ভুবন সর্দার

ভুবন সর্দার

যখনকার কথা বলছি তখন বর্ধমান জেলায় ডান পলান পিপুল, সুবলদা, সাহসেনপুর, প্রভৃতি গ্রামগুলো ডাকাত

প্রধান গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এখানকার বাগদি ডাকাতরা ছিল প্রবল পরাক্রান্ত। যেমন ভয়ঙ্কর ছিল এদের

চেহারা, তেমনি অমানুষিক শক্তি ছিল এদের দেহে। দামোদর নদের অববাহিকায় এইসব ডাকাতদের ভয়ে তখন

আশ-পাশের গ্রামের লোকেরা তটস্থ হয়ে থাকত সব সময়। দলবদ্ধ না হয়ে রাতভিত কেউ গ্রাম গ্রামান্তরে যেত না।

দিন দুপুরে পথে ঘাটে ছিল ঠ্যাঙাড়ের উপদ্রব আর রাতে ডাকাতের ভয়। এরই মধ্য দিয়ে জেলার মানুষরা

দিনাতিপাত করত।

তা এই অঞ্চলের ডাকাতরা ছিল বড়ই দুর্ধর্ষ। আর ডাকাতিও করত এরা বড় বড় জায়গায়। বড় বড় জমিদাররাই ছিল

এদের আসল শিকার। তারপর পথে ঘাটে অচেনা লোকদের মারধর, জিনিসপত্তর

লুটপাট করাও ছিল আর এক পেশা। তাই এই সমস্ত ডাকাতদের ভয়ে জমিদাররা সদা সতর্ক থাকত এবং এদের

আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য বলিষ্ঠ চেহারার কিছু লেঠেলকেও প্রতিপালন করত।

তারাপ্রসন্নবাবুও এই অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট জমিদার ছিলেন। তার জমিদারিতে ভুবন সর্দার নামে এক লেঠেল

ছিল। ভুবন এমনই লেঠেল ছিল যে ভুবনের হাতে লাঠি মানেই ত্রিভুবন অন্ধকার। ভুবন নিজেও এক সময় ছিল এক

দুর্ধর্ষ ডাকাত। তবে তার দলের লোকেরা সবাই ধরা পড়ে যাওয়ায় সে নিজের দেশ ছেড়ে এসে জমিদার

তারাপ্রসন্নবাবুর বাড়িতে আত্মগোপন করে। তারাপ্রসন্নবাবু ভুবনের পূর্ব পরিচয় জানতেন না। তবে ভুবনের

সাহসিকতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং কর্তব্যনিষ্ঠা দেখে তার ওপর খুবই প্রসন্ন ছিলেন।

ভুবন সর্দার দিনের বেলায় ঘুমতো আর রাত জেগে পাহারা দিত। ভুবনের লাঠির সঙ্গে যাদের পরিচয় ছিল তারা

ভুবনকে ঘটাত না। এই অঞ্চলের ডাকাতরাও ভয় করত ভুবনকে।

একদিন সন্ধেবেলা লাঠি হাতে ভুবন সর্দার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে এমন সময় বহু দূরে কয়েকটি উজ্জ্বল আলোর রেখা সে দেখতে পেল।

জমিদার তারাপ্রসন্নবাবুও দোতলার বারান্দা থেকে দেখতে পেলেন সেই দৃশ্য। দেখেই ভয়ে শঙ্কিত হয়ে ডাক দিলেন—

ভুবন, একবার এদিকে এসো তো?

ভুবন উঠোনে দাঁড়িয়েই লাঠিতে ভর দিয়ে তিড়িং করে লাফিয়ে বারান্দায় উঠল। এরকম লাঠিয়াল সত্যই বিরল। শুধু

লাঠিতে ভর দিয়েই বড় বড় গাছের মগডালে সে অনায়াসে উঠে পড়তে পারত। লাঠিতে ভর দিয়ে ছিটকে বাড়ির

ছাদে ঝাপিয়ে পড়তে পারত। আর লাঠিতে ভর দিয়েই দশ বিশ মাইল দূরের গ্রাম থেকে সামান্য কিছু সময়ের মধ্যে

ঘুরে আসতে পারত।

যাই হোক। ভুবন সর্দার বারান্দায় এলে তারাপ্রসন্নবাবু দূরের দিকে অঙ্গুলি সংকেত করে বললেন—ঐ দেখো।

ভুবন সর্দার সেই দিকে তাকিয়ে বলল—হ্যাঁ, আমিও লক্ষ করেছি। কতকগুলো আলোর শিখা। মনে হচ্ছে কতকগুলো

মশাল জুলিয়ে কারা যেন এদিকে আসছে।

তারাপ্রসন্নবাবু বললেন—এই সন্ধে রাতে মশাল জ্বলিয়ে যখন দলে দলে এগিয়ে আসছে তখন ওরা যে কারা তা বুঝতে

পারছে তো? অতএব তৈরি হও। এরা যেভাবে আসছে তাতে মনে হচ্ছে গ্রামকে গ্রাম এরা জুলিয়ে দেয়।

ভুবন বলল—ঠিক আছে। আপনি বাড়ির মেয়েদের নিয়ে গুপ্তকক্ষে চলে যান। আমি দেখে আসি দলে ওরা কতজন ।

এই বলে যেই না ভুবন যেতে চায় অমনি তারাপ্রসন্নবাবু ওর একটা হাত খপ করে ধরে বললেন—না ভুবন, এ সময়

তুমি আমাদের ফেলে রেখে কোথাও যেও না। ওদের খোঁজ নেবার জন্য আমি অন্য লোক পাঠাচ্ছি। তুমি বাড়িতে না

থাকলে আমি লোহার সিন্দুকে ঢুকেও শান্তি পাব না। এই বলে তারাপ্রসন্নবাবু ভুবনকে আটকালেন। এবং আর

একজন লোককে বললেন—যাও তো দূর থেকে একটু ভালো করে দেখে এসে তে ওরা কারা। তারপর সেই বুঝে

ব্যবস্থা নেবো। কেন না দিনকাল খুব খারাপ। অতএব সতর্ক হয়ে থাকতে দোষ কি?

তারপর আদেশ পেয়েই লোকটি তখন লাঠিতে ভর করে অন্ধকারে এগোতে লাগল মশালধারীদের দেখতে ।

তখনকার দিনে ডাকাতরা রণপার সাহায্যে বহুদূর দূরান্তরে ডাকাতি করতে যেত। কিন্তু শুধুমাত্র একটি লাঠিতে ভর

করেও অনেকে অপূর্ব কৌশলে খুব তাড়াতাড়ি দূরে যাতায়াত করতে পারত। এই যাতায়াতে ভুবন সর্দারের জুড়ি ছিল

না কেউ। তবু এই কৌশলেই লোকটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই মশালধারীদের খোজ নিয়ে এসে বলল—না বাবুমশাই।

ভয়ের কোন কারণ নেই। হুগলীর দিক থেকে একদল লোক বরকনে দিয়ে এই দিকে আসছে। বাজনা বাদ্য বাজিয়ে

মশাল জেলে অন্তত জনা পঞ্চাশেক লোক এগিয়ে আসছে এদিকে।

তারাপ্রসন্নবাবু আশ্বস্ত হয়ে বললেন—যাক বাবা। বাঁচা গেল। কিন্তু এই সব অঞ্চলে যেরকম ডাকাতের উপদ্রব তাতে

তো এদের এইভাবে যেতে দেওয়া যায় না।

লোকটি বলল—তা অবশ্য ঠিক। তবে দলে তারা এত বেশি যে ওদের ঠেকায় কার সাধ্য। তাছাড়া লাঠি সড়কি বল্লম

তলোয়ার সবই আছে ওদের সঙ্গে।

এই কথা শোনামাত্রই ভুবন সর্দার উত্তেজিত হয়ে উঠল।

এমন সময় দূর থেকে নানা রকম বাদ্যবাজনার শব্দ শোনা যেতে লাগল। তখন সন্ধেরাত্রি। আলো আর বাদি বাজনার

শব্দ শুনে তো আহ্বাদে আটখানা হয়ে গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই ছুটল কি আসছে দেখতে।

এদিকে সুসজ্জিত পালকি কাঁধে বর কনের শোভাযাত্রা ধীরে ধীরে গ্রামে এসে ঢুকল। গ্রামের বারোয়ারীতলায় বিশাল

বটগাছের নিচে বিশ্রামের জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসল সকলে। অনেক দূর থেকে আসছে তো সব। কাজেই বিশ্রামের

জন্য এবার একটু বসার প্রয়োজন।

জমিদার তারাপ্রসন্নবাবু বর কনের দলকে ডাকাত ভ্রমে প্রথমে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তারপর যখন বুঝলেন

তার আশঙ্কা ভুল তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। তিনি এমনিতে সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন। তাই বললেন— তাহলে

ভুবন, ঐ লোকগুলো তো আজ রাত্রে এই গ্রামের অতিথি। ওদের কাছে গিয়ে একটু জিজ্ঞেস করে দেখো আমাদের

কোন সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা ওদের। যদি ওরা আজ রাত্রে থাকতে চায় বা খেতে চায় তাহলে সেই মতো

ব্যবস্থা করো।

ভুবন এতক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল। এবার একটু হেসে বলল—বাবু! এতটা

উদারতা না দেখিয়ে বরং আপনার লেঠেলদের তৈরি হয়ে বাড়ির চারপাশে লুকিয়ে থাকতে বলুন।

—সে কি! এ তুমি কি বলছ ভুবন ?

—ঠিকই বলছি। আপনি আর দেরি করবেন না। একবার নায়েব মশাইকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন।

তারাপ্রসন্নবাবু ভীত হয়ে বললেন—আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

—একটু পরেই বুঝতে পারবেন। ভুবন সর্দার এত ভুল করে না। বিপদের মেঘ ঘনিয়ে এসেছে বাবু। আপনি বাড়ির

মেয়েদের ও ছোট ছেলেপুলেদের গুপ্তকক্ষে পাঠিয়ে দিন। তাড়াতাড়ি করুন, দেরি করবেন না।

তারাপ্রসন্নবাবু ভুবন সর্দারকে ভালো রকমই চিনতেন। তাই ওপর থেকে হাঁক দিয়ে লেঠেলদের বললেন, —এই ভুবন

কি বলছে শোন। বলে নায়েবমশাইকে ডাকতে ডাকতে নিচে নেমে এলেন।

একটু পরেই নায়েবমশাই এলেন।

ভুবন নায়েবমশাইয়ের কানে কানে কি যেন বলতেই নায়েবমশাই দ্রুত চলে গেলেন সেখান থেকে ।

ভুবন এবার বারান্দা থেকে নিচে নেমে এলো। তারপর লেঠেলদের বলল— তোমরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে এই বাড়ির

আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকো। আর একটু বাদেই হয়তো এ বাড়িতে ডাকাত পড়বে।

লেঠেলরা বলল—কি করে বুঝলে ?

বাঘের গায়ের গন্ধ যেমন তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয় তেমনি ওদের এই সশস্ত্র আবির্ভাবও ওদের পরিচয় পাইয়ে

দিচ্ছে। ওরা সত্যিই বর কনে নিয়ে এলে ওদের ভেতর থেকে কেউ না কেউ আমাদের কাছে এসে রাতের আহার এবং

আশ্রয় প্রার্থনা করত। কিন্তু সে সব না করে চুপচাপ বসে রইল বারোয়ারীতলায়। এতে কি মনে হয়। আমার মনে হচ্ছে

এদের বরকনে সবই ভুয়া। আসলে এটা ওদের ছদ্মবেশ। আর ওই বাজি বাজনার উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রামের লোককে

ভুলিয়ে অন্যমনস্ক করা। ওদের অসতর্কতার সুযোগে ওরা এসে এখানে ডাকাতি করবে। অতএব তোমরা সতর্ক

থাকো!

ভুবনের কথামতো লেঠেলরা তাই করল।

এদিকে নায়েব মশাই ভুবন সর্দারের শেখানো পড়ানো মতো লোকজন সঙ্গে নিয়ে বারোয়ারীতলায় এসে অতিথিদের

জিজ্ঞেস করলেন—আপনাদের বরকর্তা কে?

একজন ষণ্ডামার্কা বাবরি চুলওয়ালা লোক গোঁফ পাক দিয়ে এগিয়ে এসে বলল—আমি।

—আমাদের মা ঠাকরুণ জানতে পাঠিয়েছেন আজ রাত্রে আপনারা কি এখানে থাকবেন? যদি থাকেন তাহলে

আপনাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা এখানে হতে পারে। কেননা আমাদের নিয়ম আছে এই গ্রামে কেউ অতিথি হয়ে

এলে আমরা তাদের অভুক্ত থাকতে দিই না।

বাবরি চুলওয়ালা লোকটি বলল—তা মন্দ প্রস্তাব কি? কিন্তু তোমাদের প্রজাবৎসল জমিদার তারাপ্রসন্নবাবু থাকতে

হঠাৎ মা ঠাকরুণ এই নিমন্ত্রণ জানালেন কেন ?

নায়েব মশাই হাত কচলাতে কচলাতে বললেন—মানে, বাবুমশাই তো নেই। উনি আজই সকালে লোকজন নিয়ে

বর্ধমান গেছেন একটি বিশেষ কাজে। ফিরতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে। তাই মা ঠাকরুণ বলে পাঠালেন বাবু

নেই বলে অতিথিসেবার যেন কোনরকম ক্রটি না হয়। আর এও বলে দিয়েছেন আপনারা ভিনদেশি লোক। হয়তো

জানেন না এ সমস্ত জায়গা ভালো নয়। তাই আপনারা পারলে এ রাত্রিটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালে যেখানে ইচ্ছে

যান।

—সে ভেবে দেখবখন। তা তোমাদের সেই ভুবন সর্দার লোকটি কি এখানে আছে ?

নায়েব মশাই বললেন—হঠাৎ ভুবন সর্দারের খোঁজ করছেন কেন বলুন তো ?

—সে আমাদের পুরনো বন্ধু। তার সঙ্গে একটু দেখা করবার ইচ্ছে আছে আমাদের।

—তাই নাকি! কিন্তু মহাশয় ভুবন সর্দার তো এখানে নেই।

—কোথায় গেছে সে ?

—ভুবনও তো বাবুর সঙ্গে গেছে। পথে ঘাটে বাবুর যদি হঠাৎ কোন বিপদ হয় তখন বাবুকে রক্ষা করবে কে! কাজেই

ভুবনের সঙ্গে তো এখন দেখা হবে না। বাবরি চুলওয়ালা লোকটি এবার গোঁফে তা দিয়ে বলল—জয় মা। তা তোমাদের

ভুবন সর্দার লোকটি কিন্তু সত্যিই দুর্ধর্ষ। তা কি জান—ঘটে একটুও বুদ্ধি নেই। এই যে সে বাবুর সঙ্গে গ্রাম থেকে চলে

গেল এখন হঠাৎ কোন বিপদ হলে তোমাদের রক্ষা করবে কে?

নায়েব মশাই বললেন—সে অবশ্য ঠিক। তবে আমাদের এখানে সচরাচর কোন বিপদের আশঙ্কা দেখি না আমরা।

তার পরেও যদি কিছু ঘটে তবে সেটা দুর্ভাগ্য।

বাবরি চুলওয়ালা লোকটি বলল—বেশ। আমরা এই রকমটিই চাইছিলুম। তোমাদের মাঠাকরুণকে বলো আমরা আজ

রাত্রে এখানেই থাকছি। তোমরা আমাদের রাতের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাটা একটু তাড়াতাড়িই করো তাহলে।

নায়েব মশাই ফিরে এসে সেই কথাটা ভুবন সর্দারকে বলতেই ভুবন বলল— ঠিক আছে। যা ভেবেছি তাই। আপনি এক

কাজ করুন—বেশ কড়া করে কিছু লোককে সিদ্ধি বাটতে বসিয়ে দিন। তারপর সেই সিদ্ধির সরবত বালতি বালতি

নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে থাকুন ওদের, তবে খুব সাবধান, লোভে পড়ে আপনার লোকেরা যেন ঐ সিদ্ধি চেখে দেখতে না

চায়। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

নায়েব মশাই বললেন—ও ভারটা আমার ওপরই ছেড়ে দাও ভুবন। এই বলে নায়েব মশাই তাঁর সমস্ত অনুচরদের

সিদ্ধি বেটে সরবত তৈরী করতে লাগিয়ে দিলেন। তারপর সেই সরবত বড় বড় বালতিতে করে নিয়ে চললেন

বারোয়ারীতলায়।

এদিকে নায়েব মশাই চলে আসার পর দলের লোকেরা কি সব কথাবার্তা কয় তা শোনবার জন্য ভুবনের একজন

অনুচর লুকিয়ে ছিল বটগাছের আড়ালে। নায়েব মশাই চলে আসতেই লোকটি দেখল বর কনের দল আনন্দে উল্লাসে

ফেটে পড়ল।

বাবরি চুলওয়ালা লোকটি বলল—আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলুম রে ভাই। এ যে দেখি না চাইতেই জল। বাবু

তারাপ্রসন্ন নেই। ভুবন সর্দার নেই। তার মানে আরো কিছু লোক নেই। এ বাড়িতে ডাকাতি করার এর চেয়ে সুবর্ণ

সুযোগ আর কি হতে পারে।

আর একজন বলল—তার ওপরে উপরি পাওনা এই নেমস্তন্ন। ভালোই হ’ল। অন্ধকারে লুকিয়ে চুরিয়ে আচমকা

ঢুকতে হবে না। দল বেঁধে খেতে যাব আর সেই সুযোগে লুটপাট করে কেটেকুটে রেখে আসব।

বাবরি চুলওয়ালা লোকটি বলল—এমন সুযোগ হবে জানলে এত পরিকল্পনা করে বাজি বাজনা না নিয়ে এলেই হোত।

হৈ হৈ করে আচমকা ঢুকে পড়লেই চুকে যেত ল্যাঠা।

লোকটি এসব শুনেই চুপিচুপি এসে খবর দিল ভুবনকে। তারাপ্রসন্নবাবুও শুনলেন। শুনে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন

তিনি।

ভুবন সর্দার বলল—আপনি নিৰ্ভয়ে থাকুন বাবু। আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ আপনার গায়ে আঁচড়টি লাগতে

দেব না আমি।

তারাপ্রসন্নবাবুর ভয় তবুও গেল না। তিনি দুহাত জোড় করে ইষ্টদেবতাকে ডাকতে লাগলেন।

ডাকাতের দল যখন বারোয়ারীতলায় বটগাছের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আনন্দ উল্লাস করছে তখন নায়েব

মশাইয়ের লোকেরা দলে দলে সিদ্ধির বালতি নিয়ে এসে বলল—তা মাননীয় অতিথিরা, আপনাদের জন্য আমাদের

এখানে লুচি মণ্ডার ব্যবস্থা হয়েছে। ততক্ষণ একটু সরবত খেয়ে ক্লান্তি দূর করুন।

নায়েব মশাইও তদারকি করতে করতে বললেন—ওরে দে দে অতিথিদের সরবত দে। বেশ যত্ন করে খাওয়া।

ডাকাতরা তো আকণ্ঠ সেই সরবত খেয়ে খুব প্রসংশা করতে লাগল। আহা কি চমৎকার! এমনটি আমরা কখনো

খাইনি।

নায়েব মশাই বললেন—আমাদের গ্রামের এই সরবতের এক বিশেষ গুণ আছে। খেলে খিদে হয়, হজম হয়। ঘুম

আসে। একবার খেলে ভোলা যায় না। একে সিদ্ধির সরবত। তার ওপর অঢেল খাওয়া। কাজেই খেতে খেতে নেশা

হ’ল। আর নেশার ঘোরে সবাই তখন চেঁচাতে লাগল—আরো দাও, আরো দাও করে।

ওরা যত চায়, এরাও ততই দেয়। তারপর যখন দেখল আর না খাওয়ালেও চলবে তখন গিয়ে খবর দিল ভুবন

সর্দারকে।

একটু পরেই দেখা গেল কয়েকজন লোক ঢোল কাসি বাজিয়ে আসছে। একজনের কাঁধে মস্ত একটা হাড়ি কাঠ। আর

ভুবন সর্দারের হাতে একটি ধারালো কাতান (খড়গ)।

ওরা এসে ঢোল কাসি বাজিয়ে বারোয়ারীতলায় হাড়ি কাঠ পুঁততে লাগল। আর ভুবন সর্দার কাতান উঁচিয়ে

বারোয়ারীতলায় দেবীর শূন্য আসরের কাঠামোর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল—মা—মাগো, আজই যেন ওদের শেষ

রাত হয় মা।

এই দেখে একজন ডাকাত সিদ্ধির ঘোরেই জিজ্ঞেস করল—কি ভায়া, তোমরা এসব এখানে এনেছ কেন?

ভুবন সর্দার বলল—আজ আমাদের শুভ রাত্রি। তাই আজ মায়ের সামনে বলি হবে।

—অ। তা আমরা সেই বলির প্রসাদ পাবো তো?

—নিশ্চয়ই পাবে। সবাই জোড় হাত করে মাকে ডাকো।

ইতিমধ্যে ভুবনের ইঙ্গিতে ডাকাতের দলকে লেঠেলরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ভুবন বলল—এদিকে যে এক

মুশকিল হয়ে গেছে ভাই।

—কি মুশকিল হয়েছে বলো ?

—বলি তো হবে, কিন্তু বলির পাঠা যে পাওয়া যাচ্ছে না।

—সে কি রকম কথা। ওসব কিছু আমরা শুনতে চাই না। আমরা বলি দেখব। বলির প্রসাদ চাই আমাদের। যেমন করে

পারো বলি দাও।

ভুবন সর্দার বলল—আরে সেই জন্যেই তো আমি এসেছি। আমি বলি কি পাঁঠা নাইবা পেলাম। মায়ের পুজোর জন্যে

তোমাদের ভেতর থেকে কি কেউ বলির পাঁঠা হতে পারো না ?

এমন সময় ডাকাতদের ভেতর থেকে একজন ‘প্যাঁ প্যাঁ’ করে ডাকতে ডাকতে এসে বলল—আমি, আমি হব বলির

পাঁঠা। আমাকে বলি দাও আজ, তবে ভাই, একটা কথা আগেই বলে রাখছি, আমার ভাগের পেসাদটা কিন্তু বেশি চাই।

সেই না শুনে আর একজন ডাকাত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল—একি মগের মুলুক নাকি? তুই কেন বেশি পেসাদ

পাবিরে? তাছাড়া আমি থাকতে তুই কি পাঁঠা হবি। পাঁঠা তো আমি হবো।

অন্য ডাকাতরা তখন পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। ওরা পাঁঠা হলে আমরাও তো পাঁঠা । ।

ভুবন সর্দার বলল—তোমরা সবাই পাঁঠা। একটু সবুর করো, তোমাদের সবাইকেই এক এক করে এই হাঁড়ি কাঠে বলি

দেবো আমি।

এইবারেই হল মুশকিলের চুড়ান্ত। কে আগে পাঁঠা হবে তাই নিয়ে ডাকাতদের দলে নিজেদের ভেতর লেগে গেল

দারুণ মারামারি। আর তারই ফাঁকে ভুবন করল কি হাতের সামনে যাকে পেল তাকেই ধরে বলি দিতে লাগল।

এইভাবে দলকে দল শেষ করে দেবার পর একজনই শুধু বাকি রইল। সে হল সেই বাবড়ি চুলওয়ালা লোকটি। সেই

হচ্ছে দলের সর্দার। সর্দার বলল-আমার দলের লোকেরা সবাই যখন পাঁঠা হ’ল তখন আমিই বা বাকি থাকি কেন?

আমিও পাঁঠা হবো। তবে ভাই একটু আস্তে কোপটা মেরো। যেন না লাগে।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই সর্দারের মাথা হাঁড়িকাটে লাগানো হ’ল। আর লাগানো মাত্রই ঢোল কাঁসি বাজনার সঙ্গে সঙ্গে ভুবন

সর্দারের উদ্যত খড়গ দ্বিখণ্ডিত করল ডাকাত সর্দারকে।

ভুবনের বুদ্ধির চালে পঞ্চাশজন ডাকাতকে এক রাতের মধ্যে শেষ করে দেওয়া হ’ল। সেই রাতে এই অঞ্চলের প্রায়

সমস্ত কুখ্যাত ডাকাতকেই বলি দেওয়া হয়েছিল। ডাকাত বলির পর তারাপ্রসন্নবাবু ভুবন সর্দারকে প্রচুর পুরস্কার

দিয়েছিলেন। অনেক জমিজমা লিখে দিয়েছিলেন। আর গ্রামসুদ্ধ লোককে পরদিন পেট ভরে মণ্ডা মিঠাই

খাইয়েছিলেন। সেই থেকে ভুবন সর্দারের নামই হয়ে গিয়েছিল ডাকাত কাটা ভুবন।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত