অনেক দিনের কথা। খুলনা অবধি নতুন রেললাইন বসেছে। একটা স্টেশন ঝিকরগাছি।
শ্রাবণ মাস। সারাদিন ঝুপঝুপে বৃষ্টি। সন্ধ্যে থেকে একটুখানি ধরেছে। রাত্রি সাড়ে আটটায় কলকাতার ট্রেন ঝিকরগাছি এসে থামল। দুর্যোগে মোটে ভিড় নেই। জন তিন-চার গাড়িতে উঠল। নামল একজন মাত্র যুবাপুরুষ। নাম বিনোদ। কাছাকাছি সাদিপুর গাঁয়ের মাখনলাল করের জামাই। তাঁর ছোট মেয়ে চঞ্চলার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বছর দুই আগে।
পুনায় থাকে বিনোদ, মিলিটারিতে চাকরী করে। সম্প্রতি বাসা পেয়েছে। বউকে নতুন বাসায় নিয়ে যাবে। এক হপ্তার ছুটি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছে। এরপর ভাদ্র মাস পড়ে যাবে। শ্বশুর -শাশুড়ি তখন মেয়ে পাঠাবেন না। সেইজন্য তাড়াতাড়ি।
স্টেশনে নেমে বিনোদ গেট পেরিয়ে বেরোল। গেটে লোক নেই, কেউ টিকিট চাইল না। বিনোদ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, কোন দিকে জনমানব দেখা যায় না। এর আগে আরও দু-বার সে শ্বশুরবাড়ি এসে থেকে গেছে, পথ মোটামুটি জানা। তবু ভাল করে একবার স্টেশনমাস্টারের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে নেবে।
অফিসঘরের দরজা ঝাঁকাচ্ছে বিনোদ : ” মাস্টারমশায়, মাস্টারমশায়…..”
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ভেতরে আলো জ্বলছে। স্টেশনমাস্টার অফিসেই আছেন। সাড়া দিচ্ছেন না। “শুনুন একবারটি মাস্টারমশায়”….. বিনোদ আরেকবার দরজার শেকল ধরে ঝাঁকাল।
পয়েন্টসম্যান এল হঠাৎ কোন দিক থেকে। গায়ে নীল কোট, তার ওপর মোটা কম্বল জড়ানো। তা স্বত্তেও হি হি করে কাঁপছে। সে বলে, ” ডাকেন কেন বাবু? স্টেশনমাস্টার জ্বরে বেহুঁশ। গাড়ির ছাড় গার্ডসাহেব আজ আমার কাছ থেকে নিয়ে নিল। আমায় বলুন কি দরকার”……।
বিনোদ এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে বলল, ” সাদিপুর থেকে আমার জন্য পালকি আসার কথা। দেখতে পাচ্ছিনা তো….”
ভ্রুভঙ্গি করে পয়েন্টসম্যান বলল, ” পালকি চাচ্ছেন বাবু, বলি পালকিটা বইবে কারা? বেয়ারা জুটবে কোথা? এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার নতুন আমদানি হয়েছে….ঘরে ঘরে মেয়ে-মর্দ সকলের জ্বর। একবাটি বার্লি রেঁধে দেবার মানুষ জোটে না, আপনার মাথায় পালকির শখ চাপল এখন!”
হাঁসফাঁস করছিল লোকটা….বিনোদের সামনে সেইখানে মেঝের ওপর বসে পড়ল। বলল, ” আগের লোকটা মারা গেল জ্বরে। পরশুদিন আমায় এই স্টেশনে পাঠাল। আমাকেও জ্বরে ধরেছে। কপালে কি আছে জানিনা।”
দু-মাসের মধ্যে বিনোদ শ্বশুরবাড়ির কোনও চিঠিপত্র পায়নি। মন বড় উতলা। স্টেশনমাস্টার পুরনো লোক, তিনি হয়তো কিছু খবরাখবর দিতে পারতেন। এ লোক একেবারে নতুন, একে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই।
সারাদিন খাওয়া হয়নি বিনোদের। বড় ক্লান্ত। একবার ভাবল, রাত্রিটা স্টেশনে কাটিয়ে সকালবেলা বেরোবে। কিন্তু সামান্য পথ, মাইল তিনেকের বেশি না। মশা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে পড়ছে….যা গতিক, রাতের মধ্যে চোখ বুজতে দেবে না। তারচেয়ে কোনওরকমে পথটুকু হেঁটে শ্বশুরবাড়ির খাটের ওপর গদিয়ান হয়ে পড়া ভাল।
পথে নেমে পড়ল বিনোদ। হনহন করে চলেছে। হাতঘড়িতে ন’টা। সন্ধ্যারাত্রি বলা যায়। এরই মধ্যে চারিদিকে একেবারে নিশুতি। রাস্তার জল কলকল করে নালায় পড়ছে। ব্যাঙ ডাকছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। বাদুড়ের ঝাঁক উড়ছে মাথার ওপর।
চাঁদ দেখা দিল আকাশে। মেঘ ভাঙা ঘোলাটে জ্যোৎস্না। অদূরে কেয়াঝাড়। ছত্রাকার কেয়া পাতার নিচে মানুষ যেন। মানুষটা কাঁটাবনের মধ্যে মোটা কেয়া গুঁড়ির ওপর আরামে পা ছড়িয়ে বসে আছে, স্টেশন থেকে বেরিয়ে এতক্ষণের মধ্যে প্রথম এই মানুষের দেখা মিলল।
বিনোদ ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ” সাদিপুরে মাখনলাল করের বাড়ি যাব! যাচ্ছি তো ঠিক?”
” উঁহু”, শঙ্খের মতো আওয়াজে মানুষটা জবাব দেয়, ” সাদিপুর যাবে তো এইদিকে চলে এসো। ডাকছি, আসছ না কেন?”
মানুষটার কথায় বিনোদ আশ্চর্য না হয়ে পারল না। পথ কোথায় ঐ গহীন জঙ্গলের মধ্যে! পাগল নিশ্চয়… নয়তো রাত্রিবেলা ঘরবাড়ি ছেড়ে এমন জায়গায় পড়ে থাকে কখনো? মিলিটারি মানুষ বিনোদ, সে কিছুই গ্রাহ্য করে না। নিরুত্তরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আরও জোরে গটমট করে এগিয়ে চলল।
দীর্ঘ একটা খেজুরগাছ ঝড়ে বেঁকে গেছে। কাত হয়ে আছে সেটা রাস্তার ওপর। গাছটা আগেও দেখেছে, বিনোদের মনে পড়ল। ঠিক পথেই যাচ্ছে তাহলে, পথ হারায়নি। কিন্তু যেইমাত্র গাছের নীচে আসা, গাছটা নুয়ে এসে বিষম জোরে মাটিতে আছড়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আবার আগের অবস্থায়। তেমনি কাত হয়ে আছে রাস্তার ওপর। আর কার যেন খলখল হাসি শুনতে পেল বিনোদ। ছুটে রক্ষা পেল বিনোদ, তাই রক্ষে। নইলে গাছটা ঠিক মাথার ওপর পড়ত, মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যেত। অল্পের জন্য বেঁচে গেল।
খুব খানিকটা গিয়ে পেছনে তাকাল বিনোদ। খেজুরগাছ যেমন তেমনি আছে, পাতা ঝিলমিল করছে জ্যোৎস্নায়। সাহসী মানুষ বিনোদ, প্যারেড করে, বন্দুক চালায়। ভাবছে চোখের ভুল। বম্বে মেল আজ বড্ড লেট ছিল….হাওড়া স্টেশনে নেমেই শিয়ালদা মুখো ছুটতে হল। খাওয়াদাওয়া হয়নি সমস্তটা দিন। খিদে তেষ্টায় অবসন্ন হয়ে মাথা ঘুরছে,আর এইসব ভুলভাল জিনিস দেখছে। আসলে কিছুই নয়, সব দৃষ্টিভ্রম।
শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে গেল বিনোদ। অবস্থা ভাল এঁদের, পাকা কোঠাবাড়ি। তবে বৈঠকখানা অন্ধকার। গত বছর শীতকালে বড়দিনের সময় বিনোদ এসেছিল, দিনরাত লোক গিজগিজ করত তখন। রাত দুপুর অবধি পাশা খেলার হুল্লোড়। আজ কেউ নেই। সেটা হয়তো ঐ পয়েন্টসম্যানের মুখে যা শোনা গেল, জ্বরজারির মধ্যে আড্ডা দেবার পুলক নেই মানুষের। বাড়ির কর্তারাও হয়তো জ্বরের তাড়সে ভেতর বাড়ির বিছানায় পড়ে কোঁ কোঁ করছেন।
ভেতর বাড়ির দরজাটা হা হা করছে। জামাই ঢুকে গেল ভেতরে। বারান্দা দিয়ে যাচ্ছে শব্দসাড়া করে। গলা খাঁকারি দিচ্ছে। একজন কেউ শব্দ শুনে বেরিয়ে আসুক। কি আশ্চর্য! শ্বশুরবাড়ির সবাই গেল কোথায়?
এইরকম ভাবছে। কোন দিক দিয়ে ঘোমটা দেওয়া একটা বৌ এসে সামনে দাঁড়াল। বিনোদ হকচকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পরিচয় দিল, “এ বাড়ির ছোট জামাই আমি….বিনোদ “।
খিলখিল খিলখিল উচ্ছসিত হাসি। হাসতে হাসতে ঘোমটা খুলে ফেলে চঞ্চলা। বিনোদের সঙ্গে এই মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
চঞ্চলা আগে আগে চলেছে। মস্ত বড় বাড়ি। আরও কত বারান্দা, কত সিঁড়ি, উঠোন পার হয়ে চলল। একসময় বিনোদ সেই আগের প্রশ্ন করে, ” কাউকে দেখছি না কেন? গেলেন কোথায় সব?”
চঞ্চলা বলে, ” ঝিকরগাছি আমার এক পিসির বাড়ি। পিসির মেয়ের বিয়ে আজ, বাড়িসুদ্ধ লোক সেখানে গেছেন।”
একবার ঢোক গিলে ফের চঞ্চলা বলল, ” আমারও যাবার কথা ছিল। কিন্তু জ্বর থেকে উঠে সবে অন্নপথ্য করেছি কিনা…..”
ঘরের মধ্যে এসে গেল দুইজন। কুলুঙ্গিতে প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের আলোয় বিনোদ চঞ্চলার দিকে ভাল করে তাকাল। অসুখ করেছিল, চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। আগে যেমন দেখে গেছে, তেমনি রয়েছে। চমৎকার স্বাস্থ্য, ঠিক আগের মতো।
বিনোদ বলে, ” এত বড় বাড়ির মধ্যে তুমি এই একলা একটি প্রাণী, ভয় করছে না তোমার?”
চঞ্চলা বলে, ” একলা কেন হব? বুড়ো দারোয়ান আর গোবিন্দ চাকর রয়েছে। তারা বৈঠকখানায়। সৌদামিনী ঝি-ও রয়েছে। শরীর খারাপ বলে সকাল সকাল শুয়ে পড়েছে, ডাক দিলে এসে পড়বে।”
পালঙ্কের বিছানায় চেপে বসে বিনোদ অভিমান ভরে বলল, ” আজ এসে পৌঁছব, স্টেশনে পালকি রাখার জন্য চিঠি দিয়েছিলাম। পালকি না জুটুক, স্টেশনে অন্তত বুড়ো দারোয়ানকে পাঠাতে পারতে।”
চঞ্চলা ঘাড় নাড়ল, ” চিঠি পৌঁছয়নি, পৌঁছবার উপায়ও নেই। পোস্টমাস্টার -পিওন দুজনেই মারা গেছে। যে রানার ডাক বয়ে আনত, সে-ও নাকি নেই।”
একটু থেমে ফের চঞ্চলা বলতে লাগল, “সাঙ্ঘাতিক ম্যালেরিয়া চলছে এ অঞ্চলে। জ্বরজারি কাকে বলে এ অঞ্চলের লোক আগে জানত না। পাথরে কোঁদা নিরেট দেহ যেন মানুষের। নতুন রেললাইন হয়ে অবধি এই কান্ড। গাঙ খালের মুখ বন্ধ করে রেল রাস্তা বেঁধেছে। খানাডোবা চারিদিকে। বর্ষার জল পড়তে না পড়তে নরক গুলজার! মানুষজন উজাড় হয়ে গেল।”
কথাবার্তার মধ্যে একসময় বিনোদ বলে, ” তোমার কাছে বলতে কি…..সারাদিন ভাত জোটেনি, বিষম ক্ষিধে চেপেছে। ক্ষিদের চোটে মুখ দিয়ে কথা সরছে না। তাড়াতাড়ি চাট্টি ভাত ফুটিয়ে দিতে পারো তো দেখ।”
চঞ্চলা ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল, ” ছি, ছি, আগে বলতে হয় তো! চালে ডালে খিচুরি চাপিয়ে দিইগে, তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তরকারির হাঙ্গামায় যাব না। তুমি শুয়ে বিশ্রাম কর। এসে ডাকব তোমায়।”
চলে গেল চঞ্চলা। যেন উড়ে বেরিয়ে গেল পাখির মতো।
এই ঘরটায় বিনোদ আগেও থেকে গেছে। পেছনে খিড়কির বাগান। কদম ফুল ফুটেছে, খোলা জানলা দিয়ে ফুলের মিষ্টি গন্ধ আসছে। কুলুঙ্গির প্রদীপটা হঠাৎ দপদপ করে উঠল। আলো নাচতে লাগল দেওয়ালে দেওয়ালে। বাইরের উঠোনে যেন অনেক লোকের আনাগোনা, বাইরে থেকে ভেসে আসছে কাদের ফিসফাস কথাবার্তা।
” কে রে? গোবিন্দ নাকি ওখানে?” বিনোদ খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল।
কোনও জবাব এল না। বিনোদের মনে হল, একা গোবিন্দ কিংবা দু চারজন মানুষ নয়। অনেক, অনেক লোকজন যেন দাঁড়িয়ে বাইরে। বাড়ির সকলে নিমন্ত্রণ খেতে গেছে। এত লোক তবে কোথা থেকে এল?
উঁকি দিয়ে দেখল জানলার বাইরে। জ্যোৎস্না উজ্জ্বল হয়েছে এখন। না, কিছুই নয়। কেউ নেই বাইরে। কিন্তু যেইমাত্র জানলা থেকে ভেতর দিকে সরে আসে, আবার সেই পাতার খসখসানি। চাপা গলায় অনেকের শলাপরামর্শ।
উঠে গিয়ে বিনোদ দড়াম করে জানলার কপাট বন্ধ করল। একলা ঘরে গা ছমছম করছে। চঞ্চলার কাছে একথা বলা যাবে না। হাসবে, ঠাট্টা করবে। বলবে, ” এই তুমি বীরপুরুষ! এই সাহস নিয়ে তুমি লড়াইয়ের পাঁয়তারা কষে বেড়াও!”
বিনোদ ভাবল, তার চেয়ে কোথায় চঞ্চলা রান্নাঘরে খিচুরি চাপিয়েছে…চলে যাওয়া যাক সেখানে। রান্না চলবে আর গল্প হবে দুজনায়।
পা টিপে টিপে নিঃসাড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঢুকে চঞ্চলাকে চমকে দেবে।
কিন্তু…. ওরে বাবা, কি সব্বোনেশে কান্ড গো। রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়ে বিনোদ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। রান্না করছে চঞ্চলা…উনুন জ্বালাবার কাঠকুটো নেই বুঝি, সেইজন্য নিজের পা দুখানা ঢুকিয়ে দিয়েছে উনুনের ভেতর, দাউদাউ করে পা জ্বলছে। উনুনের ওপর কড়াইতে খিচুরি ফুটছে টগবগ করে। চঞ্চলা আঙুল দিয়ে একবার তুলে টিপে দেখছে সিদ্ধ হল কিনা। গরম খিচুরির মধ্যে ইচ্ছামত আঙুল ডুবিয়ে দিচ্ছে, পা জ্বলছে ওদিকে উনুনের ভেতর।
মশলা বাটবে। কোণের দিকে শিলনোড়া। চঞ্চলার উঠবার জো নেই…পা তুললেই তো নিভে যাবে আগুন। হাত বাড়াল শিলনোড়া আনার জন্য। হাত ক্রমেই লম্বা হচ্ছে। লম্বা হয়ে শিলনোড়া ধরল। তারপর ছোট হতে লাগল হাত। হতে হতে স্বাভাবিক আকারে এল। কাছে এনে শিল পাতল। আবার হাত লম্বা করে তাকের ওপর থেকে মশলার ডালা নামিয়ে আনল। এক জায়গায় বসে সমস্ত হচ্ছে। ঘটরঘটর করে বাটনা বাটছে এবার।
বিনোদ রুদ্ধনিশ্বাসে দেখছে সব। পা দুটো খুঁটির মতো অনড় হয়ে গেছে। দেখছে একদৃষ্টে।
খিচুরি নামিয়ে চঞ্চলা থালায় ঢালল। পিঁড়ি পেতে ঠাঁই করল, জলের গ্লাস দিল পাশে। পাতিলেবুর কথা মনে হল বুঝি এইসময়। জানলার গরাদ দিয়ে হাত বের করে লম্বা করে দিল। লম্বা হতে লাগল হাত…..আরও, আরও। হাত পঞ্চাশ তো হবেই। পাঁচিলের প্রান্তে পাতিলেবুর গাছ, বিনোদের দেখা আছে। ডান হাত সেই অবধি বাড়িয়ে পটপট করে গোটা চারেক লেবু ছিঁড়ে হাত আবার গুটিয়ে আনল। বঁটি পেতে লেবু কাটছে।
হঠাৎ বিনোদ যেন সম্বিত ফিরে পেল। উঠি কি পড়ি ছুটছে। শ্বশুর বাড়ির বাইরে, একেবারে রাস্তার ওপর। রাস্তা ধরে ছুটছে। মানুষ দেখা যাচ্ছে না কোথাও, কিন্তু চারদিক থেকে যেন কাদের কলরব। বহুকন্ঠে ডাকাডাকি করছে…..” পালাস কোথা? দাঁড়া। ভালর তরে বলছি, দাঁড়িয়ে যা!”…….শোনা যাচ্ছে অনেকের গলায় খলখল করে হাসি।
বাঁশতলার অন্ধকার। ছুটতে ছুটতে অন্ধকার কাটিয়ে বিনোদ ফাঁকায় এল। কি আশ্চর্য, তার সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে চারদিকে চারটে বউ। সে যত ছোটে, বউগুলোও ছোটে ততই। ছায়াকে যেমন ছেড়ে পালানো যায় না, তেমনি এরা।
সামনের বউটা একসময় থমকে দাঁড়ায়। গায়ের ওপর বিনোদ হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল, কোনোরকমে সামলে নিল। রক্ষা নেই, এইবার ধরল। তাকিয়ে দেখল, অন্য তিনটে বউও সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেছে।
সামনের বউটা ঘুরে দাঁড়াল বিনোদের দিকে। এতক্ষণে মুখের ঘোমটা তুলল। বিনোদ দেখল, তারই স্ত্রী চঞ্চলা….রান্না করছিল যে বসে বসে। ডাইনে বাঁয়ে আর পেছনে মুখ ঘুরিয়ে বিনোদ দেখে, অন্য বউগুলোও ঘোমটা খুলেছে। সবাই চঞ্চলা। এক চঞ্চলা চারজন হয়ে গেছে। পালাবার পথ নেই কোনওদিকে। বিনোদের গায়ে ঘাম দেখা দিয়েছে। চারজনের আটখানা হাত অক্টোপাসের মতো টুঁটি চেপে ধরে বুঝি এইবার। হাতগুলো সত্যি লম্বা হচ্ছে একটু একটু করে; তার দিকে এগিয়ে আসছে। ফাঁকা মাঠের মধ্যে বেঘোরে প্রাণটা গেল বুঝি এইবার! হা ভগবান!
চেতনা হারিয়ে বিনোদ পড়ে যায় আর কি পথের ওপর! কিন্তু না….হাতের মুঠিতে গলা চেপে ধরল না, বরঞ্চ কোমল স্পর্শ টের পেল বিনোদ। সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেল।
চঞ্চলার চোখে জল। চারজন চঞ্চলার একসঙ্গে জল এসে গেছে চোখে। চঞ্চলা বলে, ” একজন আমি চারজন হয়ে চারিদিক থেকে ঠেকিয়ে নিয়ে এলাম। নয়তো আজ আর তোমার রক্ষা ছিল না। প্রাণ নিয়ে ফিরতে দিত না ওরা।”
বিনোদ বলে, ” ওরা কারা?”
চঞ্চলা বলে, “আমি মরে গেছি। আমার ভাই বোন বাপ মা কেউ বেঁচে নেই। মহামারিতে এত বড় গাঁয়ের মধ্যে একটি প্রাণীও আজ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকতে এখানকার মানুষ যেমন গাঁয়ের মধ্যে চোর ডাকাত ঢুকতে দিত না, মরার পর তেমনি জ্যান্ত মানুষ ঢুকতে দেয় না! জ্যান্ত মানুষ ঢুকে পড়লে তাকে গলা টিপে মেরে নিজেদের দলে করে নেয়। তোমায় পারেনি, সে কেবল আমার জন্য। তুমি বেঁচে থাকো শতেক পরমায়ু নিয়ে। এই কম বয়সে কেন মরতে যাবে তুমি?”
একটু থেমে চঞ্চলা আবার বলল, ”গোড়ায় পিছু পিছু আসছিলাম। কিন্তু ভরসা হল না। সামনের দিক দিয়ে কিংবা ডাইনে বাঁয়ে কেউ এসে যদি টপ করে ধরে নেয়। তাই একা চারজন হয়ে চতুর্দিক ঘিরে নিয়ে এসেছি। আর ভয় নেই, সাদিপুরের সীমানা ছাড়িয়ে এসেছি। একটুখানি এগোলেই স্টেশন পাবে।”
চার বউ চার পাশ থেকে মাথা নুইয়ে চারখানা ডান হাত বের করে বিনোদের পায়ের ধুলো নিল। পলকের মধ্যে বিনোদ দেখে, ফাঁকা মাঠের মধ্যে একলা সে দাঁড়িয়ে। কোনও দিকে কেউ নেই।
…………………………………………. (সমাপ্ত) …………………………………………