একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে । তাই আজ বেরাতে একটু দেরি হয়ে গেল সমরেস এর । বাস টা ধরা যাবে না হয়তো । ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটা দিল । টোটো ধরলে খুব সহজে পৌঁছে যেত এই ২ কিমি পথ । কিন্তু ১০ টাকা টা বাঁচাতে পারলে খুব ভালো হয় । কারন মাসের শেষ প্রায় । টিউশন এর টাকা যা পেয়েছিল তা পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করতে করতে সব শেষ প্রায় ।
পাড়ার চা দোকানের মোড় টার কাছে যেতেই কানে এল ‘ অপদার্থ ‘ কথাটা । চায়ের দোকানে পাড়ার গুনি জ্ঞানি ব্যাক্তি গন রোজ বসে চা খেতে খেতে সমালোচনার পালা চালিয়ে যান । কথাটা যে তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে তা অবশ্য বুঝতে বাকি নেই সমরেস এর । দীর্ঘ দিন ধরে পড়াশুনা শেষ করে একটা চাকরির জন্য অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে । কিন্তু চাকরিটা হচ্ছে না । বহু দিন থেকে বেকার । টিউশন করে নিজের হাত খরচ টা কোন রকমে চালিয়ে নেয় ।
‘অপদার্থ “ কথাটা পাড়ার লোক শুধু নয় , নিজের পরিবারের লোকদের কাছ থেকেও শুনে শুনে এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে । প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো । মনে হতো কবে চাকরিটা পাবো আর এই “ অপদার্থ “ বিশ্রী শব্দটা শোনা থেকে মুক্তি পাবে ।
যাই হোক এখন বাসটা ধরতে পারলেই হল । বেলদা কলেজে আজ তার ইন্টারভিউ আছে সহ গ্রন্থাগারিক পদ এর জন্য । ভাগ্য ভালো বাস টা পাওয়া গেল । কলেজে পোঁছে গিয়ে দেখল অনেকে উপস্থিত আছে । শেষে আসার কারনে সব শেষে ডাক পড়ল ইন্টারভিউ এর জন্য । ইন্টারভিউ খুব ভালো হল । বাইরে এসে সমরেস দেখল প্রায় সকলে চলে গিয়েছে । সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয় নি তার । ব্যাগ এ কাগজে মোড়া শুকনো মুড়ি টা আসার সময় বোন ব্যাগে ভরে দিয়ে বলেছিল “ দাদা দোকান থেকে চপ বা চানাচুর –কিছু কিনে খেয়ে নিস “। মা মরার পর বোনটাই একটু খবর রাখে তার । পকেটে কিছু কেনার পয়সা নেই , তাই শুকনো মুড়ি গুলোই চিবাতে থাকলো ।
পিছন থেকে একটা বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে তার খাওয়া লক্ষ্য করছিল । কোথায় যেন লোকটাকে দেখেছে । হ্যাঁ ইনি তো ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় দূরে সেই রুমের মধ্যে বসেছিলেন । ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন সমরেস এর দিকে । পাশে এসে নিজের পরিচয় দিলেন , তিনি এই কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক । তার ছেলেও আজ ইন্টারভিউ দিয়েছে । কিন্তু দ্বিতীয় হয়েছে । প্রথম হয়েছে সমরেস ।
কথাটা শুনে মন আনন্দে ভরে গেল । এই ভদ্রলোক এর কথা যদি ঠিক হয় তাহলে তার চাকরিটা হয়ে যাবে । আর তাকে কারো কাছে “অপদার্থ “ শব্দ টা শুনতে হবে না ।
কিন্তু পরক্ষনেই ভদ্রলোকের কথা শুনে খুব রাগ হল । তিনি বললেন যে , “ তুমি পড়াশুনায় খুব ভালো , তাই অন্য অনেক ভালো চাকরি পেয়ে যাবে । আমার ছেলেটা পড়াশুনাতে খুব খারাপ । ইচ্ছে ছিল এই কলেজে যাতে সে চাকরি টা পেয়ে যায় । তুমি যদি চাকরি টা না করো , তাহলে আমার ছেলে চাকরিটা পেয়ে যেত । এর জন্য তুমি যত টাকা চাও দেব ।“
সমরেস খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ে কিছু না বলে বাড়ীর পথে হাঁটা দিল । তাড়াতাড়ি বাড়ী পৌঁছে সে বোন , বাবা, দাদা , বউদি সবাইকে জানাবে যে সে “ অপদার্থ “ নয় ।
বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে বাইরে থেকে শুনতে পেলে বাবা – দাদা এর মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছে । সমরেস এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাস করলো , কি হয়েছে ?
বাবা রেগে গিয়ে বললেন , তোকে জানতে হবে না কিছু , তোর দ্বারা তো আর কিছু হবে না “ অপদার্থ “।
সমরেস ব্যাগ টা রেখে বোন এর রুমে গিয়ে দেখল বোন অঝরে কেঁদে চলেছে । কারন জানতে চাইলে , বউদি এসে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল , তুমি কারন জেনে কি করবে ? তোমার তো কিছুই করার সামর্থ্য নেই । তোমার বোন হারান বাবুর ছেলে রবির সাথে প্রেম করে । বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে যেতে ৩ লক্ষ টাকা দাবি করেছে হারান বাবু । এখন এত টাকা আসবে কোথা থেকে । তা না হলে তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে তার ছেলেকে অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন ।
কথা গুলো শুনে বোন এর কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে সমরেস বলে ,কাঁদিস নে । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
সমরেস কয়েকবার দেখছে রবির সাথে দাঁড়িয়ে বাড়ীর পিছন দিকে বোন রুমা কে কথা বলতে । অনেক দিন থেকেই ওরা একে অপরকে ভালোবাসে ।
বোন রুমা সমরেস কে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো । রবির সাথে না বিয়ে হলে সে মরে যাবে বলল ।
সমরেস কি একটা দ্রুত চিন্তা করে নিয়ে বোন এর কাছে ১০ টাকা চাইল । বোন ১০ টাকা বের করে দিল । সমরেস দ্রুত বাড়ী থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিল । আবার বাসে করে বেলদা কলেজে এসে পৌঁছে খোঁজ করতে লাগলো সেই ভদ্রলোকের । ঠিকানা নিয়ে তাঁর বাড়ীতে এসে দেখা করলো ।
গতকাল রাতেই বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে । বোন , বাবা ,দাদা ,বউদি সব খুশি । হটাত করে হারান বাবু বিনা যৌতূক এ রুমা কে তাঁর ছেলের বউ করে নিয়ে গেলেন —– সকলে খুব অবাক ।
যাই হোক , আজ বোন নাই , তাই ব্যাগে শুকনো মুড়ি টা কেউ ভরে দেয় নি । খালি ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করলো সমরেস । কাল টিউশন পড়াতে যেতে পারে নি । আজ তাড়াতাড়ি না গেলে অপমানকর দুটো কথা শুনতে হবে । চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেই কানে “ অপদার্থ “ শব্দ টা ভেসে এল । এখন আর শব্দ টা শুনে কষ্ট হচ্ছে না । কলেজে চাকরিটা পেয়ে গেলে সে “পদার্থ “ হয়ে যেতে পারতো , কিন্তু তা হলে হয়তো বোনের বিয়ে টা হতো না । কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপকের কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সেই টাকা চুপি চুপি হারান বাবুর হাতে তুলে দিয়ে অনুরধ করেছিল … এই টাকার কথা কাউকে বলবেন না । আপনার ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে টা যেন হয় ।
শুনে হারান বাবু খুব আনন্দিত হয়ে গিয়েছিলেন । তিনি তাঁর কথা রেখেছেন । কেউ জানতে পারলো না এই অপদার্থের কথা । সময় , পরিস্থিতি অনেক সময় মানুষের জীবনের সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । হওয়া কাজ অনেক সময় ভণ্ডুল হয়ে যায় । কেউ কেউ একে ভাগ্যের দোষ বলে থাকে । তাই বলে কি সে “ অপদার্থ “ ?