শার্দূল সিংয়ের কৃপাণ

শার্দূল সিংয়ের কৃপাণ

চোখের সামনে কেউ বিপদে পড়লে মহীতোষ রায় কখনই নির্লিপ্ত থাকতে পারেন না। এজন্য ঝামেলা কম পোয়াতে হয়নি। শুভার্থীরা এসব ব্যাপারে না জড়াতেও পরামর্শও দিয়েছেন। কিন্তু মহীতোষবাবু কানে তোলেননি।

ব্যতিক্রম হয়নি আজও। অফিসের কলিগদের সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে এসেছিলেন। আসলে অডিটের কাজে আসতে হয়েছিল জলপাইগুড়ির এক অফিসে। বাইরে কোথাও কাজ পড়লে‚হাতে যদি সময় থাকে‚ কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসা অভ্যেস। এবার অবশ্য দার্জিলিং আসার ইচ্ছে মহীতোষবাবুর একেবারেই ছিল না। আসতে হয়েছে সঙ্গীদের ইচ্ছেয়। ইদানীং দার্জিলিংয়ে এলেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। বাবা–মায়ের সঙ্গে সেই সত্তরের দশকের শেষের দিকে প্রথম এসেছিলেন। দার্জিলিং তখন ছবির মতো এক শৈল সহর। আর এখন তো স্রেফ কংক্রিটের জঙ্গল। সঙ্গীরা দুপুরে বেরিয়ে পড়লেও মহীতোষবাবু ঠিক করে রেখেছিলেন‚ দুপুরটা বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে একটু ম্যালের দিকে বেড়িয়ে আসবেন। দার্জিলিং শহরের সেই পুরোনো আবেশ এখনও যেটুকু আছে‚ তা ওই ম্যালে। নিরিবিলিতে কোথাও বসে এক দেড় ঘণ্টা বেশ কাটিয়ে দেওয়া যায়।

ব্যাপারটায় জড়িয়ে পড়তে হল আসার পথেই। পথের উপরেই গোটা কয়েক কিউরিও শপ।চিনে নিতে পারলে পাহাড়ি অঞ্চলের নানা পুরোনো জিনিস মেলে। এসব ব্যাপারে মহীতোষবাবুর আগ্রহ অনেক দিনের। অগত্যা ঢুকে পড়েছিলেন এক কিউরিও শপে। খানিক ঘুরে দেখার পরে বেরিয়ে এসেছেন‚ পাশে ফুটের উপর বড় একটা জটলা নজরে পড়ল। মাঝবয়েসী এক গোবেচারা ভদ্রলোককে স্থানীয় ষণ্ডামতো কয়েকজন ঘিরে ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। তার দু’চার কথা কানে আসতেই‚ মহীতোষবাবুর বুঝতে বাকি রইল না ব্যাপারটা। নিতান্ত গোবেচারা ওই ভদ্রলোক নাকি এক ষণ্ডার পকেট থেকে টাকার ব্যাগ তুলে নিয়েছে। তাই তাকে সার্চ করতে চায় ওরা।

এই জিনিস কলকাতার পথেও মহীতোষবাবু দেখেছেন। পকেটমারা ছাড়াও ইদানীং এই এক নতুন কায়দা চালু হয়েছে। নিরীহ কাউকে পেলেই পকেটমারের অভিযোগে ওরা দল বেঁধে ঘিরে ধরে তাকে। তারপর সার্চ করার নামে টাকাপয়সার ব্যাগ হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়ে। বাড়তি জোটে দু’চার ঘা চড়–থাপ্পড়। আশপাশে যারা জমা হয়‚ তাদের কেউ মজা দেখে‚ নয়তো সমর্থন করে বদমায়েশের দলকেই।

ব্যাপারটা চেখে পড়তেই মহীতোষবাবু আর দেরি করেননি। সোজা ঢুকে পড়েছিলেন জটলার ভিতরে। ‘ওনাকে পকেট মারতে দেখেছো তোমরা।’

মহীতোষবাবু কড়া গলায় প্রশ্ন করতেই একটু থতমত খেয়ে গেলেও সামলে নিয়ে নীল জ্যাকেট গায়ে একজন বুক চিতিয়ে বলল‚ ‘হো সর‚ মেরে পকেট মারে। ম দেখে ছ।’

‘কী? মানিব্যাগ?’ মহীতোষবাবু মুহূর্তে প্রশ্ন করলেন।

‘হো সর‚ মানিব্যাগ।’ থতমত খেয়ে লোকটা বলল।

‘কী রং?’

‘রং!’ হকচকিয়ে গেলেও সামান্য ঢোঁক গিলে লোকটা বলল‚ ‘কালা।’

নীল জ্যাকেটের ওই জবাবের পরে তার বাকি সঙ্গীরা হঠাৎ ভিড় ঠেলে এক পা এক পা করে পিছুতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা লক্ষ করে মহীতোষবাবু এবার সেই গোবেচারা লোকটির দিকে চোখ ফেরালেন। এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। মুহূর্তে পকেট থেকে একটা খয়েরি রঙের মানিব্যাগ বের করে বললেন‚ ‘দাদা‚ আমার কাছে এই একটিই মানিব্যাগ আছে। সন্দেহ হলে পকেট দেখুন।’

কিন্তু কে পকেট দেখবে? সঙ্গীরা আগেই সটকে পড়েছিল। এরপর নীল জ্যাকেটও হঠাৎ পিছন ফিরে ভিড় ঠেলে দৌড় লাগাল। ভদ্রলোক তখন প্রায় জড়িয়ে ধরেছেন মহীতোষবাবুকে‚‘দাদা‚ আমাকে বাঁচালেন। আজই বেড়াতে এসেছি। এরা সর্বস্বান্ত করে দিত আমাকে। বিদেশ বিভূঁই!’

মহীতোষবাবু অবশ্য দেরি করেননি। ভদ্রলোককে থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি করার পরামর্শ দিয়ে নিজের পথ ধরেছেন।

অল্প আগে দিনের আলো বিদায় নিয়েছে। তাতে আলো ঝলমল ম্যালের ব্যস্ততা কমেনি। নানা বয়সী টুরিস্টের ভিড়ে গমগম। এক কোনে সামান্য অন্ধকারে ফাঁকা একটা বেঞ্চ পেয়ে মহীতোষবাবু গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লেন। ঘণ্টা দেড়েক দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবেন। শীতটা ইতিমধ্যে আরও জাঁকিয়ে নেমেছে। একের পর এক ছেঁড়া মেঘ ম্যালের রাস্তা ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে। আনমনে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ চাপা গলায় বলল‚ ‘থোড়া শুনিয়ে সাহাব।’

ঘাড় ফিরিয়ে মহীতোষবাবু দেখলেন‚ পাশে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সী একটা মানুষ। গৌরবর্ণ শক্ত পোড় খাওয়া চেহারা। মুখের আদলে স্থানীয় নেপালিদের মতো নয়‚ উত্তর ভারতের ছাপ। নাকের নীচে ভারী গোঁফ। বাইরে গেলে মহীতোষবাবু সাধারণত বাংলাতেই কথা বলেন। এই নিয়ে অনেকবার সমস্যাও হয়েছে। কিন্তু গোঁ ছাড়েননি। আজও পরিষ্কার বাংলাতেই বললেন‚ ‘কিছু বলছেন?’

‘হ্যাঁ বাবুজি।’ ঘাড় নাড়িয়ে লোকটি এবার পরিষ্কার বাংলায় বললেন‚ ‘একটা ভাল অ্যান্টিক আছে আমার কাছে। নেবেন?’

মহীতোষবাবু লোকটির দিকে এবার ভাল করে তাকালেন। মনে পড়ল‚ অ্যান্টিকের দোকানের সামনে সেই ঝামেলার সময় লোকটা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। মুখটা মনে আছে। তবে তখন পরনে প্যান্টের উপর ভারি জ্যাকেট থাকলেও এখন হালকা হলদে রঙের দেহাতি ধুতির সঙ্গে ডোরাকাটা একই রঙের মামুলি চাদর। বললেন‚ ‘আপনাকে সেই অ্যান্টিকের দোকানের সামনে দেখেছিলাম না?’

‘ঠিক তাই বাবুজি।’ অল্প হেসে লোকটা আরও ঝুঁকে পড়লেন। ‘আপনি জিনিসটার কদর বুঝবেন বলেই দেখাতে নিয়ে এলাম।’

এসব অ্যান্টিক জিনিস কেনা যথেষ্ট ঝুঁকির। ঠকে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। বিশেষ করে‚ এমন উটকো লোকের কাছ থেকে। তবু বললেন‚ ‘কী জিনিস দেখি?’

লোকটা এবার সাবধানে চাদরের ভিতর হাত ঢুকিয়ে খাপে ঢাকা একটা বড় আকারের ভোজালি বের করে এগিয়ে দিলেন। ‘এই দেখুন বাবুজি। শার্দূল সিংয়ের কৃপাণ। রাজা পৃথ্বীনারায়ণ শাহর আমলের জিনিস।’

শার্দূল সিং কে‚ জানা নেই মহীতোষবাবুর। তবে রাজা পৃথ্বীনারায়ণ শাহর নাম শুনেছেন।বর্তমান নেপালের প্রথম রাজা। তার আগে নেপালে অসংখ্য ছোট ছোট রাজা রাজত্ব করতেন। পরস্পরের ভিতর গোলযোগ লেগেই থাকত। সাধারণ মানুষের দুর্দশার সীমা ছিল না। পৃথ্বীনারায়ণ শাহই প্রথম সবাইকে পদানত করে অখণ্ড নেপালের পত্তন করেন। সে প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। তাই জিনিসটি অ্যান্টিক হিসেবে যথেষ্টই মূল্যবান। মহীতোষবাবু সাবধানে খাপের ভিতর থেকে ভোজালিটা বের করলেন। এসব পুরোনো জিনিস যেমন হয়‚ তেমন নয়। বেশ ঝকঝকে। তীক্ষ্ণ ফলার ধার প্রায় নতুনের মতোই। তবে বাঁট দেখে যথেষ্ট পুরোনো বলেই মনে হয়। এমনকী‚ বাঁট এবং খাপের গায়ে নেপালি অক্ষরে লেখাও রয়েছে কিছু। সেগুলো বর্তমান নেপালি বর্ণমালা থেকে সামান্য আলাদা। খানিক দেখে বললেন‚ ‘খাপের গায়ে কী লেখা‚ বলতে পারেন? পুরোনো দিনের অক্ষর মনে হচ্ছে।’

‘ঠিকই ধরেছেন বাবুজি। আপনি সমঝদার মানুষ।’ লোকটি একগাল হাসলেন‚ ‘খাপের গায়ে পুরোনো দিনের নেপালি হরফে লেখা রয়েছে‚ ‘চুপি’ মানে কৃপাণ। আর ওই বাঁটের উপর খোদাই করা শার্দূল সিংয়ের নাম।’

‘কিন্তু মানুষটি কে? কোথাও পড়েছি বলে তো মনে হয় না।’

‘না জানারই কথা বাবুজি।’ ঠোঁট চেটে মানুষটি অল্প হাসলেন। ‘পৃথ্বীনারায়ণ শাহ রাজা‚ তাই তাঁর কথাই লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু শার্দূল সিং সামান্যই এক রাজপুত যোদ্ধা। যুদ্ধক্ষেত্রে দু’দুবার পৃথ্বীনারায়ণ শাহকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তাই রাজার খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। এতটাই যে‚ নবজাতক পুত্রের নামকরণের সময় ‘সিং’ জুড়ে দিয়ে নাম রেখেছিলেন প্রতাপ সিং শাহ। কিন্তু দু’জনের সেই সখ্যতা চিরকাল বজায় থাকেনি। গোলমালের সূত্রপাত পৃথ্বীনারায়ণ শাহ সিংহাসনে বসার পরেই। শোনা যায়‚ শার্দূল সিং চেয়েছিলেন‚ রাজা এবার দেশের সাধারণ প্রজাদের দিকে মন দিন। তাদের জন্য কাজ করুন। কিন্তু সিংহাসনে বসে রাজা পৃথ্বীনারায়ণ শাহ তখন আমোদ–প্রমোদে ব্যস্ত। প্রজাদের দিকে মন দেবেন‚ সেই সময় নেই।

শার্দূল সিং রাজার সামান্য এক অনুচর। অন্য কেউ হলে হয়তো থেমে যেতেন। কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া শার্দূল সিং থামতে জানতেন না। দু’জনের সেই গোলমাল একদিন চরমে পৌঁছুল। ক্রদ্ধ রাজা তাঁকে বন্দী করার আদেশ দিলেন। প্রহরীদের হাতে বন্দি হলেন তিনি। মানুষটির কোনও খোঁজ তারপরে আর জানা যায়নি। কেউ বলেন তাঁকে রাজার আদেশে হত্যা করা হয়েছিল। কেউ বলেন‚ এক রাতে তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে তরাইয়ের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।’

মহীতোষবাবু হাঁ করে শুনছিলেন। গল্পটা চমৎকার। যদিও প্রমাণ কিছু নেই। তাছাড়া ভালই জানেন‚ এই ধরণের অ্যান্টিক বিক্রির জন্য এমন গল্প অনেক সময় বিক্রেতাই জুড়ে দেয়। আনাড়ি ক্রেতাকে খুব সহজেই পেড়ে ফেলা যায়। কিন্তু মহীতোষবাবু তেমন খদ্দের নয়। ছোরাটি ফের খাপে ভরে লোকটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন‚ ‘আপনার গল্পটা চমৎকার হলেও জিনিসটি তেমন কিনা‚ সন্দেহ আছে। যাই হোক‚ যদি কিনি কত দিতে হবে?’

‘আপনাকে একটি টাকাও দিতে হবে না বাবুজি।’ খরখরে গলায় উত্তর এল। বোঝা যায় মহীতোষবাবুর কথায় বেশ আহত হয়েছেন তিনি।

সেই কথায় মহীতোষবাবু হকচকিয়ে গেলেন। এমন উত্তর একেবারেই আশা করেননি। ওর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটি বললেন‚ ‘বাবুজি‚ এ জিনিসের দাম যে টাকা দিয়ে হয় না‚দু’চার দিনের মধ্যেই বুঝতে পারবেন। আপনাকে জিনিসটা আমি এমনিই দেব।’

‘ক–কেন?’ থতমত খেয়ে মহীতোষবাবু বললেন।

‘একেবারে অকারণে নয় বাবুজি। শার্দূল সিংয়ের এই কৃপাণ তার যোগ্য মর্যাদা আপনার কাছে পাবে‚ সেই কারণে। শোকেসে মূল্যহীন হয়ে পড়ে থেকে কী——।’

লোকটার কথা শেষ হতে পেল না‚ হঠাৎ একটা পুলিশের জিপ সামনে এসে থামতেই তিনি মস্ত এক লাফে রাস্তা পার হয়ে নীচে পাকদণ্ডীর গাছপালার অন্ধকারে মুহূর্তে মিলিয়ে গেলেন। জনা কয়েক পুলিশ ছুটল সেদিকে। একজন অফিসার এগিয়ে এসে বললেন‚ ‘লোকটা কী কথা বলছিল আপনার সঙ্গে?’

গোলমেলে ব্যাপার‚ সন্দেহ নেই। ভাগ্যিস‚ জিনিসটা আগেই লোকটার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। নইলে এখন অকারণে ঝামেলায় পড়তে হত। কিছু রাখঢাক না করে মহীতোষবাবু সব কথাই খুলে বললেন। এমন কী‚ লোকটাকে যে খানিক আগে কিউরিও শপের বাইরে দেখেছেন‚গোপন করলেন না সেটাও। পুলিশ অফিসার আর কোনও প্রশ্ন না করে নাম–ঠিকানা লিখে নিয়ে চলে গেলেন। ব্যাপারটা তার কাছে জানা গেল। লোকটা অল্পদিন হল কিউরিও শপে কাজ নিয়েছে। তারপর আজই এক ফাঁকে দামি অ্যান্টিকটা চুরি করে পালিয়েছে।

সেদিন সন্ধের সেই ব্যাপারটা এরপর প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন মহীতোষবাবু। এসব ছোটখাটো ঝামেলা তাঁর জীবনে কম ঘটেনি। তাই সঙ্গীদেরও বলার প্রয়োজন বোধ করেননি। তবু বিষয়টি থেকে যে মুক্ত হতে পারেননি‚ বুঝলেন তিন দিন পরে কলকাতায় ফিরে।

লাইনে কোনও এক বিভ্রাটের কারণে দার্জিলিং মেল সেদিন ঘণ্টা কয়েক লেট। ট্রেন শিয়ালদহ পৌঁছোতে প্রায় দুপুর। তবে রবিবার বলে তাড়া ছিল না। বাড়ি ফিরে স্নান–খাওয়া সেরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। স্ত্রী মনোরমা স্বামীর সুটকেস খুলে জামাকাপড় বের করতে গিয়ে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠলেন‚ ‘ওমা‚ এমন দামি অ্যান্টিক কিনেছ‚ বলনি তো! খাপে‚ বাঁটে সোনার কাজ!’

স্ত্রীর কথায় ভীষণ চমকে উঠলেও মুহূর্তে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এলেন মহীতোষবাবু। মনোরমা ইতিমধ্যে সুটকেস থেকে জামাকাপড় প্রায় সবই নামিয়ে ফেলেছে। একেবারে নীচে সেই ভোজালিটা। সেদিন সন্ধের অন্ধকারে বুঝতে না পারলেও এখন বেশ বুঝতে পারছিলেন‚ খোদাই করা হরফগুলো সোনার। স্ত্রীর বুঝতে কিছুমাত্র ভুল হয়নি। কিন্তু জিনিসটা কীভাবে তাঁর সুটকেসে এল‚ কিছুতেই ভেবে পেলেন না।

আসলে মহীতোষবাবুর মাথায় সব তখন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। ম্যালে সেই লোকটা ওকে ভোজালিটা এমনিই দিতে চেয়েছিল অবশ্য। তাই বলে পরে কোনও এক ফাঁকে তার হোটেলের ঘরে ঢুকে সুটকেসে জামাকাপড়ের তলায় ঢুকিয়ে রেখে গেছে‚ তাই বা কী করে সম্ভব! হোটেলে দু’দিন ছিলেন। কবে ঘটল ব্যাপারটা? কিন্তু সেসব কথা এই মুহূর্তে স্ত্রীকে জানানো একেবারেই সম্ভব নয়। কী বলবেন ভাবছিলেন‚ স্ত্রী বললেন‚ ‘এমন দামী জিনিস‚ শো–কেসে রাখবে?

বাড়িতে বসার ঘরে এসব অ্যান্টিক রাখার জন্য মামুলি একটা শো–কেস আছে। স্ত্রীর ওই কথায় হঠাৎ যেন বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন। ‘খেপেছ নাকি! এখন বরং ওই সুটকেসেই থাক। পরে ভেবে দেখা যাবে।’

‘কত দিয়ে কিনলে গো?’ অ্যান্টিকের ব্যাপারে এই প্রথম স্ত্রীর আগ্রহ লক্ষ করলেন মহীতোষবাবু। হাজার হোক‚ জিনিসটা সোনার। এসব ব্যাপারে মেয়েদের আগ্রহ হওয়াই স্বাভাবিক। কিছুটা মজা করেই বললেন‚ ‘সে অনেক ব্যাপার। পরে বলব।’

ডাকাবুকো গোছের মানুষ মহীতোষবাবু এই প্রথম টের পেলেন‚ দুশ্চিন্তা তাঁরও হয়। সত্যি কথা বলতে কী‚ রাতে এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর চোখের পাতা এক হয়নি। অদ্ভুত ব্যাপারটা নিয়ে সারা রাত ভেবেও কোনও কিনারা করতে পারেননি। ম্যালে লোকটার মুখে শার্দূল সিংয়ের গল্প শুনে তখন এক বর্ণও বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে‚ গল্পটা হয়তো মিথ্যে নয়। এমন মূল্যবান জিনিস কোনও রাজপরিবারের হওয়াই সম্ভব। কিন্তু সেটি অ্যান্টিকের দোকান থেকে চুরি করে লোকটা কেন তাকে দিতে চাইবে? ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে সন্দেহ নেই‚ জিনিসটা গোপনে ওর সুটকেসে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজটা সে হোটেলের কোনও কর্মচারীর সাহায্য নিয়ে করেছে। ঘরের চাবির ডুপ্লিকেট হোটেলেই থাকে। সমস্যা হবার কথা নয়। অসাবধানে সুটকেসেও তালা দেওয়া ছিল না।

পরের দিন সোমবার। একমাত্র ছেলে বাইরে থেকে পড়ে। স্ত্রী ন–টায় তাঁর অফিসে বেরিয়ে গেছেন। ফাঁকা বাড়ি। দুপুরে একসময় মহীতোষবাবু সুটকেস খুলে ভোজালিটা বের করলেন।জিনিসটা একান্তে ভাল করে দেখবেন বলেই আজ অফিসে যাননি।

ঘরের দরজা বন্ধ করে মহীতোষবাবু ভোজালিটা হাতে নিয়ে দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর সারা শরীর কেমন শিরশির করে উঠল। মনে হল‚ মুহূর্তে রক্তচাপ যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। আগুন ছুটছে শরীর দিয়ে। তারই মধ্যে কেমন নিশপিশ করে উঠল হাত। বেশ বুঝতে পারছিলেন‚ কেমন অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছেন তিনি।

মহীতোষবাবু যখন সম্বিৎ ফিরে পেলেন‚ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন‚ ইতিমধ্যে প্রায় আধঘণ্টা সময় পার হয়ে গেছে। তার পরেই বুঝতে বাকি রইল না‚ ভোজালিটা হাতে নিয়ে দেখার সময় হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সারা রাত এক ফোঁটা ঘুম হয়নি‚ ব্যাপারটা সেই কারণে অস্বাভাবিক নয়। হয়তো তা নিয়ে মাথাও ঘামাতেন না। কিন্তু এই সামান্য সময় ঘুমের ভিতর তিনি যে স্বপ্ন দেখেছেন‚ তা ভয়ংকর বললেও কম বলা হয়। ডাকাবুকো স্বভাবের জন্য অনেক ঝামেলাতেই জড়িয়ে পড়েছেন। প্রায় গা–সওয়া হয়ে গেছে। তবু ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে কেমন হিম হয়ে আসছিল মহীতোষবাবুর শরীর। হাতের ভোজালিটা তাড়াতাড়ি সুটকেসে ভরে বন্ধ করে দিলেন।

শুয়ে পড়েছিলেন। খানিক এপাশ–ওপাশ করেও ঘুম এল না। অগত্যা উঠেই পড়লেন। টয়লেটে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে এসে কী করবেন ভাবছেন‚ চোখ পড়ল টিভির দিকে। টিভি দেখার অভ্যাস একেবারেই নেই। কখনও যদি খোলেন‚ নিউজ চ্যানেল ছাড়া অন্য কিছু দেখেন না। কাছে গিয়ে টিভির সুইচ অন করে রিমোট হাতে অদূরে সোফায় বলে একটা নিউজ চ্যানেল খুলেছিলেন। মুহূর্তে চমকে উঠলেন তিনি।

পর্দা জুড়ে বড় বড় হরফে ব্রেকিং নিউজ। কাঁকুলিয়ার এক ফ্ল্যাটে আজ দুপুরে চারজন দুষ্কৃতী হানা দিয়েছিল। ফ্ল্যাটের মালিক দুই বৃদ্ধ–বৃদ্ধাকে বেঁধে রেখে আলমারি‚ দেরাজ খুলে  লুটপাট চালাচ্ছিল তারা। ওই সময় হঠাৎই পাগড়ি মাথায় এক পোড় খাওয়া শক্তসমর্থ চেহারার মাঝবয়সী ব্যক্তি‚ টকটকে ফরসা রং‚ নাকের নীচে ভারি গোঁফ‚ হাতে ভোজালি নিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতর। মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে চার দুষ্কৃতির উপর। চার দুষ্কৃতির সঙ্গেও আগ্নেয়াস্ত্র‚ চপার প্রভৃতি ছিল। কিন্তু তা স্বত্বেও তারা নতুন এই আগন্তুকের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। বাধা দেবার আগেই আগন্তুক দুই দুষ্কৃতিকে কুপিয়ে ফেলে দিয়েছে। তাই দেখে ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে বাকি দু’জন রণে ভঙ্গ দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেছে। এরপর ফ্ল্যাটের দুই বৃদ্ধ–বৃদ্ধার বাঁধন খুলে তাদের কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সরে পড়েছে সেই আগন্তুকও। আহত দুই দুষ্কৃতিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাদের শারীরিক অবস্থার কারণে এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। তাই পুলিশ সম্পূর্ণ অন্ধকারে। রহস্যের কোনও কিনারা এখনও হয়নি।

হাঁ করে টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলেন মহীতোষবাবু। একটু পরেই পর্দায় ফ্ল্যাটের সেই ঘরের ছবি ভেসে উঠল। সেই দিকে তাকিয়ে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে উঠল। কী ভয়ানক! স্বপ্নে এমনই এক ঘরের ছবি তিনি দেখেছেন। ওই তো সেই খোলা দেরাজ। পাশে খাট‚ লণ্ডভণ্ড বিছানা। ওই বিছানার উপরেই দুই বৃদ্ধ–বৃদ্ধাকে হাতমুখ বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছিল। কাছেই মেঝের অনেকটা রক্তে থিকথিক করছে। স্বপ্নে দেখা ছবিটা স্পষ্ট মনে আছে। ওইখানেই ভোজালি হাতে সেই ভারি গোঁফ ওয়ালা মানুষটি বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পিস্তল হাতে এক দুষ্কৃতিকে কুপিয়ে ফেলে দিয়েছিল। টিভি বন্ধ করে মুহূর্তে ছুটে গিয়ে সুটকেসটা বের করে খুলে ফেললেন মহীতোষবাবু। খাপে ঢাকা ভোজালিটা যথাস্থানে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবেন, কী ভেবে হাতে নিয়ে ভোজালিটা খাপ থেকে বের করলেন। শুকনো রক্তের দাগ লেগে রয়েছে এখনও।

ডাকাবুকো মানুষ মহীতোষ রায়ের মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগল। সন্দেহ নেই‚খানিক আগে এই অস্ত্র দিয়েই ভারি গোঁফ ওয়ালা সেই মানুষটি কাঁকুলিয়ার ফ্ল্যাটে দুই দুষ্কৃতীকে কুপিয়ে ধরাশায়ী করেছে। ভোজালির ফলায় সেই রক্তের দাগ রয়ে গেছে এখনও। মাথার উপর ফুল স্পীডে ফ্যান ঘুরছে। তবু হাতের সেই অস্ত্রটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কুলকুল করে ঘামতে লাগলেন তিনি। বেশ বুঝতে পারছিলেন‚ ঘুমের ভিতর যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন‚ তার প্রতিটি অংশ সত্যি। শুধু তাই নয়‚ টিভিতে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে‚ মিলে যাচ্ছে সেটিও। ভাবতে গিয়ে মাথার ভিতর ক্রমশ তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। সামলে উঠতে সময় লাগল। ভাগ্যিস‚ স্ত্রী বাড়িতে নেই। এই অবস্থায় দেখলে হাজার কৈফিয়ৎ দিতে হত। বাথরুমে গিয়ে ভোজালির রক্ত ভাল করে ধুয়ে ফেললেন তিনি। তারপর সুটকেসে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিলেন।

কৌতূহলের কারণে মহীতোষবাবু এরপর আর মাত্র একদিনই সুটকেস খুলেছিলেন। খালি সুটকেসের তলায় সেই ভাবেই পড়ে আছে ভোজালিটা। তাকিয়ে দেখছিলেন‚ হঠাৎ হাতটা কেমন নিশপিশ করে উঠল। শিরশির করে উঠল সারা শরীর। অজান্তেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ভোজালির দিকে। ওই সময় সশব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠল।

আচমকা সেই শব্দে হঠাৎ যেন সাড় ফিরে পেলেন তিনি। মুহূর্তে সুটকেসটা বন্ধ  করে চাবি দিয়ে দিলেন। পরে ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে বেশ বুঝতে পেরেছিলেন‚ ওই সময় ফোনটা না এলে‚ফের সেই আগের দিনের মতোই কোনও ঘটনা ঘটে যেত! টিভির পর্দায় রোমহর্ষক আর এক ব্রেকিং নিউজ! শার্দূল সিংয়ের কৃপাণের কিছু রহস্য ওই সময় হঠাৎই যেন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে। বলা বাহুল্য‚ এরপর মহীতোষবাবুর আর সুটকেস খোলার  সাহস হয়নি।

মাস তিনেক কেটে গেছে তারপর। অডিটের কাজে বছরে বেশ কয়েকবার বাইরে যেতে হয়। সয়ে গেছে ব্যাপারটা। তার উপর এই সুযোগে কাছাকাছি কোথাও একটু ঘুরেও আসা যায়। তাই এবার যখন কোচবিহারে যাবার অর্ডার এল‚ খুশিই হলেন। সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে তখনই ঠিক করে ফেললেন‚ এই সুযোগে বিখ্যাত মানস ন্যাশনাল পার্কটা ঘুরে আসবেন। অনেক দিনের ইচ্ছে। কোচবিহার শহর থেকে আসামের এই বিখ্যাত অরণ্য খুব দূরে নয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ।

ট্যুরে বেরোবার সময় বরাবর স্ত্রী মনোরমাই মহীতোষবাবুর সুটকেস গুছিয়ে দেয়। প্রায়ই বেরোতে হয়। তাই গোটা কয়েক সুটকেস রয়েছে এজন্য। কিন্তু এবার বেরোবার আগে যখন খেয়াল করলেন‚ স্ত্রী সেই আগের বারের সুটকেসেই জামাকাপড় গুছিয়ে দিয়েছে‚ প্রায় সিটিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। একদম খেয়াল ছিল না‚ সুটকেসের ডুপ্লিকেট চাবি স্ত্রীর কাছেও থাকে। ভয়ানক সেই ভোজালিটা ওই সুটকেসেই রাখা ছিল। কীভাবে ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করবেন ভাবছেন‚ স্ত্রী নিজেই বললেন‚ ‘আগেরবার দার্জিলিং থেকে আনা সেই দামি অ্যান্টিকটা ভিতরে নেই দেখলাম। লকারে রেখে এসেছ নাকি?’

বাইরে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। স্ত্রীর সেই প্রশ্নের উত্তরে কোনও রকমে সামান্য মাথা নাড়িয়ে সুটকেস হাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন মহীতোষবাবু। কিন্তু ব্যাপারটা যে মাথা থেকে নামানো যায়নি‚তা বলাই বাহুল্য। অনেক ভেবে একটা ব্যাখ্যাও খাড়া করেছিলেন। জিনিসটা যেমন অদ্ভুতভাবে তার ঘাড়ে চেপেছিল সেই ভাবেই হয়তো বিদায় নিয়েছে। কদিন ভয়ানক চিন্তায় ছিলেন। এরপর হাওড়ায় ট্রেনে সহকর্মী সঙ্গীদের সঙ্গে দেখা হতেই উঠে পড়ল মানস ফরেস্টের প্রসঙ্গ। শুধু মহীতোষবাবু নয়‚ অন্যরাও এ ব্যাপারে দারুণ উৎসাহী। তাই নিয়ে নানা গল্পে অন্য ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গেলেন তিনি।

ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। কোচবিহারে পৌঁছে দিন তিনেকের মধ্যে কাজ শেষ করে পরের দিন ভোরেই কোম্পানির জিপ মানসের উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়লেন ওরা। দিন শেষে মাথানবাড়ি ফরেস্ট লজে পৌঁছে সবাই তো অবাক! মানস ন্যাশনাল পার্কের কথা কাগজে পড়েছেন। বেড়িয়ে আসা কয়েকজনের কাছে শুনেছেনও কিছু। কিন্তু ঘন জঙ্গলের ভিতর মাথানবাড়ি ফরেস্ট লজ এমন দারুণ‚ ভাবতেও পারেননি। মানস নদীর ধারে দু’তলা লজটা প্রায় ছবির মতোই বলা যায়। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। ওপারে বিস্তীর্ণ ঘাসবন‚ ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। ওরা যখন শেষ বিকেলে পৌঁছুল‚ একপাল বাইসন নদীর ওপারে সেই ঘাসবনে চরে বেড়াচ্ছে। অনেকটা পথ জার্নি করে সবাই তখন ক্লান্ত। ভেবেছিলেন পোশাক পালটে একটু জিরিয়ে নেবেন। কিন্তু ওই দৃশ্য দেখে লজের হাতায় পাতা চেয়ারে বসে পড়লেন সবাই। তারপর সেইভাবে বসে চায়ের কাপ হাতে কখন অন্ধকার নেমে এসেছে‚ খেয়াল নেই। বাইসনের পাল বিদায় নিতে একপাল হরিণ আর সম্বর তাদের জায়গা নিয়েছে। অন্ধকারে তাদের দেখা না গেলেও টুনি বাল্বের মতো তাদের চোখ মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে জ্বলে উঠছে। সেই সাথে নদীর একটানা স্রোতের কলকল শব্দ। এর মধ্যেই বিট অফিসার আলাপ করতে এসেছিলেন। ওরা এই সন্ধেয় বাইরে বসে রয়েছেন দেখে সাবধান করে দিলেন। দিন কয়েক হল এদিকে ঘন ঘন বাঘ দেখা যাচ্ছে। বাইরে আর না থাকাই ভাল।

আগামী কাল জঙ্গলে ঘোরার ব্যবস্থা হয়েছে কিনা‚ জানতে চাইলেন একজন।

উত্তরে বিট অফিসার জানালেন‚ সেই কথা বলতেই তিনি এসেছেন। আগামী কাল ভোরেই হাতির পিঠে ওদের জঙ্গল দেখাতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। পরের দিনটা ঘোরা হবে গাড়িতে। বাঘ দেখার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে। ইদানীং অনেকেই দেখতে পেয়েছেন

বিট অফিসার চলে গেলেন। ওরা সবাই অবশ্য বাইরেই বসে ছিলেন। হয়তো আরও অনেকটা সময় কাটিয়ে দিতেন। ওই সময় বেয়ারা এসে জানাল‚ লজে সোলার লাইট যা আছে ঘণ্টা দুয়েক চালু থাকে। এর মধ্যে ডিনার সেরে নিতে হবে। তাই কেউ যদি স্নান করতে চায়‚ করে নিতে পারেন। বাথরুমে জলও দেওয়া হয়েছে। অন্যরা তেমন গরজ না দেখালেও মহীতোষবাবু উঠে পড়লেন।সেই ভোরে বের হয়েছেন। স্নানটা সেরে নেওয়া দরকার।

উপর তলায় দুটো ডবলবেড রুম ওদের চারজনের জন্য দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট ঘরের দরজা খুলে সুইচটা অন করতে যাবেন‚ অন্ধকারে চাপা গলায় কেউ বলল‚ ‘বাবুজি‚ একটু অনধিকার চর্চা করে ফেলেছি। আপনার অনুমতি ছাড়াই ঘরে ঢুকেছি। মাফ করে দেবেন।’

ভীষণ চমকে উঠলেও সামলে নিতে সময় লাগল না মহীতোষবাবুর। সুইচটা খুঁজে পেয়ে অন করতেই আলোয় ভরে উঠল ঘরটা। অনুমান অভ্রান্ত। ঘরে ওর খাটের উপর বসে রয়েছেন ম্যালের সেই মানুষটা। পরনে সেদিনের মতোই হালকা হলুদ রঙের দেহাতি ধুতির উপর ডোরাকাটা মামুলি চাদর। সুটকেসের ডালা খুলে কিছু খুঁজছেন। মহীতোষবাবু বললেন‚ ‘সে তো দার্জিলিংয়ের হোটেলেও আমার ঘরে অনুমতি না নিয়েই ঢুকেছিলেন।’

‘ঢুকেছিলাম তো।’ প্রায় নির্লিপ্ত গলায় উত্তর এল‚ ‘ভেবেছিলাম শার্দূল সিংয়ের কৃপাণ আপনার কাজে লাগবে। কিছু উপকার হবে মানুষের। শার্দূল সিংও চিরকাল তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু হল কোথায়? সেই পড়েই রইল সুটকেসের ভিতর। ফেলে রাখার জন্য ওটা আপনাকে দিইনি বাবুজি।’বলতে বলতে হতাশায় ভেঙে পড়ল মানুষটির কণ্ঠস্বর।

মানুষটি তখন ব্যগ্রভাবে সুটকেস হাতড়ে চলেছেন। মহীতোষবাবু বললেন‚ ‘সেই কৃপাণ কিন্তু সুটকেসের ভিতর নেই।’

‘সে কী! কোথায় রেখেছেন?’ উদ্বিগ্ন হয়ে উনি তাকালেন মহীতোষবাবুর দিকে।

‘অন্য কোথাও রাখিনি। ওই সুটকেসের ভিতরেই ছিল। কিন্তু এবার বের হবার সময় পাওয়া যায়নি।’

‘তাই বলুন।’ নিশ্চিন্ত হয়ে ফের সুটকেস হাঁটকাতে শুরু করলেন তিনি। একটু পরেই জামাকাপড়ের ভিতর থেকে টেনে বের করলেন ভোজালিটা। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন‚ ‘চলি বাবুজি। বেশ বুঝতে পেরেছি‚ শার্দূল সিংয়ের ইচ্ছে কোনও দিনই আর পূর্ণ হবার নয়। এটা দার্জিলিংয়ের সেই শোকেসেই থাক বরং।’

‘একটা কথা বলব?’ মহীতোষবাবু বললেন।

‘কী কথা বাবুজি?’

‘সেদিন কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে দুই দুষ্কৃতিকে ওই ভোজালি হাতে আপনিই তো আক্রমণ করেছিলেন! ওরা অবশ্য চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। তবে দু’জনেরই ডান হাত বাদ দিতে হয়েছে।’

‘জানি।’ মানুষটি অল্প হাসলেন। ‘ওদের মেরে ফেলতে চাইলে সহজেই পারতাম। আসলে আক্রান্ত দুই বৃদ্ধ–বৃদ্ধা যাতে সর্বস্বান্ত না হন‚ আর দুই বদমাশ যাতে ফের এই কাজে নামতে না পারে‚ সেজন্য যেটুকু দরকার সেইটুকুই করেছি।’

 ‘কিন্তু‚ কিন্তু কী করে এটা সম্ভব! কে আপনি?’

সেই কথায় মানুষটি বড় দুই চোখ মেলে তাকালেন। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে মহীতোষবাবুর মাথা হঠাৎ ঝিমঝিম করে উঠল। অত বড় চোখ‚ অমন সুতীব্র দৃষ্টি কোনও মানুষের হতে পারে‚ তিনি ভাবতেও পারেননি। কিন্তু তখনও দেখার আরও বাকি ছিল। দেখতে দেখতে মানুষটির নাকের তলায় ভারি গোঁফ জোড়া ক্রমশ দুপাশে ছড়িয়ে যেতে শুরু করতেই বড় হতে লাগল দু’পাটি দাঁত। তারপর হাতের সেই ভোজালি দাঁতে কামড়ে ধরে এক লাফে দরজার কাছে। চমকে উঠে মহীতোষবাবু দেখলেন‚ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বিশাল এক ডোরাকাটা বাঘ। একটু আগের সেই মানুষটির ধুতি চাদর মেঝেয় পড়ে রয়েছে। শেষ বারের মতো মহীতোষবাবুর উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে প্রাণীটা গটমট করে খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল এরপর।

 হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মহীতোষবাবু। সম্বিৎ ফিরে পেলেন লজের কর্মচারীদের চিৎকারে‚ ‘বাঘ-বাঘ, সবাই ভিতরে আসুন।’

মুহূর্তে দুপদাপ শব্দে প্রায় উদভ্রান্তের মতো সঙ্গীদের সবাই ভিতরে ঢুকলেন। বাঘটাকে শেষ মুহূর্তে তারাও দেখতে পেয়েছেন। ওদের কাছ দিয়েই জঙ্গলের দিকে চলে গেল। মুখে কিছু একটা ছিল। অন্ধকারে বোঝা যায়নি। সশব্দে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে হাঁপাতে একজন মহীতোষবাবুকে বললেন‚ ‘ভাগ্যিস‚ আপনি চলে এসেছিলেন!  বাপরে‚ ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারত।’

উত্তরে মহীতোষবাবু অল্প হেসে বললেন‚ ‘যতদূর জানি‚ মানস অরণ্যের বাঘ কিন্তু নরখাদক নয়।’

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত