ছা দটা বেশ বড়ো। ছাদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা নারকেল গাছটার আড়াল থেকে উঁকি মারছে চাঁদ। গোল থালার মতো চাঁদটার গা বেয়ে চলকে পড়া সাদা আলোয় চাদ্দিকটা কেমন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে ডিংকার। গরমের রাত। তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে ছাদের ওপর মাদুর বিছিয়ে বসেছে ওরা। দাদুভাই আর ও।
– আচ্ছা। দাদুভাই তুমি যে বলেছিলে এই বাড়িটার একটা গল্প আছে, কী গল্প?
– সে বড় কষ্টের গল্প দাদাভাই। শুনবে যখন, তখন শোনো। সালটা ১৮৯৫, খড়গপুরে রেল এল। জায়গাটা রেল শহর হিসেবে গড়ে উঠতে লাগলো। লন্ডন থেকে এসেছেন জর্জ সাহেব। রেল বাংলোতেই থাকেন। একটু একটু করে গড়ে উঠতে থাকা শহরটাকে ভালোবেসে ফেললেন। ১৯২৫ সালে, তাঁর যখন পঞ্চাশের ওপর বয়স, তখন এই জায়গাটা কিনে জঙ্গল কাটা শুরু করলেন। খুব বড়, ছিমছাম বাড়ি তৈরি করে বাকি জীবনটা এখানেই কাটাবেন। বাধ সাধল শরীর। সবে মাত্র ভিত কাটা হয়েছে মারা গেলেন জর্জ সাহেব। মারা যাবার আগে তাঁর এই সম্পত্তি দিয়ে গেলেন সদ্য বিদেশ থেকে আসা বাইশ বছরের রেডল্যান্ড সাহেবকে। সাহেব কাজ নিয়ে ঘুরে বেড়ান এদিক সেদিক। বাড়ি তৈরি আর হয় না। কেটে গেল কুড়িটা বছর। না, আর দেরি করলে চলবে না। একটু একটু করে তৈরি হলো এই বিরাট বাংলো। সাহেবের ছিল বই পড়ার নেশা। কত যে বই তিনি সংগ্রহ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। বাড়ির কোণার দিকে তৈরি হলো লাইব্রেরি। সারাদিন কাজ আর বই। এরই ফাঁকে বিয়াল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করলেন লন্ডন থেকে আসা মেমসাহেব লিজাকে। দুটো বছর দেখতে দেখতে কেটে গেলো। চারিদিকে তখন স্বাধীনতা আন্দোলন তুঙ্গে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গেই লিজা মেমসাহেব চাইলেন এখানের পাট চুকিয়ে লন্ডনে ফিরে যেতে। মাত্র দুবছর আগে বিদেশ থেকে এসেছেন। এই দেশের প্রতি তাঁর আর টান কিসের। কিন্তু রেডল্যান্ড সাহেব, দীর্ঘ চব্বিশটা বছর এই দেশে। এতো তাঁর বলতে গেলে নিজেরই দেশ। তাছাড়া এই লাইব্রেরি! বই পাগল মানুষটার মন কিছুতেই চাইছে না। এত বই তো আর নিয়ে যাওয়া যাবে না। এদিকে মেমসাহেবের তুমুল জেদাজেদি। অগত্যা রাজি হলেন সাহেব। আমার বাবার কাছে বিক্রি করলেন এই বাড়ি। বাড়ি বিক্রির আগে শর্ত ছিল যিনি বাড়ি কিনবেন তাঁকেও হতে হবে বই পাগল। তুমি তো জানোই দাদাভাই, আমার মতো আমার বাবাও খুব বই ভালবাসতেন। সাহেবের জহুরির চোখ। অনেক খরিদ্দারের থেকে ঠিক বেছে নিলেন বাবাকে। ঠিক হল যাওয়ার দিন সকালে বাড়ির চাবি বাবার হাতে তুলে দেবেন। যাওয়ার আগের দিন সমস্ত গোছগাছ সেরে মেমসাহেব শুতে গেলেন। সাহেব গিয়ে ঢুকলেন লাইব্রেরি ঘরে। পরের দিন সকাল বেলা একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য। লাইব্রেরি ঘরের মধ্যে পড়ে আছেন সাহেব। বোধ হয় মাঝরাত্রেই মারা গেছেন। চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। এতটাই স্পষ্ট যে ওঁর দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। এরপর বাবাকে সবাই বারণ করেছিলেন এই বাড়িটা না নিতে। বাবা কথা শোনেননি। তাঁর একটাই কথা, ‘আমি সাহবেকে কথা দিয়েছি। তাঁর বইপত্রের খেয়াল রাখব। তখন রাখব।
এককথার মানুষ আমি।’ মেমসাহেব সাহেবের কাজকর্ম মিটিয়ে দেশে ফিরে গেলেন। আমরা থেকে গেলাম এখানে। এরপর থেকেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে।
– কী কাণ্ড দাদুভাই?
– সে কথা এখন থাক দাদাভাই। অনেক রাত হল। ঘুমবে চলো।
ডিংকা জানে দাদুভাই বলতে না চাইলে একটা কথাও আর বলবেন না। নীচে নেমে কোণার দিকে লাইব্রেরি ঘরের কাছাকাছি ওর জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা ঘরটিতে তাই সে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎই ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রচন্ড গরম। কারেন্ট চলে গেছে। বাইরের ঘরে রাখা আগেকার দিনের বড়ো ঘড়িটা জানান দিচ্ছে রাত দুটো। কোথাও একটা আওয়াজ হচ্ছে। কারা যেন কথা বলছে। ডিংকা উঠে পড়ে। স্মার্টফোনের টর্চটা জ্বালিয়ে আওয়াজ লক্ষ্য করে তাকায়। কান পাতে। চমকে ওঠে। আওয়াজটা লাইব্রেরি ঘরের ভেতর থেকেই আসছে। এতরাতে কারা ওখানে! দরজার সামনে পৌঁছে ডিংকা তো হতবাক।
দরজার গায়ে দাদুভাইয়ের লাগানো মস্ত তালাটা ঝুলছে। অথচ! ও দরজার গায়ে কান রাখে। ভেতরে দুজন লোক ঝগড়া করছে ইংরেজিতে। কথা বলার ধরণে মনে হচ্ছে দুজনেই সাহেব। ওঁদের কথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। ডিংকা বেশ বুঝতে পারছে ওর পা দুটো কাঁপছে। তবু চেষ্টা করেও নড়তে পারছে না। হঠাৎই অসাবধানে ওঁর হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায়। ওই শব্দে ভেতরের লোক দুটো ঝগড়া থামায়। এদিকে মোবাইলটা হাত থেকে পড়ায় আলোটা নিভে গেছে। ঘুটঘুটি অন্ধকার। ডিংকা কিছু বোঝার আগেই টের পায় সাঁড়াশির মতো চারতে হাত ওকে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে। হাত চারটে অসম্ভব ঠাণ্ডা। অন্ধকার ঘরে চারটে চোখ ভাঁটার মতো জ্বলছে। ‘বিপদে পড়লে ভয় পাবে না। ভয় পেলে মাথা কাজ করবে না।’ মায়ের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায় ডিংকার। না, কিছুতেই ভয় পাওয়া চলবে না। ডিংকা স্পষ্ট ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করে,
– তোমরা কারা? তোমরা কী জর্জ সাহেব, রেডল্যান্ড সাহেব?
আগুনের মতো জ্বলতে থাকা চোখগুলো স্থির হয়ে গেল।
– তুমি, তুমি কী করে জানলে?
– আমি এও বুঝে গেছি জর্জ সাহেব, তুমিই মেরেছ রেডল্যান্ড সাহেবকে। সেদিন রেডল্যান্ড সাহেব মরতে চাননি। তোমার ব্যবহারে নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছিলেন। তাই বীভৎস আতঙ্ক ফুটে উঠেছিল তাঁর মুখে।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক বলেছ তুমি। সেদিন জর্জসাহেব আমায় ভয় দেখিয়েছিলেন, আমার স্ত্রীকেও মেরে ফেলবেন বলেছিলেন। অথচ কী হাস্যকর কারণ! তবে আমায় মেরে ফেলে বেশ বড়ো ভুলই করেছেন জর্জসাহেব। ওঁর তো খেয়ালই ছিল না মরে গেলে আমার শক্তিও তাঁরই মতো হবে। বলতে বলতেই বিকট হাসিতে ফেটে পড়লেন রেডল্যান্ড সাহেব।
– কী, কী বললে তুমি, আমি শুধু শুধু মেরেছি তোমায়? মেরেছি বেশ করেছি। আমি বাঙালিদের সহ্য করতে পারি না। তুমি কিনা বাড়িটা সেই বাঙালি নেটিভদের বিক্রি করলে! চিৎকার করে উঠলেন জর্জ।
– আরে আরে তোমরা থাম। হচ্ছেটা কী। রাতদুপুরে কী শুরু করলে তোমরা। এই যে জর্জসাহেব তোমার বাঙালিদের ওপর রাগের কারণ কী? ডিংকা একটু কঠিন ভাবেই বলল।
ডিংকার গলার স্বর এতটাই দৃঢ় যে দুই সাহেবই খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন।
তারপরই খিঁচিয়ে উঠলেন জর্জসাহেব।
– হ্যাঁ রাগ করব না আবার। প্রায় দুশো বছর ধরে আমাদের স্বজাতিরা ইন্ডিয়াকে শাসন করল। তাছাড়া এই খড়গপুরে, আমি অবশ্য তখন মারা গেছি কিন্তু তাতে কী হয়েছে! আমাদের জাতভাইরাই তো বাঙালিদের সাইকেল চড়া নিষিদ্ধ করেছিল। সন্ধের পর বেরনো বন্ধ করেছিল। করবে নাই বা কেন, তিন জন ম্যাজিস্ট্রেটকে খুন করেছিল তো বাঙালি। বেশ হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল। সেই বাঙালিকেই কি না বিক্রি করে বসল রেডল্যান্ড। আমার কেনা এই সাধের জমিটা ভোগ করবে বাঙালি। এটা আমি কিছুতেই মানব না।
রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ডিংকার। সামলে নিল নিজেকে। ঠিক তখুনি বেদম হাসি পেল। হাসি চাপতে না পেরে হেসেই ফেলল। ওর হাসি দেখে এগিয়ে এল বেঁটেখাটো লোকটা। অন্ধকার সয়ে যেতে ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দুজনকেই। বেঁটেখাটো লোকটার চোখ দুটো আগুনের মতো ভয়ঙ্কর নয়। আরেকজন লম্বাটে। চোখ দুটোয় রাগ বিরক্তি। বেঁটে লোকটা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
– মাই বয়, হাসছ কেন?
ওদিক লম্বাটে লোকটা চিৎকার করে উঠল,
– হাসির কথা কী বলেছি আমি? এত হাসির কী আছে? দেবো নাকি গলাটা টিপে?
– এই যে জর্জসাহেব, তুমি তো খুনখারাপি ছাড়া আর কিছুই বোঝো না দেখছি। হ্যাঁ আমি তোমার কথা শুনেই হাসছি। তোমার দেখছি বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারেই নেই। আরে বাবা এই দেশটা আমাদের। আমরা তো চাইবই ফিরে পেতে। তুমি চাইতে না? এই যে সামান্য এই জায়গাটা তোমার, সেটাকেই আগলে রাখতে চাইছ। ভালবাসো বলেই তো চাইছ।
– হ্যাঁ তা ঠিক। ভালবাসি বলেই তো চাইনি অপছন্দের লোকের হাতে যাক।
তবে হাসির মতো কি কথা বলেছি সেটা তো বুঝলাম না।
ডিংকা লোকটার চোখে চোখ রাখে।
– আসলে জর্জ সাহেব তুমি তো দেখছি জানই না। মানুষ কখনো আলাদা হয় না কী? এই ঘরে এত্ত বই কোনোদিন পড়েও দেখনি দেখছি। পড়লে বুঝতে, যারা বুদ্ধিমান যারা ভাল সারা পৃথিবী জুড়েই তারা সবাই সবার বন্ধু। আর তুমি কি না, যাদের দেখতে পারো না তাদের হাতে এই বাড়িটা তুলে দেওয়াতে এতটাই রেগে গেলে যে রেডল্যান্ড সাহেবকে মেরেই ফেললে! আরে বাবা, তোমার ভালোবাসার জিনিস ভালো লোকের হাতে গেছে সেটাই তো আসল কথা তাই না?
জর্জ সাহেব মাথা নাড়লেন,
– এভাবে ভাবিনি তো কখনো।
রেডল্যান্ড সাহেব ডিংকার মাথায় হাত রেখে বললেন,
– আমি আগেই বুঝেছি, তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। নয় তো এতদিন ধরে আমি যা বোঝাতে পারিনি, তুমি এক মুহূর্তেই বুঝিয়ে দিলে। তুমিও বই পড়তে খুব ভালবাসো তাই না?
– হ্যাঁ বাসি তো। আসলে জর্জ সাহেবের মাথা এতটাই গরম ছিল, তুমিও প্রচণ্ড রেগে ছিলে তাই এই দীর্ঘ সত্তরটা বছর ঝগড়া করেই কাটিয়ে দিলে।
– ঠিক বলেছ। কতদিন বই পড়িনি। অথচ এই বইগুলোই তো আমার প্রাণ। বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন রেডল্যান্ড সাহেব।
– কেঁদো না, আজ থেকে আর ঝগড়াঝাঁটি নয়। এইসব ব্যাকডেটেড কারণে তো নয়ই। এবার প্রতিদিন রাত্রে বই পড়বে, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন। ডিংকা রেডল্যান্ড সাহেবের হাতে একটা বই তুলে দেয়।
আনন্দে চকচক করে ওঠে রেডল্যান্ড সাহেবের লাল চোখদুটো।
– বুঝলে জর্জ এবার থেকে তুমিও বই পড়ার অভ্যাসটা করে ফেলো দেখি। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরেন।
হঠাৎই খেয়াল হয় রেডল্যান্ড সাহেবের।
– আচ্ছা ডিংকা এই সব বই পড়া হয়ে গেলে নতুন বই কী করে পাব বলতো?
– চিন্তা কর না তোমরা । তোমরা তো আর এখন নিজেরা বই কিনতে পারবে না। দোকানে বাজারে গেলে লোক ভয়টয় পেয়ে একসা হবে। আমি প্রতি মাসে একটা করে নতুন বই কিনে আমার দাদুভাইয়ের এই বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব কেমন। তোমরা পড়ো। আমি এবার শুতে যাই। ওহো দরজাটা তো আবার বাইরে থেকে লাগানো। আমায় বের করে দাও।
দুই সাহেব একসঙ্গে বলে ওঠেন,
– গড ব্লেশ ইউ মাই চাইল্ড।
ঠিক তখুনি ডিংকা বুঝতে পারে ও দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে ওর পড়ে যাওয়া মোবাইলটার পাশটিতে। স্মার্টফোনের টর্চটা জ্বালিয়ে বিছানায় ফিরে আসে। বালিশে মাথা রাখতেই টের পায় মাথার ওপরের ফ্যানটা চলতে শুরু করেছে। ডিংকা বুঝতে পারে দাদুভাই রাতের এই ঝগড়ার আওয়াজটার কথাই তখন বলতে গিয়ে বলেননি। সকালে উঠেই দাদুভাইকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হবে। ওর চোখ ঢুলে আসছে ঘুমে।
এদিকে রাত প্রায় শেষের দিকে। কোজাগরী চাঁদ ডুবে যাওয়ার আগে ডিংকার ঘুম ঘুম চোখের ওপর মিষ্টি আলো ঢেলে দেয়।
…………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………