হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেল আনুর। চোখের সামনে কালিগোলা অন্ধকার। কেমন অস্বাভাবিক লাগছে ঘরের পরিবেশ। ঘুটঘুটে অন্ধকারের সাথে অতিপ্রাকৃত কিছু মিশে আছে যেন। এমন তো হয় না কোনদিন। আনুর ভয় ভয় করতে লাগল। বুকটাও জমে বরফ। অন্ধকারে যেমন ভয় লাগছে তেমনি ভয় পাচ্ছে বাতি জ্বালতেও। আচমকা সুইচটা টিপেই দিল সে।
আলোটা চোখ সয়ে আসতেই আনু ঘরে বোলাতে লাগল ভীত দৃষ্টি। শফিক আমানের খাটের দিকে দৃষ্টি যেতেই অসম্ভব আতঙ্কে একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার বুক চিরে। শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে আনুর চোখ দুটো আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে গেল। এটা কি স্বপ্ন? নাকি চোখের ভুল? মাথায় প্রশ্ন খেলে যেতেই সে সাহস সঞ্চয় করে তাকাল আবারও।
হৃৎপিণ্ডটা পাঁজরের সাথে বাড়ি খেল দমাদম। বীভৎস কঙ্কালটা আগের মতোই ঝুলে আছে শফিক আমানের খাটের পাশে। লিকলিকে হাত-পাগুলো ছড়িয়ে এখনি তেড়ে আসবে যেন—এমনই কঙ্কালটার ভাবভঙ্গি। চোখহীন কোটরে নারকীয় উল্লাস তার। দুই সারি দাঁতে অশুভ হাসির রেখা। আনু আবারও একটি আর্তচিৎকার দিয়ে বন্ধ করে ফেলল চোখ দুটো।
দুই
‘আনু, এই আনু, চোখ খোল।’ শফিক আমানের কণ্ঠ শুনে আনু স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে তাকাল।
‘তুই এত ভীতু?’ ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল শফিক আমানের কণ্ঠ থেকে।
‘ওটা তো একটা সাধারণ কঙ্কাল রে!’
আনুর ভয় এখনও বিন্দুমাত্র কাটেনি। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘সা-সাধারণ কঙ্কাল? কি-কিন্তু ওটা এ-এখানে কি-কিভাবে এল?’
‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য আমিই এনেছি। পুরুষ মানুষের পরিচয় দিয়ে তুই এবার ঘুমা তো। সকালে সব খুলে বলব।’ বলে শফিক আমার বাতি নিভিয়ে নিজের বিছানায় চলে গেল।
বিজ্ঞানের ছাত্র শফিক আমান। আনুর এক বছরের সিনিয়র। আনু কমার্সের। একই কলেজে পড়ে ওরা। এই মেসটাতে আছে অনেক দিন ধরেই। সাথে শফিক আমানের দুজন ক্লাসমেট। দিনতিনেক আগে ওরা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে।
আজই সকালে শফিক আমান এবং আনু কবরখানার দিকে হাঁটতে গিয়েছিল। ভাঙা কবরটা আনুর নজরেই পড়ে প্রথমে। সে দেখায় শফিক আমানকে। দুই-তৃতীয়াংশ ভেঙে গেছে কবরটার। ফাঁক দিয়ে দেখা যায় একটা কঙ্কালের অনেকটা অংশ। অজানা ভয়ে আনুর বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেলেও শফিক আমান স্বাভাবিকই রইল। ভয় পাবে দূরের কথা, বরং খুশিতে তার চোখ দুটো চকচক করে উঠেছিল। সকালের এ ঘটনাটি স্মরণে আসতেই আনু বুঝতে পারল শফিক আমান রাতের আঁধারে কবর থেকে তুলে এনেছে কঙ্কালটা। নিঝুম রাতে কবরখানা থেকে যে একাকী এমন একটা কঙ্কাল তুলে আনতে পারে তার সাহস আছে মানতেই হবে। তাই বলে এতবড় দুঃসাহস? আনুর ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই শফিক আমান নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে শুরু করলেও আনুর চোখে কিছুতেই ঘুম আসছে না। আতঙ্কটা বুকের উপর পাথর চেপে বসেছে যেন। উত্তেজনা এবং ভয়ে নার্ভগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল বলে এক সময় আনুর চোখে ঘুম এলেও ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে জেগে উঠেছে বারবার।
তিন
পরের তিনটি দিন বলতে গেলে আনু কাটিয়ে দিয়েছে বাইরে বাইরেই। একটা কঙ্কালের সাথে অস্বস্তিকর সময় কাটানোর কথা কল্পনা করলেও গা শিরশির করে তার। কিন্তু রাতে বাধ্য হয়ে ফিরতেই হয়। ঘুম হয় ছাড়াছাড়া, আসেও দেরিতে। তার উপর দুঃস্বপ্ন তো আছেই। আনুর ধারণা—এ রকম আরও কয়দিন চললে সে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে!
শফিক আমানকে অনেক বুঝিয়েছে আনু। অনুরোধ করেছে কঙ্কালটা যেখানে ছিল সেখানে রেখে আসতে। নতুবা যেকোন সময় ঘটে যেতে পারে খারাপ কিছু।
আনুর অনুরোধ এবং আশঙ্কার কথা শুনে শফিক আমান প্রতিবারই হো হো করে উঠেছে। বলে, ‘তুই অযথাই ভয় পাচ্ছিস, আনু। বিজ্ঞান যারা পড়ে তাদের এভাবে হাতে-কলমে শিক্ষা নিতেই হয়।’
শফিক আমানের এই যুক্তি স্বস্তি দেয়নি আনুকে। বিজ্ঞানের স্বার্থে সবাই একটা করে কঙ্কাল কবর থেকে তুলে এনে ঘরে ঝুলিয়ে রাখবে—এটা মেনে নেয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
আনুর আশঙ্কাও কিন্তু অমূলক নয়। ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনাগুলোই তাকে এমন ভাবতে বাধ্য করেছে। যে রাতে কঙ্কালটা আনা হয় তার পরদিন সকালে শফিক আমান এবং আনু হোটেল থেকে নাস্তা সেরে এসে দেখে—কঙ্কালটা মাটিতে সটান দাঁড়িয়ে আছে অবিকল মানুষের মতো। যে রশি দিয়ে ঝুলানো ছিল সেই রশিটি ছিঁড়ে ঝুলে আছে গলায়। আনু তো অবাক। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল শফিক আমানও। তবে পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে নেয়। ইতোমধ্যে তার বিজ্ঞানমনস্ক মন কোন যুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছে হয়তো। এরপর কঙ্কালটাকে যেখানে খুশি দাঁড় করিয়ে রেখেছে শফিক আমান।
সেদিনই সকাল থেকে আনু তার পোষা বিড়ালটাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। শেষে শফিক আমানের খাটের নিচে সে আবিষ্কার করে ওটাকে। কোন অঙ্গই আস্ত নেই বিড়ালটার। দেহের মানচিত্র পাল্টে পরিণত হয়েছে একদলা মাংসপিণ্ডে! পোষা বিড়ালের এমন নির্মম পরিণতি দেখে আনু তো কেঁদেই ফেলেছে হাউমাউ করে। ওর বিশ্বাস—এই বর্বরতা কঙ্কালটারই।
মারাত্মক দুর্ঘটনাও ঘটেছে দুবার। একবার সিলিংফ্যানটা খুলে দুম করে পড়ে গেল মেঝের মধ্যে। শফিক আমান রক্ষা পেল অল্পের জন্য। গত রাতে শফিক আমান ঘুমিয়ে পড়ে বেশ আগে ভাগেই। আনুর ঘুমুতে একটু দেরি হয়। হঠাৎ সে দেখে—শফিক আমানের বিছানায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। দুজন মিলে যখন আগুন নেভাতে সক্ষম হলো ততক্ষণে বিছানার অর্ধেক পুড়ে শেষ। শত অনুসন্ধান করেও আগুন লাগার কোন কারণ বের করতে পারেনি ওরা।
এইসব রহস্যময় ঘটনা বিন্দুমাত্র দুর্বল করতে পারেনি শফিক আমানকে। প্রতিবারই সে ঘটনাগুলোর পেছনে দাঁড় করিয়েছে কোন না কোন যুক্তি, ব্যাখ্যা! আনুর সেসব পছন্দ হয়নি একদম।
আজ সন্ধ্যেবেলায় যা ঘটেছে তা আনুকে এতই আতঙ্কিত করে তুলেছে যে— সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে—আজ রাতটা পার করে কাল সকালেই চলে যাবে খালার বাসায়। শফিক আমান কঙ্কালটাকে সরিয়ে ফেললে এই মেসে ফিরে আসবে, নয়তো নতুন ঠিকানা খুঁজবে।
সন্ধ্যেবেলা টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন লিখছিল শফিক আমান। কঙ্কালটা দাঁড় করানো ছিল তার পেছনেই। আনুকে একটা কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। সে ফিরে এসে দেখে—কঙ্কালটা হাত দুটো ধীরে ধীরে শফিক আমানের গলার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে—অনেকটা চেপে ধরার ভঙ্গিতে। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে আনু। সাথে সাথে কঙ্কালটা ঝট করে হাত দুটো নামিয়ে ফেলে স্বাভাবিক হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য ঘটনাটা শফিক আমানকে খুলে বললে সে আনুকে তিরস্কার করে বলে, ‘কুসংস্কারে পূর্ণ তোর মন। ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানব—এসব অবাস্তব চিন্তা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায় সারাক্ষণ। এই মস্তিষ্ক নিয়ে কি দেখতে কি দেখিস—আল্লাই মালুম!’
আনু আর কিছু বলার সাহসই পায়নি।
চার
আনুর যখন ঘুম ভাঙল কাকভোর তখন। দরোজা-জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে ভোরের মৃদু আলো। ঘরের কোণগুলোতে বাদুড়ঝোলা অন্ধকার। যেন অদ্ভুত এক আলো-আঁধারির খেলা চলছে ঘরের ভেতর। সাধারণত এ সময়ে ঘুম ভাঙে না আনুর। চাদরটা সরিয়ে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামল সে। হাই তুলতে তুলতে জ্বালল বাতিটা।
শফিক আমানের বিছানাটা খালি দেখে অবাক হলো। কোথায় গেল শফিক আমান? মেঝের দিকে দৃষ্টি যেতেই রীতিমতো জমে গেল আনুর দেহ। অসম্ভব আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখ দুটো বেরিয়ে আসতে চাইল কোটর ছেড়ে। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইছে সে। কিন্তু গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই বের হলো না।
মেঝেতে শফিক আমানের দেহটা পড়ে আছে একতাল কাদার মতো, রক্তাক্ত। শরীরের একটা হাড়ও আস্ত নেই বোধহয়। হাত-পাগুলো মুচড়ে এমনভাবে ভাঙা হয়েছে যে—এগুলো মানুষেরই অঙ্গ ছিল কোনদিন—বিশ্বাস করা মুশকিল। কোটর শূন্য! রক্তভেজা চোখ দুটো মার্বেলের মত পড়ে আছে দেহের একপাশে। থ্যাঁতলানো নাক! গলাতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে পাঁচ আঙুলের চাপের দাগ। চাপটা যে রক্তমাংসের কোন হাতের নয়—এটাও বুঝতে অসুবিধা হলো না আনুর। জ্ঞান হারাবার ঠিক আগ মুহূর্তে অনেক কষ্টে সে একবার সারা ঘরটাতে দৃষ্টি বোলাতে পেরেছিল। কঙ্কালটাকে কোথাও দেখতে পায়নি।
পাঁচ
কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল বলতে পারবে না আনু। একসময় জ্ঞান ফিরলেও ঘোরটা কাটল না পুরোপুরি। এই ঘোরের মধ্যেই বিচিত্র এক কৌতূহলে কবরখানার দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। নির্জন কবরস্থানে তখন শান্তি সুবাতাস। সবুজ ঘাসে ভোরের মায়াবী আলোর স্নিগ্ধতা। ভাঙা কবরটার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল চরম সত্যটা। নিজেকে নিজেই মুক্ত করে কঙ্কালটা কবরে এসে শুয়ে আছে ঠিক আগের মতোই। আপন ঠিকানায়। কিন্তু এজন্য শফিক আমানকে বড্ড বেশি মূল্য দিতে হলো। কষ্টে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আনুর বিপর্যস্ত বুক চিরে।
……………………………………………(সমাপ্ত) ………………………………………….