শ্যামাবতী

শ্যামাবতী

বৈশাখের প্রারম্ভ হয় ঝড় বৃষ্টি দিয়া।আজ প্রভাত হইতেই গগনে মেঘের আনাগোনা। শ্যামাবতীর মনখানা মেঘ দেখিয়া বড়ই চঞ্চল হইয়া উঠিল। শ্যামাবতীর বাপজান ডাক্তার হরিচন্দ্র বাবু যে এখনও বাড়ি ফেরে নাই।
শ্যামা ঘর হইতে উঠান – উঠান হইতে ঘর পায়চারি করিতেছিল।
এমন সময় পশ্চাৎ হইতে একটি পুরুষ কণ্ঠ কহিয়া উঠিল,
-কীরে শ্যামা এত অস্থির হইয়া আছিস কেন?”
-ও গোপী দাদা!তুমি আসিয়াছ! দেখ না বাপজান সেই সূর্যোদয়ের প্রথম প্রহরে বাহির হইয়াছেন, এখনও ফিরিবার নাম নাই। অম্বরখানা মেঘে ঢাকা, সাথে আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটাও দেখা যাইতেছে।”
-আচ্ছ তুই চুপ করিয়া একটু বস দেখি। আমি যাইতেছি কাকাজানরে খুঁজিয়া লইয়া আসিতেছি।”
-কীরে গোপী কাহারে খুঁজিবার কথা হইতেছে?”
– ও কাকাজান আসিয়া পড়িয়াছেন। আপনারে খুঁজিবার কথাই হইতেছিল। আমি মাঠ হইতে বাড়ি ফিরিতে ছিলাম। আপনাদের বাড়ির দিকে চোখ বুলাইতেই, দেখিতে পাইলাম শ্যামা অস্থির হইয়া উঠানে পায়চারি করিতেছে। তাহা দেখিয়া আমি শ্যামারে তাহার অস্থিরতার কারণ শুধাইলাম। শ্যামা কহিল, আপনি বাড়ি ফেরেন নাই।”
-বাপজান তুমি কহো এত বেলা কই ছিলা? আমার বুঝি চিন্তা হয় না! মাথাখানাও দেখিতাছি ভিজাইয়া লইয়া আসিয়াছ! লও গামছা দিয়া আগে মাথাখান মুছিয়া লও।”
— দেও আমার বুড়ি মা মাথাখানা মুছিয়া লই।”
মাথা মুছিতে মুছিতে হরিচন্দ্র বাবু কহিলেন,
-আমি বাড়ি ফিরিতে ছিলাম। এমন সময় জমিদার বাবুর পেয়াদাদের সাথে সাক্ষাৎ হইল। তাহারা কহিল, ডাক্তার বাবু আপনার কাছেই যাইতে ছিলাম। দু’দিন আগে শহর হইতে আমাদের ছোট জমিদার বাবু আসিয়াছেন। কাল দ্বি-প্রহরে যখন বৃষ্টি হইতেছিল, তখন তিনি বৃষ্টিতে ভিজিয়া জ্বর বাঁধাইয়াছেন।
তাহার জন্য জমিদার বাবু আপনাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন” শুনিয়া শ্যামা কহিল,
-সে তুমি যাহাই কহো না কেন বাপজান, মেঘ দেখিয়া বাড়ি ফিরিবা না!”
বাপবেটির কথার মাঝে গোপী কহিল,
-আচ্ছ কাকাজান আমি তাহা হইলে এখন বাড়ি ফিরিয়া যাই।
ওদিকে আপনার বৌমা আমার জন্য হইত চিন্তা করিতেছেন।”
– আচ্ছা গোপী তুমি তাহা হইলে যাও।”
-মা শ্যামা ভাত দেও, পেটে যে আর ক্ষুধা সহিতেছে না।”
-আচ্ছ বাপজান তুমি হাত, মুখখানা ধুইয়া আসো, আমি ভাত দিতেছি।”

খাওয়া দাওয়া শেষ করিয়া যখন দাওয়াই বসিয়া বাপবেটি গল্প করিতেছিল, তখন আচমকা ঘটক বাবুর আগমন ঘটিল। ঘটক
বাবু কহিলেন,
– ডাক্তার বাবু কন্যা তো ১৮ পার করিয়া দিতেছে। কন্যারে এবার পাত্রস্থ করিয়া দাও। আমার হাতে একখান পাত্র আছে।
বয়স একটু বেশি, একবার বিয়েও করিয়াছিল। তবে পাত্র খারাপ না। জমিজমা আছে তোমার কন্যা রাজরানী হইবে।
তাহাদের বেশি কিছু চাহিবার নাই। একখান বাইসাইকেল আর এক ভরি সোনা দিলেই হইবে। তাছাড়া তোমার কন্যা শ্যামাবতী দেখিতে একেবারেই কৃষ্ণকলি। তাহার জন্য এর চাহিতে ভালো পাত্র তুমি কই পাইবে কহো?”
ইহা শুনিয়া হরিচন্দ্র বাবু রাগান্বিত কণ্ঠে কহিলেন,
– দেখো ঘটক বাবু আমার মা মরা কন্যা শ্যামা হইতে পারে একটু কালো, তবে ভারি মিষ্টি মেয়ে। কন্ঠেও তাহার জাদুময় ছন্দ আছে। তাছাড়া আমার কন্যার পেটে বিদ্যাও ভরপুর।
আমি তোমাকে পূর্বেও কহিয়াছিলাম, আবার ও কহিতাছি, আমি যৌতুক দিয়া আমার কন্যারে পাত্রস্থ করিবো না।”
ঘটক বাবু রাগে গজগজ করিতে করিতে প্রস্থান করিলেন।

গোধুলি লগ্নে মেঘ কাটিয়া গিয়া অম্বর বেশ চকচক করিয়া উঠিল।
হরিচন্দ্র বাবু দাওয়া হইতে উঠিয়া ঘরে গিয়া মাদুরখানা বিছাইয়া গা হেলাইয়া দিলেন। ইহা দেখিয়া শ্যামা কহিল,
– বাপজান এই অবেলায় শুইয়া পড়িলে যে, শরীরখান ঠিক আছে তো?”
-নারে মা তেমন কিছু না। শরীরখান একটু গরম গরম অনুভাব হইতেছে।”
আমি দেখিতেছি বলিয়া শ্যামা তাহার বাপজানের কপালে হাত রাখিয়া কহিল,
-একি বাপজান, জ্বরে না তোমার গা পুড়িয়া যাইতেছে।
আমি এক্ষুণি তোমার জ্বরের ঔষধ দিতেছি।’

ঔষধ খাওয়াই দিয়া শ্যামা পাশে বসিয়া জলপট্টি করিতে লাগিল। ততক্ষণে বাহিরে অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে।
চারিদিক হইতে ভাসিয়া আসিতেছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
জলপট্টি করিতে করিতে শ্যামার চক্ষুদ্বয়ে নিদ্রা আসিয়া ভর করিল।
হঠাৎ ডাক্তার বাবু, ও ডাক্তার বাবু বলিয়া কেহো ডাকিতে শুরু করিলেন। এমন আচমকা ডাকে শ্যামাবতীর ঘুমখানা ভাঙিয়া গেল। শ্যামাবতী বিরক্ত ভাব লইয়া কহিল,
-এই অর্ধেক রাত্রে আবার কে জ্বালাতন করিতে আসিলেন?”
শ্যামা চোখ মিলিয়া দেখিতে পাইলো জমিদার দক্ষিণাচরণ বাবুর পেয়াদা। ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া পাশের মাদুরখানা টান দিয়া বিছাইয়া তাহাকে বসিতে দিলো। শ্যামাবতী উদ্বিগ্ন ভাবে তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। পেয়াদা বিবর্ণ মুখে বিস্ফারিত নেত্রে কহিলেন,
-ছোট জমিদার বাবুর জ্বরখানা বাড়িয়াছে।”
শ্যামা কিঞ্চিৎ সংকোচে কহিল,
-বাপজানের শরীরখান ভালো নাই।”
পেয়াদা অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিলেন,
-ওসব আমি জানিনা। ডাক্তার বাবুকে আমার সঙ্গে যাইতেই হইবে। তাহা না হইলে জমিদার বাবু দু’জনেরই গর্দান লইবেন।”
বাদপ্রতিবাদ কথায় চলে, কিন্তু অসুস্থতায় নহে।
তাই শ্যামা অনুরোধ করিয়া কহিল,
-আমিও তো ডাক্তারি পড়িতেছি, বাপজানের জায়গায় আমি চলিয়া যাই!”
পেয়াদা আর অমত করিল না।
শ্যামাবতী কে সঙ্গে করিয়া প্রাসাদে ফিরিলেন। দাসী শ্যামাবতী কে ছোট জমিদার বাবুর কক্ষে পৌঁছাইয়া দিলেন। শ্যামাবতী কক্ষে প্রবেশ করিয়া অপলক দৃষ্টিতে প্রাণ ভরিয়া ছোট জমিদার বাবুকে দেখিয়া লইল। এমন সুদর্শন পুরুষ যে শ্যামা এ জন্মে দেখে নাই। শ্যামা রাতভর ছোট জমিদার বাবুর সেবাকার্য করিল।
ভোরের আলো ফুটিতেই শ্যামা রক্তজবা ফুল দিয়া কৃষ্ণ দেবতারে গান গাহিয়া পূজা দিয়া ফুলটা লইয়া ছোট জমিদার বাবুর কক্ষে প্রবেশ করিল। ততক্ষণে জানালা দিয়া সূর্যের আভা আসিয়া বাবুর মুখে পড়িয়া ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল। জমিদার দক্ষিণাচরণ বাবু পাশেই বসিয়া ছিলেন। জমিদার বাবু শ্যামাবতীকে দেখাইয়া কহিলেন,
-এ হলো আমাদের ডাক্তার বাবুর কন্যা শ্যামাবতী। শ্যামা নিজেও ডাক্তারি বিদ্যা অধ্যয়ন করিতেছে। এই শ্যামাই রাতভর তোমার সেবাকার্য করিয়া সুস্থ করিয়া তুলিয়াছে। তাছাড়া কিছুক্ষণ পূর্বে তুমি আমাকে শুধাইলে না, এই মিষ্টি গানের গলা কাহার! এই শ্যামাবতীই কৃষ্ণ দেবতারে গান গাহিয়া পূজা দিতেছিল।”
শ্যামা জমিদার বাবুর মুখে তাহার নিজের প্রশংসা শুনিয়া কহিল,
-জমিদার বাবু আমারে আর লজ্জা দিবেন না। কী এমন কন্ঠ আমার!”
ছোট জমিদার বাবু শ্যামাবতী কে কৃতজ্ঞতা জানাইয়া আবদার করিলেন রোজ প্রভাতে তাহাকে গান শুনাইতে হইবে।জমিদারের হুকুম অমান্য করিবার সাধ্য কাহার হইবে? তাই শ্যামাবতী ফুলটা ছোট জমিদার বাবুর কপালে ঠেকাইয়া, মুচকি হাঁসির সহিত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিল।
শ্যামাবতী বাড়ি ফিরিয়া দেখিতে পাইলো তাহার বাপজানও সুস্থ হইয়া গিয়াছেন। সে দিন দ্বি-প্রহর হইতে মুশল ধারে বৃষ্টি শুরু হইল। রাত্রি পর্যন্ত থামিবার নামই লইল না।
ভোরের আভা চারিদিকে ছড়িয়া পড়িতেই বৃষ্টি থামিয়া গেল।
শ্যামাবতী ছুটিলেন জমিদার বাড়ির দিকে। জমিদার বাড়ি পৌঁছাইলে ছোট জমিদার বাবু শ্যামাবতীকে সঙ্গে লইয়া বাহির হইলেন। মাঠ হইতে মাঠ ছুটিয়া বেড়াইলেন তাহারা।
পূর্ব দিনের বৃষ্টি শেষে আজ ক্ষান্তবর্ষণ প্রাতঃকাল ম্লান রৌদ্র ও খন্ড মেঘ মিলিয়া পরিপক্ব প্রায় আউশ ধানের ক্ষেতের উপর পর্যায়ক্রমে আপন আপন সুদীর্ঘ তুলি বুলাইয়া যাইতেছিল সুবিস্তৃত শ্যাম চিত্রপট। একবার আলোকের স্পর্শে উজ্জ্বল পান্ড্রুবর্ণ ধারন করিতেছিল আবার পরক্ষণেই ছায়া প্রলেপে গাঢ় স্নিগ্ধতায় অঙ্কিত হইতেছিল। যখন সমস্ত আকাশ রঙ্গ ভূমিতে মেঘ এবং রৌদ্র, দুইটি মাত্র অভিনেতা আপন আপন অংশে অভিনয় করিতেছিল, তখন সংসার রঙ্গ ভূমিতে ছোট জমিদার বাবু শ্যামাবতীর গানে প্রেমের লীলাভূমিতে খেলা করিতে ছিলেন।
প্রথম যৌবন কালে ছোট জমিদার বাবু সম্মুখে তাহার হরিণী চোখের কোহেলীকে দেখিয়া প্রেমের কুহকে, সুখের আশ্বাসে সমস্ত ভবিষ্যৎ জীবন প্রফুল্ল দেখিতেছিলেন।
কিছু কাল সুখেই কাটিল শ্যামাবতীর সেবা আর প্রেমময় গানে।
ছোট জমিদার বাবু যেন এ পীড়া হইতে মুক্তি পাইতেছিল না।তাই রোজ প্রভাতে শ্যামাবতীকে ডাকিয়া আনিতো।
এইবার জমিদার বাবুর আর বুঝিতে দেরি হইল না যে, ছোট জমিদার বাবুর প্রেম পিড়াই ধরিয়াছে। তাই তিনি ছোট জমিদার বাবুকে ডাকিয়া কহিলেন, প্রেম-পিরিতি ভালোবাসা আমার রাজ্যে চলিবে না। অমন নিচু জাতের কন্যারে আমি আমার জমিদার বাড়ির বৌমা হিসাবে মানিয়া লইতে পাড়িব না।
সেই দিনই ছোট জমিদার বাবু স্থির করিয়া ফেলিলেন শ্যামাবতীকে লইয়া রাজ্য ত্যাগ করিবেন।
সেদিন বৈকালেই ছোট জমিদার বাবু শ্যামাবতীর হাত ধরিয়া এক অজানা পথে গমন করিলেন। সূর্যটা তাহাদের সহিত চলিতে চলিতে ক্লান্ত হইয়া অস্তগমন করিল।
চারিদিকে অন্ধকার আরো ঘনীভূত হইতে লাগিল।
তাই শ্যামাবতীকে বুকে লইয়া, কপালে একটি মিষ্টি চুম্বন বকুল তলার শুভ্র পাথরের বেদীর উপর নিজের বাহুর উপর মাথা রাখিয়া শয়ন করিলেন। মাথার উপর যতটুকু আকাশ দেখা যাইতেছিল একে বারে তারায় আচ্ছন্ন।
তরুতলের ঝিল্লিধ্বনি যেন অনন্ত গগন বক্ষচূত্য নিঃশব্দতার নিম্ন প্রান্তে একটি সরুপাড় বুনিয়া দিতেছিল।
ভোরের আলো ফুটিতেই একটি মন্দিরে গিয়া শ্যামাবতী কে বিবাহ করিলেন ছোট জমিদার বাবু। বিবাহ কার্য সম্পূর্ণ হইবার সঙ্গে সঙ্গে জমিদারের পেয়াদারা তাহাদের ধরিয়া জমিদার বাড়ি লইয়া আসিলেন। জমিদার দক্ষিণাচরণ বাবু শ্যামাবতীকে কারাগারে নিক্ষেপ করিলেন।
ছোট জমিদার বাবু শ্যামাবতীর ভালোবাসা বিহনে পাগল হইয়া গেলেন। তাহাকে সুস্থ করিতে রাজ্যের যত, হাকীম, কবিরাজ, ডাক্তার ছিল সকলে আসিয়া ব্যর্থ হইয়া ফিরিয়া গেলেন।

জমিদার দক্ষিণাচরণ বাবু তাহার এক মাত্র উত্তরাধিকারিকে পাগল অবস্থায় দেখিয়া সহ্য করিতে পারিলেন না।
তিনি শ্যামাবতী কে কারাগার হইতে মুক্ত করিয়া দিলেন।
শ্যামাবতী তাহার প্রেম ভালোবাসা আর আদর দিয়া আবার ছোট জমিদার বাবু কে সুস্থ করিয়া তুলিলো। জমিদার দক্ষিণাচরণ বাবুর অহংকার শ্যামাবতীর ভালোবাসার কাছে হার মানিয়া লইতে বাধ্য হইল।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত