বকুল

গল্পটা কোনখান থেকে শুরু করব? আগে থেকে? পরে থেকে? নাকি এখন থেকে? কোনটা হলে ঠিক হবে?
যদি ‘এখন’ থেকে বলি তাহলে শুরুটা একরকম হবে। যদি ‘আগে’ বা ‘পরে’ থেকে বলতে যাই তাহলে হবে অন্যরকম। অনেকে বলে, গল্প যেখান থেকেই ‘শুরু’ হোক না কেন, একই থাকে। আমি মানি না। আমার মনে হয়, গল্পের শুরু গল্প সম্পর্কে একধরনের ধারণা তৈরি করে। সেই ধারণা যেমন ঠিক হতে পারে, আবার ভুলও হতে পারে। সবথেকে বিপদ ঘটে যখন ধারণা হয় বিভ্রান্তিকর। আসল গল্পকে সে গুলিয়ে দেয়।
বিষয়টা কি একটু জটিল হয়ে যাচ্ছে? মনে হচ্ছে, যাচ্ছে। একটা উদাহরণ দিলে খানিকটা সহজ হতে পারে। ধরা যাক, ‘আগে’ থেকে আমার এই গল্প শুরু হল।
আমার স্বামীর নাম রঞ্জন। রোজ অফিসে বেরোনোর সময় সে আমাকে চুমু খায়। আমিও তাকে চুমু খাই। আমি ভাজাভুজি ভালবাসি। রঞ্জন আমার জন্য চপ কাটলেট কিনে বাড়ি ফেরে। দুপুরবেলা খাওয়ার পর শেষপাতে একটু দই পেলে রঞ্জন খুশি হয়। মিষ্টি দই নয়, সাদা দই। আগে কেনা দই খেত। কোনওদিন পেত, কোনওদিন পেত না। এখন আমি নিজেই বাড়িতে দই বসাই। রঞ্জন খুশি মনে খায়। শেষ হওয়ার পরও বলে, ‘আর একটু হবে নাকি?’ আমি জানি ও চাইবে তাই সব সময়েই একটু সরিয়ে রাখি। হেসে বলি, ‘না হবে না। ফুরিয়ে গেছে।’ তারপর এনে দিই।
রঞ্জন প্রায়ই আমার জন্য এটা সেটা কিনে আনে। কোনও দিন শাড়ি, কোনওদিন ব্যাগ, কোনওদিন ইমিটেশনের গয়না। জিনিস ভাল হয় না। কোয়ালিটি বাজে, দাম বেশি। রঞ্জন আহ্লাদি মুখ করে বলে, ‘সুন্দর হয়েছে না?’ আমি হেসে বলি, ‘হ্যাঁ, সুন্দর হয়েছে।’ আমিও রঞ্জনের জন্য কেনাকাটা করি। স্ট্রাইপ শার্ট পরলে ওকে হ্যাণ্ডসাম লাগে। সরু স্ট্রাইপ। আমি ওর জন্য স্ট্রাইপ শার্ট কিনি। পরিয়ে দেখি। এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। আমি কোথাও গেলে রঞ্জন বার বার ফোন করে।
‘বকুল, কোথায় তুমি?’
‘এই তো আসছি।’
‘অনেকক্ষণ থেকেই তো আসছি আসছি বলছো। আসছো কই?’
‘ওরে বাবা, আর একঘন্টার মধ্যে চলে যাব।’
‘একঘন্টা! বল কী! সে তো অনেকক্ষণ। আমি অতক্ষণ একা থাকব?’

কোনও কোনওদিন রঞ্জনও অফিস থেকে ফিরতে দেরি করে। আমি অস্থির হয়ে পড়ি। আজকাল রাস্তাঘাটে কত গোলমাল হয়। এই তো কদিন আগে মুম্বাইতে কী কাণ্ড হল। কলকাতায় হবে না তার কী গ্যারান্টি? চিন্তা হয়। আমি রঞ্জনের জন্য ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। রঞ্জন রাত করে আসে। দরজা খোলার পর, ঘরে ঢুকেই ঘেমো গায়ে আমাকে জাপটে ধরে। আমি ঠেলে সরিয়ে দিই। নাক মুখ কুঁচকে বলি, ‘মাগো! যাও আগে বাথরুমে ঢোকো।’
‘বাথরুম থেকে এলে হবে তো?’
আমি ডান হাত মুঠো করে কিল দেখিয়ে বলি, ‘মার হবে।’
গল্পের এই ‘শুরু’ থেকে কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে, আমার আর রঞ্জনের জীবন সুখে ভালবাসায় একেবারে মাখামাখি। ভবিষ্যতেও আমরা এই মাখামাখি জীবন কাটাব। তাই তো?
গল্পটা কিন্তু মোটেও তা নয়। একেবারেই অন্যরকম। বিয়ের দিন থেকেই রঞ্জনকে আমার অসহ্য লাগতে শুরু করে। স্ত্রীর প্রতি তার এই গদগদ প্রেম দেখলে আমার বমি পায়, মাথায় আগুন জ্বলে। আরও কিছুদিন পর বুঝতে পারি, তাকে আমি ঘৃণা করছি। গল্পের ‘শুরু’ সেটা বুঝতে দেয়নি। সে বিভ্রান্ত করেছে। অনেকক্ষণ ধরে আমার সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা তৈরি করেছে। সেই ধারণা হল, আমি একজন ভাল মেয়ে। চমৎকার বউ। অথচ এই গল্পটাই যদি ‘পরে’ থেকে শুরু হত তাহলে ধারণাটা হত উলটো।
তখন ‘শুরু’টা হত এরকম-
রঞ্জন আজ দেরি করে অফিস থেকে ফিরবে। খানিক আগে সে আমাকে ফোন করেছিল। তার জন্য মোবাইলে ‘অ্যাসাইন টোন’ আলাদা। রবীন্দ্রসঙ্গীত।
‘ওলো, রেখে দে, সখী, রেখে দে – /মিছে কথা ভালবাসা। সুখের বেদনা, সোহাগযাতনা -/বুঝিতে পারি না ভাষা।’

মায়ার খেলার গান। আমার ভাল লাগে না। রঞ্জনের আবার মায়ার খেলা খুব পচ্ছন্দের, সেই কারণেই গানটা রাখা। গানটা জোগাড় করে রিং টোনে লাগিয়ে রঞ্জনকে শোনালাম। রঞ্জন ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তুমি মায়ার খেলার গান রাখলে কেন? তোমার তো মায়ার খেলা পছন্দের নয়!’
আমি হেসে বললাম, ‘তোমার ভাল লাগে তাই।’
রঞ্জনও হাসল। বলল, ‘লাভ কী? আমি তো আর শুনতে পাব না। তোমাকে বাইরে থেকে ফোন করব। বকুল, তুমি বরং এমন ব্যবস্থা কর যাতে গানটা ভেতরে বাজে। আমি ফোন করতে করতে শুনব। আমার ভাল লাগবে।’
আমি গাঢ় গলায় বললাম, ‘না, তোমার ভাললাগাটা আমার কাছে থাকবে। তোমার ভাল লাগার থেকেও সেটা জরুরি।’

মোবাইলে ‘মায়ার খেলা’ বাজল। আমি তাড়াতাড়ি ফোন ধরলাম।
রঞ্জন বলল, ‘আজ আমার ফিরতে রাত হতে পারে বকুল। তুমি খেয়ে নিও।’
আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। দেরি হবে! তাহলে রঞ্জন কি আজ বাড়িতে খাবে না? মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে নিচু গলায় বললাম, ‘তুমি কি খেয়ে আসছো?’
‘না, বাড়ি গিয়ে খাব। বস চেন্নাই থেকে আসছে, এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যাব। ফ্লাইট যদি লেট হয় তাই বলছিলাম।’
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বললাম, ‘ঠিক আছে। তোমার বুকের চিনচিনে ব্যথাটা কেমন আছে?’

রঞ্জন হেসে বলল, ‘দূর, ওটা কিচ্ছু না। অম্বলের ব্যথা। কখন ভ্যানিস হয়ে গেছে।’
‘তাও তুমি ডাক্তার ঘোষকে একটা ফোন করে নাও প্লিজ।’
‘ছাড়ও তো। ডাক্তার লাগবে না।’
এবার আমি রাগের ভান করলাম।
‘তুমি যতক্ষণ না ডাক্তারবাবুকে ফোন করবে ততক্ষণ আমি দু’মিনিট অন্তর অন্তর তোমাকে ফোন করে যাব। তুমি যখন এয়ারপোর্টে তোমার বসকে রিসিভ করতে যাবে, তখনও করব।’
আমার এই উদ্বেগে রঞ্জন খুশি হল। সব স্বামীই চায়, তার শরীরের ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে বউ উদ্বেগ দেখাক। বিষয় যতও তুচ্ছ হবে, উদ্বেগ তত ভাল লাগবে। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে।
‘আচ্ছা, বিপদে ফেললে তো। ডাক্তারবাবুকে কী বলব?’

আমি বললাম, ‘কী আবার বলবে? বলবে, আজ লাঞ্চের পর বুকে একটা পেইন ফিল করছিলাম, কাল সকালে আপনাকে দেখাতে যাব। আপনি যদি মনে করেন, একটা ইসিজি করাব। নাও, এখনই ফোন কর। আমি কিন্তু ঠিক দশ মিনিট পরে ডাক্তারবাবুকে ফোন করে দেখব তুমি অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়েছ কিনা।’
রঞ্জন হেসে বলল, ‘ওরে বাবারে! করছি রে বাবা করছি। বিয়ে করে দেখছি বিরাট ঝামেলায় পড়লাম। বউয়ের জ্বালায় কাজকর্ম সব ডকে উঠল।’
ফোন ছেড়ে আমি সোফায় এলিয়ে পড়লাম। ঠিক দশ মিনিট পর আমি ডাক্তার ঘোষকে ফোন করব। জানতে চাইব, রঞ্জন তাকে ফোন করেছে কিনা। বুকের ব্যথার জন্য অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়েছে কি? তারপর আমি রাগ দেখাব। বলব, ‘জানেন ডাক্তারবাবু, আমি কত করে বললাম, তুমি আজ অফিসে যেও না, ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে এসো। না শুনে অফিস চলে গেল। আমার একটা কথা যদি অ শোনে।’ ডাক্তারকে রঞ্জনের ফোনটা করাটা খুব জরুরি। এটা আমার পক্ষে মোক্ষম একটা যুক্তি তৈরি করবে। অনেকটা অ্যালিবাইয়ের মতো। প্রমাণ হবে, রঞ্জনের বুকে সকাল থেকেই সমস্যা চলছিল। রাতে তার হার্টফেল হঠাৎ হয়নি। সিমটম্‌ ছিল।

আসলে আমি রঞ্জনকে খুন করবার জন্য যে বিষটা ব্যবহার করব সেটার কাজকর্ম বেশ মজার। জিনিসটার কাজ কারবার সব হার্টে। রক্তের সঙ্গে মিশে সটান নিজের লক্ষ্যে পৌঁছোয়। তারপর সেখানকার ধমনিগুলো এক এক করে আটকে দিতে থাকে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে ‘ব্লক’। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম – আমি যেখানে পৌঁছেছি, সেখানে আর কারও আসার অধিকার নেই। হিংসুটে প্রেমিকার মতো। মজার না? দুপুরে রঞ্জনের বুকে হালকা ব্যথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তাকে খুন করার জন্য আজকের দিনটাকে বেছে নিয়েছি। রঞ্জনের বুকের ব্যথা কিছুই নয়, নিছকই অম্বল। একটা জেলুসিল মুখে ফেলতেই ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু ততক্ষণে আমার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, ব্যথাটা কাজে লাগাব। রাতে রঞ্জনের খাবারে বিষ মেশাব। এই কারণেই দেরি করে ফিরবে বলায় চমকে উঠি। তবে বাড়িতে কি খাবে না? তাহলে বিষটা খাওয়াব কী করে? জলে মিশিয়ে খাওয়াতে সমস্যা হবে। এই বিষে একটা হালকা গন্ধ আছে। ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো। সবথেকে সুবিধে পুডিং জাতীয় কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে দিলে। গন্ধ আলাদা করা যায়। আমি ঝুঁকি নেব না। রঞ্জনের জন্য পুডিং-ই করব। রান্নার মাসি চলে গেলে দুধ জাল দেব। এই বিষের খবর অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি। সংগ্রহও করেছি ঝামেলা করে। মানুষ মারার পক্ষে জিনিস চমৎকার। পাকস্থলিতে প্রায় যায় না বললেই চলে। গেলেও দ্রুত রক্তে মেশে। ফলে পোস্টমর্টেমে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। রঞ্জনের এই কেসটায় অবশ্য পোস্টমর্টেম হওয়ার ব্যাপার নেই, ডাক্তার ঘোষকে দিয়ে আমি ডেথ সার্টিফিকেট লিখিয়ে নেব। উনি তো জেনেই যাচ্ছেন, রঞ্জনের হার্টে সমস্যা হয়েছে। হার্টফেল নিয়ে সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। খুনের পর ডাক্তার ম্যানেজ করাটা খুনির জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যদি মৃত্যুটাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করেন, সবটা জলের মতো সরল হয়ে যায়। এই বিষের কারণে হার্টের কাজ পুরোপুরি থামতে মিনিট সাত আট সময় লাগে। শুনেছি, শেষ দিকের সময়টা খুব কষ্টের। রঞ্জনের কষ্ট আমি চোখে দেখতে পারব না। ওই সময়টা আমি থাকব ছাদে। পাশের বাড়ির রজনী মল্লিক খাওয়া দাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে পায়চারি করেন। বৃদ্ধ মানুষ। আমিও হাঁটব আমাদের ছাদে। ভদ্রলোকের সঙ্গে টুকটাক কথা হবে। এটা হবে আমার দ্বিতীয় অ্যালিবাই। রঞ্জনের মৃত্যুর সময় আমি তার ধারে কাছে ছিলাম না। ঘটনাটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য গত তিন সপ্তাহ ধরে আমি মাঝেমধ্যে রাতের দিকে ছাদে এসে রজনী মল্লিকের সঙ্গে কথা বলছি। আজ যখন বলব, তখন রঞ্জন নিচে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করবে। পরিকল্পনা কেমন?

আচ্ছা, এবার গল্পটা সম্পর্কে কেমন ধারণা হচ্ছে? নিশ্চয় মনে হচ্ছে, এটা একটা নিষ্ঠুর মেয়ের গল্প। মেয়েটির নাম বকুল। সে তার স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার সঙ্গে ভালবাসার অভিনয় করেছে। তার কাছে ভালবাসা নামক বস্তুটির কোনও মূল্য নেই। সেই কারণেই ভালবাসা তার অসহ্য লাগে। ভালবাসাকে সে ঘৃণা করে। সেই ঘৃণা এতটাই যে তাকে খুন পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যেতে পারে!
না, এটাও ঠিক হল না। আমি ভালবাসার কাঙাল। সেই ছোটবেলা থেকেই ভালবাসার জন্য ছটফট করেছি। আমার যখন ন’বছর বয়স আমার মা আমাকে আর বাবাকে ছেড়ে চলে যায়। যে লোকটার সঙ্গে যায় তাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। জন্ম থেকেই তার বাড়িতে আসা যাওয়া দেখেছি। বাবার বন্ধু। মানুষটা একদিনের বেশি দুদিন না এলে কান্নাকাটি জুড়তাম। সেই কান্নাকাটি শুনে মা মাঝেমধ্যে রেগে যেত। আমাকে দু’ঘা দিয়ে বলত, ‘একটা বাইরের লোকের জন্য এত সোহাগ কীসের?’ যখন শুনলাম মা সেই ‘বাইরের লোক’এর সঙ্গে চলে গেছে এবং চিঠি লিখে গেছে আর কখনও ফিরবে না তখন এতটাই হকচকিয়ে গিয়েছিলাম যে দুঃখ করতেও পারিনি। প্রথমে আমার বাবা আমাকে আঁকড়ে ধরল। তিনবছর পর, বাবা আবার বিয়ে করল। ঠিকই করল। তখন কী আর এমন বয়স বাবার? বিয়ের স্বাদ পাওয়া পুরুষ মানুষ ঐ বয়সে বিয়ে না করলে নানা সমস্যা হয়। বাবা ঠিকই করেছিল।

কী মনে হচ্ছে? সেই বস্তা পচা গল্প? সেই সৎ মা? সেই সৎ মায়ের অত্যাচার? খেতে না দেওয়া, কাপড় কাচানো, ঘর ঝাঁট দেওয়া? না, একেবারেই তা নয়। আমার সৎ মা মানুষটা ছিলেন ভীষণ ভাল। যত ভাল হলে একটা মানুষকে ভাল বলা যায় তার থেকেও ভাল। ঢলঢলে চেহারায় এক মাথা চুল। চোখ দুটো মায়াকাড়া। একটা বেশ মজার বিষয় ছিল। আমার সৎ মা ছিলেন একজন ‘স্নান বিলাসিনী’ মহিলা। শীত গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই অনেক আয়োজন করে স্নান করতেন। সময়ও নিতেন অনেক। গরমের সময় আগে কল খুলে জল ভরে রাখতেন বালতিতে। ছাদের ট্যাঙ্কের জল গরম, তাই ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা। শীতে আবার জল গরম করে নিতেন। প্রথম দিকে বাইরে থেকে কেটলি করে গরম জল নিয়ে বাথরুমে ঢুকতেন। পরে বাবা একটা ইলেকট্রিক তার কিনে দিল। তারের একদিকে রড। রড বালতিতে জলে ডুবিয়ে সুইচ দিলেই জল গরম হয়ে যেত। স্নান করার আগে আমার সৎ মা বাথরুমের ভেতরেই জল গরম বসাতেন। রোজ তেল সাবান শ্যাম্পু মাখতেন। স্নান শেষ করে বাথরুম থেকে বেরোলে ফুরফুর করে গন্ধ বের হত। তবে এসবই ছোটকথা। বড়কথা হল, উনি আমাকে খুব ভালবাসতেন। সেই ভালবাসা ছিল আমার অসৎ (সৎ-এর উলটো তো অসৎ-ই হয়। তাছাড়া যে মা ন’ বছরের মেয়েকে ছেড়ে পালায় সে অসৎ ছাড়া কী?) মায়ের থেকে অনেক অনেক বেশি। মহিলা আমাকে যেন সর্বক্ষণ হাতের তেলোর মধ্যে রাখতে চাইতেন। জড়িয়ে ধরে খাওয়াতেন, জাপটে ধরে আদর করতেন। নজরে নজরে রাখতেন। চাইতে না চাইতে আমি হাতের কাছে সব পেয়ে যেতাম। জামা, জুতো, খাবার, পড়াই বই, খেলার পুতুল – সব। উনি এমন সব কাণ্ড করতেন যা একজন এগারো বছরের মেয়ের জন্য ছিল বাড়াবাড়ি। ওর শেষ বাড়াবাড়ির গল্পটা বলি। শেষ এই কারনে যে ঘটনাতার কিছুদিনের মধ্যে উনি মারা যান। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। ইলেকট্রিক শক লেগে মৃত্যু। খবরের কাগজে ভাষায় যাকে বলে ‘বিদ্যুৎস্পৃষ্ট’। লোহার বালতির সঙ্গে কী ভাবে যেন জল গরম করার তার জড়িয়ে গিয়েছিল। উনি শক খেয়ে বাথরুমের ভেতরে ছিটকে পড়েন। সমস্যা হল, যেহেতু স্নানে উনি অনেকটা সময় নিতেন, তার মৃত্যুর খবর বুঝতেই অনেকটা দেরি হয়ে যায়। সেই বিকেল। আমার বাবা আবার সেদিন ব্যবসার কাজে সারাদিন কোর্টে ছিলেন। আমি স্কুলে। বাথরুমের দরজা ভেঙে ডেডবডি বের করাটাও একটা সমস্যার ছিল। একেই ইলেকট্রিক কারেন্টের ব্যাপার, তারওপর মহিলার গায়ে কোনও জামা কাপড় ছিল না।

যাই হোক, আসল কথায় আসি। সৎ মা আমাকে নিয়ে কেমন বাড়াবাড়ি করতেন সেই কথা।
রোজই মার স্কুলের টিফিন বক্সে একটা না একটা মিষ্টি থাকত। কখনও সন্দেশ, কখনও দরবেশ, কখনও বড় জিলিপি। একদিন সৎ মা আমাকে মিষ্টি দিতে বুলে গেলেন। টিফিনের সময় দেখি, স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি অবাক হয়ে তার কাছে গেলাম। ওর হাতে মিষ্টির কৌটো, চোখে জল। আমি বললাম, ‘তুমি কাঁদছো কেন?’
উনি বললেন, ‘তোমাকে মিষ্টি দিতে ভুলে গেছি সেই দুঃখে কাঁদছি।’
আমি বললাম, ‘এই তো দিয়ে গেলে, এবার কান্না থামাও।’
উনি চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘থামাতে পারছি না বাবা। তোমাকে যে মিষ্টিটা এস এ দিয়ে যেতে পারলাম, এখন সেই আনন্দে চোখে জল আসছে।’

এরপর থেকেই আমার কেমন যেন হতে লাগল! মহিলা কাছে এলে আমার ভাল লাগত না। শরীরে অস্বস্তি অনুভব করতাম। দমবন্ধ হয়ে আসত। উনি আমাকে আদর করলে মনে হত গলায় কেউ ফাঁস পরিয়ে দিচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম, সুন্দর মানুষটাকে আমি ভয় পাচ্ছি। তাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করলাম। ভালবাসার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম, কিন্তু ভালবাসা সহ্য করতে পারছিলাম না। বিষয়টা কি খুবই অদ্ভুত? না, খুব অদ্ভুত নয়। এই অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে। সে কথায় পরে আসব।
যাই হোক, সৎ মায়ের মৃত্যুর পর আমি ভালবাসার ফাঁস থেকে মুক্ত হলাম।
ও, একটা ছোট কথা বলতে ভুলে গেছি। সেই ভয়ংকর ঘটনার দিন বাথরুম থেকে ডেডবডি সরানোর পুলিশ আবিষ্কার করে, জল গরম করবার ইলেকট্রিক তার এক জায়গায় ছেঁড়া। ব্লেড দিয়ে চিরলে যেমন হয় অনেকটা সেরকম। পুলিশ নিশ্চিত হয়, লোহার বালটির কোনায় ঘষে পুরোনো তার কেটে গেছে। সেখান থেকেই সরাসরি কারেন্ট চলে এসেছে বালতি এবং জলে।

বাবা মাথা নামিয়ে বলতে লাগলেন, ‘উফ্‌, আমি যদি জানতাম… উফ্‌ আমি যদি জানতাম…।’
পুলিশ অফিসার ভাল মানুষ। সহানুভূতির সঙ্গে বললেন, ‘আগে থেকে যদি সব জানা যেত তাহলে তো আর অ্যাক্সিডেন্ট বলে কিছুই থাকত না। দুঃখ করবেন না, যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে।’
প্রথমে আমি একটু ঘাবড়েই ছিলাম। ব্লেডের কথাটা যদি ওঠে। না উঠতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যদিও তেমন চিন্তার কোনও কারণ ছিল না। কারণ জ্যামিতি বক্সে রাখা ব্লেডটা আমি স্কুলের ডাস্টবিনেই ফেলে এসেছি। ভগবান আমাকে যেমন অনেক কিছু দেননি, তেমন আবার অনেক কিছু দিয়েছেনও। ছোট থেকেই আমি লেখাপড়া পছন্দ করি। নিজের ক্লাসের থেকেও বড়দের বই ঘাঁটি। অঙ্ক, বিজ্ঞান আমার প্রিয় বিষয়। ত্রিভুজের কোন, বৃত্তের ব্যাসার্ধ নিয়ে পড়ে থাকতে আমার ভাল লাগে। ভাল লাগে, আলোর ছোটাছুটি, শব্দের প্রতিধ্বনি, ইলেকট্রিক কারেন্টের কেরামতি জানতে। লোহা আর জলের মধ্যে দিয়ে গেলে বিদ্যুৎ যে মানুষ মারতে পারে তা আমি বই পড়েই জেনেছি। দুনিয়ার ভাল কথা সব বইতেই লেখা থাকে। ব্লেডের দুশ্চিন্তা কেটে গেলে আমি হালকা মনে সৎ মায়ের জন্য অনেকটা সময় ধরে কাঁদতে পারলাম।

যাই হোক, একটা জরুরি কথা বলতে গিয়ে অনেক হাবিজাবি কথায় চলে গেলাম। তাহলে একটা জিনিস প্রমাণিত হল, গল্পের ‘শুরু’ যা-ই বলুক, আমি ভালবাসা, স্নেহ, আদর, যত্ন পাইনি এই ধারণা ঠিক নয়।
এবার ধরা যাক, গল্পটা ‘শুরু’ হল ‘শেষ’ থেকে। তাহলে কেমন হবে?
বেডরুমের দরজাটা ঠেলতেই রঞ্জনকে দেখতে পেলাম। সে খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হাতের বইটা আধখোলা অবস্থায় খসে পড়েছে বুকের ওপর। ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে। আমি পা টিপে টিপে বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এটা নতুন কিছু নয়। বই হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া রঞ্জনের স্বভাব। বিয়ের পর থেকে দেখছি। কিন্তু আজ অন্য দিনগুলোর মতো নয়। আমি জানি, আজ রঞ্জন ঘুমোচ্ছে না। আমি আলতো করে বইটা সরিয়ে নিলাম। নাকের তলায় ডান হাতের চেটোটা পেতে দিলাম। নিঃশ্বাস কী পড়ছে? না পড়ছে না। মুখ তুলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। খাবার পর থেকে ধরলে প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। বিষ কাজ করার পক্ষে অনেক সময়।

আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। আমার পরপর সব ভাবা আছে। মাথা ঠাণ্ডা করে সেগুলো এখন করতে হবে। সবার প্রথমে আমি যে বাটিতে রঞ্জনকে পুডিং খেতে দিয়েছিলাম সেটা ভাল করে ধোবো। শুধু বাটি নয়, পুডিং তৈরির কোনও প্রমাণই বাড়িতে থাকবে না। ইতিমধ্যেই বিষের শিশি আমি বাথরুমের প্যানে খালি করে ফ্ল্যাশ টেনে দিয়েছি। ধোয়াধুয়ির কাজ শেষ হলে ডাক্তার ঘোষকে ফোন করব। ওকে আসতে বলব। তারপর ডাকব পাশের বাড়ির রজনী মল্লিককে। তিনি আসার আগে ফোন করব, ব্যারাকপুরে। রঞ্জনের দিদিকে। তবে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে। এই ফাঁকে দরজা টেনে দিয়ে আর একবার ছাদে ঘুরে এলে কীরকম হয়? না থাক। কাজগুলো মাথা ঠাণ্ডা করে শেষ করি।
রাতে খাওয়ার পর আমি ছাদে গিয়ে হাঁটি। রোজ নয়, মাঝেমধ্যে হাঁটি। যেদিন শরীরটা আনচান করে সেদিন। অনেক সময় শরীর নয়, মনের জন্যও ছাদে হাঁটি। মনটা হয়তো কোনও কারণে বিক্ষিপ্ত, একটু খোলা আকাশের তলায় রইলাম। অবশ্যই খুব শীত বা বৃষ্টিতে এটা সম্ভব হয় না। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকেন রজনী মল্লিক। বুড়ো মানুষ। উনিও রাতে খাওয়ার পর ছাদে ওঠেন। আমার সঙ্গে একটা দুটো কথা হয়। একেবারে সাধারণ কথা। উনি আবার আমাকে ঠাট্টা করে ‘বউমা’ ডাকেন। বুড়ো মানুষ, বেশ লাগে শুনতে।

‘কী বউমা, আজ রান্না কী হয়েছিল?’
‘বেশি কিছু নয়, মেসোমশাই, খুব সামান্য।’
‘সামান্যটাই কী শুনি।’
‘ডাল, তরকারি আর পারশে মাছের একটা ঝোল।’
‘ভেরি গুড। তা আমাদের রঞ্জনবাবু রাতে ভাত খান? নাকি রুটি?’
‘ভাত। দুবেলা ভাত না হলে ওর আবার চলে না মেসোমশাই।’
‘বাঃ, তোমার কর্তাটি তো দেখছি একেবারে মাছে ভাতে বাঙালি হে। হা হা।’
রঞ্জন রাতে আমার ছাদে ওঠা পছন্দ করে না। আবার স্বাস্থ্যের কারণে বারণও করতে পারে না। সে অবশ্য নিজে কখনও ছাদে ওঠে না। খাওয়া হলেই দুম করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আমি ফিরে এসে দেখি কোনওদিন বই পড়ছে। কোনওদিন ঘুমের ভান করে মটকা মেরে পড়ে আছে। আলো নেভালেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আজও আমি ছাদে ছিলাম। অন্য দিনের থেকে বেশি সময়ই ছিলাম। কিন্তু রজনীবাবুকে দেখলাম না। মনটা খচ্‌ খচ্‌ করছিল। আর রজনীবাবুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা জরুরি ছিল। যদি প্রশ্ন ওঠে পুলিশকে বলতে পারবেন, ঘটনার সময় আমি তার সঙ্গে গল্প করছিলাম। গল্পের বিষয় ছিল পারশে মাছের ঝোল। এখন কি একবার ট্রাই নেব? কোনও কারণে হয়তো ভদ্রলোক আজ দেরি করে ডিনার করেছেন। এবার গেলে দেখা হয়ে যেতে পারে। আমি ঘরের আলো নেভানোর আগে, আবার গিয়ে রঞ্জনের বুকের ওপর আলতো করে হাত রাখলাম। না, ধুকপুকুনি নেই। আলো নিভিয়ে, পায়ের কাছে ভাঁজ করে রাখা চাদরটা গায়ে দিয়ে দিলাম।

এই হল গল্পের ‘শেষ’ দিয়ে ‘শুরু’। রঞ্জনের মৃত্যু দিয়ে। সত্যি কথা বলতে কী, এতেও কিন্তু গল্পের প্রতি সুবিচার হল না। সবাই ভাববে, এটা একটা খুনের গল্প। না, একটা নয়, দুটো খুনের গল্প। তবে প্রথম খুন, অর্থাৎ সৎ মাকে শক দিয়ে মারার কথাটা গল্পে পাওয়া যেতে পারে, আবার নাও পাওয়া যেতে পারে। যদি পাওয়া যায় তাতেও কি গল্পের মূল বিষয়টা ঠিক থাকবে? থাওবে না। কারণ গল্পতে দুট নয়, তিনটে খুন রয়েছে। তাই গল্পটা খুনের গল্প নয়, ভালবাসার গল্প। সেই খুনটার কথা না জানলে এটা বোঝা মুশকিল। কিন্তু সমস্যা হল খুনটার কথা কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। একটা জটিলতা দেখা দিচ্ছে। সময়ের জটিলতা। বলার সময় ঘটনাটাকে ঠিক কোন সময়ে নিয়ে গিয়ে ফেলব? আগে? পরে? নাকি এখন? ঠিক করতে পারছি না। আসলে খুন হওয়া মানুষটার সঙ্গে আমার এখনও নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। সুযোগ পেলেই আমি তার কাছে চলে যাই। যোধপুর পার্কের কাছে ফ্ল্যাট। টু বেড রুম। বড় লিভিং ডাইনিং। ঘটনার পর থেকে ফ্ল্যাটে তালা। বউ কেটে পড়েছে। যতদূর খবর, বিয়ে করেছে আবার। তাতে আমার সমস্যার কিছু নেই। আমার সমস্যা হল, অতীত হয়ে যাওয়া একটা মানুষকে বর্তমানে এনে ফেলতে গেলে কী বলতে হবে? ‘আগে’ নাকি ‘এখন’? নাকি দুটো সময় পাশাপাশি চলবে? ট্রেন আর ট্রেনের ছায়ার মতো।

যাক গে বলতে যখন হবে, খুনের কথাটা সংক্ষেপে সেরে নিই। ঘটনাটা ছিল সোজাসাপটা। যাকে বলে ওয়ান ডাইমেনশনাল।
ছেলেটার নাম তীর্থ। লম্বা চওড়া হ্যাণ্ডসাম চেহারা। ভাল চাকরি করে। কোনও এক বিয়ে বাড়িতে একটা মেয়ের সঙ্গে তার দেখা। বলা ভাল, মেয়েটিই দেখল তাকে। আর দেখামাত্রই পড়ল প্রেমে। তীর্থ বিশেষ পাত্তা দিল না। তাতে মেয়ের প্রেম গেল আরও বেড়ে। প্রেমের নিয়মই তাই। কঠিন ঠাঁইতে ফরফর করে বাড়ে। জল বাতাস পাওয়া চারা গাছের মতো। তবে এতেও তীর্থর কিছু এসে গেল না। সে মেয়েটিকে আরও এড়িয়ে যেতে লাগল। মেয়ের তখন পাগল পাগল অবস্থা। নাওয়া খাওয়া বন্ধ। এমনকি তৃতীয় শ্রেণীর প্রেমের কায়দায় সুইসাইডের হুমকি দিয়ে চিঠি পর্যন্ত পাঠিয়ে বসল। তাতেও ছেলে তেমন টলল না। মেয়ের অবস্থা হল শোচনীয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেয়েটি জিতেই যায়। গজগজ করতে করতে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল তীর্থ। মনে হয় মেয়ের কান্নাকাটি দেখে করুণা হয়েছিল। তবে ফুলশয্যার রাতেই সে কঠিন গলায় বউকে বলে দেয়, ‘বিয়ে করেছি মানে ভেব না আমি তোমার মুখের দিকে হাঁ করে চইয়ে বসে থাকব। আমি চলব আমার মতো, তুমি চলবে তোমার মতো। নিজের নিজের কাজ নিয়ে থাকব। অতিরিক্ত সোহাগ, আহ্লাদের কোনও প্রয়োজন নেই।’ মেয়ে খুশি হয়ে মাথা নাড়লও। সে এটাই চায়। সে এমন একজন পুরুষমানুষকে ভালবেসেছে, ভালবাসার ব্যাপারে যে উদাসীন, কঠিন এবং নির্মম। তাই সে আলাদা। তাই সে লোভনীয়।

কিন্তু বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই জল গড়ালও উলটো দিকে। তীর্থ গিয়ে পড়ল তার বউয়ের ঘাড়ে! সারাক্ষণ চোখে হারায়। দূরে গেলে ডাকাডাকি করে, কাছে থাকলে হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে থাকে। একেবারে নেতাজোবড়া অবস্থা। মানুষটা পুরোপুরি গেল বদলে! বউয়ের সঙ্গে লেপটে থাকতে গিয়ে কাজকর্মও শিকেয় তুলল। লোকে আড়ালে হাসে। সামনে ঠাট্টা করে। তবে বেশিদিন নয়, এই অবস্থা চলল ঠিক বছরখানেক। মেয়েটি একদিন তীর্থর সঙ্গে ঠাণ্ডা গলায় কথা বলল।
‘আমি চললাম। যে মানুষটাকে আমি ভালবেসেছিলাম, তুমি সেই মানুষ নও। এত ভালবাসা আমার সহ্য হচ্ছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে। বাকি জীবন তোমার সঙ্গে কাটানো অসম্ভব। মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স হলে ভাল, না হলেও অসুবিধে নেই। আমি কোর্টে কনটেস্ট করব। তবে তুমি চিন্তা কোরো না, আমি এখনই তোমাকে পুরোপুরি ছেড়ে চলে যাচ্ছি না। সেটা তোমার পক্ষে বিরাট আঘাত হবে। তুমি আমাকে এত ভালবাস, তোমাকে বিরাট ধাক্কা দেওয়াটা আমার উচিত কাজ হবে না। তুমি সেটার প্রাপ্য নও। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আরও কিছুদিন আমি তোমার কাছে আসা যাওয়া করব। ঘর পরিষ্কার করব, তোমার পছন্দের খাবার বানিয়ে দেব, তোমার সঙ্গে বসে ডিভিডিতে সিনেমা দেখব। এমনকি তুমি চাইলে তোমার সঙ্গে শুতেও পারি। আসলে ধীরে ধীরে তোমার মন শক্ত করার চেষ্টা করব।’

এর খুব অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফ্ল্যাটে তীর্থর মৃতদেহ পাওয়া যায়। সবাই জানল হার্ট অ্যাটাক। আসলে যে বিষ তাকে খাওয়ানো হয়েছিল, সেটা কাজ করে হার্টে। ধমনীগুলো অকেজো করে। হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে পার্থক্য বোঝা যায় না। খুব সন্দেহ না করলে ধরা মুশকিল। একা থাকার মানুষের ওপর কে সন্দেহ করবে? করলেই বা কী? খুনের প্রমাণ কীভাবে গোপন করতে হয় আমার থেকে ভাল কে জানে?
তীর্থের সঙ্গে ডিভোর্স না হওয়ার কারণে যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটের মালিকানা এখন আমার। খবরটা কেউ জানে না। আমি প্রায়ই সেই ফ্ল্যাটে যাই। তালা খুলে ঢুকি। তারপর তীর্থর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটাই। মরে যাওয়ার পর ছেলেটা আগের মতো হয়ে গেছে। ভালোবাসায় সেই রকম কঠিন, নির্মম। অনেক সাধ্যসাধনা করে তার ভালবাসা পেতে হয়। যে ভালবাসার জন্য নারী অপেক্ষা করে থাকে জন্মজন্মান্তর। কী যে ভাল লাগে বুঝিয়ে বলতে পারব না। হয়তো সারারাত তার আদর চাইলাম, অথচ ও রইল মুখ ফিরিয়ে। গ্রহণ করল একেবারে শেষরাতে। ব্যথা দিয়ে দিয়ে প্রবেশ করল আমার শরীরে। আমি শিৎকার করে উঠলে মুখে হাত চাপা দিল। সেই হাত কী ঠাণ্ডা! যেন রক্ত মাংস নয়, সেই হাত বরফ দিয়ে তৈরি! আহা! শুধু শরীর নয়, তীর্থর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি আলাপ আলোচনাও করি। আমার দ্বিতীয় স্বামী রঞ্জনকে খুব করার পরিকল্পনা সে-ই আমাকে দেয়। আমি তাকে কেঁদে বলেছিলাম, ‘তীর্থ, আমি আর পারছি না। আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

তীর্থ হেসে বলল, ‘পারছও না তো কী হয়েছে? না পারলে কী করতে হয় তুমি জানও না?’
‘কী করতে হয়?’
‘তোমার সৎ মাকে যা করেছও, আমাকে যা করেছও, রঞ্জনকেও তাই করবে। সমস্যা কোথায়?’
না সমস্যা নেই। রঞ্জন নেই, আমি এখন মুক্ত। আরও বেশি সময় তীর্থর সঙ্গে থাকতে পারব। ভালবাসা পাবার জন্য তার কাছে আকুতি মিনতি করব।
অন্ধকার ঘরে মৃত রঞ্জনকে রেখে আমি এখন দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছি।

………………………………………..(সমাপ্ত) …………………………………