জলপরী

জলপরী

একদিন সকালে একজন জলপরী এসে কড়া নাড়লো দরজায়, তাঁর হাতে একটি ঝুড়ি, বললো- “এই নাও উপহার, যে কোনো একটি পছন্দ করে নিয়ে বাকীগুলো রেখে দাও, বুঝে শুনে বেছে নাও- কোনটি তুমি চাও কারণ এর মধ্যে কেবল একটিই মূল্যবান!”
ঝুড়িতে ছিল ‘সম্মান’, ‘ভালোবাসা’, ‘সম্পদ’, ‘আনন্দ’ আর ‘মৃত্যু’ এই পাঁচটি উপহার। যুবকটি আগ্রহের সাথে বললো- “এখানে বিচার বিবেচনার কিছু নেই” বলে সে আনন্দটি বেছে নিল।
সে বাইরের পৃথিবীতে গেল, যৌবনের আনন্দে মেতে উঠলো। কিন্তু সব আনন্দই তার কাছে ক্ষনস্থায়ী, অপ্রত্যাশিত, এবং সবশেষে অর্থহীন মনে হলো!
যুবকটি মনে মনে ভাবলো, এই বছরগুলো অযথাই নষ্ট হলো, যদি আবার সুযোগ পাওয়া যেত আমি তাহলে খুব বুদ্ধি বিবেচনা করে বেছে নিতাম!

একদিন ওই জলপরীটি আবার এলো এবং বললো- “আরো চারটি উপহার বাকী আছে, খুব সাবধানে বেছে নাও আর মনে রেখো কেবল একটিই এখানে খুব মূল্যবান!” মানুষটা এবার খুব দীর্ঘক্ষন ধরে ভাবলো এবং বেছে নিলো- ‘ভালোবাসা’ এবং জলপরীর চোখে জ্বলজ্বল করে ওঠা অশ্রুকনাটুকু তার চোখেই পড়লো না।
অনেক বছর পর, শূন্যঘরে একটি কফিনের পাশে বসে আছে লোকটি, আর নিজেকে বলছে- “একজন একজন করে ওরা সবাই চলে গেছে, এখন সে শুয়ে আছে এখানে, সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বশেষ জন। হাহাকার আর হাহাকার করেই জীবন গেল আমার; ভালোবাসার বিশ্বাসঘাতকতা আমাকে কাঙাল করেছে, আমি অভিশাপ দেই তোকে!”

“বেছে নাও।” জলপরিটি বলছে।“এই বছরগুলো তোমাকে ‘জ্ঞান’ দিয়েছে, তাই দেয়া উচিত। তিনটি উপহার বাকী আছে, মনে রেখো শুধু একটিই কাজের সুতরাং ভালোভাবে বেছে নাও!”
দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে থেকে লোকটি বেছে নিলো, ‘সম্মান’, জলপরীটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঁর পথে চলে গেলো।
আরো কিছু বছর কাটলো, জলপরীটি এসে দাঁড়িয়েছে লোকটির পেছনে, যখন ম্লান হয়ে আসা এক দিনের শেষে লোকটি ভাবছে। জলপরীটি জানে সে কি ভাবছে!
“আমার নাম পূর্ণ করেছে এই পৃথিবীকে, সবার মুখে মুখে আমার নাম, এবং কিছু সময়ের জন্য এটা দেখতে ভালোই লেগেছে। কিন্তু কত ক্ষুদ্রতর ছিল সেই সময়টুকু! এর পরপরই আসলো ঈর্ষা, বিভ্রান্তি, ঘৃণা এবং নানা অভিযোগ। এরপর সেই পরিহাস এর পূনরাবৃত্তি।সবশেষে সেই করুণা যা সম্মানকে ধুলিস্বাত করে দিলো!”

“আবার বেছে নাও” আবার সেই জলপরীর কন্ঠস্বর।
“দুটো উপহার এখনো আছে বাকী, এবং আফসোস করো না, শুরুতে যেমন একটি মাত্র মূল্যবান উপহার ছিল এখনো তা আছে”
“সম্পদ… যার মানে হলো ক্ষমতা! কি অন্ধ ছিলাম আমি!এতদিনে জীবন হবে অর্থপূর্ণ” বলে উঠলো লোকটি।“এই পৃথিবী এখন আমার কথায় উঠবে বসবে, আমি সমস্ত বিত্ত, বৈভব, প্রাচুর্য, এবং আনন্দ সবকিছু, সম্মান, প্রভুত্ব সবকিছু আমি কিনে নেবো। এখন পর্যন্ত আমি ভুল উপহার বেছে নিয়েছি…”
তিনটি ক্ষুদ্র বছর কাটলো, একদিন লোকটি এক সাধারণ চিলেকোঠায় বসে কাঁপছে; সে ছিল অস্থি চর্মসার, চোখে ঢুকে গেছে গর্তে। শুকনো স্বরে সে বিড়বিড় করছে- “অভিশাপ পৃথিবীর সমস্ত উপহারকে, পরিহাসকে এবং সাজানো মিথ্যাকে! ওগুলো কোনো উপহার ছিল না, বড়জোর ‘দায়’ ছিল। আনন্দ, ভালোবাসা, সম্মান, সম্পদ সব কিছুই এত ক্ষনস্থায়ী যে সব শেষ হয় যন্ত্রণা, লজ্জা আর দৈন্যতার মাঝে। জলপরী ঠিকই বলেছিল একটি মাত্র উপহারই মূল্যবান ছিল! আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত অনেক, আমি বিশ্রাম চাই…”

জলপরীটি আবার আসলো, চারটি উপহার নিয়ে কিন্তু মৃত্যু ছাড়া। সে বললো- “আমি ওটা অন্য একজনকে দিয়ে এসেছি, সে ছিল উপেক্ষিত কিন্তু সে আমাকে বিশ্বাস করেছিল, আমাকে বলেছিল পছন্দ করে দিতে।তুমি তো কখনো আমাকে পছন্দ করে দিতে বলো নি!”
লোকটি বললো, “কি আর বাকী আছে আমার জন্য?”
জলপরীটি উত্তর দিলো, “যার যোগ্যও তুমি নও, বৃদ্ধকালের লাঞ্চনা!”

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত