স্যার, বাড়িটা পছন্দ হয়েছে?
বলেই রহমত আমার দিকে কাচুমাচু করে তাকালো। গাড়ি থেকে নেমেই বাড়ির কিছুটা ঘুরে দেখলাম । দারুণ পছন্দ হলো বাড়িটা । রহমতের প্রশ্ন শুনে
আমি ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম,
– হ্যাঁ রে. একদম আমার মনের মতো। আমি যেমন বলেছিলাম এটা ঠিক তেমনই বাড়ি। এতো সস্তায় এতো সুন্দর বাড়ি পাওয়া যাবে ভাবিনি।
– কিন্তু স্যার… মানে …
– আহা তুই এমন করছিস কেন? কোন সমস্যা?
– মানে স্যার আপনি যেমন যেমন বলেছেন ঠিকমত মিলাতে গিয়ে এটা ছাড়া আর কোন বাড়ি পাইনি। কিন্তু…
– তাহলে আবার কিন্তু কেন রে…. সামনের সপ্তাহেই তোর ম্যাডামকে এনে দেখাব। ও অনেক আপত্তি করেছিল বাড়িটা কিনতে এমন বাড়িতে নাকি ভূত থাকে । হা হা। কিন্তু এই মুহূ্র্তে আমার এমন একটা স্থানের খুব দরকার ছিল।
আমার হাসি শুনে রহমত যেন আরও ভয় পেল।
– স্যার , ম্যাডাম ঠিকই বলেছেন । শুনলাম এখানেও নাকি ভূত আছে।
এবার আমি বিকট জোরে হেসে উঠলাম ।
– আমাকে তুই ভূতের ভয় দেখাস রহমত। দেশের বাইরে ২৯টা দেশে গিয়ে কোনদিন একটা ভূতের সাক্ষাতও পেলাম না।
– কিন্তু স্যার গতকাল নাকি হাসেম বাজার থেকে ফেরার পথে একজন ওকে বলেছিল , এই বাড়িতে নাকি ভূত থাকে। আমার ভয় লাগছে স্যার।
– ঠিক আছে তোর ভয় লাগলে তুই হাসেমের সেই আত্মিয়ের বাড়ি চলে যা। আমিই রান্না করে খেতে পারবো। ৫দিন পর গাড়ি নিয়ে এসে আমাকে ঢাকাতে নিয়ে গেলেই হবে। এখন চল বাড়িটা একটু ঘুরে দেখি।
হাসেম রহমতের খালাতো ভাই। হাসেমের এক আত্মিয়ের বাড়ি এখান থেকে ৫মাইল দূরে। তার মাধ্যমেই রহমত এই বাড়িটার খোঁজ পায়। কিন্তু রহমত আগে জানতো না এখানে ভূত থাকে তাহলে আমাকে কিনতে দিত না। আমার আদেশ পেয়ে
ভয় ভয় চেহারা নিয়ে রহমত আমার সাথে চলতে লাগলো। প্রায় ১একর জায়গায় বিশাল জমিদার বাড়ি। অযত্ন আর অবহেলায় চারদিক জঙ্গলে ভরে গেছে। চারদিকে বিভিন্ন ফলের বাগান। গাছে আম পেকে আছে , পাখিতে খাচ্ছে। মানুষজনের কোন চিহ্নও নেই। এমন একটা বাড়িই আমি চেয়েছিলাম। নতুন একটা উপন্যাস লেখার কাজ হাতে নিয়েছি। শহরের ব্যস্ত পরিবেশে সেটা লেখা সম্ভব না। আমার লেখালেখি ও প্রকাশনী নিয়ে এতো ব্যস্ততা আমার স্ত্রী পছন্দ করে না। ও চায় ভালোভাবে ব্যবসাতে মন দেই। কিন্তু আমার এই উপন্যাসটা লিখতেই হবে। প্লটটা একদম অন্যরকম। ভূতুরে টাইপ উপন্যাস , খুব হিট হবে আশা করি। এজন্য দরকার একটা নির্জণ ভূতুরে বাড়ি। নামমাত্র দামে বাড়িটা কিনলাম এখন মনে হচ্ছে আরও দু’লাখ বেশি চাইলেও আমি এটা নিতাম। রহমতের কাছে বর্ণনা শুনেই একদিনের মধ্যে কিনে ফেললাম। উপন্যাসের কাজটা যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে। প্রথমবার এলাম তাই ৫-৬ দিন থেকেই চলে যাব। আবার এসে একটানা ১০-১২ দিন থেকে উপন্যাসটা শেষ করেই যাব। হাঁটতে হাঁটতে দীঘির পাড়ে চলে এলাম।
-স্যার এটা ‘লাল দীঘি’। পানিগুলো কেমন লাল দেখাচ্ছে দেখেন।
– সত্যিই রহমত অপূর্ব! এমন দৃশ্য আর দেখিনি।
দীঘির মধ্যে ফুটে আছে অসংখ্য লাল পদ্ম। সূর্যের আলো দীঘির পানিতে তীর্যকভাবে পতিত হয়ে পদ্মের গায়ে পড়ে পানিটাকে লাল দেখাচ্ছে। এতো সুন্দর একটা বাড়ি কিনে দেবার জন্য তোমাকে ১০হাজার টাকা বকশিশ দেব।
রহমত আমার গাড়ির ড্রাইভার । অনেক নম্র-ভদ্র। আমার যথেষ্ট কেয়ার করে। আমার বকশিস দেবার খবরেও ওর চোখেমুখে বিন্দুমাত্র আনন্দ দেখলাম না। ও হয়তো আমার বিপদের আশংকায় অস্থির আছে।
– বখশিস লাগবে না স্যার। আপনি একা এখানে থাকতে পারবেন না স্যার। বিপদ হতে পারে। আমরা ফিরে গিয়ে রাসেল , আনিস ওদের ৪-৫ জনকে নিয়ে আসি। অনেকে থাকলে ভূত কিছু করতে পারবে না।
– আমি ভূতকে নিয়েই গল্প লিখবো। ভূত আমাকে কিছুই করবে না। তুই অযথাই টেনশন করছিস রহমত। ক্ষুধা লাগছে খাবার বের কর।
লেখালেখি আমার শখ কিন্তু পেশা এখন ব্যবসা। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেবার পর সময় যেন আর কাটেই না তাই ব্যবসাতে মন দিয়েছিলাম। পাশাপাশি শখের বশে লেখালেখি শুরু করেছি। সামনে প্রকাশনায়ও হাত দেব। নতুন কিছু করায় আমার প্রবল আগ্রহ কাজ করে। এই উপন্যাসটা দিয়েই আমি প্রকাশনীর জগতে আসতে চাই। ‘নহলী’ নামক যে প্রকাশনী করেছি তাতে নবীন লেখকদের পাশাপাশি আমার নিজের লেখাও থাকবে। তাই উপন্যাসটাকে যথাসম্ভব নিঁখুত করতে হবে। সেজন্যই এমন পরিবেশে আসা।
খাবার বের করে রহমত তা সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো টেবিলে।টেবিলটা খুব সুন্দর । পুরনো ডিজাইন হলেও দেখতে খুব সুন্দর। ঘরে কিছু কিছু আসবাবপত্র অক্ষতই আছে। দুইটা খাট , একটা আলমারি, এই ডায়নিং টেবিলটা খুব সুন্দর। দেখে মনেই হয় না এগুলো শত বর্ষ পার করেছে। খেতে বসে লক্ষ্য করছি রহমতের গলা দিয়ে খাবার নামছে না।
– কিরে খাচ্ছিস না?
– এই তো খাচ্ছি স্যার। আসলে তেমন ক্ষুধা লাগেনি।
– আচ্ছা তুই খেয়ে আমার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যা।
– আপনি একা থাকবেন?
– হা হা হা তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি তো একা থাকতেই এসেছি।
খাওয়া শেষ করে রহমত সব গোছগাছ করল। কিন্তু আমাকে একা রেখে যেতে চাইল না। অনেক বুঝিয়ে শেষে ধমক দিয়ে ওকে ফেরত পাঠালাম। সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। লেখাটা শুরু করতে হবে।
.
ধীরে ধীরে সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে। বাড়িটা অপূর্ব সুন্দর লাগছে। এই বাড়িতে কেন মানুষ বাস করতে আসে না , বুঝলাম না। আমার এতো ভালো লাগছে কী বলবো!
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ইলেকট্রিসিটি নেই তাই চার্জার লাইট নিয়ে এসেছি। মোমবাতিও আছে। গ্যাসের সিলিন্ডারও এনেছি , চুলাসহ। রাতে এককাপ চা বানিয়ে খেলেই হবে।
চারদিকে নিস্তব্ধ নীরব। সন্ধ্যা হবার সাথে সাথেই বাড়িটাতে যেন গভীর রাত নেমে এল। আমি কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লাম। লিখতে খুব মজা লাগছে । আসলে এখানে এসে যে ভুল করিনি তা প্রমান হলো। শহরে থাকলে এতখানি লিখতেই দু’দিন লাগতো। তাও এতো আবেগ দিয়ে লেখা সম্ভব হতো না। ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রেখেছি বারোটার। বারোটা বাজলেই এককাপ চা খেয়ে আবার শুরু করবো। ডংডং করে ঘড়িতে এলার্ম বাজতে শুরু করল। তারমানে বারোটা বেজে গেছে। লেখা রেখে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম ডায়নিংয়ে চিনি রাখা। সেখানে যেতেই অবাক হয়ে দেখলাম টেবিলের উপর গরম চা থেকে ধোঁয়া ওঠছে, সাথে হরেক রকমের পিঠা। চা কে বানাল, পছন্দের পিঠাগুলো কে রাখল? সেটা চিন্তা না করেই পান করতে লাগলাম। আহা! একেবারে আমার স্ত্রীর হাতের চায়ের মতো। ভালোই হলো সময় বাঁচল। দ্রুত কাপটা টেবিলে রেখে লিখতে চলে গেলাম। কলমটা হাতে নিতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে তা লিখতে শুরু করলো। আমি শত চেষ্টা করেও কলমকে থামাতে পারছি না। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেই চলেছে। এইবার আমার কেমন ভয় ভয় লাগলো। এসব কী হচ্ছে আমার সাথে? দেখতে দেখতে খাতা শেষ হয়ে এল। ১০-১২ দিন লাগে যে খাতা লিখে শেষ করতে তা এক নিমিষেই লেখা শেষ! খুব ক্ষুধা লেগেছে। প্রচুর খাবার নিয়ে এসেছিলাম সাথে করে। মনের ভিতরে সূক্ষ্ম ভয়টাকে চাপা দিয়ে খাবার খেতে গেলাম। কিন্তু …. ফাঁকা। বিকেলে রেখে যাওয়া প্রতিটি খাবারের প্যাকেটই এখন শূন্য। কে খেল এত খাবার? আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল।
ঘড়ির দিকে তাকালাম রাত ২টা। অথচ আমার মনে হচ্ছে কয়েকটা বছর কেটে গেছে। উপন্যাস লেখা শেষ। মনের ভিতরে কেমন খুশি লাগছে। ভয়টাও চলে গেছে। বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। কোন বিষয়েই ভয় বেশিক্ষণ থাকে না আমার। নিজের মৃত্যু সামনে দেখলেও ভয় পাওয়ার লোক আমি না। ক্ষুধাটা বাড়ছেই । কিছু খাওয়ার দরকার। উঠে দাঁড়াতেই কে যেন আমাকে ঠেলে নিয়ে চলল। বিশাল একটা রুমে নিয়ে এল আমাকে। আমি নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কেটে দেখলাম সত্যিই জেগে আছি কিনা! রুমভর্তি বিভিন্ন মানুষ। কেউ নাচছে কেউ গান গাইছে। এককথায় বিশাল এক পার্টি। আমার গলা শুকিয়ে এল , আমি প্রচন্ড ভয় পেতে শুরু করলাম। এসব কী দেখছি আমি? মনে মনে অন্যকিছু কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম । দেখলাম ,
আমি মধুপুরের নির্জন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কিন্তু সেখানে কোন শালবন নেই। চারিদিকে শুধু তিন চার ফুট উঁচু একধরণের ঝাঁকড়া মাথার গাছ, যেই গাছ আমি জীবনে কখনো দেখিনি, এমনকি ছবিতেও নয়! সবগুলো গাছের উচ্চতা, আকার, রঙ একই রকম এবং সবগুলো একই রিদমে দুলছে, যেন আমার সাথে কথা বলছে। আমি গাঢ় সবুজ রঙের সেই গাছগুলোর ভেতর দিয়ে খুবই আনন্দে এবং অনির্দিষ্টভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
.
দেখতে দেখতে একসময় আমি অচেতন হয়ে গেলাম। চেতনা ফিরে পেয়ে নিজেকে গাড়ির ভিতরে আবিস্কার করলাম। পাশে আমার স্ত্রী বসে আছে। ধীরে ধীরে রাতের ঘটনা সব মনে পড়লো। আমি উঠে গাড়ি থেকে বের হতে চাইলাম। আর লেখা! আমার প্রকাশনীর প্রথম উপন্যাস! গাড়ির জানালা দিয়ে অদূরে দেখলাম আগুন জ্বলছে। আমার স্ত্রী জোর করে আমাকে বসিয়ে দিলো গাড়িতে।
ড্রাইভিং সিট থেকে রহমত বললো,
– স্যার, ম্যাডাম বলেছেন বাড়িটাতে আগুন দিতে তাই পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বেলে দিছি।
তার মুখে বিজয়ের হাসি।
আমি চিৎকার করে উঠলাম,
– আমার উপন্যাস! হায় হায়! সেটা তো তাহলে পুড়ে গেছে!
আমার স্ত্রী কঠিন চোখে তাকাল। তার এই চাহনীটাকে খুব ভয় পাই আমি।
– এক রাতেই একটা উপন্যাস লিখে ফেলছো? বাহ! তাহলে অমন চিৎপটাং হয়ে সিঁড়ির মুখে পড়ে রইলে কেন?
আমি চুপসে গেলাম তার এই তিরস্কার শুনে।
নাহ! ভূতুরে উপন্যাসটা আর ছাপা হলো না , আমার প্রকাশনী থেকে।
– আসলে … আ আ আমি…
– অমন তোতলাতে হবে না। বাসায় গিয়ে তোমার স্টাডি রুমে বসে রাত-দিন লেখালেখি করিও। আমি আর বাঁধা দেব না। তাও এমন ভূতুরে বাড়িতে থাকার চিন্তা করিও না।
যাক , তবু তো একটা শিক্ষা হলো! কিন্তু আমার উপন্যাসটা? সেটা খুব পড়ে দেখতে ইচ্ছে করছ যে!