আমাদের গাড়ি যখন বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো ছ’টা বেজে গেছে ততক্ষণ। সূর্যের তেজ কমতে কমতে থিতু হয়ে এসেছে অনেকটাই। বিরাট আকাশ জুড়ে লালচে লালচে আভা বিকেলটাকে কেমন মায়াবী করে তুলেছে। গাড়ি থেকে নেমে বড় গেটটার সামনে দাঁড়ালাম। অরিজিত আমার দিকে ক্লান্ত চোখে তাকাল। বুঝতে পারছিলাম ওর হাল। প্রায় তিন’শ কিলোমিটার টানা ড্রাইভ করে এসেছে। কিন্তু আমিই বা কী করব? এতদূর রাস্তা একা আসার তেমন সাহস পাচ্ছিলাম না। তাই অরিজিতকে ধরলাম। অরিজিত আমার ছেলেবেলার বন্ধু। দু’জন দু’জনের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ি নির্দ্ধিধায়। এক্ষেত্রেও ও যে না করবে না, এ আমি ভালো করেই জানতাম। তাই একটা ছুটির দিন দেখে দু’জনে রওনা হয়ে গেলাম গন্তব্যে।
বাড়িটা যেমন বড় গেটটাও তেমনই। এত বড় গেট আমি জীবনে দেখিনি। সত্যিই যে এটা এক’শ বছরেরও পুরোনো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জনমানব শূন্য এমন এক জায়গায় আমার দাদু কেন বাড়ি কিনতে গেল সেটা আমার আজ পর্যন্ত মাথায় ঢুকল না। অবশ্য মা-এর মুখে দাদুর উদ্ভট শখের কথা অনেক শুনেছি। শেষ বয়সে যখন চলতে পারতেন না, তখনও নাকি নানা রকম প্ল্যান বানাতেন। বাবা মজা করে বলেন, বেশি টাকাপয়সা থাকলে এমন শখ পোষাই যায়! তবে এই অদ্ভুত সমস্ত শখের জন্য আখেরে আমাদেরই লাভ হয়েছে সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। দাদু মারা গিয়েছেন আমার জন্মের বহু বছর আগে। দাদু-র মৃত্যুর আগে উইল করে বিভিন্ন জায়গায় যে সমস্ত জায়গা কিনে রেখেছিলেন তা ভাগ করে দিয়েছেন নাতি নাতনিদের মধ্যে। আমার ভাগ্যে জুটেছে এই বাড়িটা। আমি বড় হওয়ার পর সব শুনতে পাই। এখানে জীবনেও থাকতে আসব না, তাই বাবা বুদ্ধি দিল বাড়িটা দেখেশুনে বিক্রির ব্যবস্থা করাই ভালো। সেজন্যই আমার এখানে আসা। মা মৃদু আপত্তি তুলেছিল কিন্তু আমার আর বাবার তীব্র জোরের কাছে তা ধোপে টেকেনি মোটেও।
অরিজিত ক্লান্ত গলায় বলল, ‘কেউ জানে না আমরা এখানে আসব?’
‘একটি লোককে দাদু বাড়িটা দেখাশোনার দায়িত্বে রেখেছিলেন, আসার আগে তাকে ফোন করে বলে রেখেছি। কিন্তু তাকে তো দেখছি না’, হতাশ গলায় বললাম।’
অরিজিত বলল, ‘কিন্তু যা অবস্থা দেখছি তাতে তো কেউ না থাকলে ভেতরে ঢোকাই যাবে না।সামনের জঙ্গল টঙ্গলগুলো তো একটু সাফ করে রাখবে!’
বুঝতে পারছিলাম অরিজিত বিরক্ত হচ্ছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ওই লোকটার নম্বরে ডায়াল করলাম। যা ভয় করছিলাম ঠিক তাই হল। লোকটি ফোন তো তুললই না, উলটে সার্ভিস প্রোভাইডার বলতে লাগল, নম্বরটি নাকি বাস্তবে নেই। অরিজিত সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আগে থেকে সব ঠিক না করে এইরকম একটা জায়গায় হুট করে চলে আসা উচিৎ হয়নি আমাদের।’
সন্ধ্যে রঙের আলো সারা আকাশটাকে মুড়ে ফেলেছে মুহূর্তে। আমারও ভয় ভয় করছিল। শুকনো গলায় বললাম, ‘জোরে হর্ণ দে তো একবার!’
গাড়ির ভেতর হাত ঢুকিয়ে অরিজিত লম্বা হর্ণ বাজালো। নাহ্, কেউই বেরিয়ে এল না। আশপাশে কোনো বাড়িঘরও নেই যে জিজ্ঞেস করব। অরিজিত আমার মনের কথা হয়ত পড়তে পারল, নিজের মনেই বলে উঠল, ‘শেষ জনবসতি দেখেছিলাম তাও কয়েক কিলোমিটার আগে… চল ফিরেই যাই।’
আমারও তাই ইচ্ছে। তবু অরিজিতকে বললাম, ‘এতদূর এলামই যখন একবার ভেতরে গিয়ে দেখেই আসি। কী বলিস?’
অরিজিত স্পষ্টতই অবাক হল। একটু চেঁচিয়েই বলল, ‘তুই কি পাগল? এই রাতের অন্ধকারে ভেতরে ঢুকবি! তাও এমন একটা জায়গায়? চল, পরে আসা যাবে।’
অরিজিতের কথাটা পাত্তা দিলাম না। বাড়ির ভেতরটা কেমন যেন টানছে আমাকে। মুখে বললাম, ‘তোর আবার ভূতের ভয়টয় আছে নাকি!’
লজ্জা পেয়ে অরিজিত বলল, ‘ভূতের চেয়ে মানুষের ভয় বেশি। বলা কী যায় ভেতরে কোনো খারাপ লোকেদের আস্তানা গড়ে উঠেছে কিনা! তাছাড়া সাপ খোপের ভয় তো আছেই।’ আমি ওর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বললাম, ‘তুই এইখানে দাঁড়া, আমি চট করে এক চক্কর দেখে আসি।
ভেতরে হয়ত ওই লোকটাও থাকতে পারে।’
অরিজিত আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। আমি ওর কথা না শুনে বাড়ির দিকে হনহন করে হাঁটা দিলাম।
(দুই)
বিরাট গেটটা আমার একার পক্ষে ঠেলে খোলা অসম্ভব ঠেকল। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করলাম। নাহ্ কিছুতেই খুলছে না। উল্টে এই নির্জন অঞ্চলে লোহার গেটের শব্দটা কর্কশভাবে বেজে উঠছে। পেছনে ঘুরে দেখলাম অরিজিত পার্কিং লাইটটা অন করে রেখেছে। হলুদ বাতিটা একবার জ্বলছে একবার নিভছে। গাড়ির গায়ে তারার মতো আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলছে ধিকধিক করে। আগুনটা সরে সরে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে।
অরিজিত টেনশনে সিগারেট খায় জানি। সিগারেট খেতে খেতে পায়চারি করছে। একটা গ্লানিবোধ আমার মনে বিষাদের মতো ছড়িয়ে পড়ল। তবু ফিরে যাওয়ার কথা মনে এল না। ধাক্কাধাক্কি করতে করতেই মাঝের একটা ছোট্ট পাল্লা হুট করে খুলে গেল। আর একটু হলেই উলটে পড়তাম সামনের দিকে। ঝোপঝাড়ে পা আটকে যাচ্ছে বারবার। পুরোপুরি অন্ধকার নেমে এসেছে এই এলাকা জুড়ে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে আলো জ্বালালাম। আবছা আলোয় পুরোনো বাড়িটার দিকে চোখ তুলে তাকালাম। গেটটা দেখে যা মনে হচ্ছিল বাড়িটা তার চাইতে আরও অনেক বেশি পুরোনো। উঁচু দেওয়াল জুড়ে আগাছা এমনভাবে গজিয়েছে যে বাড়িটার আসল রূপটাই দেখা যাচ্ছে না। শুধু ছোট গাছপালাই নয়, বড় বড় গাছও প্রচুর আছে এই চত্ত্বর জুড়ে। যদিও এই গভীর কালো আঁধারে কোনটা কী গাছ ঠাহর করা যাচ্ছে না। গাছের সারিকে পেছনে ফেলে আমি এগিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে। মোবাইলের টর্চটার আলো ততটা জোরালো নয়, তবু এক তীব্র চোরা টানে আমি এগিয়ে চলছি সামনের দিকে। মাথার একদম কাছ দিয়ে ধাঁ করে একটা কিছু উড়ে গেল, বাঁদুড় বা পেঁচা কোনোটাই হওয়া অসম্ভব নয়! একটু না, বেশ ভালোই গা ছমছম করছে। এত নিশুতি শান্ত রাত আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। একটা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পর্যন্ত নেই। বাড়ির দরজাটা সেই সাবেকী আমলের। দামি কাঠের ওপর কারুকাজ করা দরজাটা একটু ঠেলতেই ক্যাঁচ করে শব্দ করে খুলে গেল। মুখ জুড়ে জালের মতো কিছু আটকে গেল, বুঝলাম মাকড়শার জাল। লোকটি কেন পরিষ্কার করে রাখেনি ভেবে একটু অবাকই লাগছিল। মুখের জাল সরাতে সরাতেই মোবাইলের টর্চটা হঠাৎই নিভে গেল দপ করে আর অমনি আমি আমার পিঠে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম।
(তিন)
এমন হিমশীতল হাতের ছোঁয়ায় সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা তীব্র তীক্ষ্ণ ভয়ের স্রোত নেমে গেল নিচে আরও নিচে।অন্ধকারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, অথচ আমি কারো উপস্থিতি স্পষ্ট টের পাচ্ছি। আমার বাম ঘাড়ের কাছে গরম ভাপ এসে পড়ছে। বুঝতে পারছি কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে, অথচ কে সে? ডাকার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু গলা দিয়ে তেমন আওয়াজ বের হচ্ছে না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আওয়াজ বের করলাম, ‘কে?’
উত্তর পেলাম না। বদলে একটা ঝরনার মতো উচ্ছ্বল হাসি আমার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। চুড়ির আওয়াজ আর একটা মেয়ের প্রাণ খোলা হাসি… আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। আমাকে এখন পালাতে হবে। এই ঘর থেকে আমাকে যেমন করে হোক চলে যেতে হবে অরিজিতের কাছে, যেখানে ও গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য! আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। মেয়েটি মিষ্টি গলায় বলে উঠল, ‘আমি জানতাম তুমি আসবে রাজনাথ, আমি জানতাম।’
আমি থমকে দাঁড়ালাম। রাজনাথ? সে তো আমার দাদুর নাম? ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে আমার। কোনোমতে বলতে পারলাম, ‘আমি রাজনাথ নই।’
‘আমি বিশ্বাস করিনা। তুমিই আমার রাজনাথ। ওই গলা, ওই মুখ আমি কি ভুলতে পারি? এসো আমার কাছে এসো রাজনাথ… মেয়েটি রিনরিনে স্বরে বলে উঠল। আমি পালাতে চাইলাম। কিন্তু নাহ্, একটা অদৃশ্য হাত আমায় আটকে ধরছে শক্ত করে। আমি ছুটছি জোরে আরও জোরে, অথচ আমার পা যেন ওইখানেই গেঁথে গেছে চিরদিনের জন্য। দরদর করে ঘামছি আমি। চিৎকার করে ডাকছি, ‘অরিজিত!!!’
জানি না আমার এই ডাক ওর কাছে আদৌ পৌঁছালো কিনা!
(চার)
জ্ঞান যখন ফিরল আমি তখন হাসপাতালের বেডে। অরিজিত ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সামান্য হাসলাম। অরিজিত কাছে এগিয়ে এল। বলল, ‘কী হয়েছিলটা কী কালকে? ওই ভেতরে ঢুকে অমন গোঙাচ্ছিলি কেন?’
দূর্বল গলায় বললাম, ‘আজ একবার ওই বাড়িটাতে নিয়ে যাবি আমাকে অরিজিত?’
অরিজিত আঁতকে উঠে বলল, ‘পাগল? আর যাই ওখানে? এখান থেকে সোজা বাড়ি, কাকু কাকিমাও চিন্তা করছে।’
‘না রে গিয়েই চলে আসব, কাল তো কিছুই দেখা হল না বাড়ির ভেতর’, আগ্রহ দেখিয়ে বললাম।
‘নাহ, যাব না। আর দেখার কীইবা আছে? একটা বড় ভাঙাচোরা বারান্দা ছাড়া বাড়িটার তো কোনো অস্তিত্বই নেই! গিয়ে দেখবিটা কী? অরিজিত বলল।
‘বারান্দা ? কাল যে একটা বিরাট ঘরে ঢুকলাম। কারুকাজ করা সদর দরজা!’ আমি একটু অবাকই হয়েছি।
‘সদর দরজা? ধুর ধুর! কোথায়? কিছুই তো নেই? কাল যখন তুই অনেকক্ষণ আসছিস না, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি চালিয়ে একে তাকে জিজ্ঞেস করে চলে যাই স্থানীয় থানায়। ওরা এসেই তো তোকে ওই বারান্দায় আবিষ্কার করে। আমিও গিয়েছিলাম ওদের সঙ্গে… কিছুই তো নেই একটা বারান্দা ছাড়া!’ এক নাগাড়ে বলে গেল অরিজিত
আমি ভ্রু কুঁচকে অরিজিতের তাকালাম। মনে তো হচ্ছে না ও মিথ্যে বলছে! তবে আমি যা দেখলাম সবই কী মিথ্যে ছিল? ওই দাদুর নাম ধরে ডাক, হাসি, কাঁচের চুড়ির শব্দ সবই মিথ্যে? আমার মনের ভুল? এ কি সম্ভব?
অরিজিত ডিসচার্জের কাজে বাইরে বেরিয়ে গেলে আমি শ্লথ পায়ে হাসপাতালের জানালার ধারে দাঁড়ালাম। একটা হালকা ঠান্ডা বাতাস আমার শরীর ছুঁয়ে চলে গেল দূর বহুদূর। আমার গা শিরশির করে উঠল। দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই আমার দাদুর কথা মনে পড়ল।
ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি আমি নাকি আমার দাদুর মতো দেখতে। কাল কি তবে সে আমাকে এইজন্যই…
আর কিছু ভাবতে পারলাম না। একটা অশরীরী হাত আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল। আমি সে টান এড়াতে পারছি না কোনোমতেই। এক পা এক পা করে আমি দরজার দিকে এগোলাম। অরিজিত আসার আগে আমাকে দাদুর ওই বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। গেট পেরিয়ে চলে যেতে হবে ওই কারুকাজ করা সদর দরজার ওপারে। ওখানেই কেউ একজন অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য, কয়েক’শ বছর ধরে, আমাকে তার কাছে যে করে হোক পৌঁছাতেই হবে…
আমিই যে পেয়েছি ঠাকুর রাজনাথ চৌধুরি-র সত্যিকারের উত্তরাধিকার।
……………………………………………(সমাপ্ত)……………………………………….