প্রাচীন গল্পের সমৃদ্ধ একটি ধারা হলো ‘মাথাল’। মাথাল হাস্যরসাত্মক গল্প। তবে গল্পটি বর্ণিত হয় কবিতার মতো করে এবং বাদ্যবাজনা সহকারে। ফার্সিতে এগুলোকে তারানা বলা হয়। সংগীতজ্ঞ যাঁরা তারানা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা আছে। ইরানী বিখ্যাত একটি ‘মাথাল তারানা’ হলো ‘দোভিদাম ও দোভিদাম’ অর্থাৎ দৌড়লাম আর দৌড়লাম। এই তারানাটির বাংলারূপ দাঁড়াবে এরকম:
দৌড়লাম আর দৌড়লাম/ পাহাড় চূড়ায় পৌঁছলাম
সেখানে দুই নারী ছিল/ একজন আমায় রুটি দিল
পানি দিলো বাকিজন/ রুটি খেলাম ক্ষুধায় তখন
পানি দিলাম মরুর বুকে/ মরু দিল ঘাস
ঘাস খেয়ে ছাগল আমায়/ দিল দুধের রাশ
দুধ দিলাম দোকানে/ দোকানী দিল কিশমিশ
সেই কিশমিশ খেয়ে বুড়ো/ করল দোয়া শুভাশীষ
সেই দোয়াকে বানিয়ে তাবিজ/ বেঁধে রেখেছি বাজুতে
আল্লাহ আমায় দিলেন শাফা/ দোয়ার বিশেষ রহমতে
নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন এই মাথালের ভেতর চমৎকার একটা গল্প আছে। ছোট্ট শিশুটি সেই গল্পের ভেতর ডুবে যায়। আমরাও আর দেরি না করে বরং গল্পে মন দেই।
পুরনো দিনের কথা। এক লোক একটা ছাগল পালত। একদিন লোকটা তার ছোটো ছেলেকে বলল: ‘ছাগলটাকে নিয়ে যা চারণভূমিতে। ভালো করে চরাবি, বেশি বেশি ঘাস খাওয়াবি’।
ছেলেটা ঠিকই ছাগলটাকে নিয়ে গেল মরুপ্রান্তরের দিকে। সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত চরালো ছাগলটাকে। রাত হয়ে এলে ছেলেটা ছাগলটাকে নিয়ে ফিরে এলো বাড়িতে। রাতের বেলা বাবা ছাগলটাকে জিজ্ঞেস করল: ‘কীরে ছাগল! আজ তো দেখছি ভালোমতো খেয়েছিস, একেবারে পেট ভরে খেয়েছিস তাই না!’
ছাগল বলল: ‘কী যে বলেন! মরুভূমিতে আবার ঘাস হয় নাকি যে পেটভরে খাবো? তোমার পোলায় আমার রশির খুঁটিটা একেবারে মরুভূমির মাঝখানে গিয়ে গেড়ে রাখলো। খুঁটি গেড়ে সেই যে কোথায় চলে গেল খেলাধুলা করতে, আর ফিরে এলো সেই সন্ধ্যায়। ওই মরুতে আমি কোথায় কী খাই?
ছাগলের কথা শুনে লোকটার ভীষণ রাগ হলো। সে সাথে সাথেই ছেলের গালে কষে চড় লাগিয়ে দিলো। ছেলেটা খুবই অভিমান করল। এতোই অভিমান করল যে মাঝরাতে সবাই যখন ঘুমে, সে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেল। সকাল বেলায় বাবা ছাগলটাকে দিলো তার মেজো ছেলেকে। বলল ভালো করে চরাবি, পেট ভরে ঘাস খাওয়াবি। ছেলে তো চলে গেল ছাগল চরাতে। ভালো করে চরিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে এলো বাড়ি। রাতের বেলা আবারো একই ঘটনা ঘটলো। ছাগলটা আজও একইরকম অভিযোগ করল। বাবা আজো ছোটো ছেলের মতো মেজো ছেলেকেও শাসন করল। অপমানে রেগেমেগে মেজে ছেলেও মাঝরাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। একই ঘটনা ঘটলো বড় ছেলের ক্ষেত্রেও। সেও শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো।
পরদিন সকালবেলা কী আর করা…লোকটা অগত্যা নিজেই মরুভূমিতে গেল ছাগল চরাতে। ছেলেদের মতোই সন্ধ্যাবেলা ছাগল নিয়ে সে ফিরে এলো বাড়িতে। রাতের বেলা আগের মতোই ছাগলকে জিজ্ঞেস করল: হ্যাঁ…আজ তাহলে পেট ভরেছে.. না?…ভালোই তো ঘাস খেয়েছিস’? ছাগল জবাব দিলো: ‘খোদা তোমার ছেলেদের বাবাকে ক্ষমা করুন! তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে গেছো..সেখানে তো খাবার মতো কিছুই ছিল না’।
লোকটা আশ্চর্য হয়ে ছাগলের দিকে তাকাল। মনে মনে বলল: ছাগলটা তো দেখছি মিথ্যা বলছে…তার মানে আমার ছেলেরা তো কোনো অপরাধ করে নি.. মিথ্যাবাদী ছাগলটার কারণে খামোখাই আমি ছেলেদেরকে মারলাম… এরপরই ছাগলটাকে নিয়ে গিয়ে বদমেজাজি গাধার ঘরে নিয়ে বেঁধে রাখলো। আর গাধাটাকে মরুতে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলো…।
পাঠক! ছেলে তিনটি যে পালিয়ে গেল, তারা কোথায় কী করছে, কেমন আছে তারা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, বলছি। একেবারে ছোটো ছেলেটা গেছে এক রাখালের কাছে। সেখানে সে রাখালের কাজ অর্থাৎ পশু চরানোর কাজে জড়িয়ে গেল। মেজো ছেলেটা গেছে তামা শিল্পীর কাছে কাজ শিখতে। আর বড়ো ছেলেটা গেছে এক স্থপতি বা পাথর খোদাইকারীর কাছে। মোটামুটি তিন ছেলেই কাজে লেগে গেছে। কাজ করতে করতে বছর তিনেক কেটে গেল তাদের। বড়ো ছেলেটার মন বাড়িতে যাবার জন্যে খুব চাচ্ছিল। সে তার ওস্তাদকে বলল: ওস্তাদ! আমি একটু আমার নিজের শহরে যেতে চাই, অনেকদিন হয়ে গেল বাড়ির খোঁজখবর নাই…যদি অনুমতি দেন তাহলে যেতে চাচ্ছিলাম।
ওস্তাদ অনুমতি দিল এবং তাকে একটা হাতে ঘুরানোর যাঁতা দিয়ে বলল: ‘যখনি তোমার ক্ষিদে লাগবে তখন যা খেতে চাইবে মনে মনে ভেবে যাঁতাটা ঘুরাবে, যাঁতার ভেতর থেকে তোমার চাওয়া খাবার দাবারগুলো চলে আসবে’। ছেলেটা যাঁতা নিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির পথে। যেতে যেতে পথের মাঝেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। রাত কাটাবার জন্যে একটি বাড়িতে ঢুকলো সে। বাড়িটা ছিল এক যাঁতাকল মালিকের। মালিক তাকে থাকার অনুমতি দিলো। রাতের বেলা যখন ক্ষিদে লাগল, ছেলেটা মনে মনে খাবারের চিন্তা করে তার যাঁতাটা ঘুরাল। অমনি যাঁতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো তরতাজা চিকেন পোলাও আর ফলপাকড়া। যাঁতাকল মালিক ব্যাপারটা দেখে ঐ যাদুকরি যাঁতাটা চুরি করার সিদ্ধান্ত নিল। ছেলেটা যখন রাতে ঘুমিয়ে পড়লো, ঠিকই সে যাঁতাটা নিয়ে গিয়ে তার বদলে একইরকম দেখতে একটা মামুলি যাঁতা রেখে দিল।
সকালবেলা তো ছেলেটা প্রশান্তমনে বাড়ির পথে পা বাড়াল, সাথে নিল তার ওস্তাদের দেওয়া যাঁতা। বাড়িতে গিয়ে বাবাকে বলল: ‘আমি অমুক মেয়েকে বিয়ে করবো। এই যাঁতা আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে’। বাবা বিয়ে ঠিক করল। বিয়ের দিন অতিথিদের খাবার দাবারের জন্যে যাঁতাটাকে যতোই ঘুরাল কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। বিয়ের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে গেল।
এদিকে, মেজো ছেলেও বাড়িতে আসতে চাইলো। তার ওস্তাদ তামাশিল্পী তাকে অনুমতি দিল এবং তাকে একটা তামার পাতিল দিয়ে বলল: ‘যখন যা প্রয়োজন হবে একটা চামুচ দিয়ে পাতিলটার ভেতর ঘুরাবে আর মনে মনে চাইবে, সাথে সাথে তা চলে আসবে’।
ছেলেটা রওনা দিল এবং সন্ধ্যার সময় সেই যাঁতাকল মালিকের বাড়িতে গিয়েই উঠলো। রাতে যখন তার ক্ষিদে লাগল চামুচটা দিয়ে পাতিলের ভেতর ঘুরালো আর পাতিলে খাবার দাবার সব এসে ভর্তি হয়ে গেল। বদমাশ যাঁতাকল মালিক রাতে একই কায়দায় এই যাদুকরি পাতিলটাও চুরি করে পাল্টে নিলো। সকালবেলা ছেলেটা মামুলি পাতিলটা নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো। সেও তার বাবাকে বিয়ের কথা জানাল। বাবা বিয়ের আয়োজন করল এবং বিয়ের দিন খাবার দাবারের সময় একইরকম দুর্ঘটনা ঘটলো। পাতিল কাজ করল না, বিয়ের অনুষ্ঠান ভেস্তে গেল।
এবার ছোট ছেলের পালা। সেও বাড়ি যেতে চাইল এবং তার রাখাল ওস্তাদ তাকে যাবার সময় একটা হাতুড়ি উপহার দিয়ে বলল: ‘যখনই কারো সাথে তোমার ঝগড়া হবে, বলবে-‘বেরিয়ে আস’ সাথে সাথে এক শ জন মানুষ হাতুড়ি হাতে বেরিয়ে আসবে। আবার যখন বলবে ‘প্রবেশ করো’ তখনি তারা সবাই হাতুড়ির মাথা দিয়ে ঢুকে যাবে।
ছেলেটা হাতুড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে রাতের বেলা সেই যাঁতাকল মালিকের বাড়িতে গিয়েই উঠল। সেখানে গিয়ে সে দেখলো যাঁতাকল মালিক অদ্ভুত এক পাতিল আর যাঁতা থেকে মুরগি পোলাও বের করে এনে মানুষের কাছে বিক্রি করছে।
ছেলেটা জিজ্ঞেস করল: এগুলো কোত্থেকে এনেছো?’ যাঁতাকল মালিক বলল: ‘সেটা তোমার জেনে কাজ নেই’। ছেলেটা হাতুড়িকে বলল: ‘বেরিয়ে আসো’। অমনি হাতুড়ি হাতে একশ’ জন বেরিয়ে এসে যাঁতাকল মালিকের খবর করে দিলো। ভয়ে যাঁতাকল মালিক পুরো ঘটনা নত্য সত্য বলতে বাধ্য হলো। বর্ণনা শুনে ছেলেটা বুঝল ওরা তারই ভাই ছিল। তামার যাদুকরি পাতিল আর যাদুময় যাঁতাটা নিয়ে সে বাড়ি ফিরে গেল। ছোটো ভাই বড়ো দু-ভাইয়ের যাদুময় পাতিল আর যাঁতা নিয়ে আসায় তাদের সকল সমস্যা কেটে গেল। তারপর থেকে তিন ভাই বিয়ে শাদি করে সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে লাগল।