সবার সাথে বিদায় নিয়ে,শেষবারের মত মায়ের দিকে তাকালাম।তাকিয়ে আর নিজেকে আঁটকিয়ে রাখতে পারলাম না।ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
নিজের অজান্তে চোখ বেয়ে অঝোর ধারাতে অশ্রুজল ঝরে পড়তে লাগলো।
আমার থেকে মা আরো বেশি কাঁদছে,কিন্তু সেটা আমাকে আঁড়াল করে।
বাবা, ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করবি,কারো সাথে কোনো রকমের ঝামেলাতে জড়াবি না।নিজের খেয়াল তো করিস না কি অবস্থা করেছিস শরিরের,আর হ্যা ব্যাগের ভিতরে তোর প্রিয় নারিকেলে নাড়ু আর পায়েস রান্না করা আছে।”পায়েস টা বাসের ভিতরে খেয়ে নিস না হলে নষ্ট হয়ে যাবে।
আচ্ছা খাবো মা,তুমিও তোমার শরিরের দিকে একটু নজর রেখো,আর আমি এখন আর সেই ছোট্ট টি নেই।
মা’য়ের চোখের দিকে চেয়ে দেখলাম,চক্ষু দুটো রক্তবর্ণ হয়ে আছে।
বুঝতে বাকি রইলো না,আমার চলে যাওয়াতে মা অনেক আগে থেকে কেঁদেছে,যার কারণে এমনটা হয়েছে।
বাবা-মা আর পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম।
চলে আসার সময় যতবার পিছু ফিরে তাকিয়েছি ততোবারই লক্ষ্য করলাম মা অঝোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,আর বার বার চোখের পানি মুচছে।
নিজেরও খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তারপরো যেতে হবে।
শেষবারের মত মায়ের দিকে তাকিয়ে বাসে উঠে পড়লাম।
বাসের ছিটে বসে বসে ভাবছিলাম,ফেলে আসা দিন গুলোর কথা।
কতই না সুন্দর ছিলো,তখন হয়তো একটু বিরক্ত লাগতো।
কিন্তু এখন সেই শৈশবটা কে খুব মিস করি।
মিস করি মায়ের বকা,মায়ের হাতে খাবার খাওয়া।
মিস করি,মায়ের শাসনের আঁড়ালে লুকিয়ে থাকা আদরটাকে।
এই ১০ দিনের ছুটিতে দেখেছি মা আমাকে কাছে পেয়ে কতটা খুশি হয়েছিলো।
যেমনটা খুশি হয় বাচ্চার ঈদের চাঁদ টা দেখতে পেয়ে।
মনে হচ্ছিলো মা’য়ের কাছে আমিও ঈদের চাঁদের থেকে বেশি কিছু।
ছোট বেলা থেকে হাজারো আবদার অনায়াসেই মিটিয়েছে,হাজারো কষ্ট মুখ বুুজে সহ্য করার পরও কখনো না বলে নি।
ছোট থাকতে আমার একবার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিলো,
যে কয়দিন ছিলো সেই কয়দিন মা রাতে ঘুমোতেও পারতো না।
সারারাত জেগে আমার মাথার পাশে বসে থাকতো।যখনই ঘুম থেকে জেগে উঠতাম তখনি চোখ মেলেই দেখতাম,মায়ের আদরমাখা কোমল হাতটা আমার মাথার উপরে রাখা আছে।
হাজারো দুষ্টুমি হাসি মুখে মেনে নিতো।
যখন বাইরে থাকি তখন মায়ের কথা সব থেকে বেশি মনে পড়ে আর কষ্ট দেয়।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে দু চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমে গেছে নিজের বুঝতে পারি নি।
পাশের ছিটে বসে থাকা,এক ভাই এর কথা শুনে বাস্তবে ফিরলাম।
:-ছোট ভাই কাঁদছো কেন?
:-বাড়ি থেকে আবার চাকরিতে ফিরে যাচ্চি,তাই মায়ের জন্য মনটা খারাপ ।
:-আমার কথা শুনে পাশে থাকা লোকটি বাচ্চাদের ঢুকরে কেঁদে ফেললো।
:-আপনি কাঁদছেন কেন?
:-আমি এমনই অভাগা সন্তান যে বেঁচে থাকাকালীন সময়ে মায়ের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি,বউ এর কথা শুনে।
বউ কে বেশি প্রধান্য দিতাম।
মা কে অনেক কষ্ট দিয়েছি।
অবশেষে কষ্ট সহ্য না করতে পেরে মা মারা যাই।
তখনি মায়ের গুরুত্ব বুঝেছি।
কিন্তু অনেক দেরিতে,তখন মা অনেক দুরে চলে গেছে।
লোকটি কথা গুলো বলছিলো আর বাচ্চাদের মতন করে চোখের জ্বল ফেলছিলো।
কথা গুলো শুনে,রাগ করবো কি,শান্তনা দিবো বুঝতে পারছিলাম না।
তবুও খুব রাগ হয়েছিলো,ইচ্ছে করছিলো ঠাটিয়ে দু গালে দুটো চড় মারি।
কিন্তু বয়সে বড়,বিধায় মারতে পারলাম না।
:-ভাইয়া,আপনার বউ কি এখনো আছে?
:-হ্যা আছে,তবে মা মারা যাওয়ার পরে ভেবেছিলাম বউ কে তালাক দিয়ে দিবো।
:-তালাক দেন নি ভালো করেছেন,তালাক দিলে তো আর আপনার মা ফিরে আসবে না।
নামাজ পড়েন?
:-হ্যা পড়ি।
:-প্রতি নামাজে আপনার মায়ের জন্য দোয়া করবেন,এতেই হয়তো আপনি মুক্তি পেতে পারেন,কারণ বাবা-মা তো আর আমাদের মত না তারা অনেক দরদি হয়।
আর হ্যা আপনার শ্বাশুড়ি বেঁচে আছে।
:-হ্যা আছে।
:-তাকেই এখন থেকে মা বলে ডাকবেন,তাহলে আপনার স্ত্রীর অনুশোচনা হবে।
:তুমি ছোট হয়েও এত কথা জানো কি করে।
:-জানার জন্য বয়স লাগে না,একটু বাস্তব ধারনা থাকলেই হয়।
যাই হোক যে গুলো বললাম মনে রাখলেই হবে।
তারপর ঐ ভাই নেমে গেলো।
আবারো ভাবতে লাগলাম,
এরা আবার কেমন সন্তান, যে বউ কে পেয়ে মা য়ের এতদিনের ভালোবাসাকে ভুলে যেতে একটা মিনিট ও সময় নেই না।
সাথে সাথে প্রতিজ্ঞা করলাম,জীবনে সেই মেয়েকেই আমার বউ বানাবে যে আমার থেকে আমার মা’কে বেশি ভালবাসবে।
কারণ বউ এর জন্য মা’য়ের চোখ দিয়ে কোনোদিন ও অশ্রু ঝরতে দিবো না।
বউ এর স্বার্থ লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার জন্য,সারাজীবনে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা মমতাময়ী মায়ের ভালোবাসা আমি হারাতে চাই না।
সুখে থাকুক সারাজীবন বেঁচে থাকুক এই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মানুষ গুলো।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প