আত্মার আত্মশুদ্ধি

আত্মার আত্মশুদ্ধি

মানুষ চলার পথে চেনা অচেনা বিভিন্নজনের সাথে পরিচিত হয়। । অবিস্মরণীয় বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হয়। ঘটনাগুলি থেকে হয়তো আনন্দ, বেদনা, সুখ-দুঃখ কিংবা শিক্ষালাভ করা যায়। চলার পথের কোন ঘটনা থেকে যদি শিক্ষালাভ করা যায় তাহলে ক্ষতি কি?
জ্ঞানলাভ অতঃপর আত্মার আত্মশুদ্ধিও হয়ে যায়।
.
গল্পটা আত্মার আত্মশুদ্ধির । ঠিক গল্প বললে ভুল হবে , সত্য ঘটনা থেকে বলছি।
.
.
সপ্তাহখানেক আগে মাগুরা থেকে বাসে করে যশোর যাচ্ছিলাম। বেশি সময়ের পথ না, সর্বোচ্চ হলে ১ ঘন্টা লাগে যেতে। সাধারণত আমি জানালার সাথের সিটে বসি। কারণ বাসে চড়লে প্রায় প্রায় প্রবলেম হয় আমার। একারণেই জানালার ধারে সিটে বসলাম। প্রায় পেছনের দিকের সারিতে বসেছিলাম আমি। দেখতে দেখতে ১০ মিনিটের মধ্যে গাড়ি যাত্রীতে পরিপূর্ন। গাড়ি চলতে লাগল। তবে মাঝে মধ্য থামছে যাত্রী নামাতে এবং উঠাতে। প্রায় পথিমধ্যে ৬০ কিংবা ৭০ বছর বয়সের ( আনুমানিক) একজন যাত্রী উঠলো বাসে। হাতে ছিল একটা লাঠি। বোঝায় যাচ্ছিলো লোকটি লাঠিতে ভর করে হাঁটে। যেহেতু গাড়ি ভর্তি যাত্রী ছিল সেহেতু মুরব্বী লোকটি সিট পাচ্ছিলো না । ভেবেছিলাম কেও হয়তো সিট ছেড়ে দিয়ে লোকটিকে বসতে দিবে। কিন্তু না, আমার ধারণা ভুল। সবাই তার নিজের নিজের সিট ছাড়তে নারাজ। কন্টাকটারেরও কিছু বলার নেই, কারণ বাস ভর্তি যাত্রী ছিল, দাড়াতেই অনেক কষ্ট হচ্ছিলো অনেকেরই। সেখানে সিট ম্যানেজ করে দেওয়াটা একটু কঠিনই বটে।
.
আমি পেছন থেকে নিরবে দেখছিলাম। মুরব্বী লোকটির হাত-পা কাপছে দাড়িয়ে থাকতে। বোঝায় যাচ্ছিলো তার কষ্ট হচ্ছে।
ছোট থাকতে আব্বু-আম্মু এমনকি স্কুলের শিক্ষক একটা জিনিস আমাদের সবাইকে শিখিয়েছেন —- ” ছোটদের স্নেহ আর বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করা “। হয়তো এই সামান্য শিক্ষা থেকেই নিজের সিটটা ছেড়ে দিয়ে মুরব্বীলোকটিকে বসিয়েছিলাম। আর আমি পেছনে একটু গাদাগাদি করে দাড়িয়েছিলাম। কষ্টহচ্ছিলো,, তবে কষ্টটা দাড়িয়ে থাকার জন্য নয়, শারিরিক । কেমন যেন বমি বমি ভাব আসতেছিলো। বাসে উঠলে এই সমস্যাটা প্রায় হয় আমার, আগেই বলেছিলাম। তবুও দাড়িয়ে ছিলাম এই ভেবে যে, আর তো বেশি পথ নেই থাকতে পারব অসুবিধা হবে না।
.
কিন্তু আমার বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে হয় নি। মুরব্বীলোকটির পাশের জন নেমে পড়বে। সিট খালি হওয়ার সাথে সাথেই অন্য কেও সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। কিন্তু মুরব্বীলোকটি তাকে উঠিয়ে দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। আমি দুয়েকবার না করেছি তবে লাভ হয় নি । হাত ধরে টানদিয়ে বসিয়ে দিলো । মুরব্বীলোকটির সাথে পরিচিত হলাম। একটা বিষয় ছিলো যে মুরব্বীর চেহারায় আক্ষেপের চিহ্ন। প্রখর আক্ষেপের সাথেই বলতে লাগলো…………… জানো আঙ্কেল (আমাকে উদ্দেশ্য করে ) আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বয়স্কদের দেখলে সালাম দিয়ে চলতাম। গাড়িতে উঠলে মুরব্বী কিংবা মহিলাদের জন্য সিট ছেড়ে দিয়ে দাড়িয়ে থাকতাম। যে কেওই সিট ছেড়ে দিতে প্রস্তুত থাকত। আর এখন সালাম দেওয়াটাতো বলতে গেলে উঠেই গিয়েছে । বয়স্ক তো দুরের কথা মহিলাদের সিট দখল করে বসে থাকে যাত্রীরা । কি যুগে আসলাম রে বাবা…!!
একসময় আসবে মুরব্বীরা হাটুর বয়সই ছেলেদের সালাম দিয়ে চলবে ।।
.
উপরের কথাগুলা ছাড়াও অনেক উপদেশমূলক কথা শুনিয়েছেন তিনি। বলতে বলতে বাস যশোর নিউ মার্কেট স্টান্ডে এসে থামল। বিদায় কালে মুরব্বীলোকটি বলল….অনেক বড় হও তুমি। আল্লাহ তোমার ভালো করবে । এই বলে তিনি মনিহারের দিকে গেলেন আর আমি যাবো জেসটাওয়ার।
নিউ মার্কেট থেকে একটি রিকসায় করে জেসটাওয়ার নামলাম। ভাড়া দিলাম ২০ টাকা।
.
___মামা, ৩০ টাকা দেন।
=> কি বলেন, ভাড়াতো ২০ টাকা। সেটাই আপনাকে দিলাম।
___ না, মামা । আপনি ৩০ টাকা দেন।
=> কিন্তু আপনাকে বেশি ভাড়া কেন দিবো?
__মামার,সারাদিন রোজা থাইকা এই গরমে রিক্সা চালাইতেছি। পাঁচ ট্যাকা বেশি দিলে কষ্টটা একটু কম হয়তো মামা।
.
আমার কিছু বলার ছিলো না। রিক্সাওয়ালা মামাকে ৩০টাকায় দিলাম। জেসটাওয়ারের সামনে বেশ কয়েকটা ফুটপাতের দোকান রয়েছে। বিভিন্ন রকমের দোকান। বাবার বয়সী এক লোক পতাকা বিক্রি করতেছে। চোখে চঁশমা পড়া। দেখতে ভদ্রলোকই মনে হয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন সহ বাংলাদেশের পতাকাও বিক্রি করছে। যেহেতু এটা ফুটবল বিশ্বকাপ এর সময় সেহেতু বেচা-কেনাটা ভালোই চলতেছে। আমি ব্রাজিলের সাপোর্টার হিসেবে একটা ছোট্ট পতাকা কিনতে তার দোকানে হাজির হলাম।
.
অনেকটা জোরে জোরে বলতেছে……. মামা, পতাকা নিন, পতাকা। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের পতাকা আছে, ছোট বড় সবই আছে । নিন মামা নিন, কমদামে নিয়ে নিন।
.
আশ্চার্যের বিষয় এই যে, তিনি একসাথে দুইটা পতাকা ছাড়া বিক্রি করবেন না। যেমন যে ব্রাজিলের পতাকা কিংবা আর্জেন্টিনার পতাকা কিংবা জার্মানির কিংবা স্পেনের পতাকা নিক না কেন তাকে সাথে একটি বাংলাদেশের পতাকাও নিতে হবে। নয়তো সে বিক্রি করবে না। আমার আশ্চার্য্য হওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। অনেকেই শুধু একটা পতাকা নিতে চাচ্ছে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা। কিন্তু সে একটা পতাকা বিক্রি করবে না। যে দুইটা নিবে তার কাছেই বিক্রি করবে। অদ্ভূত আচরণ লোকটির। যে জোর করে একটা নিতে চাচ্ছে তাকে সে বলছে–” আপনার কাছে আমি পতাকা বেচব না, আপনি আসতে পারেন ”
.
মনে কৌতুহল জেগে উঠল। দোকানে গেলাম।
.
___মামা, একটা ব্রাজিলের পতাকা দিনতো। ঐ যে নিচের ছোটটা।
=> মামা, একটা না দুইটা নিতে হবে। নয়তো বেচমু না। সাথে দ্যাশের পতাকাও নিবার লাগব।
__আচ্ছা দুইটায় দেন। তবে ছোট দুইটা দিয়েন।
.
মামা, কিছু না মনে করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
=> কি প্রশ্ন করেন।
___ এই যে আপনি কিন্তু ইচ্ছা করলে একটা একটা করে এসব পতাকা বিক্রি করে ফেলতে পারতেন বেশি সময় লাগতো না। কিন্তু আপনি সেটা না করে দুইটা বিক্রি করছেন নিজের দেশের পতাকা সহ। ব্যাপারটা তো ঠিক বুঝে আসছে না।
=> মামা, কথাই আছে না — সময় অসময় নেই, দেও এক্কান হাফ টিকেট।
এই দেহেন সারাবছর কোথাও কোন পতাকা দেখছেন কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপ আসলেই যেন পতাকার মেলা বইসা যায় যেখানে সেখানে। সারাবছরে কোথাও তো নিজের দ্যাশের পতাকা দেহি না উড়তে। শুধু টিভিতেই দেহি । আর অহন অন্য দ্যাশের পতাকা উড়বে আমগোর দ্যাশে কিন্তু নিজেগোর দ্যাশের পতাকা উড়বো না সেইটা তো হয় না। এজন্য আমি একটা পতাকা বেচি না বুচ্ছেন মামা।
শুনেন মামা, অশিক্ষিত হতে পারি তয় নিজেগোর দ্যাশটারে ভালোবাসি অন্তর দিয়া। নেহাত প্যাটে টান পড়ছে দেইখ্যা পতাকা ব্যাচতাছি নয়তো কোনদিনও ব্যাচতাম না।

কি জবাব দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবে লোকটার কথাগুলা বুকের কোথায় গিয়ে যেন আঘাত করছিলো। একধরণের ভালো লাগা কাজ করছিলো। লোকটির কথাশুনে মনটা সত্যিই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল।
.
আমরা অনেকেই সারাবছর মোটা মোটা বই পড়ে, কোচিং করে বড় বড় শিক্ষাঙ্গন রঙ্গিন করতেছি। কিন্তু মনটাকে কতোটা রঙ্গিন করছি, সেইটার খবর ক-জনেই বা রাখে। যেখানে কিনা অন্য দুই দেশ দিয়ে আমরা লাফালাফি, মাতামাতিতে মেতে উঠেছি, নিজেদের মধ্যেই বিবাধ তৈরি করতেছি , ঝগড়া, মারামারি এমনকি খুন-খারাপি করতেও দ্বিধাবোধ করছি না। আর সেখানে একজন সামান্য ফুটপাতের দোকানদার দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হয়ে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে।

এতো মোটা মোটা বইয়ের অক্ষরগুলোকে ব্রেনের মেমোরিতে আপলোড করে আমরা কি শিখছি, কতোটা শিখতে পেরেছি, শিখে কি করছি, ভালো করছি নাকি খারাপ করছি এতটুকুই যদি বুঝতে না পারি তাহলে লাভ কি। নিজের দেশটাকেই যদি ভালো
বাসতে না জানি, তাহলে অন্যদেশ নিয়ে টানাটানি করে লাভটা কি?
আছে কি কোন উত্তর ?
.
কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছে যারা দশটাকার পতাকা একশ টাকাতে বিক্রি করছে। দশগুন লাভে বিক্রি করছে তবুও আমাদের ক্রয় করতে কোন দ্বিধাদন্দ্ব নেই। কিন্তু দ্বিধা এখানেই যখন কোন পথশিশুকে পাঁচটা টাকা দিতে গিয়ে। আচ্ছা একটা পাওরুটি আর একটা কলার দাম কতো?
সর্বোনিম্ন দাম ধরলেও ৫ টাকা একটা পাওরুটি আর ৫ টাকা একটা কলা । মোট দশটাকা । এই দশটাকার বিনিময়ে যদি কেও একবেলা খেয়ে অন্ততো পেটের ক্ষুধাটা কিছুটা হলেও নিবারণ করতে পারে, তাহলে আপনার দ্বিধাকোথায় দশটাকা তাকে দিতে?
.
কোথায় যেন দেখেছিলাম , দেয়ালে বড় করে একটা বাণী লেখা আছে,—- যে দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীণতা অর্জন করতে পারে, সে দেশের মানুষ কখনও গরীব থাকতে পারে না । বাণীটা কে দিয়েছে জানেন….. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আশ্চার্য্য হবেন এই যেনে যে — ঐ দেয়ালের ধারেই নোংরা পরিবেশে কয়েকজন পথশিশুসহ বসতহীন মানুষ রাত্রীযাপন করে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত