ইস! ধরতে পারলাম না। আঙুলে লেগেও ছুটে গেল। ঐ তো, ঐ কড়ই শাখের ডগায় গিয়ে বসেছে ।Ó খুব সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছে রবিন। ইয়া লম্বা লম্বা ঘন ছনগুলো সব এমন ভাবে একদিকে কাত হয়ে আছে; যেন কুঁড়েঘরের চালা। এই ছনচালার ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। পা রাখতে গেলেই শন্শন্ শব্দ। ছনের নিচে অসংখ্য লজ্জাবতী কাঁটা। উপরে দাঁতইগাছ- বেতকাঁটা- তেওড়াকাঁটা- মনকাঁটা- ডেফিলাকাঁটা- লাউঘোরি গাছে জড়িয়ে আছে হাজারো লতা- পাতা। এগুলো ফাঁকা করতে গেলেই নড়ে উঠে অনেক দূর পর্যন্ত। সেই সাথে নড়ে উঠে কড়ই শাখা। উড়ে যায় ভ্রমর। ছিঁড়ে যায় রবিনের বুকের বীণা। গত ক’দিন ধরেই চেষ্টা করছে রবিন একটা ভ্রমর ধরার জন্য। কিন্তু পারছে না কোন ভাবেই। কত শত কাঁটার ঘা যে লেগেছে গায়ে-পায়ে তার হিসাব নেই। ভ্রমর উড়ে গেলেই বেশি টের পায় সেসব ব্যথা। নরম তুলতুলে শরীর। গোলাপি টানটান স্বচ্ছ চামড়ার নিচে উঁকি দিয়ে আছে টক্টকে রক্তের আভা। বয়স মাত্র ৯ বৎসর। স্বাস্থ্য ভালো। বয়সের তুলনায় বেশ বড় সে। শহরে থাকে। পূজার ছুটিতে স্কুল বন্ধ থাকায় নানা বাড়ি এসেছে কয়েক দিন বেড়ানোর জন্য। অনেক বলে কয়ে সেজমামা রাজি করিয়েছেন রবিনের মা কে। মা-বাবাকে বাদ দিয়ে এই প্রথম তার গ্রামে আসা। স্কুল বন্ধের সময় সেজমামা বাসায় না গেলে এবারও সম্ভব হতো না আসা। বেড়াতে আসাতো মুখের কথা মাত্র; ভ্রমর ধরাই আসল টারগেট। প্রাইভেট টিচারের নিকট থেকে ভ্রমর ধরা ও ঘুরানোর গল্প শুনার পর থেকেই রবিনের মাথায় ঢুকেছে এই চিন্তা।
সবুজ পাহাড় এলাকার সবচেয়ে বড় ও নির্জন তার নানাভাইয়ের এই ছন বন। বিশাল আম- জাম- কাঁঠাল- লট্কন-পেয়ারা বাগানের তিন দিকের ঢালু জমিতে এর অবস্থান। এটির তুলনায় কিছুই না দাদা বাড়ির ছন্চালা। তাছাড়া এত লক্লকে ছোট ছোট কড়ই গাছও নেই দাদা বাড়ির ছন্চালায়। যেখানে কড়ই গাছ, সেখানেই ভ্রমর। ভ্রমরের খুব প্রিয় খাবার কড়ই শাখের কচি পাতা। Òবাহ্! ঐখানে দেখি দুই- তিনটে ভ্রমর।Ó শিয়াল চলাচলের রাস্তা ধরে রবিন এগিয়ে যায় সেখানে। ভাবে- Òএবার নিশ্চিত ধরা যাবে যে কোন একটা। সবচেয়ে বড়টাই ধরবো।Ó কালো- নীল- সোনালি চক্চকে শক্ত পাখায় ঝল্মল করছে আশ্বিনের দুপুর রোদের আলো। ব্ম্বু্ম্ ভ্রমর ঘুরছে রবিনের চোখের ভেতর। হাত বাড়াতেই উড়ে গেল কাছের ছোট ভ্রমর দু’টি এবং এ দুÕটির দেখা দেখি উড়ে গেল বড়টিও। যেন বজ্রপাত হল রবিনের হৃদপিন্ডে। আরো অসহনীয় মনে হচ্ছে সূর্যের তীব্রতা। ব্যথা হয়ে যায় হাঁটুতে। কোন উপায় নেই সম্পুর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়ানোর। কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেয় ঘন লতা জড়ানো কড়ই গাছের ছায়ায়। বেড়ে যায় পানি পিপাসা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ‘যতই কষ্ট হোক আজ ভ্রমর না নিয়ে বের হব না এই জঙ্গল থেকে। আজকেই রোদ সবচেয়ে বেশি। এমন রোদ নাও থাকতে পারে কাল-পরশু’। প্রাইভেট টিচার ঠিকই বলেছিলেন- যে দিন রোদ বেশি থাকে, সে দিন ভ্রমরও বেশি আসে। হঠাৎ ব্ম্বু্ম্ শব্দ। মনেহয় খুবই কাছে। এদিক সেদিক তাকায় রবিন। ঠিক তার মাথার উপরে উড়ছে বড় একটি ভ্রমর। ভ্রমরের সাথে সাথে ঘুরছে রবিনের চোখের দৃষ্টি। কোথায় বসে! কোথায় বসে! এইতো বসেছে কড়ই শাখের ডগায়। একেবারেই হাতের কাছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘাড়ের ছোট ছোট তিল। একটু একটু করে কেটে খাচ্ছে লক্লকে তেল্তেলে সবুজ ডগা। মনে হয় মজা পাচ্ছে খুব। দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে খাওয়ার গতি। সারাদিন পর মাছ-ভাত পাওয়া ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকের মত। মনে হয় খেয়াল করছে না কিছুই। একমনে গিলছে আর গিলছে। খুব সাবধানে হাত বাড়ায় রবিন। ঘন লতাপাতার মঝে ছোট্ট একটা ফাঁক। কোথাও হাত স্পর্শ করলেই উড়ে যাবে ভ্রমর। আস্তে, আস্তে! রবিনের হাত উঠে গেলো কড়ই ডগাটির উপরে। ট্ক্টুুক্ শব্দ হচ্ছে তার বুকের ভেতর। কাঁপতে থাকে অর্ধ সোজা হাঁটু। কিঞ্চিত কেঁপে উঠে হাত। নিজেই বন্ধ করে নেয় দম। আস্তে! ধীরে। আস্তে! খপ্ করে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় ভ্রমর। রবিনের আঙ্গুলের ভাঁজ ঢুকে পড়ে ভ্রমরের ঘাড়ের কলে। বন্দি করার প্রতিবাদে ভ্রমর কেটে নেয় রবিনের তুল্তুলে আঙ্গুলের মাংস! গড়িয়ে আসে এক ফোঁটা রক্ত! তবু ব্যথাই যেন পাচ্ছে না রবিন। খুব কৌশলে গেঞ্জির পকেটে রেখে দিল ভ্রমর।
কিছুতেই সংগ্রহ করতে পারছে না গরুর লেজের লম্বা চুল। লেজে হাত দিতে গেলেই চটে যায় গরু। ছোট লেজের চুলে ভ্রমর বাঁধলে ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। বড় গরু গুলোর এত রাগ যে, পিছনে গেলেই লাথি মারে; লেজে হাত দেয়া তো দূরের কথা। রবিন ভেবে পায় না এসব গরু দিয়ে কিভাবে যে হালচাষ করেন সেজমামার ঐ বেঁটে মত কাজের লোকটা! যে দুÕটি গরুর লেজ বড়; ঐ দুÕটিরই ইয়া বড় বড় শিং, লাল মাংসের মত চোখ, ঊটের পিঠের মত উঁচু উঁচু গজ। দেখলেই ভয় লাগে! গুঁতা দেয়ার জন্য তেড়ে আসে বারবার। অথচ কিছুই করে না কাজের লোকটাকে এবং সেজমামাকে।
গত কালও তো কাজলা গরুটার লেজ থেকে ছারপোকার ন্যায় অনেক ছোট-বড় রক্তচোষা পোকা ছাড়িয়েছেন সেজমামা। গরুর গায়ে কামড় দিয়ে আঠার মত লেগে থেকে সারাক্ষণ রক্ত চোষে বলেই নাকি এ পোকার নাম হয়েছে ‘আটাঁলি’। জোঁক স্বভাবের আঁটালির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই মনে হয় গা এলিয়ে চুপচাপ শুয়ে ছিল গরু । নির্ভয়ে শালিকও এসে খুঁটে খুঁটে আঁটালি খেয়েছিল গরুর গা-কান থেকে। গরুটাও জিব দিয়ে বারবার চেঁটে দিচ্ছিলো মামার শরীর। শেষে বিরক্ত হয়ে মুখেই মেরেছিলেন থাপ্পর। বিন্দুমাত্রও ক্ষ–ব্ধ হয়নি গরু। চুপ করেছিল মাথা নিচু করে। অবাক হয়ে ভাবছিল রবিন- প্রতিপালকের অবাধ্য হয় না পশু! তখন মামাকে বললে কত সহজেই পাওয়া যেত লেজের লম্বা লম্বা চুল। আজ কখন জানি মামা ফিরে আসে মরজাল বাজার থেকে। এত কষ্ট করে ভ্রমর ধরে চুলের অভাবে ঘুরানো যাবে না এক বিকেল; এটি মেনে নিতে পারছে না রবিন। বিশেষ করে ওর চোখের সামনে যখন ঝুলছে মেডিকেলের ফ্লোর পরিষ্কার করার লাছার মত বড় বড় লেজের চুল। Òকিভাবে যে একটা চুল ছিঁড় আনা যায় লেজর আগা থেকে! কিভাবে, কিভাবে…? Ó রবিন নিজেকেই প্রশ্ন করে বারবার। অবশেষে একটা বুদ্ধি আসে মাথায়। আমড়া গাছের নিচে থেকে নিয়ে আসে লম্বা চিকন বাঁশ। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে খুব কৌশলে বাঁশের ফাটা মাথায় পেঁচিয়ে ফেলে বড় গরুটির লেজের চুল। সঙ্গে সঙ্গে সাঁইকরে লেজ উঁচিয়ে ছুঁড়ে মারে পিছনের পা। আনন্দে ভরে উঠে রবিনের মন। বাঁশের ফাটা মাথায় আট্কে আসা চুল থেকে মোটা-লম্বাটি বেছে নেয় রবিন। অত্যন্ত সতর্ক ভাবে চেইন খুলে গেঞ্জির পকেট থেকে হাতে নেয় ভ্রমর। ওর প্রাইভেট টিচারের নিকট থেকে জেনে নেয়া কৌশলে চুলের দুই মাথায় শক্ত করে বাঁধে ভ্রমরের দুই পা। অন্য চার পায়ে কিল্বিল্ করে প্রতিহত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ভ্রমর। পা নাড়ানাড়ির কারণে বেশ কিছু সময় নষ্ট হয় রবিনের। চাউল কলের ফিতার মত বৃত্তাকার চুলটিতে গেঁথে দেয় প্রায় একফুট দীর্ঘ পাটকাঠি। ধরে রাখে দুই মাথায়; ঠিক যেন ঘুড়ির লাটাই। মুক্তি পেয়েছে মনে করে উড়তে থাকে ভ্রমর। ঘুরতে থাকে পায়ে বাঁধা চুলের সীমানায়। রবিনের কানে লাগে ব্ম্বু্ম্ ু- বুম্ব্ম্ ুশব্দ! বুকে বাজে কাঙ্খিত আনন্দ সঙ্গীত। আগে কখনো সে পায়নি এত আনন্দ! স্কুলের দৌড়ে বা পরীক্ষায় প্রথম হলেও এমন লাগে না তার। ঈদে কিংবা জন্মদিনে নতুন জামাও দিতে পারে না এমন আনন্দ! এ আনন্দ যেন বিশ্ব জয়ের! এ আনন্দ একান্ত নিজের।
গ্রামের বাড়িতে যেন ১০টা না বাজতেই গভীর রাত! সবাই ঘুমিয়ে। মাটির দেওয়াল ঘেরা টিনের ঘরের পাটাতনে রাখা ধান খেয়ে আনন্দে কিচিরমিচির করছে অনেকগুলো ইঁদুর। নানুর পায়ের কাছে ঘুমন্ত বিড়ালের গলার র্গর্গ শব্দ। সাঁই সাঁই শব্দ করে লেজ দিয়ে মশা তাড়াচ্ছে গোয়ালের গরু। ঘরের উপরে হেলে থাকা বড় তেঁতুল গাছে বসে একমনে কু কু ডাকছে পেঁচা। রবিনের চোখে ঘুম নেই। ভাবে কালই চলে যাবে বাসায়। ভ্রমর ঘুরিয়ে দেখাবে বন্ধুদের। রাতে বন্দি করে রাখবে ফিল্মের স্বচ্ছ খালি কৌটায়। সাথে দিয়ে রাখাবে কিছু কড়ইয়ের ডগা। বাইরে থেকে দেখবে কিভাবে খায়। বিছানা থেকে উঠে হাত ছোঁয়ায় চেয়ারের পিঠে রাখা গেঞ্জিতে। পকেটের গায়ে আল্তো ভাবে ধরে খেয়াল করে আছে কিনা ভ্রমর। হ্যাঁ, আছে। ভালোভাবে চেইন লাগানো হয়েছে কি না নিশ্চিত হয়ে এসে শুয়ে পড়ে বিছানায়। মনে পড়ে ওর নানুর কথা-‘ভ্রমরটা তুই ছেড়ে দে ভাই। স্বাধীনতা হরণ করা মহাপাপ। এভাবে বন্দি করে রাখলে এটা বাঁচবে না।’ এত কষ্ট করে ভ্রমর ধরে ছেড়ে দেবে, এমনটি যেন ভাবতেই পারে না রবিন। ভীষণ রাগ হয় নানুর উপর।
ঘুমে চোখে বন্ধ হয়ে আসে এক সময়। লিফ্টে আট্কা পড়ে কান্নাকাটি শুরু করে রবিন। কে জানে কখন আসে বিদ্যুৎ। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার! কপালের ঘাম এসে মিশে যাচ্ছে চোখের পানিতে। ক্ষুধায় জ্বলছে পেট। পিপাসায় আড়ষ্ট হয়ে আসছে কণ্ঠ। দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে হাত-পায়ের কাঁপন। দাঁড়ানো থেকে বসে এবং বসা থেকে শুয়ে পরে লিফ্টের মেঝেতে । ধীর ধীর নিস্তেজ হয়ে পড়ছে শরীর ও কণ্ঠ । চিৎকার করার চেষ্টা করছে সর্ব শক্তি দিয়ে। কিন্তু পারছে না! মনে মনে প্রত্যাশা করছে সৃষ্টিকর্তার সহায়তা। ক্ষমা প্রার্থনা করছে অতীতের সকল কৃত অপরাধের। হঠাৎ নানুর ডাকে ঘুম ভাঙে রবিনের। ভেঙে যায় দুর্বিসহ দুঃস্বপ্ন। মুক্তি পায় বন্দি জীবন। বুক ভরে টেনে নেয় ভোরের নির্মল বাতাস। কড়্কড়্ শব্দ হয় গেঞ্জির পকেটে। ভ্রমর এখনো চালাচ্ছে মুক্তির চেষ্টা। রবিন বুঝতে পারে বন্দি ভ্রমরের কষ্ট! কেঁদে উঠে বুকের ভেতর। পকেটের চেইন খুলে হাতে নেয় ভ্রমর। চলে যায় উঠানে। গত কালের মত চক্চক্ করে না ভ্রমরের পাখা। ছোড়াছুড়ি করে না হাত-পা । আগের মত গায়ের সাথে ঠিক মিলছে না উপরের শক্ত পাখা । নিচে থেকে বেরিয়ে আছে কার্বন কাগজের মত হালকা পাখার অংশ । ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিধ্বস্ত ভ্রমর দেখে খুব মায়া হয় রবিনের। খুলে দেয় পা থেকে চুলের গিঁট । কিন্তু উড়ে যায় না ভ্রমর! যেন বুঝতেই পারে না, সে মুক্ত হয়েছে কিনা। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে রবিনের খোলা হাতের তালুতে। ভ্রমরের গায়ে ফুঁ দেয় রবিন। আরো জোরে ফুঁ দিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয় ভ্রমর! সূর্যের আভায় লাল হয়ে উঠা মেঘমুক্ত আকাশ! উড়ে চলা ভ্রমরের দিকে রবিনের অপলক চোখ।