এক ইঁদুরের গর্তের পাশেই ছিল একটা কাকের বাসা। কাকের সাথে ইঁদুরের শত্রুতার কথা তো জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু তারপরেও অদ্ভুতরকমভাবে এই কাক আর ইঁদুরের প্রতিবেশী জীবন কাটে দীর্ঘদিন। কেন যেন কাকের মনে ইঁদুরের প্রতি মমত্ববোধ জেগে উঠল এবং সে চাইল ইঁদুরের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে। সম্ভবত ইঁদুরের পরোপকারী মনোভাবই তার সাথে কাকের বন্ধুত্ব স্থাপনে উৎসাহ জুগিয়েছে। যাই হোক, কাক একদিন ইঁদুরের গর্তের মুখে গিয়ে ইঁদুরকে ডাকল। ইঁদুর কাকের ডাক শুনে গর্তের ভেতর থেকেই জিজ্ঞেস করলো: আমার কাছে কী চাও তুমি? কাক বলল: আমরা পরস্পরের প্রতিবেশী। বহুদিন ধরেই তো আছি পাশাপাশি। আসলে আমরা চাইলে খুব ভালো বন্ধু হয়ে যেতে পারি, তাই না?
ইঁদুর বলল: কাকের সাথে ইঁদুরের শত্রুতার কথা সবাই জানে, কিন্তু বন্ধুত্ব হতে পারে এরকম কথা তো জীবনে কোনোদিন শুনি নাই। ঠিক আছে, হতে পারে। তবে শর্ত হলো একজনের বন্ধুত্ব যেন অপর বন্ধুর মৃত্যুর কারণ না হয়।
কাক বলল: হ্যাঁ, জানি কাকেরা ইঁদুরের শত্রু। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি বন্ধুত্বের অপমান করব না, কখনোই তোমাকে আমি শিকার করব না।
কাক আর ইঁদুরের মাঝে এ নিয়ে অনেক কথা হলো এবং একসময় ইঁদুর রাজি হলো। সে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল। তারপর থেকে দুজনের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকল।
এভাবে কিছুদিন কেটে যাবার পর কাক একদিন ইঁদুরকে বলল: আমরা এখানে আর শান্তিতে বসবাস করতে পারব না। শিকারীরা প্রায়ই এখান দিয়ে যাওয়া আসা করে। আমি আগে একটা ঝর্নার পাশে চমৎকার একটা তৃণভূমিতে ছিলাম। সেখানে আমার এক কচ্ছপ বন্ধুও ছিল। জায়গাটা বেশ সুন্দর। খাবার দাবারেরও কোনো সমস্যা নাই। চলো আমরা সেখানে চলে যাই।
ইঁদুর কাকের কথায় সায় দিল। কাক ইঁদুরকে একটা খাঁচায় ঢুকিয়ে পায়ের নখে আটকে উড়াল দিল এবং চলে গেল বন্ধু কচ্ছপের কাছে। কচ্ছপ তার পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে গেল। কাক তার নতুন বন্ধু ইঁদুরকে পরিচয় করিয়ে দিলো। কীভাবে তাদের বন্ধুত্ব হলো তাও বলল। সেইসাথে ইঁদুরের পরোপকারের কয়েকটি ঘটনারও বর্ণনা দিল কচ্ছপের কাছে। কচ্ছপ ইঁদুরের ভীষণ প্রশংসা করল। এরপর থেকে তারা তিন বন্ধু একসাথে গল্প গুজব করে দারুন সমসয় কাটাতে লাগল।
একদিন এভাবে গল্পগুজব করার সময় হঠাৎ তারা দেখল একটা হরিণ হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের দিকে আসছে। দৌড়ানোর ভাবটা এমন যেন কোনো শিকারী তাকে তাড়া করেছে। এ অবস্থা দেখে কাক ইঁদুর এবং কচ্ছপ আত্মগোপন করল। হরিণ যখন তাদের কাছে এসে পৌঁছলো, একটু পানি খেয়ে আরামে দাঁড়িয়ে রইল। এ অবস্থা দেখে তিন বন্ধু নিশ্চিত হলো যে কেউ তাকে তাড়া করে নি। তারা বেরিয়ে এল।
কচ্ছপ হরিণকে জিজ্ঞেস করলো: কোত্থেকে এসেছো? এতো উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
হরিণ বলল: আমি তো এখান থেকে কাছেই একটা চারণভূমিতে বাস করতাম। আজ চারণভূমির কাছে কালো একটা বস্তু দেখতে পেলাম। শত্রু ভেবে দৌড়ে পালিয়ে এলাম এখানে।
কচ্ছপ বলল: তুমি তো একটা শান্তিপ্রিয় নিরীহ প্রাণী। আমরাও তিন বন্ধু তোমার মতোই শান্তিপ্রিয়। এখানে আমরা একসাথে থাকি। তুমি চাইলে আমাদের সাথে থাকতে পারো। হরিণ সায় দিল এবং সে মিলে চার বন্ধু একসাথে কাটাতে লাগলো। সবাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একসাথে গল্পগুজব করে ভালোভাবেই কাটাতে লাগল।
একদিন হলো কী, হরিণ সময়মতো ফিরে এলো না। সবাই মানে কাক, ইঁদুর এবং কচ্ছপ সেজন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। কাক উড়ে উড়ে চারদিকে দেখে এসে বলল: হরিণ শিকারীর জালে আটকা পড়েছে।
কচ্ছপ বলল: এখনই কিছু করার উপযুক্ত সময়। চলো হরিণকে মুক্ত করে আনি।
ইঁদুর দৌড়ে গিয়ে শিকারির জাল কেটে হরিণকে বের করল। কচ্ছপও তখন তাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছল। হরিণ তাকে বলল: বন্ধু,, এখন পালাতে হবে। তুমি তো দ্রুত পালাতে পারবে না, এলে কেন?
কচ্ছপ বলল: বন্ধুত্বের প্রাপ্য অধিকার পূর্ণ করতেই এসেছি,আর সেই অধিকার হলো বিপদের সময় বন্ধুর পাশে থাকা।
তিন বন্ধুই কচ্ছপকে বলল তাড়াতাড়ি পালাতে।
একটু পরেই শিকারী সেখানে এসে বুঝতে পারল জাল কেটে হরিণ পালিয়ে গেছে। শিকারী আশেপাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না। অবাক হয়ে গেল সে। ভাবতে লাগলো হরিণ কী করে জাল কাটল! ভাবতে ভাবতেই সে তার জাল নিয়ে রওনা দিল। পথেই তার নজরে পড়লো কচ্ছপকে। মনে মনে বলল: জানি, মূল্যহীন তবু ‘নাই মামার’ চেয়ে ভালো। কচ্ছপকে তুলে নিয়ে ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে ভালোভাবে ব্যাগের মুখ আটকে দিল। ব্যাগটা কাঁধে ফেলে আবারো হাঁটতে শুরু করল শিকারী।
এদিকে হরিণ, কাক আর ইঁদুর পরস্পরকে খুঁজে পাবার পর কচ্ছপকে খুঁজতে বেরুলো। কোত্থাও না পেয়ে তারা বুঝলো শিকারীর হাতে ধরা পড়েছে। সবার মন খারাপ হয়ে গেল। হরিণ কাঁদতে কাঁদতে বলল: সব আমার কারণে হয়েছে। এখন কী করে কচ্ছপকে খুঁজে বের করব!
কাক বলল: কেঁদো না বন্ধু। শোনো। ঐক্যের জয় সুনিশ্চয়! যতোক্ষণ আমরা ত্যাগের চিন্তায় অটল থাকব ততোক্ষণ সবই আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হবে।
হরিণ বলল: কী করতে হবে বল।
কাক বলল: শোনো! আমরা একটা নাটক সাজাব। তুমি শিকারীর পথে শুয়ে পড়বে। আমি উড়ে এসে তোমার ওপর হামলা করব। এমনভাবে হামলা করবো যেন আমি তোমার চোখ দুটো খুঁটে খাচ্ছি। শিকারী আমাদের দেখতে পাবে। সে এগিয়ে এলে তুমি উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড় দেবে। শিকারী তোমাকে দেখে ভাববে তুমি দ্রুত দৌড়তে পারবে না। তাই সে তোমাকে ধরতে এগিয়ে আসবে। তোমার কাছাকাছি এলে তুমি জোরে দৌড় দেবে। শিকারী তখন তার ব্যাগ ফেলে তোমার পেছনে দৌড়াবে। ঠিক আছে!
হরিণ বলল: ঠিক আছে।
সথ্যি সত্যিই নাটকটি ঠিকঠাকমতো করা হল। শিকারী যখন তার ব্যাগ ফেলে হরিণকে ধরতে দৌড়তে শুরু করল তখন ইঁদুর এসে ব্যাগ কেটে কচ্ছপকে মুক্ত করল।
আকাশে উড়ন্ত কাকা যখন দেখলো ইঁদুর তার কাজ ঠিকঠাক মতোই পালন করেছে এবং কচ্ছপ মুক্ত হয়ে পালিয়েছে তখন সে হরিণকে বলল: কাজ হয়ে গেছে, তুমি দ্রুত পালাও।
হরিণও পালিয়ে গেল। শিকারী যখন দেখলো হরিণকে ধরা সম্ভব না, ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসে দেখল ব্যাগ কাটা এবং কচ্ছপও নেই। মন খারাপ করে হতাশার গ্লানী নিয়ে ফিরে গেল নিজ শহরে। আর ইঁদুর, কাক, কচ্ছপ আর হরিণ ঐক্যবদ্ধভাবে মিলেঝুলে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করতে লাগল। পারস্পরিক সহযোগিতা আর সহমর্মিতার মাধ্যমে তারা এরকম বহু বিপদ থেকে রেহাই পেয়েছে।