলেছি। এই মুহূর্তে এমন অস্বস্তি আমার মস্তিষ্ককে দূর্বল করে দিচ্ছে।
হঠাৎ জানালা থেকে আগত মৃদু হাওয়া কিছুক্ষণের জন্য আমার হৃদয়ে স্বস্তির ফোঁটা জল ছিটিয়ে দিতে থাকলো। আমি আমার চোখ দুখানাকে ধীরে ধীরে বন্ধ করলাম।
মনে হচ্ছে আমি যেন কল্পনার রাজ্যে নিঃশব্দে প্রবেশ করছি,,,,
হ্যাঁ ঐতো আমি রুত্তির শরীরের ঘ্রান পাচ্ছি, রুত্তির পায়ে পরিধানকৃত পায়েলের ঝুনঝুন শব্দ স্পষ্ট শুনতে পারছি আমি। ফিসফিসিয়ে নিজের অজান্তেই বলে উঠলাম,,,
—– ” রুত্তি তুই এসেছিস বান্ধবী? ”
আমার প্রশ্নের কোন উত্তর আমি পেলাম না, আমি জানি এ প্রশ্নের উত্তর কখনোই আমি আর পাবো না।
রুত্তি!
আমার জীবনের প্রিয় ব্যক্তিত্ব, আমার সবথেকে আপনজন। সে আমার প্রানের সখী, আত্নার বান্ধবী। ছোট বেলা থেকেই রুত্তির সাথে আমি বেড়ে উঠেছি , জীবনের এক মুহূর্ত আমি রুত্তিকে ছাড়া ভাবতে পারতাম না। সে আমাকে শাষন করতো, স্নেহ করতো এবং তার থেকে অধিক পরিমান ভালোবাসতো। জীবনের এতগুলো বছরে একদিনের জন্য হলে ওর থেকে আমি আলাদা থাকিনি। আমার জীবনের সমস্ত হাসি কান্নার সাক্ষী ছিলো রুত্তি। সে প্রায়শই আমাকে বলতো তুই আমার সতীন হবি, বিয়ে হলে তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না প্রিয়ন্তী। তোকে আমার সতীন বানিয়ে রাখবো, আমি হবো তোর বড় সতীন আর তুই হবি আমার ছোট সতীন।তুই সারাদিন কাজ করবি আর আমি দিব্যি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিন পার করবো। রুত্তির কথা শুনে আমি ভীষণ ক্ষেপে যেতাম, নানা রকম কথা বার্তা তাকে আমি শুনিয়ে দিতাম।
সে যখনই সুযোগ পেতো আমাকে রাগিয়ে দিতো শুধু মাত্র একটি প্রশ্ন করে,,,
—” বলনা বান্ধবী তুই আমার কে? ”
আমিও চিৎকার করে উত্তর দিতাম আমি মরে গেলেও তোর সতীন হবো না।
আমাদের নিয়ে মা খালাদের মাঝে যে কি হাসি তামাশা হতো যা দেখে মাঝেমধ্যে নিজেরাই লজ্জা পেয়ে যেতাম।
বছর চারেক আগে ইমরান নামের এক ছেলের প্রেমের প্রস্তাবে বান্ধবী যখন আমার সামনেই রাজী হয়ে যায়। আমি রাস্তায় সজোরে ইমরানকে ধাক্কা দিয়ে আমার বাসার দরজায় খিল দিয়ে তিনদিন মরা কান্না কেঁদেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো, ইমরান নামের ছেলেটি আমার বান্ধবীকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। আর আমার বান্ধবী আমাকে আগের মতো সময় দিবে না। আর এই কষ্ট আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না।
রুত্তি ঐ তিনদিনে আমার বাসায় অনেকবার এসেছে, অনেক কান্নাকাটি করেছে, কিন্তু আমি তার সাথে অভিমানের আড়ি কেটে ছিলাম। সে আমাকে বলেছিল,,
—-” তুই আমার সব রে প্রিয়ন্তী, আমি আর কখনোই ইমরানের সাথে কথা বলবো না ”
রুত্তির ঐ কথা শোনার পর নিজেকে শান্ত করে নিয়েছিলাম আমি।
তারপর আর কি? সে তো আমাকে একা ভালোবাসে না , আমিও তাকে ভালোবাসি। মনের মাঝে পাথর বসিয়ে ইমরান আর রুত্তির সম্পর্ক আমি মেনে নিলাম। কিন্তু যেই ছয় মাস তারা প্রেম করেছিলো, এক মিনিটের জন্যেও আমি তাদের একা ছাড়িনি। তারা কথা বলতো আর আমি তাদের মাঝখানে বসে থাকতাম। ইমরান মাঝেমধ্যে আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো, আর আমি মুখভেংচি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমি কখনোই ইমরানের সাথে কথা বলতাম না, সে কথার বলার চেষ্টা করলেও আমি না শোনার ভান করতাম।
পারিবারিক ভাবে যেদিন ওদের বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিলো, ঐদিন ভীষণ মন খারাপ ছিলো। লুকিয়ে লুকিয়ে ভীষণ কেঁদে ছিলাম।
বিয়ের আগের দিন রাতে ইমরান আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।
আমার হাতে একখানা কাগজের টুকরো ধরিয়ে দিয়ে সে আবার চলে যাচ্ছিলো।
আমি তাড়াতাড়ি কাগজখানা খুলে দেখলাম, সেখানে ঠিক এভাবেই লেখা ছিল,,
—-” আমি তোমার বান্ধবীকে অনেক ভালোবাসি , আমি সারাজীবন তাকে যত্নে রাখবো ”
ঐ দিন প্রথম আমি ইমরানের সাথে কথা বলেছিলাম।তাকে আমি ডেকে কাঁদো কাঁদো মুখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
—- ” আপনার কি কোন বড় ভাই বা ছোট ভাই আছে?”
ইমরান আমার কথা শুনে হেসে উত্তর দিয়েছিলো,,
—-“জ্বী না নেই। থাকলে আপনাকে তার জন্য নিয়ে যেতাম ”
আমি ইমরানের উত্তর শুনে রাগে সেখান থেকে বিদ্যুৎ গতিতে চলে গিয়েছিলাম।
বিয়ের পর রুত্তি কুমিল্লায় চলে গিয়েছিল, যাওয়ার দিন আমাকে জড়িয়ে সে যে কত কান্না করেছিলো। এটা করবি না, সেটা করবি না কত কি উপদেশ দিতে থাকলো।
আর আমি তাকে থামিয়ে শুধু একটি কথাই বলেছিলাম,,
—-” বান্ধবী আমাকে ভুলিস না ”
রুত্তিকে ছাড়া আমার দিনগুলো যে কীভাবে কেটেছিল তা শুধু আমি নিজেই জানি।
আমি যেদিন জানতে পারলাম রুত্তি মা হতে চলেছে, ঐদিন যে আমি কি খুশী হয়েছিলাম। ঐ দিন রুত্তিকে ফোন দিয়ে দুই বান্ধবীর সে কি কান্না!
গর্ভকালীন সময় রুত্তি সামান্য বিষয়ে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করতো, তার নাকি একা খুব ভয় করতো। ইমরান তো চাকরীর জন্য অধিকাংশ সময়ে বাহিরে থাকতো। আমি আর বেশী কিছু ভাবলাম না সোজা রওনা দিলাম রুত্তির বাসায়, এই কয়েকমাস আমি তার বাসায় থাকবো।
আমাকে দেখে রুত্তি আর ইমরান ভীষণ খুশী হয়েছিলো। আর ইমরান বেচারাও একটু নিশ্চিত হতে পারলো।
ডেলিভারির দিন দূর থেকে যখন দেখলাম সেবিকা ছোট্ট একটি দেহ নিয়ে আসছে সেই মুহূর্তে আমার হৃৎস্পন্দন টা কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলো। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এটা আমার রুত্তির মেয়ে।
সেবিকা যখন পরিবার কে জিজ্ঞাসা করেছিলো ,,,
—-” বাচ্চাটা কার কোলে সর্বপ্রথম দেওয়া হবে? ”
ঠিক তখনই ইমরান সেবিকা কে ইশারা করে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলো।
রুত্তির সন্তানকে যখন আমি প্রথম কোলে নিয়েছিলাম, ঐদিনই বুঝেছিলাম মাতৃত্বের স্বাদ কাকে বলে। অশ্রুসিক্ত নয়নে ছোট দেহ টাকে পরম যন্তে আমার আত্নার সাথে বেঁধে নিয়েছিলাম সেদিনই।
রুত্তি আর ইমারানের মেয়েকে আমি ভালোবেসে নাম দিয়েছিলাম “পরী”।
প্রায় একমাস যাবত আমি ওদের সাথে ছিলাম। যেদিন আমি আমার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছিলাম, আমার মনে হচ্ছিলো যেন আমার আত্নাকে আমি এখানেই ছেড়ে যাচ্ছি। পরী বোধহয় আমারই সন্তান, আমি তাকে শেষবারের মত আমার বুকে জড়িয়ে পরম স্নেহে চুমু খেয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।
২০১৩ সালের, ১৮ই সেপ্টেম্বর।
আমার জীবনের কালোদিন, যেই দিনটা আমার জীবন থেকে ‘সুখ’ নামক বিশেষ অনুভূতির ইতি ঘটিয়েছে। রুত্তি কিছুদিনের জন্য তার বাবার বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিল। পরীর বয়স তখন দুইমাস, আমি সারাদিন ওদের সাথেই ছিলাম। দুপুর বেলায় আমি আমার বাসায় এসে রান্নাবান্নার কাজে মাকে সাহায্য করছিলাম। সন্ধ্যায় আবার রুত্তি আর পরীর কাছে যাবো, সেই কথা ভেবেই আমি খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ!
প্রচণ্ড চিৎকারে আমি ধড়ফড়িয়ে বিছানায় বসে পড়লাম, হৃৎপিন্ডটা বুঝি বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
মা আমার কাছে এসে চিৎকার করে কেঁদে বলে উঠলো,,,,
—-” প্রিয়ন্তী বের হ, রুত্তিদের বাসায় আগুন লেগেছে ”
হায় সৃষ্টিকর্তা!
এ আমি কি শুনলাম? আমার মনে হচ্ছিলো পৃথিবীতে মাটি নামক কোন বস্তু নেই, আমি বোধহয় শূন্যে ভাসছি ।
চোখ দুখানাতে রুত্তি আর পরীর ছবি ভেসে উঠলো। আমি দিকশূন্য হয়ে পাগলের মত রুত্তিদের বাড়ীর দিকে ছুটতে থাকলাম।
বাড়ীর আশেপাশে হাজারো লোকের ভীড়, এদেরকে পাশ কাটিয়ে সামনে যাওয়ার শক্তি পর্যন্ত নেই আমার।
চারিদিকের চিৎকার আহাজারি, সে যেন এক অভিশপ্ত পরিবেশ!
আগুনের কালো ধোয়া এখুনি বুঝি দেহ থেকে প্রান কে আলাদা করে নিয়ে যাবে।
দূর থেকে দেখতে পারলাম, রুত্তির ভাই রুদ্রের কোলে পরী। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার মনে সৃষ্টিকর্তা প্রশান্তির বৃষ্টি বর্ষিত করলো,আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সেদিকে ছুটে গেলাম। রুদ্রের কোল থেকে পরীকে নিয়ে আমার বুকের সাথে লাগিয়ে পাগলে মত চুমু খেতে লাগলাম।
আমি রুদ্রকে জিজ্ঞাসা করলাম, বাকীরা কই?
রুদ্র কেঁদে উত্তর দিলো,,,,
— সবাই ভেতরে আটকে গিয়েছেরে আপু! আমি তো পরীকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম । কেউ একজন আমাকে ফোন দিয়ে বললো আমাদের বাড়ীতে আগুন লেগেছে। মা, বড় আপু, ছোট আপু এরা ভেতরেই আটকে গিয়েছে। ”
রুদ্রের কথা শুনে, ইচ্ছা করছিলো নিজের জীবনটাকে এখানেই শেষ করে দেই।
বেশ অনেকক্ষণ পর বাড়ীতে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা গেলো।
একের পর এক পোড়া ক্ষত বিক্ষত লাশ গুলো বের করা শুরু হলো।
হায় সৃষ্টিকর্তা!
আমাকে তুমি ধৈর্য দাও কি দেখছি আমি এগুলো!
দূর থেকে দেখলাম কারা যেন আমার রুত্তির পোড়া শরীরটাকে টেনে হেচরে বের করছে। আমি চিৎকার করে সেখানে ছুটে গেলাম।
রুত্তিকে দেখে আমি হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম, আমার কান্নার শব্দে সেদিন দুনিয়া ভারী হয়ে গিয়েছিল। আমি রুত্তিকে জড়িয়ে ধরতে পারছিনা, সারা শরীরটা পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছে। চামড়া ঝলসে পড়ে যাচ্ছে, যেখানেই ধরবো সেখানে সে ব্যথা পাবে। এ কেমন পরীক্ষার সম্মুখীন করলে বিধাতা আমাকে?
রুত্তি করুন বেদনাময়ী নয়নে খুব কষ্টে আমাকে একটি কথা বলে গিয়েছিল,,,
—-” প্রিয়ন্তী আমার মেয়েটাকে দেখে রাখিস ”
কে যেন দরজার কড়া নেড়ে উঠলো !
(খানিকটা চমকে উঠলাম, আমার ছোট বোন এসেছে)
—–” আপু নিচে চলো! সবাই অপেক্ষা করছে। ”
—–” হ্যাঁ যাচ্ছি, পরীকে নিয়ে আয় তো। ”
পরীকে আমার বুকে জড়িয়ে আমি আমার জীবন শুরু করতে চলেছি, পরীর মাঝে আমি রুত্তির ঘ্রান পাই।
ইমরানকে বিয়ের প্রস্তাব আমিই দিয়েছিলাম, সে সারা দিনই পরীকে কোলে জড়িয়ে কাঁদতো।
আমিই তাকে বলেছিলাম,
—” ইমরান আমাকে বিয়ে করবেন? আপনি কোনদিনও রুত্তিকে ভুলতে পারবেন না, না পারবেন অন্য কোন মেয়ে ভালোবেসে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে। আর আমার পরী মা হারা কোন সন্তান হোক আমি তা চাই না। লাভের ভিত্তিতে আমাদের মাঝে অন্ততপক্ষে এমন চুক্তি হতেই পারে, কারন আমরা যে স্বার্থপর! ”
লোকজন অনেক হাসাহাসি করেছিলো আমাদের নিয়ে, বান্ধবী মারা যাওয়ার দুইমাস পরেই আমি তার স্বামীকে বিয়ে করছি।
কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না পরীকে দেখার মত কেউ নেই, আর সে আমারই সন্তান মনে প্রানে আমি এটাই মানি।