ভেঙে যায় কাঁচের চুড়ি

ভেঙে যায় কাঁচের চুড়ি

আমি এক সাধারণ মেয়ে। আমার ভেতরে আছে এক গভীর গহ্বর। শুধু পুরুষাঙ্গ নয়, অবাধে সেখানে ঢুকে যেতে পারে মহাবিশ্ব।

লোকে আমায় ফতে পাগলী বলে ডাকে। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন ফাতেমা। কৈশোরে দুরন্ত, গাছে ওঠা, মধ্যদুপুরে অবাধ সাঁতার, পাড়ার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গোধূলী বেলায় খেলা, আরও কত কী! লেখা-পড়া করতে বেশ ভালই লাগতো। বি.এ পড়তাম স্থানীয় কলেজে। লোকে বলত, সোনার বরণ কন্যা, কাজল কালো কেশ, বিদ্যুৎচ্ছটা বের হয় অঙ্গ থেকে। হাসি-খুশী ফরফুরে আর ডান পিটে দুরন্ত। পড়া চলছিল। ভাল পাত্রের সন্ধান এলো। বাবা-মা আর ঘরে বসে খাওয়াবেন না। এবার আসল বিয়ে করতে হবে। পাত্র সুদর্শন, চাকুরী করে। ধুমধামের সাথেই বিয়ে হলো। শ্বশুর বাড়ি গমন। এক বছর পরেই পুত্র হলো। সবাই খুশীতে দশখান।

১৯৭১ সাল। হঠাৎ কী যে হলো, চারিদিকে থমথমে অবস্থা! গুলির আওয়াজ। ২৫ মার্চের ভয়াল রাত। ঢাকা যেন শ্মশানপুরী। সবাই নিস্তব্ধ। ভয়ে ঘরে জড়ো-সড়ো। তিন-চার দিন পর স্বামী গেলেন কর্মক্ষেত্রে, ফিরলেন না। কোন খোঁজ-খবর পাচ্ছিনা। আশে-পাশের সবাই গ্রামের দিকে পালাচ্ছে। আমরাও যাব ভাবছি।

কয়েকদিন পর খুব ভোরে রওনা হলাম। কিছুদূর যাবার পর একটি জিপ এসে আতর্কিত থামলো। কোন কথা বাদেই শ্বশুর-শাশুড়িকে ব্রাশ ফায়ার করল। রক্তে রঞ্জিত হয়ে লুটিয়ে পড়ল। চার-পাঁচজন আমাকে টানছে। কেউ কেউ কিল-ঘুষি-থাপ্পড় মারছে। কোলে আমার ছেলে। আমিও ডানপিটে মেয়ে। সমানে ধস্তাধস্তি করছি। আমার সাথে সুবিধা করতে না পেরে ছোঁ মেরে আমার ছেলেকে টেনে নিয়েই পিচের রাস্তায় জোরে এক আছাড় মারল। সাথে সাথেই তার মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে গেল। আমি সম্বিত হারালাম। জ্ঞান ফিরলে দেখলাম আর্মিদের ব্যারাকে। রাতেই হলো বিভীষিকাময় অত্যাচার। আমি ভাবতে পারিনা-একটি তুলতুলে শরীরে কীভাবে এতো অত্যাচার করা যায়! একের পর এক পাঁচ-ছয়জন। ওদের কোন ক্লান্তি নেই। ওরা চলছে তো চলছেই। শাড়ি-কাপড় খুলে নিয়েছিল আগেই-যেন গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে না পারি।

লজ্জা কাকে বলে? কোথায় তার বসবাস? পাশের বাড়ির বড় ভাইয়ের বন্ধুকে চা দিতে যেয়ে একটু হাতে হাত লেগেছিল, সারারাত মুখটি লাল হয়েছিল লজ্জায়। তার সামনে যাইনি বহুদিন। এখন একগুচ্ছ বিবস্ত্র মেয়ে এক সাথে থাকি অন্ধকার ব্যারাকে। কেউ কারো দিকে ঠিক মতো তাকাই না। ওরা প্রতিরাতেই আসে। পালা করে আমাদের তুলে নিয়ে যায়। একদিন এক মা ও মেয়েকে ধরে আনে। একই ঘরের দু’পাশে দু’জনকে অত্যাচার করে আমাদের সাথে রেখে যায়। ওরা নাকি সাচ্চা মুসলমান! এ কোন রীতি? মায়ের দেয়া দুধ-ভাতও না খেয়ে সরিয়ে দিয়েছি কতদিন! এখন শত্রুর দেয়া রুটি আর ডাল পাষণ্ডের মতো খেয়ে ফেলি নিঃশব্দে।

এক মাতাল রোজ এসে আমাকে অত্যাচার করে। পরে লাথি-কিল-চড় মেরে রেখে যায়। খুব রাগ হয়। কিন্তু কোন উপায় নেই। আমি কি বেঁচে আছি, নাকি মরে গেছি বুঝিনা। জীবিত লাশ সম্ভবত এমনই হয়। একদিন সে যথারীতি অত্যাচার করে তার মহান অঙ্গটি জোর করে মুখে ঢুকিয়ে দেয়।  আমি সহ্য করতে না পেরে সব ক’টা দাঁত বসিয়ে দিলাম। সে কুঁকড়ে উঠে সরে গেল। বুঝলাম-আজই আমার শেষ রাত। এরপর দড়ি দিয়ে আমার চুল বেঁধে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে ফ্যান চালিয়ে দিল। চিৎকারে চিৎকারে আমি অসহায়। এরপর জ্ঞানহীন। পরে শুনেছি আমার আর্তহাহাকার শুনে কোন এক সিপাহী এসে ফ্যান বন্ধ করে দেয়। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে পেলাম হাসপাতালে। কিছুটা সুস্থ হলেই পাঠিয়ে দেয়া হলো ব্যারাকে। দু’তিন দিন আর কিছু হলো না। তারপর যথারীতি শুরু হলো অত্যাচার। একেকবার এক এক দল আসে। ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো নরম শরীরগুলো নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করে। তারপর চলে যায়। আমার ছেলের কথা মনে পড়ে। আমি অবচেতন হয়ে যাই।

কয়েক মাস এভাবে কেটে গেল। মাঝে মাঝে দেয়ালে কান পেতে থাকি। হঠাৎ একদিন শুনলাম ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। জীবন্ত লাশগুলো নড়ে-চড়ে উঠল যেন। এখন আর তেমন কেউ আসেনা। বিষয় কী, ঠিক বুঝতে পারিনা। কেউ একজন এসে বলল, দেশ স্বাধীন হয়েছে। চোখে-মুখে আলোর ঝিলিক। একটি বড় গাড়ি এসে থামল মনে হয়। দরজা ভেঙে এগিয়ে এলো। আমরা ভয়ে নিশ্চুপ। তারা বলল-মা, আপনারা আসেন। কিছু পোষাক দিল। হঠাৎ মা সম্বোধন কেমন যেন লাগল। ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল ঢাকায়। এতদিন কোথায় ছিলাম, কোন অন্ধপুরীতে জানিনা। যারা স্বেচ্ছায় বাড়ি যেতে চাইল, ওরা তাদের কিছু টাকা দিয়ে ছেড়ে দিল। দ্রুত রিকশা নিয়ে বাসায় আসি। শ্বশুর-শাশুড়িকে মেরে ফেলেছে। আমার সন্তানকে আমার সামনেই আছড়ে মেরেছে। ননদ-দেবর-বর কেউ আছে হয়ত, এ আশায় গেলাম। ননদ,দেবর আমায় দেখে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠল। আমিও অনেকক্ষণ ওদের ধরে কাঁদলাম। শান্ত হবার পর শুনলাম, আমার স্বামী অফিসে যাচ্ছে নিয়মিত। সন্ধ্যায় ফিরবে। অপেক্ষায় আছি। ছটফট করছি। দু’চোখ ভিজে আসছে বারে বারে। মাথাটা যেন ঘুরে উঠছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। তিনি এলেন। এসেই আমাকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, তুমি এখানে এসেছ কেন? মরনি এখনও! বেরিয়ে যাও। আমি নির্বাক হলাম। আমি হতবাক হলাম। আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো। আমার ভেতর ভেঙে-চুরে গুঙিয়ে উঠল। আমি প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। রিকশা নিয়ে ছুটে চলেছি আশ্রয় কেন্দ্রে। আমার বাবা-মাকে চিঠি লিখলাম। বাবা এলেন কয়েকদিন পর। দেখে হাউ-মাউ করে কান্নাকাটি। আমি পোষাকগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি দেখে বাবা বললেন, এখন তোমার যাওয়ার দরকার নেই, এখানে কিছুদিন থাক। তোমার ছোট বোনের বিয়ে হবে শীঘ্রই। তোমার না যাওয়ায় ভাল। আমার কিছু বলার ছিলনা। বুকের ভেতর হাজারো কান্না চেপে রেখে নির্বাক রইলাম। মাকে কতদিন দেখিনি।

আমার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা। পড়তে চাই। কে পড়াবে আমাকে? যারা আমাদের দেখা-শোনা করছিল, তারাই ব্যবস্থা করে দিল। কিন্তু মাথা আমার মাঝে মাঝে কেমন করে ওঠে! খুব ব্যথা হয়। পড়াটা শেষ হলো না। সন্তানের মৃত্যু, স্বামীর ঘৃণা, নিজের বাবার অবহেলা, মনে হয় কেন বেঁচে আছি? মাঝে মাঝেই জ্ঞান হারাতাম। জেনেছিলাম বঙ্গবন্ধু আমাদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছে। এ কেমন বীরাঙ্গনা? স্বামী, বাবা, পরিবার সবাই পরিত্যাগ করে! রাস্তায় বের হলে লোকজন শিষ দেয়। একদল কিশোর আমাকে দেখে ‘বেবুশ্যে মাগী’ বলে দৌড়ে পালায়। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা। কিন্তু পড়তে পারিনা। এলাকার কলেজে যাই, কিছুক্ষণ বসে থাকি, তারপর আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসি। সব কিছু ঠিক করে আর মনে রাখতে পারিনা। কখন কি করি, ঠিক নেই। মাঝে মাঝে ওরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। বেশ কিছুটা উদ্ভ্রান্ত। কলেজের মাঠে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কে যেন আরেকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে, এ কে? কিছুটা দূরে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। শুনতে পেলাম, তারা বলাবলি করছে, ‘ও ফতে পাগলী। মাঝে মাঝে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, আবার চলে যায়।’ ফিসফিস করে আরও কী যেন বলল, বুঝতে পারলাম না।

আমি ফতে পাগলী। হ্যাঁ, আমি ফতে পাগলী। অনেক আগের সেই রূপবতী ফাতেমা। আমি মরে যেতে পারিনি। কাপুরুষ স্বামী-বাবা আমাদের রক্ষা করতে পারেনি। আবার জীবন্ত লাশ হয়ে ফিরে আসলেও তারা মেনে নেয়নি। ওদের প্রতি আমার কোন ঘৃণা নেই। ওদের আমি দয়া করি। বেঁচে আছি বঙ্গবন্ধুর বীরাঙ্গনা হয়ে। আমি ফতে পাগলী।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত