১.
এক রাজার দুই রাণী, সুয়োরাণী আর দুয়োরাণী। সুয়োরাণী যে, নুনটুকু ঊন হইতেই নখের আগায় আঁচড় কাটিয়া, ঘর-কান্নায় ভাগ বাঁটিয়া সতীনকে একপাশ করিয়া দেয়। দুঃখে দুয়োরাণীর দিন কাটে।
সুয়োরাণীর ছেলে-পিলে হয় না। দুয়োরাণীর দুই ছেলে,-শীত আর বসন্ত। আহা, ছেলে নিয়া দুয়োরাণীর যে যন্ত্রনা!-রাজার রাজপুত্র, সৎমায়ের গঞ্জনা খাইতে-খাইতে দিন যায়!
একদিন নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিয়া সুয়োরাণী দুয়োরাণীকে ডাকিয়া বলিল-“আয় তো, তোর মাথায় ক্ষার খৈল দিয়া দি।” ক্ষার খৈল দিতে-দিতে সুয়োরাণী চুপ করিয়া দুয়োরাণীর মাথায় এক ওষুধের বড়ি টিপিয়া দিল। দুঃখিনী দুয়োরাণী টিয়া হইয়া “টি, টি” করিতে-করিতে উড়িয়া গেল।
বাড়ি আসিয়া সুয়োরাণী বলিল,-“দুয়োরাণী তো জলে ডুবিয়া মরিয়াছে।
রাজা তাহাই বিশ্বাস করিলেন।
রাজপুরীর লক্ষ্মী গেল, রাজপুরী আঁধার হইল; মা-হারা শীত-বসন্তের দুঃখের সীমা রহিল না।
টিয়া হইয়া দুঃখিনী দুয়োরাণী উড়তে উড়তে আর এক রাজার রাজ্যে গিয়া পড়িলেন। রাজা দেখিলেন, সোনার টিয়া। রাজার এক টুকটুকে মেয়ে, সেই মেয়ে বলিল,-“বাবা, আমি সোনার টিয়া নিব।”
টিয়া, দুয়োরাণী রাজকন্যার কাছে সোনার পিঞ্জরে রহিলেন।
২.
দিন যায়, বছর যায়, সুয়োরাণীর তিন ছেলে হইল। ও মা! এক-এক ছেলে যে, বাঁশের পাতা-পাট-কাটি, ফুঁ দিলে উড়ে, ছুঁইতে গেলে মরে। সুয়োরাণী কাঁদিয়া কাটিয়া রাজ্য ভাসাইল।
পাট-কাটি তিন ছেলে নিয়া সুয়োরাণী গুম্রে গুম্রে আগুনে পুড়িয়া ঘর করে। মন ভরা জ্বালা, পেট ভরা হিংসা,-আপনার ছেলেদের থালে পাঁচ পরমান্ন অষ্টরন্ধন, ঘিয়ে চপ্ চপ্ পঞ্চব্যঞ্জন সাজাইয়া দেন; শীত-বসন্তের পাতে আলুন আতেল কড়কড়া ভাত সড়সড়া চাল শাকের উপর ছাইয়ের তাল ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যান।
সতীন তো ‘উরী পুরী দক্ষিণ-দু’রী,’-সতীনের ছেলে দুইটা যে, নাদুস্-নুদুস্-আর তাঁহার তিন ছেলে পাট কাটি! হিংসায় রাণীর মুখে অন্ন রুচে না, নিশিতে নিদ্রা হয় না।
রাণী তে-পথের ধূলা এলাইয়া, তিন কোণের কুটা জ্বালাইয়া, বাসি উননের ছাই দিয়া, ভাঙ্গা-কুলায় করিয়া সতীনের ছেলের নামে ভাসাইয়া দিল।
কিছুতেই কিছু হইল না।
রণমূর্তি সৎ-মা গালি-মন্দ দিয়া খেদাইয়া দিল
শেষে একদিন শীত-বসন্ত পাঠশালায় গিয়াছে; কিছুই জানে না, শোনে না, বাড়িতে আসিতেই রণমূর্তি সৎমা তাহাদিগে গালিমন্দ দিয়া খেদাইয়া দিল!
তাহার পর রাণী, বাঁশ-পাতা ছেলে তিনটাকে আছাড় মারিয়া থুইয়া, উথাল পাতাল করিয়া এ জিনিস ভাঙ্গে ও জিনিস চুরে; আপন মাথার চুল ছিঁড়ে, গায়ের আভরণ ছুঁড়িয়া মারে।
দাসী, বাঁদী গিয়া রাজাকে খবর দিল!
‘সুয়োরাণীর ডরে
থর্ থর্ করে-
রাজা আসিয়া বলিলেন,-“এ কি।”
রাণী বলিল,-“কি! সতীনের ছেলে, সেই আমাকে গা’লমন্দ দিল। শীত-বসন্তের রক্ত নহিলে আমি নাইব না!”
অমনি রাজা জল্লাদকে ডাকিয়া আজ্ঞা দিলেন,-“শীত-বসন্তকে কাটিয়া রাণীকে রক্ত আনিয়া দাও।”
শীত-বসন্তের চোখের জল কে দেখে! জল্লাদ শীত-বসন্তকে বাঁধিয়া নিয়া গেল।
৩.
এক বনের মধ্যে আনিয়া জল্লাদ, শীত-বসন্তের রাজ-পোশাক খুলিয়া, বাকল পরাইয়া দিল।
শীত বলিলেন,-“ভাই, কপালে এই ছিল!”
বসন্ত বলিলেন,-“দাদা, আমরা কোথায় যাব?”
কাঁদিতে কাঁদিতে শীত বলিলেন,-“ভাই চল, এতদিন পরে আমরা মা’র কাছে যাব।”
খড়গ নামাইয়া রাখিয়া দুই রাজপুত্রের বাঁধন খুলিয়া দিয়া, ছলছল চোখে জল্লাদ বলিল,-“রাজপুত্র! রাজার আজ্ঞা, কি করিব-কোলে-কাঁখে করিয়া মানুষ করিয়াছি, সেই সোনার অঙ্গে আজ কি না খড়গ ছোঁযাইতে হইবে!-আমি তা’ পারিব না রাজপুত্র।-আমার কপালে যা’ থাকে থাকুক, এ বাকল চাদর পরিয়া বনের পথে চলিয়া যাও, কেহ আর রাজপুত্র বলিয়া চিনিতে পারিবে না।”
বলিয়া, শীত-বসন্তকে পথ দেখাইয়া দিয়া, শিয়াল-কুকুর কাটিয়া জল্লাদ রক্ত নিয়া রাণীকে দিল।
রাণী সেই রক্ত দিয়া স্নান করিলেন; খিল-খিল করিয়া হাসিয়া আপনার তিন ছেলে কোলে, পাঁচ পাত সাজাইয়া খাইতে বসিলেন।
৪.
শীত-বসন্ত দুই ভাই চলেন, বন আর ফুরায় না। শেষে, দুই ভাইয়ে এক গাছের তলায় বসিলেন।
বসন্ত বলিলেন,-“দাদা, বড় তৃষ্ণা পাইয়াছে, জল কোথায় পাই?”
শীত বলিলে,-“ভাই, এত পথ আসিলাম জল তো কোথাও দেখিলাম না! আচ্ছা, তুমি বস আমি জল দেখিয়া আসি।”
বসন্ত বসিয়া রহিল, শীত জল আনিতে গেলেন।
যাইতে যাইতে, অনেক দূরে গিয়া, শীত বনের মধ্যে এক সরোবর দেখিতে পাইলেন। জলের তৃষ্ণায় বসন্ত না-জানি কেমন করিতেছে,-কিন্তু কিসে করিয়া জল নিবেন? তখন গায়ের যে চাদর, সেই চাদর খুলিয়া শীত সরোবরে নামিলেন।
সেই দেশের যে রাজা, তিনি মারা গিয়াছেন। রাজার ছেলে নাই, পুত্র নাই, রাজসিংহাসন খালি পড়িয়া আছে। রাজ্যের লোকজনের শ্বেত রাজহাতীর পিঠে পাটসিংহাসন উঠাইয়া দিয়া হাতী ছাড়িয়া দিল। হাতী যাহার কপালে রাজটিকা দেখিবে, তাহাকেই রাজসিংহাসনে উঠায়াই দিয়া আসিবে, সে-ই রাজ্যের রাজা হইবে।
রাজসিংহাসন পিঠে শ্বেত রাজহাতী পৃথিবী ঘুরিয়া কাহারও কপালে রাজটিকা দেখিল না। শেষে ছুটিতে যে বনে শীত-বসন্ত, সেই বনে, আসিয়া দেখে, এক রাজপুত্র গায়ের চাদর ভিজাইয়া সরোবরে জল নিতেছে।-রাজপুত্রের কপালে রাজটিকা। দেখিয়া, শ্বেত রাজহাতী অমনি গুঁড়ে বাড়াইয়া শীতকে ধরিয়া সিংহাসনে তুলিয়া নিল।”
“ভাই বসন্ত, ভাই বসন্ত,” করিয়া শীত কত কাঁদিলেন। হাতী কি তাহা মানে? বন-জঙ্গল ভাঙ্গিয়া, পাট-হাতী শীতকে পিঠে করিয়া ছুটিয়া গেল।
৫.
জল আনিতে গেল, দাদা আর ফিরলি না। বসন্ত উঠিয়া সকল বন খুঁজিয়া, “দাদা, দাদা” বলিয়া ডাকিয়া খুন হইল। দাদাকে যে হাতীতে নিয়াছে বসন্ত তো তাহা জানে না; বসন্ত কাঁদিয়া কাঁদিয়া সারা হইল। শেষে, দিন গেল, বিকাল গেল, সন্ধ্যা গেল, রাত্রি হইল; তৃষ্ণায় ক্ষুধায় অস্থির হইয়া দাদাকে হারাইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া বসন্ত এক গাছের তলায় ধুলা-মাটিতে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িল।
দুঃখিনী মায়ের বুকের মাণিক ছাই-পাঁশে গড়াগড়ি গেল!
খুব ভোরে এক মুনি, জপ-তপ করিবেন, জল আনিতে সরোবরে যাইতে, দেখেন, কোন এক পরম সুন্দর রাজপুত্র গাছের তলায় ধুলা-মাটিতে পড়িয়া আছে। দেখিয়া মুনি বসন্তকে বুকে করিয়া তুলিয়া নিয়া গেলেন।
৬.
শ্বেত রাজহাতীর পিঠে শীত তো সেই নাই-রাজার রাজ্যে গেলেন! যাইতেই রাজ্যের যত লোক আসিয়া মাটিতে মাথা ছোঁলাইয়া মন্ত্রী, অমাত্য, সিপাই-সান্ত্রীরা সকলে আসিয়া মাথা নোয়াইল, সকলে রাজসিংহাসনে তুলিয়া নিয়া শীতকে রাজা করিল।
প্রাণের ভাই বসন্ত, সেই বসন্ত বা কোথায়, শীত বা কোথায়! দুঃখিনী মায়ের দুই মাণিক বোঁটা ছিঁড়িয়া দুই খানে পড়িল।
রাজা হইয়া শীত, ধন-রত্ন মণি-মাণিক্য, হাতী-ঘোড়া, সিপাই-লস্কর লইয়া রাজত্ব করিতে লাগিলেন। আ এ-রাজাকে হারাইয়া দিয়া তাহার রাজ্য নেন, কাল ও-রাজাকে হারাইয়া দিয়া তাহার রাজ্য আনেন, আজ মৃগয়া করেন, কাল দিগি¦জয়ে যান, এই রকমে দিন যায়!
মুনির কাছে আসিয়া বসন্ত গাছের ফল খায়, সরোবরের জল নায়, দায়, থাকে। মুনি চারিপাশে আগুন করিয়া বসিয়া থাকেন, কতদিন কাঠ-কুটা ফুড়াইয়া যায়,-বসন্তের পরনে বাকল, হাতে নড়ি, বনে বনে ঘুরিয়া কাঠ-কুটা কুড়াইয়া মুনির জন্য বহিয়া আনে।
তাহার পর বসন্ত বনের ফুল তুলিয়া মুনির কুটির সাজায় আর সারাদিন ভরিয়া ফুলের মধু খায়।
তাহার পর, সন্ধ্যা হইতে-না হইতে, বনের পাখি সব একখানে হয়, কত মন্ত্রের এইসব শোনে। এইভাবে দিন যায়।
রাজসিংহাসনে শীত আপন রাজ্য লইয়া, বনের বসন্ত আপন বন লইয়া;-দিনে দিনে পলে পলে কাহারও কথা কাহারও মনে থাকিল না।
৭.
তিন রাত যাইতে-না-যাইতে সুয়োরাণীর পাপে রাজার সিংহাসন কাঁপিয়া উঠিল; দিন যাইতে-না-যাইতে রাজার রাজ্য গেল। রাজপাট গেল। সকল হারইয়া, খোয়াইয়া, রাজা আর সুয়োরাণীর মুখ দেখিলেন না; রাজা বনবাসে গেলেন।
সুয়োরাণীর যে, সাজা! ছেলে তিনটা সঙ্গে, এক নেকড়া পরনে এক নেকড়া গায়ে, এ দুয়ারে যায়-“দূর, দূর!” ও দূয়ারে যায়-“ছেই, ছেই!!” তিন ছেলে নিয়া সুয়োরাণী চক্ষের জলে ভাসিয়া পথে পথে ঘুরিতে লাগিলেন।
ঘুরিতে ঘুরিতে সুয়োরাণী সমুদ্রের কিনারা গেলেন।-আর সাত সমুদ্রের ঢেউ আসিয়া চরে পলকে সুয়োরাণীর তিন ছেলেকে ভাসাইয়া নিয়া গেল। সুয়োরাণী কাঁদিয়া আকাশ ফাটাইল; বুকে চাপড়, কপালে চাপড় দিয়া, শোকে দুঃখে পাগল হইয়া মাথায় পাষাণ মারিয়া, সুয়োরাণী সকল জ্বালা এড়াইল। সুয়োরাণীর জন্য পিঁপ্ড়াটিও কাঁদিল না, কুটাটুকুও নড়িল না;-সাত সমুদ্রের জল সাত দিনের পথে সরিয়া গেল। কোথায় বা সুয়োরাণী, কোথায় বা তিন ছেলে-কোথাও কিছু রহিল না।
৮.
সেই যে সোনার টিয়া-সেই যে রাজার মেয়ে? সেই রাজকন্যার যে স্বয়ম্বর। কত ধন, কত দৌলত, কত কি লইয়া কত দেশের রাজপুত্র আসিয়াছেন। সভা করিয়া সকলে বসিয়া আছেন, এখনো রাজকন্যার বা’র নাই।
রূপবতী রাজকন্যা আপন ঘরে সিঁথিপাটি কাটিয়া, আল্তা কাজল পরিয়া, সোনার টিয়াকে ডাকিয়া জিঞ্জাসা করিলেন,-
“সোনার টিয়া, বল্ তো আমার আর কি চাই?”
টিয়া বলিল,-
“সাজতো ভাল কন্যা, যদি সোনার নূপুর পাই।”
রাজকন্যা কৌটা খুলিয়া সোনার নূপুর বাহির করিয়া পায়ে দিলেন। সোনার নূপুর রাজকন্যার পায়ে রুনুঝনু করিয়া বাজিয়া উঠিল!
রাজকন্যা বলিলেন,-
“সোনার টিয়া, বল্ তো আমার আর কি চাই।”
টিয়া বলিল,-
“সাজতো ভাল কন্যা, যদি; ময়ূরপেখম পাই!”
রাজকন্যা পেটরা আনিয়া ময়ূরপেখম শাড়ি খুলিয়া পরিলেন। শাড়ির রঙে ঘর উজল শাড়ির শোভায় রাজকন্যার মত উত্তল। মুখখানা ভার করিয়া টিয়া বলিল,-
“রাজকন্যা, রাজকন্যা, কিসের গরব কর;-
শতেক নহর হীরার হার গলায় না পর।”
রাজকন্যা শতেক নহর হীরার হার গলায় দিলেন। শতেক নহরের শতেক হীরা ঝক্-ঝক্ করিয়া উঠিল।
টিয়া বলিল,-
“শতেক নহর ছাই!
নাকে ফুল কানে দুল
সিঁথির মাণিক চাই!”
রাজকন্যা নাকে মোতির ফুলের নোলক পরিলেন; সিঁথিতে মণি-মাণিক্যের সিঁথি পরিলেন।
তখন রাজকন্যার টিয়া বলিল,-
“রাজকন্যা রূপবতী নাম থুয়েছে মায়।
গজমোতি হত শোভা ষোল-কলায়।
না আনিল গজমোতি, কেমন এল বর?
রাজকন্যা রূপবতী ছাইয়ের স্বয়ম্বর!”
শুনিয়া, রূপবতী রাজকন্যা গায়ের আভরণ, পায়ের নূপুর, ময়ূরপেখম, কাণের দুল ছুঁড়িয়, ছিঁড়িয়া, মাটিতে লুটাইয়া পড়িলেন। কিসের স্বয়ম্বর, কিসের কি!
‘সোনার টিয়া, বল্ তো আমার আর কি চাই’
রাজপুত্রদের সভায় খবর গেল, রাজকন্যা রূপবতী স্বয়ম্বর করিবেন না; রাজকন্যার পণ, যে রাজপুত্র গজমোতি আনিয় দিতে পারিবেন, রাজকন্যা তাঁহার হইবেন-না পারিলে রাজকন্যার নফর থাকিতে হইবে।
সকল রাজপুত্র গজমোতির সন্ধানে বাহির হইলেন।
কত রাজ্যের কত হাতী আসিল, কত হাতীর মাথা কাটা গেল-যে-সে হাতীতে কি গজমোতি থাকে? গজমোতি পাওয়া গেল না।
রাজপুত্রেরা শুনিলেন.
সমুদ্রের কিনারে হাতী,
তাহার মাথায় গজমোতি।
সকল রাজপুত্রে মিলিয়া সমুদ্রের ধারে গেলেন।
সমুদ্রের ধারে যাইতে-না-যাইতেই একপাল হাতী আসিয়া অনেক রাজপুত্রকে মারিয়া ফেলিল, অনেক রাজপুত্রের হাত গেল, পা গেল।
গজমোতি কি মানুষে আনিতে পারে? রাজপুত্রেরা পলাইয়া আসিলেন।
আসিয়া রাজপুত্রেরা কি করেন-রূপবতী রাজকন্যা নফল হইয়া রহিলেন।
কথা শীতরাজার কাণে গেল। শীত বলিলেন,-“কি! রাজকন্যার এত তেজ, রাজপুত্রদিগকে নফর করিয়া রাখে। রাজকন্যার রাজ্য আটক কর।”
রাজকন্যা শীতরাজার হাতে আটক হইয়া রহিলেন।
৯.
আজ যায় কাল যায়, বসন্ত মুনির বনে থাকেন। পৃথিবীর খবর বসন্তের কাছে যায় না, বসন্তের খবর পৃথিবী পায় না।
মুনির পাতার কুঁড়ে; পাতার কুঁড়েতে একশুক আর এক সারা থাকে।
একদিন শুক কয়,-
“সারি, সারি! বড় শীত!”
সারী বলে,-
“গায়ের বসন টেনে দিস্।
শুক বলে,-
“বসন গেল ছিঁড়ে, শীত গেল দুরে,
কোনখানে, সারি, নদীর কূল?”
সারি উত্তর করিল,-
“দুধ-মুকুট ধবল পাহাড় ক্ষীর-সাগরের পাড়ে,
গজমোতরি রাঙা আলো ঝর্ঝরিয়ে পড়ে।
আলো তলে পদ্ম-রাতে খেলে দুধের জল,
হাজার হাজার ফুটে আছে সোনা-র কমল।”
শুক কহিল,-
“সেই সোনার কমল, সেই গজমোতি
কে আনবে তুলে’ কে পারে রূপবতী!
শুনিয়া বসন্ত বলিলেন,-
শুক সারী মেসো মাসী
কি বল্ছিস্ বল্,
আমি আনবো গজমোতি
সোনার কমল।”
শুক সারী বলিল,-“আহা বাছা, পারিবি?”
বসন্ত বলিলেন,-“পারিব না তো কি!”
শুক বলিল,-
“তবে, মুনির কাছে গিয়া ত্রিশূলটা চা!”
মুকুট আছে, তাই নিয়া যা।”
বসন্ত মুনির কাছে গেল। গিয়া বলিল,-“বাবা, আমি গজমোতির আর সোনার কমল আনিব, ত্রিশূলটা দাও।”
মুনির ত্রিশূল দিলেন।
মুনির পায়ে প্রণাম করিয়া, ত্রিশূল হাতে বসন্ত শিমুল গাছের কাছে গেলেন। গিয়া দেখিল, শিমুল গাছে কাপড়-চোপড়, শিমুল গাছে রাজমুকুট। বসন্ত বলিলেন,-“হে বৃ, যদি সত্যকারের বৃ হও, তোমার কাপড়-চোপড় আর তোমার রাজমুকুট আমাকে দাও।”
বৃ বসন্তকে কাপড়-চোপড় আর রাজমুকুট দিল। বসন্ত বাকল ছাড়িয়া কাপড়-চোপড় পরিলেন; রাজমুকুট মাথায় দিয়া, বসন্ত ক্ষীর-সাগরের উদ্দেশে চলিতে লাগিলেন।
যাইতে যাইতে বসন্ত কত পর্বত কত বন, কত দেশ-বিদেশ ছাড়াইয়া বার বছর তের দিনে ‘দুধ-মুকুটে’ ধবল পাহাড়ের কাছে গিয়া পৌঁছিলেন। ধবল পাহাড়ের মাথায দুধের সব থক্ থক্ ধবল পাহাড়ের গায়ে দুধের ঝর্ ঝর্ ; বসন্ত সেই পাহাড়ে উঠিলেন।
উঠিয়া দেখিলেন, ধবল পাহাড়ের নিচে ক্ষীরের সাগর-
ক্ষীর-সাগরে ক্ষীরের ঢেউ ঢল্ ঢল্ করে-
লক্ষ হাজার পদ্ম ফুল ফুটে আছে থরে।
ঢেউ থই থই সোনার কমল, তারি মাঝে কি?-
দুধের বরণ হাতীর মাথে-গজমোতি।
বসন্ত দেখিলেন, চারিদিকে পদ্মফুলের মধ্যে দুধবরণ হাতী দুধের জল ছিটাইয়া খেলা করিতেছে-সেই হাতীর মাতায় গজমোতি।-সোনার মতন মণির মতন, হীরার মতন গজমোতির জ্বল্জ্বলে আলো ঝর্ ঝর্ করিয়া পড়িতেছে। গজমোতির আলোতে ক্ষীর-সাগরে হাজার চাঁদের মেলা, পদ্মের বনে পাতে পাতে সোনার কিরণ খেলা। দেখিয়া, বসন্ত অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।
তখন, বসন্ত কাপড়-চোপড় কষিয়া, হাতের ত্রিশূল আঁটিয়া ধবল পাহাড়ের উপর হইতে ঝাঁপ দিয়া গজমোতির উপরে পড়িলেন।
অমনি ক্ষীর-সাগর শুকাইয়া গেল, পদ্মের বন শুকাইয়া গেল; দুধ-বরণ হাতী এক সোনার পদ্ম হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,-
“কোন্ দেশের রাজপুত্র কোন্ দেশে ঘর?”
বসন্ত বলিলেন,-“বনে বনে বাস, আমি মুনির কোঙর।”
পদ্ম বলিল,-“মাথে রাখ গজমোতি, সোনার কমল বুকে,
রাজকন্যা রূপবতী ঘর করুক সুখে!”
বসন্ত সোনার পদ্ম তুলিয়া বুকে রাখিলেন, গজমোতি, গজমোতি তুলিয়া মাথায় রাখিলেন। রাখিয়া,ক্ষীর-সাগরের বালুর উপর দিয়া বসন্ত দেশে চলিলেন।
অমনি ক্ষীর-সাগরের বালুর তলে কাহারা বলিয়া উঠিল,-“ভাই, ভাই! আমাদিগে নিয়া যায়।”
বসন্ত ত্রিশূল দিয়া বালু খুঁড়িয়া দেখিলেন, তিনটি সোনার মাছ! সোনার মাছ তিনটি লইয়া বসন্ত চলিতে লাগিলেন।
বসন্ত যেখান দিয়া যান, গজমোতির আলোতে দেশ উজ্জ্বল হইয়া ওঠে। লোকেরা বলে,-“দেখ, দেখ, দেবতা যায়।”
বসন্ত চলিতে লাগিলেন।
১০.
শীত রাজা মৃগয়ায় বাহির হইয়াছেন। সকল রাজ্যের বন খুঁড়িয়া, একটা হরিণ যে, তাহাও পাওয়া গেল না। শীত সৈন্য-সামন্তের হাতেঘোড়া দিয়া এক গাছতলায় আসিয়া বসিলেন।
গাছতলায় বসিতেই শীতের গায়ে কাঁটা দিল। শীত দেখিলেন, এই তো সেই গাছ! এই গাছের তলায় জল্লাদের কাছ হইতে বনবাসী দুই ভাই আসিয়া বসিয়াছিলেন, ভাই বসন্ত জল চাহিয়াছিল, শীত জল আনিতে গিয়াছিলেন। সব কথা শীতের মনে হইল,-রাজমুকুট ফেলিয়া দিয়া, খাপ তরোয়াল ছুঁড়িয়া দিয়া, শীত, “ভাই বসন্ত!” “ভাই বসন্ত!” করিয়া ধুলার লুটাইয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
সৈন্য-সামন্তেরা দেখিয়া অবাক! তাহারা দোল চৌদোল আনিয়া রাজাকে তুলিয়া রাজ্যে লইয়া গেল।
১১.
গজমোতির আলোতে দেশ উজ্জ্বল করিতে করিতে বসন্ত রূপবতী রাজকন্যার দেশে আসিলেন।
রাজ্যের লোক ছুটিয়া আসিল,-“দেখ, দেখ, কে আসিয়াছেন!’
বসন্ত বলিলেন,-“আমি বসন্ত, ‘গজমোতি’ আনিয়াছি।”
রাজ্যের লোক কাঁদিয়া বলিল,-“এক দেশের শীত রাজা রাজকন্যাকে আটক করিয়া রাখিয়াছেন।
শুনিয়া, বসন্ত শীত রাজার রাজ্যের গিয়া, তিনি সোনার মাছ রাজাকে পাঠাইয়া দিয়া বলিলেন-“রূপবতী রাজকন্যার রাজ্যে দুয়ার খুলিয়া দিতে আজ্ঞা হউক!”
সকলে বলিলেন-“দেবতা, গজমোতি আনিয়াছেন। তা, রাজা আমাদের ভাইয়ের শোকে পাগল; সাত দিন সাত রাত্রি না গেলে তো দুয়ার খুলিবে না।” ত্রিশূল হাতে, গজমোতি মাথায় বসন্ত, দুয়ার আলো করিয়া সাত দিন সাত রাত্রি বসিয়া রহিলেন।
আট দিনের দিন রাজা একটু ভাল হইয়াছেন, দাসী গিয়া সোনার মাছ কুটিতে বসিল। অমনি মাছেরা বলিল,-
আশে শাই, চোখে ছাই,
কেটো না কেটো না মাসি, রাজা মোদের ভাই!”
দাসী ভয়ে বটী-মটি ফেলিয়া, রাজা কাছে গিয়া খবর দিল।
রাজা বলিলেন,-“কৈ কৈ! সোনার মাছ কৈ?
সোনার মাছ যে এনেছে সে মানুষ কৈ?”
রাজা সোনার মাছ নিয়া পড়িতে পড়িতে ছুটিয়া বসন্তের কাছে গেলেন। দেখিয়া বসন্ত বলিলেন,-“দাদা!
শীত বলিলেন,-“ভাই!”
হাত হইতে সোনার মাছ পড়িয়া গেল; শীত, বসন্তের গলা ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। দুই ভাইয়ের চোখের জল দর দর করিয়া বহিয়া গেল।
শীত বলিলেন,-“ভাই সুয়ো-মার জন্যে দুই ভাইয়ের এতকাল ছাড়াছাড়ি।”-তিনটি সোনার মাছ তিন রাজপুত্র হইয়া, শীত বসন্তের পায়ে প্রণাম করিয়া বলিল,-“দাদা, আমরাই অভাগী সুয়োরাণীর তিন ছেলে; আমাদের মুখ চাহিয়া মায়ের অপরাধ ভুলিয়া যান।”
শীত বসন্ত, তিন ভাইকে বুকে লইয়া বলিলেন,-“সে কি ভাই, তোমরা এমন হইয়া ছিলে! সুয়ো-মা কেমন, বাবা কেমন?”
তিন ভাই বলিল,-“সে কথা আর কি বলিব,-বাবা বনবাসে, মা মরিয়া গিয়াছেন; আমরা তিন ভাই ক্ষীর-সমুদ্রের তলে সোনার মাছ হইয়া ছিলাম।”
শুনিয়া শীত-বসন্তের বুক ফাটিল; চোখের জলে ভাসিতে ভাসিতে গলাগলি পাঁচ ভাই রাজপুরী গেলেন।
১২.
রাজকন্যার সোনার টিয়া পিঞ্জরে ঘোরে, ঘোরে আর কেবলি কয়-
“দুখিনীর ধন
সাত সমুদ্র ছেঁচে’ এনেছে মাণিক রতন!”
রাজকন্যা বলিলেন,-“কি হয়েছে, কি হয়েছে আমার সোনার টিয়া!”
টিয়া বলিল-“যাদু আমার এল, কন্যা গজমোতি নিয়া!”
সত্য সত্যই; দাসী আসিয়া খবর দিল, শীত রাজার ভাই রাজপুত্র যে, গজমোতি আনিয়াছেন।
শুনিয়া রাজকন্যা রূপবতী হাসিয়া টিয়ার ঠোঁটে চুমু খাইলেন। রাজকন্যা বলিলেন,-“দাসী লো দাসী, কপিলা গাইয়ের দুধ আন্, কাঁচা হলুদ বাটিয়া আন্; আমার সোনার টিয়াকে নাওয়াইয়া দিব!”
দাসীকে দুধ-হলুদ আনিয়া দিল। রাজকন্যা সোনা রূপার পিঁড়ী, পাট কাপড়ের গামছা নিয়া টিয়াকে স্নান করাইতে বসিলেন।
হলুদ দিয়া নাওয়াইতে-নাওয়াইতে রাজকন্যার আঙ্গুলে লাগিয়া টিয়ার মাথার ওষুধ বড়ি খসিয়া পড়িল।-অমনি চারিদিকে আলো হইল, টিয়ার অঙ্গ ছাড়িয়া দুয়োরাণী দুয়োরাণী হইলেন।
মানুষ হইয়া দুয়োরাণী রাজকন্যাকে বুকে সাপটিয়া বলিলেন,-“রূপবতী মা আমার! তোরি জন্যে আমার জীবন পাইলাম।” থতমত খাইয়া রাজকন্যা রাণীর কোলে মাথা গুঁজিলেন।
রাজকন্যা বলিলেন,-“মা, আমার বড় ভয় করে, তুমি পরী, না দেবতা, এতদিন টিয়া হইয়া আমার কাছে ছিলে?”
রাণী বলিলেন,-“রাজকন্যা, শীত আমার ছেলে, গজমোতি যে আনিয়াছে, সেই বসন্ত আমার ছেলে।”
শুনিয়া রাজকন্যা মাথা নামাইল।
১৩.
পরদিন রূপবতী রাজকন্যা শীত রাজাকে বলিয়া পাঠাইলেন,-“দুয়ার খুলিয়া দিন, গজমোতি যিনি আনিয়াছেন তাঁহাকে গিয়া বরণ করিব।
রাজা দুয়া খুলিয়া দিলেন।
বাদ্য-ভান্ড করিয়া রূপবতী রাজকন্যার পঞ্চ চৌদোলা শীত রাজার রাজ্যে পৌঁছিল। শীত রাজার রাজদুয়ারে ডঙ্কা বাজিল, রাজপুরীতে নিশান উড়িল,-রূপবতী রাজকন্যা বসন্তকে বরণ করিলেন।
শীত বলিলেন,-“ভাই আমি তোমাকে পাইয়াছি, রাজ্য নিয়া কি করিব? রাজ্য তোমাকে দিলাম।” রাজপোশাক পরিয়া সোনার থালে গজমোতি রাখিয়া, বসন্ত, শীত, সকলে রাজসভায় বসিলেন। রাজকন্যার চৌদোলা আসিল। চৌদোলায় রঙ্ বেরঙের আঁকন, ময়ূরপাখার ঢাকন। ঢাকন খুলিতেই সকলে দেখে, ভিতরে, এক যে স্বর্গের দেবী, রাজকন্যা রূপবতীকে কোলে করিয়া বসিয়া আছেন!
রম্রমা সভা চুপ করিয়া গেল!
স্বর্গের দেবীর চোখে জল ছল্-ছল্, রাজকন্যাকে চুমু খাইয়া চোকের জলে ভাসিয়া স্বর্গের দেবী ডাকিলেন,-“আমার শীত বসন্ত কৈ রে!”
রাজসিংহাসন ফেলিয়া শীত উঠিয়া দেখিলেন,-মা! বসন্ত উঠিয়া দেখিলেন,-মা! সুয়োরাণীর ছেলেরা দেখিলেন,-এই তাঁহাদের দুয়ো-মা! সকলে পড়িতে পড়িতে জুটিয়া আসিলেন।
তখন রাজপুরীর সকলে একদিকে চোখের জল মোছে, আর একদিকে পুরী জুড়িয়া বাদ্য বাজে।
শীত বসন্ত বলিলেন,-“আহা, এ সময় বাবা আসিতেন, সুয়ো-মা থাকিতেন!” সুয়ো-মা মরিয়া গিয়াছে, সুয়ো-মা আর আসিল না; সকল কথা শুনিয়া বনবাস ছাড়িয়া রাজা আসিয়া শীত বসন্তকে বুকে লইলেন।
তখন রাজার রাজ্য ফিরিয়া আসিল, সকল রাজ্য এক হইল, পুরী আলো করিয়া রাজকন্যার গলায় গজমোতি ঝল্মল্ করিয়া জ্বলিতে লাগিল। দুঃখিনী দুয়োরাণীর দুঃখ ঘুচিল। রাজা, দুয়োরাণী, শীত, বসন্ত, সুয়োরাণী তিন ছেলে, রূপবতী রাজকন্যা-সকলে সুখে দিন কাটাইতে লাগিলেন।