শ্রাবণের জলরঙে আঁকা গল্পে পাঠক, আজ আপনার হৃদয়েও বৃষ্টির বাজনা৷
বৃষ্টির সময় সব থেকে ভাল লাগে প্রেমের গল্প৷ আমি যে গল্পটা বলব, সেটাও প্রেমের গল্প৷ তবে শুধু প্রেম নয়, সঙ্গে খুনও আছে৷ একটা নয়, দুটো খুন৷
অনেকে বলে, আগে থেকে সব বলে দিলে গল্পের ইন্টারেস্ট নষ্ট হয়ে যায়৷ আমার মতে এই থিওরি সবসময়ের জন্য ঠিক নয়৷ আমার এই গল্পের বেলাতে যেমন৷ তাই আগেই বলে নিলাম, গল্পে প্রেমের সঙ্গে খুনও আছে৷ আর আছে বৃষ্টি৷ বৃষ্টি ছাড়া গল্পটা হতই না৷ আমার বিশ্বাস, এই পর্যম্ত পড়ে কোনও কোনও অতিরিক্ত বুদ্ধিমান পাঠক মনে করছেন, তাঁরা ঘটনা ধরে ফেলেছেন৷ ঘনঘোর বর্ষায় টুপি আর লম্বা রেনকোট পরা আততায়ী আসবে৷ দুঃখিত, ঘটনা তেমন ঘটেনি৷ গল্পে খুন হয়েছে বৃষ্টির পর৷ দুটো খুনই তাই৷ বৃষ্টি এখানে নাটকের ব্যাকড্রপ নয়৷ সে খুনের অস্ত্র৷ যাকে বলে উইপন্ অব্ দ্য মার্ডার৷ চমকে যাচ্ছেন? যে বৃষ্টি নিয়ে এত গান, এত কবিতা, এত ছবি, তাকে খুনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে শুনলে চমকে যাওয়ারই কথা৷ আমিও গিয়েছিলাম৷ তবে দোহাই, এটাকে কোনও গোয়েন্দা গল্প মনে করে উত্তেজিত হওয়ার কারণ নেই৷ যতই খুনটুন থাকুক, গল্পটা আদপে একটা প্রেমেরই গল্প৷ বৃষ্টির দিনে প্রেম৷ আসুন, এবার গল্পটা বলি৷ গল্পটা নায়কের মুখ দিয়ে বলব৷ নায়কের নাম অরি৷ অরিজিৎ থেকে অরি৷ ধরে নিন গল্পটা আজকের৷
আকাশ মেঘে মেঘে ভরা৷
শ্রাবণ মাসের আকাশে মেঘ থাকাটাই স্বাভাবিক৷ তবে মেঘ থাকলেই যে সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি হবে এমন কোনও নিয়ম নেই৷ অনেক সময় আকাশের হালচাল দেখে মনে হয়, এই বুঝি হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে৷ নামে না, সময় লাগে৷ আমি চাই, তাই হোক৷ বৃষ্টি নামুক আরও খানিকটা পরে৷ দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর৷ কায়দা করে যাকে বলে, আফটার লাঞ্চ৷ রোজ দুপুরের মতো সেই সময় কণি হাতে একটা বই নিয়ে শোবে৷ অবহেলায় পাতা ওল্টাবে৷ কণির পুরো নাম হল কণিকা৷ আমি আদর করে ‘কণি’ ডাকি৷ ফর্সা, লম্বা, ঘাড় পর্যম্ত কোঁকড়ানো চুলের সুন্দরী কণি আহ্লাদি ধরনের মেয়ে৷ চেহারায় একটা পুতুল ভাব আছে৷ আমার মনে হয় কী জানেন? মনে হয়, পুতুল চেহারার মেয়েরা বেশি আহ্লাদি হয়৷ কণি সুযোগ পেলেই আহ্লাদ করে৷ কী যে ভাল লাগে আমার! আমি যখন তাকে প্রথম ‘কণি’ নামে ডাকি, সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কণি মানে কী!’
আমি বললাম, ‘কণি মানে৷…৷ কণি মানে হল, আমি তোমাকে ভালবাসি৷’
কণি আমার গলা জড়িয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে কান্না কান্না ভান করে বলল, ‘উঃ উঃ….৷ শুধু ভালবাসলে হবে না৷ ভীষণ ভালবাসতে হবে৷ উম্ উম্…’
আমি তার থুতুনি ধরে বলেছিলাম, ‘আচ্ছা খুব ভালবাসলাম৷ হয়েছে?’
কণি পুতুলের মতো চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল, ‘না হয়নি৷ আগে বল কতটা ভালবাস?’
আমি তাকে আরও কাছে টেনে বললাম, ‘ছেলেমানুষ একটা৷ মনেই হচ্ছে না তোমার বয়স পঁচিশ বছর৷ মনে হচ্ছে, পাঁচ বছর৷’
কণি আমার বুকে মাথা রেখে বলল, ‘ছেলেমানুষ তো ছেলেমানুষ৷ আগে বল, আমি তোমাকে যতটা ভালবাসি, তুমি কি আমায় ততটা ভালবাস? বল….৷ বল…’
আমি কণির কপালে চুমু খেয়ে হেসে বললাম, ‘না ততটা বাসি না, একটু কম বাসি৷’
কণি আমার কথায় খুব খুশি হল৷ আমাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর৷ যা-ই হোক, বৃষ্টির কথায় ফিরে আসি৷
বইয়ের দুটো পাতা ওল্টাতে না ওল্টাতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসবে কণির৷ আর তখনই চারপাশ শ্যাওলার মতো অন্ধকার করে, বৃষ্টি নামবে৷ ফিসফিস আওয়াজে আধো জাগা, আধো ঘুমের ভিতর থাকা কণির মনে হবে, বৃষ্টির পুরোটা সত্যি নয়৷ খানিকটা সত্যি খানিকটা মায়া৷ জাগা আর ঘুমের মাঝখানের এই সময়টা এই জন্যই এত মজা৷ ঘুমিয়ে পড়বার বেলাতেও মজা, আবার ঘুম থেকে ওঠবার সময়টাতেও মজা৷ প্রথমবার মনে হয়, ঘুমের ভিতর খানিকটা রিয়েলিটি নিয়ে ঢুকে পড়লাম, আর ঘুম ভাঙার সময় মনে হয়, খানিকটা স্বপ্ন নিয়ে জেগে উঠেছি৷ এই রিয়েলিটি বা স্বপ্ন আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ থাকবে৷ মজার না? সে যা-ই হোক, বৃষ্টির কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই কণির শীত শীত করবে৷ সে হাতের কাছে রাখা চাদর গায়ে টেনে পাশ ফিরবে আরামে৷ জোর বাড়বে বৃষ্টির৷ মেঘ ডাকবে গম্ভীর গলায়৷ পায়ের কাছে আধখোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট ঢুকে কণির চাদর থেকে বেরিয়ে থাকা ফর্সা পায়ের পাতা দেবে ভিজিয়ে৷ গোড়ালিতে বাঁধা নূপুরে জলের বিন্দু উড়ে এসে পড়বে আনমনে৷ চিক চিক করবে৷ নূপুর পরবার জন্য কণিকে আমিই রাজি করিয়েছিলাম৷
‘কণি, তোমার পা দুটো খুব সুন্দর৷ নূপুর পরলে আরও সুন্দর লাগবে৷’
কণি বলল, ‘দূর, আজকাল মেয়েরা নূপুর পরে নাকি! ওসব ঠাকুমা দিদিমাদের আমলে হত৷’
আমি আবদারের গলায় বললাম, ‘তুমি পরবে৷ আমার জন্য পরবে৷ আমি নূপুর এনে দেব৷’
কণি হেসে, আমার গালে হাত রেখে বলল, ‘পাগলামি কোরো না অরি৷’
আমি বললাম, ‘আমার বউয়ের সঙ্গে আমি পাগলামি করব না তো কার সঙ্গে করব? একশোবার পাগলামি করব, হাজারবার পাগলামি করব৷’
ক’দিন পরে কণি নিজেই নূপুর কিনে আনল৷ তবে দুটো নয়, একটা৷ আমি জানতাম না৷ সন্ধেবেলা অফিস থেকে যখন ফিরলাম, কিছু বলেনি৷ দেখলাম রাতে৷ কণিকে আদর করবার সময়৷ ডান পায়ে নূপুর! আমি যে কী খুশি হলাম! বুক ভরে গেল৷ মনে হল, ভালবাসার জন্য কণি সব কিছু করতে পারে৷ নূপুর তো সামান্য৷ পরে বুঝেছি, ঘটনা তাই৷ ভালবাসার জন্য কণি সব কিছু করতে পারে৷ সব কিছু৷
দুপুরে নামা বৃষ্টি ক্রমশ বাড়বে৷ ঝিরঝির থেকে ঘন, তারপর উথালপাতাল বৃষ্টি যাকে বলে৷ চারপাশ কুয়াশার মতো আবছা হয়ে যাবে৷ শন্ শন্ করে বাতাস বইবে৷ আমাদের বাড়ির পিছনের নারকোল গাছগুলো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নাচবে৷ মনে হবে কোথা থেকে গান ভেসে আসছে– ‘আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে৷তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে৷’ আসলে গান আসবে না৷ বৃষ্টির মজাটাই এরকম৷ কোনও কোনও সময় গানের মতো মনে হয়৷ আবার যখন ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে, জানলার শার্সি ঝনঝনিয়ে বাজ পড়ে তখন সব মজা পালায়৷ এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা না বলে পারছি না৷ ঠিক ধরেছেন, ঘটনা আমার আহ্লাদি বউকে নিয়েই৷ তখন সবে আমাদের বিয়ে হয়েছে৷ রাত দশটা বাজতে না বাজতেই খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়ি৷ শুই না হাতির মাথা৷ ঘুমোবার ছুতোয় ঘরে ঢুকে দরজা দিই৷ যদিও বাড়িতে আমরা দুটিই প্রাণী৷ দরজা বন্ধ করা না করার মধ্যে ফারাক ছিল না৷ তবু ঘরের দরজা খোলা থাকলে কণির লজ্জা করত৷ আমি মজা করতাম৷
‘লজ্জা করার কী আছে? বাড়িতে আর কেউ থাকে না৷ কে তোমাকে দেখবে?’
কণি মুখ লাল করে বলত, ‘আগে দরজা বন্ধ কর৷ নইলে কিন্তু আমি চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব৷ ডাকাডাকি করলেও উঠব না৷ নাও এই আমি চাদর টানলাম৷’
আমি হেসে বলতাম, ‘ওরে বাবা! ঠিক আছে ঠিক আছে, দরজা দিয়ে দিচ্ছি৷ কিন্তু তোমার লজ্জার কারণটা বুঝলাম না কণি৷ আমাদের ভালবাসাবাসির দৃশ্য উঁকি মেরে এই বাড়িতে দেখবেটা কে? ভূত? বাড়ি পুরনো হলেও ভূত যে নেই এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত৷ আমার মতো একজন ভূত অবিশ্বাসী মানুষের ধারেকাছে ভূত আসবেও না৷ আর যদি বা থাকে তাতে কি এসে যায়? ভূতে নরনারীর মিলন দেখলে অসুবিধে নেই৷ খুব বেশি হলে হিংসে করতে পারে৷’
কথা শেষ করে আমি জোর গলায় হেসে উঠি৷ কণি আমার পিঠে কিল মারতে মারতে বলে, ‘অসভ্য একটা৷…৷ অসভ্য…’
এই ফাঁকে আমার বাড়ির ব্যাপারটা বলে নিই৷ হাওড়া স্টেশন থেকে এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিটের লোকাল ট্রেনে আমার স্টেশন৷ সেখান থেকে আঠাশ মিনিট গুটুর গুটুর করে স্কুটি চালিয়ে গেলে আমার বাড়ি৷ নামে দোতলা, কিন্তু পারফে’ হিসেব করলে সোয়া একতলা৷ দোতলায় একটা মাত্র ঘর৷ সেই কারণে সোয়া একতলা৷ সেই ঘরের পাশে ছড়ানো নেড়া ছাদ৷ ঘর থেকে বেরোলেই ডান দিকে ছাদে যাওয়ার দরজা৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠলে পড়বে বাঁ হাতে৷ বৃষ্টির জল আটকানোর জন্য ছাদের দরজার সামনে ইঞ্চি ছয়ের উঁচু সিমেন্টের গাঁথনি৷ তবে গাঁথনি ভিতরে চিড় খেয়েছে৷ তেড়ে বৃষ্টি হলে ছাদের জল উপচে পড়ে৷ সিমেন্টের চৌকাঠও লিক করে৷ সিঁড়ি ভাসিয়ে দেয়৷ নেড়া ছাদটা দারুণ৷ বাড়ির ইউ এস পি৷ গাছে গাছে ঘেরা৷ মনে হবে, পর্দা টাঙানো৷ কোনও কোনও পাগলা বাতাসের সন্ধেবেলা মাদুর পেতে বসলে মনে হয়, বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে৷ একটা গোপন কথা বলি৷ বিয়ের পর একরাতে আমি আর কণি ছাদে প্রেম করেছিলাম৷ মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া টাইপ প্রেম৷ দিকবিদিক ভুলে, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে প্রেম৷ ভাগ্যিস আমাদের বাড়ির আশপাশে কোনও বাড়ি নেই৷ নইলে বিরাট কেলেঙ্কারি হত৷ একটা সময়ের পর মনে হল, উড়ছি৷ তারা, নক্ষত্র, মেঘের পাশে উড়ে চলেছি৷ হাত বাড়ালেই তাদের ছুঁতে পারব৷ কণি আমাকে তার ডান হাত মুঠো করে বলল, ‘দ্যাখ এর মধ্যে একটা তারা আছে৷’
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘দেখি দেখি৷’
কণি হাত সরিয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, ‘বয়ে গেছে দেখাতে৷’
আহা রে, সে যে কী সব আনন্দের দিন৷ ছোটখাট মজা, খুনসুটি, ছেলেমানুষির জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম৷
নেড়া ছাদে পাঁচিল দেওয়ার কথা অনেকবার উঠেছে, কিন্তু শেষপর্যম্ত হয়ে ওঠেনি৷ পাছে বাতাস আটকে যায়, পাছে রোদ, জ্যোৎস্না আটকে পড়ে এই ভয়ে সকলেই পিছিয়ে এসেছে৷ আমার ঠাকুর্দা টু আমি৷ ছাদ নেড়াই থেকে গেছে দিনের পর দিন৷ উৎসাহী পাঠক নিশ্চয় আবার গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিয়েছেন? ভাবছেন, গল্প ধরা পড়েছে৷ বৃষ্টিভেজা নেড়া ছাদ থেকে কাউকে ধাক্কা মেরে ফেলা হবে৷ তাই তো? দুঃখিত, আবার ভুল করলেন৷ গল্পে ছাদের সঙ্গে খুনের ডাইরে’ কোনও সম্পর্ক নেই৷ ছাদ থেকে কাউকে ধাক্কা মারা হয়নি৷
বাড়ি আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি৷ পাকাপোক্ত চমৎকার বাড়ি৷ সামনে-পিছনে অনেকটা জমি৷ এই বাড়ি ছেড়ে কলকাতা শহরের কোলাহলে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব৷ ওখানে অফিস করতে যাই তাই যথেষ্ট৷ গিয়ে খালি মনে হয়, ধুলো, ধোঁয়া, চিৎকার, গাড়ির হর্ন থেকে কখন ছাড়া পাব? বিয়ের পর বাড়ি দেখে কণিও খুব খুশি৷ সে-ও মফস্সলের মেয়ে৷ হই-হট্টগোল মোটে পছন্দ করে না৷ দোতলায় বড় ঘরটা আমাদের বেডরুম৷ আমি বললাম, ‘একা থাকতে ভয় করবে না তো কণি?’
কণি বলল, ‘এখনকার দিনে লোকজনকেই তো বেশি ভয়৷ তাছাড়া একা কোথায়, তুমি তো আছ৷’
আমি বললাম, ‘আমি তো আর সবসময় থাকব না৷’
কণি তার চোখ দুটো তুলে অপার বিস্ময়ে বলল, ‘ওমা! থাকবে না কেন৷’
দশ-বারোটা মেয়ে দেখার পর কণিকে আমার পছন্দ হওয়ার কারণ তার চোখ৷ এমন আলতো, নরম, ভালবাসাভরা চোখ আমি কোনও মেয়ের দেখিনি৷ সত্যি কথা বলতে কী, মেয়ে দেখবার সুযোগ আমার জীবনে খুব একটা হয়নি৷ ইচ্ছেও হয়নি৷ ছেলেদের মধ্যেই বড় হয়েছি৷ চাকরিও করি পুরুষমানুষদের সঙ্গে৷ মালিনীদি আমাদের সেকশনের একমাত্র ফিমেল স্টাফ৷ দু’বছর পরেই তার রিটায়ারমেন্ট৷ নিজের মতোই থাকি৷ প্রেমিকা, নায়িকা ধরনের কোনও স্বপ্নের জগতে কখনও ঢুকিনি৷ টুকটাক ম্যাগাজিন, সিনেমা পর্যম্ত যা দৌড়৷ কলেজে পড়বার সময় বিশু আমাকে একবার ভুলিয়ে ভালিয়ে লাইনের ওপারে খারাপ পাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল৷ পালিয়ে বেঁচেছিলাম৷ পাতি, আলুভাতে মার্কা পুরুষ যেমন হয়৷ কণির চোখ দেখে আমার মাথা গেল ঘুরে৷ তাকে দেখতে যাওয়ার দিন হাতে চায়ের কাপ নিয়ে সে যখন চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল, মনে হল, দীর্ঘ পঁচিশ বছর চোখভরা ভালবাসা নিয়ে সে আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল৷ বেরিয়ে আসার পর ঘটক ছোকরাকে বললাম, ‘বিয়ের দিন ফাইনাল করো৷’
ছোকরা বেশি পাকা৷ বলল, ‘আর একটু খোঁজখবর নেবেন না স্যর?’
আমি বললাম, ‘না, নেব না৷’
‘ভেবে দেখুন৷ মেয়ে তো পালিয়ে যাচ্ছে না৷’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘পালানো, না পালানোর কথা আসছে কেন? আমি কি জঙ্গলে শিকার করতে বেরিয়েছি? তোমাকে যা করতে বললাম করো৷ তাছাড়া, খোঁজ নেওয়ার কী আছে? ভদ্রঘরের মেয়ে৷ বি এ পাস করেছে৷ আর কী দেখবার আছে? তুমি দেরি কোরো না৷’
আমার তাড়াহুড়োয় ঘটক ছোকরা মুখ টিপে হাসল৷ হাসুক৷ এরা এইরকমই৷ আমার বাবা-মা নেই, আত্মীয়স্বজনও অতি সামান্য৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগও রাখি না৷ খালি চেনা জানা মেয়ে ঘাড়ে গছিয়ে দেওয়ার তাল করে৷ তাই ঘটকালির জন্য পেশাদার লোক ভাড়া করেছি৷ এখন অবশ্য কেউ কেউ বলবে, ছোকরার পরামর্শ সেদিন শোনা উচিত ছিল৷
কচুর মাথা ছিল৷ ওই ছেলে কি খবর নিয়ে বলতে পারত, কণিকা নামের আলতো, নরম চোখের মেয়ের এক প্রেমিক আছে? সেই প্রেমিক আমার মতো আলুভাতে মার্কা নয়৷ শক্ত সমর্থ, জেলখাটা গুন্ডা৷ আর সেই কারণেই মেয়ের বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করছে? পারত বলতে? বললেই বা কী হত? কণির প্রেমিক একটা কেন, দশটা থাকলেই বা আমার কী? বিয়ের পর আমি দেখেছি সে আমাকে খুবই ভালবাসত৷ পাগলের মতো৷ বলেছি না, মেয়েটার মধ্যে একটা আহ্লাদি ব্যাপার ছিল৷ ঠিক যেন বিড়াল৷ আমার সঙ্গে ঘুর ঘুর করত, আর আদর খাওয়ার জন্য গর গর গর গর করত৷ এই মেয়ের গুন্ডা প্রেমিক না নেতা প্রেমিক তাতে আমার কী?
এই যে অতিরিক্ত বুদ্ধিমান পাঠক, আবার কিছু গেস করতে যাচ্ছেন নাকি? যাবেন না৷ মিলবে না৷ কণির গুন্ডা প্রেমিক কিন্তু কোনও খুনটুনের মধ্যে যায়নি৷ ঘটনা ঘটেছে ভিন্ন৷
যাক, আমার বাড়িতে থাকা নিয়ে কণির প্রশ্ন শুনে আমি তো হেসে বাঁচি না৷ মেয়েটা চায় কী? বিয়ের পর অফিস ছুটি নিয়ে বাড়ি বসে থাকি! বললাম, ‘বাঃ কাজে যাব না!’
পুতুল মেয়ে কণি হাই তুলে বাঁ হাতের চেটো দিয়ে তুলতুলে ঠোঁট মুছল, চোখ আধখানা খুলে, আধখানা বুজে বলল, ‘তাতে কী হয়েছে৷ অফিস গেলে তুমি বুঝি আমার কাছে থাক না৷ সবসময় তুমি আমার এখানে থাকবে৷’ ডান হাত দিয়ে বুকের ঠিক মাঝখানটা দেখাল কণি৷
আমার মনে পড়ে, সেদিন জুতোটুতো পরে বেরোনোর জন্য তৈরি হওয়ার পরও অফিস যাইনি৷
প্রথম দিনই কণিকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালাম৷ বললাম, ‘বাড়ি পছন্দ হয়েছে৷’
কণি ঘাড় কাত করে বলল, ‘খুব পছন্দ হয়েছে৷ আমি তো মোটে দেড় কামরা ফ্ল্যাটে থাকতাম৷ তবে দু’একটা জিনিস বদলাতে হবে৷ দোতলায় ওঠবার সিঁড়িটা আর কেমন যেন খাড়াই৷ উঠতে ভয় করল৷ মনে হল, পড়ে না যাই৷’
আমি হেসে বললাম, ‘এই একটা ঝামেলা৷ পুরনো বাড়িতে সিঁড়ির স্টেপগুলো বড় বড় হয়৷ এই সিঁড়ি থেকে পড়ে আমার মা একবার কোমর ভেঙেছিলেন৷ প্রথম প্রথম সাবধানে ওঠানামা করবে৷ আলো জ্বেলে নেবে৷ চিম্তা কোরো না, বাড়ির অনেক কিছু আমি বদলে দেব৷’
সত্যি সত্যি আমি বাড়িতে অনেক কাজ করালাম৷ নেড়া ছাদে পাঁচিল দিলাম৷ কণির কথাতেই দিলাম৷ তার নাকি ভয় করে৷ তাছাড়া আজ বাদে কাল বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা এলে কী হবে? ছাদের এক কোণায় বাথরুম বানালাম৷ তার মাথায় জলের ট্যাঙ্ক বসালাম৷ কণির শাওয়ারে স্নান করবার শখ৷ বেডরুমে কণি নিজে দাঁড়িয়ে রঙ করাল৷ একতলায় রান্নাঘরে টাইলস বসল৷ গেস্টরুম সাজানো হল৷ কণি বলল, ‘এখন থেকে বন্ধুবান্ধব, আমার বাড়ির লোক কেউ এলে গেস্টরুমে থাকবে৷ ওপরের বেডরুমে নট অ্যালাউড. এখানে শুধু তুমি আর আমি৷’
পরে জেনেছি, গুন্ডা প্রেমিককেও ওপরে উঠতে দিত না কণি৷ আমি অফিসে চলে গেলে সে এসে কণির সঙ্গে নিচেই থাকত৷
দেখেছেন, কী কাণ্ড. কথায় কথায় বাজ পড়া নিয়ে মজার ঘটনাটাই বলতে ভুলে গিয়েছি৷ হল কী, একদিন রাতে…৷ থাক, স্বামী-স্ত্রীর সব মজার গল্প ফাঁস করা ঠিক নয়৷ আগের কথা অনেক হল, এবার আসুন, আজ কী হচ্ছে দেখি৷
এই দেখুন, বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ হুড়মুড়িয়ে নেমেছে৷ আহা! ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম৷ কণির দুপুরের খাওয়ার পর৷ এবার ভেসে যাক সব৷ কণি মোবাইলে কার সঙ্গে কথা বলছে? নিশ্চয় ওই গুন্ডা বেটা৷ বেটাকে ধমকাচ্ছে মনে হচ্ছে!
‘সে কী আজও দেরি হবে? কেন? উফ্ বিজনেস, বিজনেস আর বিজনেস….৷ আমি কেউ নই? ক’দিন আগেও তো আমাকে একমুহূর্ত পাওয়ার জন্য হাঁকপাক করতে৷…৷ করতে না? ….৷ এখন সবসময়ের জন্য হাতের মুঠোয় পেয়ে হেলাফেলা করছ….৷ নাকি বাইরে নতুন কেউ জুটেছে….৷ আমার সঙ্গে বেশি খেলতে যেও না চাঁদ….৷ জানই তো আমি সহজ মেয়ে নই….৷ নাকি জান না৷…৷ আগের মতো দেড় কামরা নয়, এখন আমি বড় বাড়ির মালিক৷…৷ জমি আছে….৷ এখন আমার….৷ অ্যাই শোন, ওইসব বিয়েফিয়ের ঝুটঝামেলায় আমি আর নেই….৷ আমায় বিয়ে করে এই বাড়ি হাতিয়ে নেওয়ার প্ল্যান থাকলে সে গুড়ে বালি….৷ বাড়ি ফিরলে তোমার সঙ্গে ফয়সালা আছে…’
হ্যাঁ, ধমকাচ্ছে৷ ঠিক করেছে৷ হারামজাদাটাকে ধমকানোই উচিত৷ বিয়ে না করলেও এক বছর হল কণির সঙ্গে আছে, বেটা মেয়েটাকে এরমধ্যেই একা ফেলে রাখতে শুরু করেছে৷ ছিঃ ছিঃ৷
ওই তো কণি বই নিয়ে খাটে শুয়েছে৷ গায়ে ফুলকাটা চাদর৷ আমাদের বিয়ের চাদর৷ বৃষ্টির দুপুরে কণির মুখটা যেন আরও সুন্দর হয়ে গেছে! কেমন একটা মন কেমন করা সুন্দর৷ আচ্ছা, বৃষ্টির দিনে মেয়েদের কি বেশি সুন্দর লাগেঞ্জ মনে হয় না৷ আমি একটা আলুভাতে মার্কা পুরুষ বলেই এই সব নেকা নেকা কথা ভাবছি৷ থাক, কণি ঘুমিয়ে পড়ুক৷ বৃষ্টির ঝমঝম গানে, ঠান্ডা হাওয়ার বাজনায় গভীর ঘুমে ডুবে যাক মেয়েটা৷ আর বাইরেটা ভেসে যাক৷
আসুন, এবার একটা কাজ সেরে ফেলা যাক৷ ছাদের জল বেরোনোর পথগুলো ইট, কাপড় দিয়ে আটকে ফেলি৷ এতে কী হবে? কী আর হবে, ছাদে জল জমবে৷ দরজার কংক্রিটের চৌকাঠ টপকে সেই জল ভিতরে ঢুকবে৷ কুল কুল করে নেমে যাবে আমার লাল সিমেন্টের খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে৷ সিঁড়ি হয়ে উঠবে পিছল৷ আনাচে-কানাচে জলও জমে থাকবে৷ সন্ধের পর কণি ঘুম থেকে যখন উঠবে, তখন বৃষ্টি যাবে থেমে৷ শুধু বিদ্যুতের আলো চমকে চমকে উঠবে৷ গুন্ডা প্রেমিককে ধমক এবং শীত শীত ঘুম দিয়ে কণির মেজাজ থাকবে ফুরফুরে৷ বলা যায় না, গুন গুন করে গানও গাইতে পারে৷ চা বানাবার জন্য নিচে নামবার আগে সিঁড়ির আলোটা জ্বালতে যাবে সে৷ পারবে না৷ শুধু সিঁড়িতে নয়, গোটা বাড়িতেই তখন আলো নিভে থাকবে৷ সেই সময় আমি মেইন সুইচ দেব বন্ধ করে৷ অন্যমনস্ক, চিম্তিত, কণি সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে এবং পা পিছলে ব্যালান্স হারাবে…৷ পা পিছলোন জোরদার করতে সিঁড়িতে বৃষ্টির জলের ওপর খানিকটা গুঁড়ো সাবান ছড়িয়ে দেব৷ ভাল হবে না? ব্যালান্স হারাবার পর কণি ডান হাতে দেওয়াল এবং বাঁ হাত দিয়ে সিঁড়ির পাশটা ধরতে যাবে৷ সিঁড়ির একপাশে আমি অনেকটা তেল লাগিয়ে রাখব৷ কণির ড্রেসিং টেবিল থেকে কৌটো এনে ক্রিমও দিতে পারি৷ এতে কণির হাত যাবে হড়কে৷ ধাক্কা খেতে খেতে কণি প্রথমে পড়বে সিঁড়ির ফার্স্ট ল্যান্ডিং-এ, তারপর দুমড়েমুচড়ে, বেঁকেতুবড়ে একেবারে নিচে৷ আমি নিশ্চিত, এই ‘দুর্ঘটনা’য় ওর স্পাইনাল কর্ডের এক নম্বর হাড়টা ভেঙে শ্বাসনালিতে ঢুকবে৷ মিনিটখানেকের ছটফটানি৷ ব্যস, ফিনিশ৷ তারপর কণি, আমার কণি, আমরা আহ্লাদি, সুন্দরী বউ আমার কাছে চলে আসবে৷
আপনি বলতে পারেন, বিনা ধাক্কায় সিঁড়ি থেকে ফেলে খুনের ব্যাপারটা আমার মাথায় এল কোথা থেকে? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে৷ কণি তিনদিন আমার ওপর অ্যাটেম্পট নিয়েছিল৷ ঠিক একবছর আগে এরকম ভরা বর্ষায় ছাদের দরজা খুলে সিঁড়িতে জল ফেলেছিল৷ আমি প্রথম দু’দিন সামলে নিয়েছিলাম৷ তৃতীয় দিনটা পারিনি৷ সেদিন বৃষ্টির জলে সাবান, শ্যাম্পুর মতো কিছু একটা মিশিয়েছিল৷ দিনটা ছিল রবিবার৷ কণির পাশে শুয়ে ঘুমোনোর পর সন্ধেবেলা ঘুম ভাঙল৷ দেখি ঘরে একা৷ কণি কোথায়? একতলায় নামবার জন্য সিঁড়ির আলো জ্বালাতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম৷ হবই তো৷ কণি যে বাল্ব খুলে রেখেছিল৷ প্রথম স্টেপেই সাবান জলে ব্যালান্স হারিয়েছি৷ সিঁড়ির পাশটা ধরতে গেলে হাত হড়কে গেল৷ কণি সম্ভবত সেখানেও তেল বা শ্যাম্পু ঢেলে রেখেছিল৷ বুঝতে পারলাম আমার এত বছরে চেনা সিঁড়ি কণির হয়ে গেছে৷ সে আমাকে ফেলে দিচ্ছে৷
কণি কি আমাকে মারতে চেয়েছিল? নাকি সারাজীবনের মতো পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল? কে জানে? হয়ত তাই হবে৷ আমি হাসপাতালে সাতদিন লড়াই করে এক বৃষ্টিদিনের সকালে ফট করে গেলাম মরে৷ আর আজ আরেক বৃষ্টির দিনে কণিকে নিতে এসেছি৷ আমি জানি, আমার চেষ্টায় কোনও ভুল হবে না৷
আমি যে কণিকে ভীষণ ভালবাসি৷ যাকে বলে পাগল টাইপ ভালবাসা৷
…………………………………………….(সমাপ্ত)……………………………………………..