এক ব্যবসায়ীর তিন ছেলে ছিল। ছেলেদের নাম ছিল যথাক্রমে সেলিম, সালেম এবং জুযার। যেমন হয় আর কি, বাবা তার ছোটো ছেলেকে অন্য দুই ছেলের তুলনায় একটু বেশি স্নেহ করতো। আর এই বিষয়টাই কাল হয়ে দাঁড়ালো। বড় দুই ভাই ছোটো ভাইকে হিংসার চোখে দেখতে লাগলো। তার বিরুদ্ধে দু ভাই বিদ্বেষী হয়ে উঠলো ভেতরে ভেতরে। এদিকে বয়স তো আর থেমে থাকে না। বৃদ্ধ বাবা ভাবলো যে-কোনো সময় তো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হতে পারে। মৃত্যুর পরে সেলিম এবং সালেম জুযারকে জ্বালাতন করে কিনা এ আশঙ্কা তাঁর ভেতর জেগে উঠলো। তিনি ভাবলেন ওরা যদি জুযারকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে, তাকে তার সম্পত্তি যদি না দেয়!
এই টেনশন থেকে ব্যবসায়ী বাবা সিদ্ধান্ত নিলো মরার আগে তাঁর সম্পত্তি ছেলেদের মাঝে ভাগ করে দেবেন। তাই করলেন। একদিন তিনি তাঁর পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত করলেন বাসায়। সবার উপস্থিতিতেই তিনি তাঁর সম্পত্তিকে চার ভাগে ভাগ করলেন। তিন ভাগ দিলেন তিন ছেলেকে আর এক ভাগ ব্যবসায়ী নিজের এবং তাঁর স্ত্রীর জন্য রাখলেন। এর কিছুদিন পর ব্যবসায়ী এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। সেলিম এবং সালেম তাদের অংশ নিয়ে সন্তুষ্ট হলো না। তারা জুযারের অংশও নিয়ে যেতে চাইলো। স্বাভাবিকভাবেই তিন ভাইয়ের মাঝে দ্বন্দ্ব কলহ দেখা দিলো।
সেলিম এবং সালেম জুযারের বিরুদ্ধে বিচারকের কাছে অভিযোগ করলো। জুযার মামলা নিয়ে এক আদালত থেকে আরেক আদালতে দৌড়লো। সেলিম সালেম এই মিথ্যা মামলা চালাতে গিয়ে ব্যাপক টাকা পয়সা খরচ করে ফেললো। কিন্তু তারপরও কোনো ফল হলো না। এভাবে কিছুদিন যাবার পর তাদের টাকা পয়সা জমিজমা সব শেষ হয়ে গেল। সর্বস্বান্ত হয়ে সেলিম সালেম নিঃস্ব হয়ে গেল। এরপর তারা গেল তাদের মায়ের কাছে। মাকে পিটিয়ে জোর করে তাঁর কাছে থাকা বাবার দেওয়া টাকাগুলো নিয়ে গেল। জুযার বাসায় ফেরার পর মা কান্নাকাটি করতে করতে তাঁর সাথে সেলিম সালেমের দুর্ব্যবহারের পুরো ঘটনা খুলে বললো। জুযার মায়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো: কেঁদো না মা! ধৈর্য ধরো! আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমার সাথে তাদের এই দুর্ব্যবহারের শাস্তি দেবেন! তুমি চিন্তা করো না! আমার বাসায় থাকো তুমি। আমি কাজ করবো। যেদিন যেটুকু মেলে বাসায় নিয়ে এসে একসাথে খাবো! মা এ কথা শুনে শান্ত হলেন।
জুযার মাছ শিকার করার জন্য একটা জাল বানালো এবং মাছ শিকার করার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রতিদিন সকালবেলা খুব ভোরে ভোরে সে জাল নিয়ে সমুদ্রের তীরে চলে যেত, মাছ শিকার করতো এবং সেগুলো বাজারে বিক্রি করে যা পয়সা পেত সে পয়সায় খাবার দাবার কিনে বাসায় গিয়ে মাকে নিয়ে খেত। ভালোই কাটছিল মা এবং ছেলের জীবন। যদিও সাদামাটা তবু প্রশান্তি ছিল। কিন্তু সেলিম সালেম বেকার জীবনযাপন করতে লাগলো। মায়ের যে টাকাগুলো জোর করে নিয়ে এসেছিলো সেগুলো খরচ হয়ে গেল। এবার তো আর উপায় নেই। কী করবে এখন! নিরুপায় হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করলো।
সেলিম সালেম খালি পায়ে ময়লা জামা কাপড় পরে অলিগলিতে বাসাবাড়িতে গিয়ে ভিক্ষা করে যা পেত তা খেয়ে কোনোরকমে জীবন কাটাতে লাগলো। কখনো কখনো ঘুরতে ঘুরতে মায়ের বাসায় গিয়ে অনুনয় বিনয় করে ভিক্ষা চাইতো। মায়ের মনটা তাদের জন্য পোড়াতো। সেজন্য ঘরে কিছু থাকলে তাদের দিতে কার্পণ্য করতেন না। নিজের ছেলে বলে কথা। তাদের খেতে দিয়ে বলতেন: তাড়াতাড়ি খেয়ে চলে যাও! জুযার এসে পড়লে কী হয় কে জানে! এ কারণে তারা জুযার আসার আগেই তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে চলে যেত। কিন্তু একদিন একটু দ্রুত বাসায় ফিরলো। সে সময় তার ভাইয়েরা খাচ্ছিলো। মা জুযারকে দেখে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রাখলো। অথচ জুযার ঠিক বিপরীত আচরণ করে ভাইদের সালাম দিয়ে বললো: স্বাগতম! তাহলে আমাকে এবং মাকে তোমাদের মনে পড়লো! আশ্চর্য! খুব খুশি হলাম তোমাদের দেখে।
ভাইয়েরা লজ্জা পেয়ে বললো: মায়ের কথা তোমার কথা তো সবসময়ই মনে পড়তো। কিন্তু যে ব্যবহার আমরা তোমাদের সাথে করেছি…লজ্জায় সামনে আসি নি। শয়তানের প্ররোচনায় আমরা তোমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছি.. সেজন্য ভীষণ অনুতপ্ত। জুযার বললো: ‘আমার মনে কিচ্ছু নেই। তোমরা নিশ্চিন্তে এখানে থাকতে পারো’। মা খুশি হলো এবং দোয়া করলো: প্রিয় ছেলে আমার! আমাকে তুষ্ট করেছো! আল্লাহ তোমার ওপর সন্তুষ্ট হন।
এভাবে ভাইদের মাঝে মিল হয়ে গেল এবং তিনভাই একত্রে বসবাস করতে লাগলো। জুযার প্রতিদিন ভোরে উঠে মাছ শিকারে যেত আর ভাইয়েরা বসে বসে খেতে লাগলো। তারা কোনো কাজই করতো না।
একদিন জুযার জাল নিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু একটি মাছও পেল না। মন খারাপ করে জালটা কাঁধে নিয়ে ফিরে আসার পথে রুটির দোকান পড়লো। বিশাল লাইন রুটির দোকানে। সে লাইনে না দাঁড়িয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। মুখ ভার। রুটির দোকানদারের দৃষ্টি পড়লো জুযারের ওপর। জুযারকে ডেকে বললো: রুটি লাগবে? নিয়ে যাও। থলি খালি দেখে বললো: মাছ পাও নি বুঝি। অসুবিধা নেই। এই বলে কিছু টাকাও জযযারকে দিল। বললো: পরে মাছ পেলে আমাকে দিও।
জুযার ওই টাকা দিয়ে মাংস কিনে বাসায় ফিরলো।
এর পরদিনও একই ঘটনা ঘটলো। কোনো মাছই পেল না। কতো দূরে দূরে গিয়ে জাল মারলো। তবু কাজ হলো না। ভাবখানা এমন যেন সাগর মাছশূন্য হয়ে গেছে।
হতাশ হয়ে বাসায় ফেরার পথে একই ঘটনা ঘটলো। রুটির দোকানদার তাকে ডেকে নিয়ে রুটি এবং কিছু টাকা দিয়ে দিলো। জুযার সেই টাকা দিয়ে মাংস কিনে বাসায় ফিরে মাকে দিলো রান্না করতে। মা রান্না করলো আর সব ভাই একসাথে বসে মজা করে খেল। কেউই বুঝতে পারলো না কীভাবে জুযার খাবারের আয়োজন করছে।
পরদিন আরো ভোরে গেল মাছ ধরতে। আজ নিশ্চয়ই মাছ পাওয়া যাবে-এরকম একটা আশা নিয়ে গেল সাগরে। কিন্তু না। আজও একই ঘটনা ঘটলো। মাছশূন্য থলি নিয়ে রুটির দোকানে সামনে আসতেই দোকানদার তাকে ডাকলো। দোকানদার তা চেহারা দেখেই বুঝে ফেললো আজও মাছ পাওয়া যায় নি। জুযারকে আজও সে রুটি আর টাকা দিয়ে বললো: সংকোচ করো না! কাল নিশ্চয়ই মাছ পাবে। তখন তুমি এসে ঋণ পরিশোধ করে দিও। যাও।
এভাবে এক সপ্তা হয়ে গেল সাগরে কোনো মাছই পেল না। পরদিন সকালে জুযার মনে মনে ভাবলো: সাগরে গিয়ে আর লাভ নেই। এবার বরং অন্য কোথাও যাই মাছ ধরতে। এই বলে সে এবার রওনা দিলো ‘কারুন’ নামের একটি খালের দিকে। তারপর কী হলো? সে ঘটনা জানতে হলে পরবর্তী আসরেও আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না।#
জুযারের ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প(২)
(দ্বিতীয় পর্ব) আমরা শুনেছিলাম জুযারের প্রতি বাবার ভালোবাসা ও স্নেহ একটু বেশি থাকার কারণে অপর দু’ভাইয়ের ঈর্ষার কথা। সেলিম এবং সালেম এমনকি মায়ের সম্পদটুকুও জোর করে কেড়ে নিয়ে খরচ করে অবশেষে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছে। ভিক্ষা করতে করতে একদিন জুযারের বাসায় এসে জুযার এবং মায়ের সন্ধান পায়। জুযারের ঔদার্যে সেলিম এবং সালেম তার বাসাতেই খায় আর ঘুমায়। জুযার মাছ ধরতে গিয়ে সপ্তাখানেক কোনো মাছই পায় না। খালি হাতে ফিরতে দেখে রুটির দোকানদার তাকে রুটি এবং টাকা ধার দেয়। তা দিয়েই সংসার চলে। এরপর জুযার সিদ্ধান্ত নেয় সমুদ্রের দিকে আর না গিয়ে কারুন নদীর দিকে যাবে।
কারুন নদীর দিকে যায় জুযার। তীরে গিয়ে জাল ফেলতে যাবে ঠিক সে সময় দেখে অদ্ভুত এক দৃশ্য! একটা লোক খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে তার সামনে আবির্ভূত হয়। ওই লোকটার পরনে ছিল বেশ দামী পোশাক। খচ্চরের পেটের জিনটাও ছিল সোনালি এবং রূপালি কারুকার্যময়। লোকটা খচ্চরের পিঠ থেকে নীচে নেমে এলো। জুযারকে সালাম দিয়ে বললো: ‘তোমার কাছে আমার একটা আবদার আছে। যদি তুমি আমার কাজটা করে দাও তাহলে তোমাকে আমি বিপুল পরিমাণে পুরস্কার দেবো’।
জুযার বললো: ‘আগে বলো তোমার কাজটা কী’?
লোকটি তার খচ্চরের জিন থেকে একটা রেশমি সূতা বের করে বললো: ‘এই সূতা দিয়ে আমার হাত-পা বাঁধবে। তারপর আমাকে ফেলে দেবে নদীতে। নদীর পানিতে ডুবে যাবার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। যদি দেখো পানির ভেতর থেকে আমার দুই হাত বেরিয়ে আসছে, তাহলে তুমি জাল মেরে আমাকে তুলে আনবে।
আর যদি দেখো পানির ভেতর থেকে আমার দুই পা বেরিয়ে আসছে তাহলে ধরে নেবে আমি মরে গেছি। তখন তুমি আমার আশা ছেড়ে দিয়ে আমার খচ্চর এবং খচ্চরের পিঠের মূল্যবান জিনটা নিয়ে বাজারে যাবে। বাজারে এক ইহুদি ব্যবসায়ী আছে ‘শামিয়া’ নামে। তার কাছে যাবে। তাকে খুঁজে পেলে এই জিন আর খচ্চর তাকে বুঝিয়ে দেবে। সে তোমাকে ১০০ স্বর্ণমুদ্রা দেবে। তুমি ওই স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিয়ে নিজের কাজে চলে যাবে’।
জুযার লোকটার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ মেরে থেকে অবশেষে মেনে নিলো। লোকটাকে ওই রেশম সূতা দিয়ে ভালো করে বাঁধলো। তারপর ছুঁড়ে মারলো পানিতে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর লোকটা পা-দুটো ভেসে উঠলো। সে বুঝলো লোকটা মরে গেছে।
তাই জুযার খচ্চর আর দামী জিনটা নিয়ে চলে গেল বাজারে। বাজারে গিয়ে বহু খোঁজাখুঁজি করে শামিয়া’কে পেল। লোকটার নির্দেশনা অনুযায়ী শামিয়াকে জিন আর খচ্চরটা বুঝিয়ে দিলো এবং শামিয়াও জুযারকে এক শ’ স্বণর্মুদ্রা দিয়ে দিলো। কিন্তু স্বর্ণমুদ্রা দেওয়ার সময় ইহুদি শামিয়া জুযারকে বলে দিলো এই ঘটনাটা যেন কাউকে না বলে। জুযার স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিয়ে বাসায় রওনা হয়ে গেল।
স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে বাসায় যাবার পথে পড়লো সেই রুটির দোকান-যে দোকানদার জুযারকে রুটি এবং টাকা ধার দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। জুযার দোকানদারের সকল পাওনা মিটিয়ে দিলো। কিছু রুটি আর গোস্ত কিনে চলে গেল বাড়িতে। যথারীতি গোশত পাকালো তার মা। খাবার সময় সব ভাই একত্রে বসে গোস্ত-রুটি দিয়ে মজা করে রাতের খাবার খেলো। খাবার দাবার শেষ করে জুযার বাকি স্বর্ণমুদ্রা মায়ের হাতে দিয়ে বললো: ‘এগুলো তোমার কাছে রাখো মা! আমি যখন থাকবো না, তুমি এবং আমার ভাইয়েরা খিদেয় কষ্ট করো না যেন’।
পরদিন সকালবেলা জুযার তার মাছ ধরার জাল নিয়ে চলে গেল কারুন নদীতে। জাল মারার আগেই আরেক লোক আবির্ভূত হল একইভাবে খচ্চরের পিঠে চড়ে। লোকটিও জুযারকে সালাম করে বললো: ‘জুযার! বলো তো! গতকাল এখানে আমার মতো একটা লোক খচ্চরে চড়ে আসে নি?’ জুযার ভেবেছিল তাকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাই সে বললো: ‘না তো! কেউ আসে নি।’ লোকটা হেঁসে দিয়ে বললো: ‘আমি সবকিছুই জানি’! এই বলেই সে পুরো ঘটনাটা বর্ণনা করলো। জুযার বললো: ‘তুমি তো সবই জানো! তাহলে আমার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছো কেন’?
লোকটি বললো: ‘এজন্য যে আমিও চাচ্ছি গতকাল লোকটির সাথে যা যা করেছো, একই কাজ আমার ক্ষেত্রেও করো’!
এই বলে লোকটা রেশমের একটা সূতা জুযারের হাতে দিলো। জুযার একই কাজ করলো এবং অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর দেখলো লোকটার পা দুটো বেরিয়ে এসেছে পানির ভেতর থেকে। সে ভাবলো লোকটা মরে গেছে। তারপর খচ্চর আর জিন নিয়ে যথারীতি চলে গেল শামিয়ার কাছে। শামিয়া ওই জিনিসগুলো নিয়ে এক শ’ স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে বাসায় ফিরে গেল। আজও একই কাজ করলো জুযার। স্বর্ণমুদ্রাগুলো মায়ের হাতে নিয়ে দিলো। মা অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো: জুযার! আমার কাছে মিথ্যে বলো না! সত্যি করে বলো তো! এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো তুমি কোত্থেকে আনো’?
জুযার মায়ের কাছে সত্যি ঘটনা খুলে বললো। তবে মা’কে বলে দিলো এই ঘটনা যেন নিজের মাঝেই রাখে! ঘুণাক্ষরেও যেন কাউকে না বলে।
পরদিনও জুযার কারুন নদীর দিকে যায়। এবার আরেক লোক এলো এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। জুযার লোকটার হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে অপেক্ষা করতে লাগলো। ঘণ্টাখানেক পর লোকটার দুই হাত ভেসে উঠলো পানির উপর। জুযার তাড়াতাড়ি তার জাল নিয়ে এসে মারলো পানিতে। জাল মেরে লোকটাকে বের করে আনলো। মজার ব্যাপার হলো লোকটার দুই হাতে দুটি লাল রঙের মাছ ছিল। সে জুযারকে বললো: ‘আমার খচ্চরের জিনে ছোট্ট দুটি বাটি আছে। সেগুলো নিয়ে আসো’! জুযার তাই করলো। লোকটা দুটি মাছই বাটিতে রাখলো এবং বাটির মুখ ভালো করে বন্ধ করে দিলো। এরপর জুযারের দিকে তাকিয়ে বললো: ‘তোমাকে ধন্যবাদ জুযার! তুমি আমাকে বাঁচিয়েছো। তুমি যদি আমাকে জাল মেরে উঠিয়ে না আনতে তাহলে আমি এই মাছ দুটিকে ছাড়তাম না এবং পানিতে ডুবে যেতাম’।
জুযার বললো: ‘খোদার কসম! তুমি আমাকে বলো-কে তুমি? ওই দুই লোকই বা কারা ছিল? কেন তারা পানিতে এভাবে ডুবতে গেলো? শামিয়া’ই বা কে? আর এই দুটি লাল মাছেরই বা রহস্য কী’?#
জুযারের ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প (৩)
(তৃতীয় পর্ব) সেলিম সালেম এবং জুযার-এই তিন ভাইয়ের গল্প শুনছিলাম আমরা। ব্যবসায়ী বাবা ছোটো ছেলে জুযারকে বেশি আদর করতো বলে বড় দু’ভাই তাকে হিংসার চোখে দেখে এবং বাবার মৃত্যুর পর তার বিরুদ্ধে মামলা করে সর্বস্ব হারায়। অবশেষে মায়ের সম্পদও জোর করে কেড়ে নেয়। তারপরও তারা নিঃস্ব হয়ে ভিক্ষা করতে করতে একদিন ছোটোভাই জুযারের বাসায় যায়। সেখানে মাকে দেখে। মা তাদেরকে বরণ করে খাবার দাবার দেয়। জুযারও কাজ থেকে এসে ভাইদের দেখে গ্রহণ করে নেয়। ভাইয়েরা বাসায় খায় দায় ঘুমায় আর জুযার বাইরে গিয়ে নদীতে মাছ ধরে। এক পর্যায়ে কারুন নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। খচ্চরের পিঠে আরাহী এক লোকের কথা অনুযায়ী কাজ করে এক শ’ স্বর্ণমুদ্রা পায়। সেগুলো এনে মায়ের হাতে দেয় জুযার।
তৃতীয় দিন মাছ ধরতে গেলে অন্যরকম ঘটনা ঘটে। পানিতে যাকে হাত পা বেঁধে ফেলা হয়েছে সে মরে নি। তাকে জাল মেরে উপরে তোলার পর দেখে তার হাতে দুটি লাল রঙের মাছ। পরপর তিন দিন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটায় জুযার মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হলো। সে ওই লোকটাকে বললো: এইসব কী হচ্ছে, আমাকে একটু খুলে বলো!
লোকটা বললো: ঘটনা হলো, গত দু’দিন যে দু’জন পানিতে ডুবে মারা গেল, তারা ছিল আমারই ভাই। তুমি শামিয়া নামে যাকে চেনো সেও আমার আরেক ভাই। সে আসলে ইহুদি নয়, মুসলমান। তার নাম হলো আব্দুর রহিম আর আমার নাম আব্দুস সামাদ। আমরা চার ভাই। আমাদের বাবা ছিলেন ভবিষ্যতজ্ঞানী এবং গোপন রহস্য ভেদকারী। বিশেষ করে গুপ্তধন কোথায় লুকিয়ে আছে সেটা জানতো। তিনি আমাদেরকেও সেই জ্ঞান শিখিয়েছেন। বাবা মারা যাবার পর আমরা তাঁর সম্পদ নিজেদের মাঝে ভাগ করে নিলাম।
অনেক বই ছিল তাঁর। বইগুলোও ভাগ করেছি। কিন্তু একটি বই নিয়ে আমাদের চার ভাইয়ের মাঝে মতপার্থক্য দেখা দিলো। বইটি ছিল খুবই মূল্যবান এবং একেবারেই বিরল। এর কারণটা হলো ওই বইতে গুপ্তধন কোথায় কোথায় আছে, কী কী আছে সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া ছিল। আমার বাবার একজন ওস্তাদ ছিল বৃদ্ধ। সেই ওস্তাদের কাছে গেলাম বিচার চাইতে-কে আমাদের চার জনের মাঝে ওই বইটা পাবার উপযুক্ত। ওস্তাদ একটা শর্ত দিয়ে দিলেন ওই বইটা পাবার ব্যাপারে। বললেন: যে এই বইটা পেতে চাও তাকে একটা কাজ করতে হবে। ‘শামারদাল গাঞ্জ’ নামক ধনভাণ্ডার খুলে তার ভেতর থেকে মূল্যবান চারটি জিনিস নিয়ে আসতে হবে’। ওস্তাদ শামারদাল গাঞ্জ খুলে মূল্যবান চারটি জিনিস নিয়ে আসতে বললেন। ভাইয়েরা তখন জানতে চাইলো: ওই মূল্যবান চারটি জিনিস কী?
ওস্তাদ বললেন: একটা মণিমুক্তার আংটি, একটা তরবারি, একটা গ্লোব এবং একটা সুরমাদানি। এগুলোর প্রত্যেকটারই বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আংটির একজন খাদেম আছে নাম হলো রাদ। রাদ হলো শক্তিশালী এক দানব। সে চাইলে সমগ্র পৃথিবী দখল করতে পারে। তলোয়ারের বৈশিষ্ট্য হলো খাপ থেকে যে তাকে বের করবে, তার শত্রুপক্ষে যত সৈন্যই থাকুক না কেন পরাজিত হবে। তলোয়ার যার হাতে থাকে সে যদি বলে: হে তলোয়ার! সকল শত্রুসেনাকে মেরে ফেল, তাহলে তলোয়ার থেকে আগুনের একটা গোলা বেরিয়ে শত্রুদের ওপর গিয়ে পড়বে এবং সবাই মারা যাবে।
গ্লোব দিয়ে সকল শহর এবং সেখানকার জনগণকে দেখা যাবে। গ্লোবটাকে কেউ যদি সূর্যের দিকে ধরে বলে অমুক শহর ধ্বংস হয়ে যাক, তাহলে ওই শহর আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সুরমাদানি থেকে যে-ই সুরমা চোখে দেবে তার চোখ এতো সূক্ষ্মদর্শী হবে যে মাটির নীচের গুপ্তধনও অনায়াসে দেখতে পাবে।
ওস্তাদতে জিজ্ঞেস করলাম: শামারদাল ভাণ্ডারে কীভাবে যাবো?
তিনি বললেন: শামারদাল ভাণ্ডারটি এখন মালেক আহমাদের সন্তানদের এখতিয়ারে আছে। কেবল জুযার নামের যুবকের মাধ্যমে ওই ভাণ্ডার খুলতে পারা যাবে। জুযার মাছ শিকার করতে কারুন নদীতে যাবে। সেখানে গিয়ে জুযারের সাথে দেখা করতে হবে এবং তাকে বলতে হবে দুই হাত বেঁধে যেন পানিতে ফেলে দেয়।
পানিতে ফেলে দেওয়ার পর আহমারের সন্তানদের সাথে যুদ্ধ হবে। যুদ্ধে যদি মারা যাও তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আর যদি আহমারের সন্তানদের পরাজিত করা যায় এবং তাদেরকে বন্দী করা যায় তাহলে নিজের বাঁধা হাতগুলো পানির উপরে তুলে ধরে জুযারের সাহায্য চাইতে হবে। আমি এবং আমার দুই ভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই কাজটা করবো। কিন্তু আব্দুর রহিম বললো: আমি বইও চাই না, নদীতেও যেতে চাই না। এরপর আমরা চলে এলাম এই শহরে এবং রহিম এই শহরে এসে নিজেকে একজন ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয়। বাকি ঘটনা তো তোমার জানাই আছে।
জুযার পুরো ঘটনা শোনার পর জিজ্ঞেস করলো: তো মালেক আহমারের ছেলেরা এখন কোথায় আছে?
আব্দুস সামাদ বললো: ওই যে দুটি লাল রঙের মাছ দেখেছো না, যাদেরকে আটক করে রাখলাম.. ওরাই হলো মালেক আহমারের ছেলে। তবে জুযার! জেনে রাখো! শামারদাল ভাণ্ডারটি কেবল তুমিই খুলতে পারবে। তুমি কি আমার সাথে ওই শহরে যাবে, যে শহরে ভাণ্ডারটি আছে?
জুযার চিন্তাভাবনা করে বললো: না, যেতে পারবো না। আমার মা এবং ভাইয়েরা আমার অপেক্ষায় আছেন। আমি যদি এখন তোমার সাথে চলে যাই তাহলে তাদের খরচপাতি কে দেবে?
আব্দুস সামাদ বললো: আমার এবং তোমার সফরে তো চার মাসের বেশি সময় লাগবে না। তোমাকে আমি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দেবো, তুমি সেগুলো তোমার পরিবারের খরচের জন্য দাও। যাতে এই চার মাসে তাদের কোনো অসুবিধা না হয়।
জুযার মেনে নিলো। আব্দুস সামাদের কাছ থেকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেল। ঘটনাটা মাকে খুলে বললো। স্বর্ণমুদ্রাগুলো মায়ের হাতে দিয়ে বললো: মাগো! এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো তোমার জন্য এবং আমার ভাইদের ভরণপোষনের জন্য। এগুলো রাখো! আর আমার জন্য দোয়া করো!
এরপর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আব্দুস সামাদের কাছে ফিরে গেল এবং শামারদাল ভাণ্ডার খুলতে ওই শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।#
জুযারের ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প (৪)
(চতুর্থ পর্ব) জুযারের হাতেই কেবল খুলবে শামারদাল ভাণ্ডারের মুখ। তাকে ছাড়া কারো পক্ষেই ওই ভাণ্ডার খোলা সম্ভব নয়। সে কারণেই আব্দুস সামাদ জুযারকে তার পরিবারের খরচ বাবদ এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তাকে নিয়ে রওনা হলো শামারদাল শহরের দিকে। যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো জুযার। আব্দুস সামাদকে বললো: কী ভুল করলাম! সাথে যদি কিছু খাবার নিয়ে আসতাম! আব্দুস সামাদ খচ্চরকে থামিয়ে বললো: কী খেতে চাও তুমি বলো! ঝলসানো মুরগি? খাসির কাবাব? মিষ্টি পোলাও? জুযার বললো: যে খাবারগুলোর কথা বললে সেগুলো যদি এখানে পাওয়া যেত! এখন যেহেতু কিছুই নাই অন্তত সামান্য রুটি পনির হলেও তো চলতো।
আব্দুস সামাদ হেঁসে বললো: ‘যেসব খাবারের কথা বলেছি সব খাবারই হাজির করবো’। এই বলে খচ্চরের পিঠের জিনের ভেতর হাত ঢুকালো এবং জুযারের চোখে এক পৃথিবী বিস্ময় ঢেলে দিয়ে জিনের ভেতর থেকে অনেক পাত্র ভর্তি খাবার বের করে আনলো। অনেক বলতে চব্বিশটি পাত্র ভর্তি খাবার। প্রত্যেক পাত্রেই আলাদা ধরনের খাবার। দস্তরখানে খাবার ভর্তি। জুযার তো হতবাক। তার মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর সে বললো: জিনের ভেতর কি কিচেন রুম কিংবা বাবুর্চি আছে যে এতো খাবার তুমি বের করে আনলে?
আব্দুস সামাদ বললো: এই জিনটা যাদুর জিন।
জুযার আর কিছু না বলে খেতে শুরু করলো। দু’জনই একেবারে পেট ভরে খাবার খেল। জিনের ভেতর থেকে পানির একটি পাত্র বের করে ওই পানি দিয়ে দু’জন ওজু করে নামায পড়ে আবার রওনা হলো।
আব্দুস সামাদ জুযারকে জিজ্ঞেস করলো: তুমি বলতে পারবে আমরা কতোটা পথ এসেছি।
জুযার বললো: দিনের অর্ধেক তো আমরা রাস্তায়…।
আব্দুস সামাদ হেঁসে বললো: আমরা প্রায় এক মাসের পরিমাণ রাস্তা পেরিয়ে এসেছি।
জুযার আশ্চর্য হয়ে আব্দুস সামাদের দিকে তাকালো।
আব্দুস সামাদ বললো: আশ্চর্যের কিছু নেই। আমার খচ্চর প্রতিদিন এক বছরের মতো পথ চলতে পারে। কিন্তু তোমার কারণে তাকে আমি আস্তে আস্তে চালাচ্ছি যেন তুমি ভয় না পাও।
তারা চারদিন পথ চললো। পঞ্চম দিনে গিয়ে পৌঁছলো তাদের গন্তব্যে। শহরের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। বিরাট একটা ঘরের সামনে গিয়ে খচ্চরকে থামালো।
আব্দুস সামাদ বাহনের পিঠ থেকে নেমে ওই ঘরের দরোজায় টোকা দিল। একটা ছোট্ট মেয়ে ঘরের দরোজা খুলে দিল। আব্দুস সামাদ খচ্চরের পিঠ থেকে যাদুময় জিনটা হাতে নিয়ে খচ্চরকে বললো: ‘চলে যাও’।
অমনি খচ্চরের পায়ের নীচের মাটিতে ফাটল সৃষ্টি হলো। খচ্চর ওই মাটির ফাটলে ঢুকে গেল এবং ফাটল বন্ধ হয়ে আগের মতোই সমান হয়ে গেল। আব্দুস সামাদ আর জুযার ঘরে ঢুকলো।
ঘরটা যেমন বড়োসড়ো তেমনি সুন্দর এবং পরিপাটি করে সাজানো। পুরো বাসাটাই খুব মূল্যবান কার্পেট দিয়ে ঢাকা। আব্দুস সামাদ ছোট্ট মেয়েটিকে ডেকে বললো: ব্যাগটা নিয়ে আসো তো!
মেয়েটি গিয়ে একটা ব্যাগ নিয়ে এলো। আব্দুস সামাদ ব্যাগ খুলে চমৎকার একটা পোশাক বের করে জুযারকে সেটা পরতে বললো। জুযার পোশাক পরার পর তাকে দেখতে একেবারে শাহজাদার মতো লাগলো। আব্দুস সামাদ যাদুময় জিনের ভেতর হাত ঢুকিয়ে নানারকম খাবার দাবার বের করে আনলো। ভালো করে খেয়ে দেয়ে দিলো ঘুম। টানা ঘুম দিয়ে উঠে পরদিনও আব্দুস সামাদ জুযারকে নতুন পোশাক দিলো। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই নতুন পোশাক আর নতুন নতুন খাবার দাবার খেতে লাগলো সে।
বিশ দিন কেটে গেল। একুশতম দিনের সকালে আব্দুস সামাদ জুযারকে বললো: আজই সেই প্রতীক্ষিত দিন। আজ আমরা বেরুবো এবং শামারদাল সিন্দুক খুলতে যাবো।
জুযার উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুস সামাদের সাথে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। বাইরে দুটি খচ্চর প্রস্তুত ছিল। সেগুলোর পিঠে সওয়ার হলো এবং রওনা হয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টা খচ্চরের পিঠে চড়ে চললো। দুপুরের কাছাকাছি সময় তারা গিয়ে পৌঁছলো বহমান পানিময় একটি নহরের কাছে। সেখানে তারা খচ্চরের পিঠ থেকে নামলো। আব্দুস সামাদ হাত নেড়ে কেমন যেন একটা ইঙ্গিত করলো। অমনি দুই গোলাম এসে হাজির হয়ে গেল।তারা এসেই খচ্চর দুটোকে দুদিকে নিয়ে গেল এবং বড়ো একটা তাঁবু খাটিয়ে ভেতরে কার্পেট দিয়ে সাজিয়ে দিলো। যাদুর জিন এবং মাছের দুটি পাত্র এনে ভেতরে রাখলো।
খাওয়া দাওয়া সেরে আব্দুস সামাদ মাছের দুটি পাত্র দুই হাতে নিয়ে কী যেন দোয়া পড়লো। হঠাৎ পাত্র দুটো ফেটে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল এবং ভাঙা টুকরোগুলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দুটি মানুষ। তাদের দু’জনেরই হাত বাঁধা। তারা কাকুতি মিনতি করে বললো: আব্দুস সামাদ আমাদেরকে ছেড়ে দাও!
আব্দুস সামাদ বললো: তোরা মুক্তি পাবি না, যদি না কথা দিস শামারদাল সিন্দুক খুলে দিবি।
ওই দুই লোক বললো: তুমি মাছ শিকারী জুযারকে নিয়ে আসো! সে-ই কেবল পারবে ওই সিন্দুক খুলতে।
আব্দুস সামাদ বললো: জুযার তো এখানেই আছে। সে তো তোদেরকে দেখছে, তোদের কথাও শুনতে পাচ্ছে।
ওই দুই লোক একথা শুনে কথা দিলো যে তারা সিন্দুক খুলে দেবে। আব্দুস সামাদ ওই লোক দুটিকে ছেড়ে দিলো।
এরপর বড়ো একটা লাঠি এবং লাল রঙের কিছু আকিক পাথর এনে জুযারকে বললো: আমি এখন এটা দোয়া পড়বো। দোয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কারো সাথে কথা বলবো না। তার আগে তোমাকে বলছি কী করতে হবে। ভালো করে শোনো এবং মনে রেখো যাতে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি। আমি দোয়া করতে করতে আগুনে ধূপ ঢালবো, তখন এই নহরের পানি শুকিয়ে যাবে এবং সোনার তৈরি বিরাট একটা দরোজা দেখতে পাবে। মণিমুক্তার দুটি কড়া হলো এই দরোজার নিশানা। তুমি দরোজায় গিয়ে ওই কড়া দুটোতে তিন বার নাড়া দিয়ে বলবে: আমি মাছ শিকারি জুযার! বলতেই দরোজা খুলে যাবে।
তখন দেখবে তলোয়ার হাতে একটা লোক দরোজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। সে তোমাকে বলবে: ‘তুমি যদি জুযার হয়ে থাকো, তাহলে মাথা নোয়াও! তোমার মাথা ঘাড় থেকে আলাদা করে ফলবো’! তুমি ওই লোকের হুমকিতে ভয় পাবে না। মাথা নোয়াবে! সে তলোয়ার উঠাবে কিন্তু তোমার ঘাড়ে আঘাত হানার আগেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিজেই মারা যাবে। মনে রাখতে হবে, যদি তুমি ঘাড় পেছনে তোলো তাহলে মারা পড়বে। এবার দরোজা দিয়ে ভেতরে ঢুকবে। একটু সামনে যাবে। আরেকটি দরোজা দেখতে পাবে। ওই দরোজাতেও টোকা দেবে। দরোজা খুলে যাবে। দেখবে বল্লম হাতে এক দারোয়ান তোমার দিকে এগিয়ে আসছে। সে তোমাকে লক্ষ্য করে বল্লম ছুঁড়ে মারবে। ভয় পেও না। বুক খুলে দেবে। তোমার বুকে ওই বল্লম আঘাত হানবে ঠিকই কিন্তু তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। উল্টো ওই দারোয়ান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা যাবে। তুমি এবার সহজেই সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।
এবার তৃতীয় দরোজা সামনে পড়বে। তাতেও টোকা দেবে। তখন তীর ধনুক হাতে এক লোক বেরিয়ে আসবে। তোমার দিকে একটা তীর ছুঁড়েও মারবে। তুমি কিন্তু পিছু হটবে না, পিছে এলেই মারা যাবে। এভাবে আব্দুস সামাদ সপ্তম দরোজা পর্যন্ত যা যা ঘটনা ঘটবে এবং সেসব থেকে কীভাবে বিপদমুক্ত থাকা যাবে সকল বর্ণনা দিলো জুযারকে। সপ্তম দরোজার বিপদ কেটে ওঠার পর সামনে পড়বে গুপ্ত ধন-ভাণ্ডারের দরোজা।#
জুযারের ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প (৫)
(পঞ্চম পর্ব) জুযারকে আব্দুস সামাদ সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে বললো: সপ্তম দরোজার বিপদ কেটে ওঠার পর সামনে পড়বে গুপ্ত ধন-ভাণ্ডারের দরোজা। ওই দরোজা তোমার সামনে খুলে যাবে। দেখবে একটা পর্দা একেবারে ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত ঝুলছে। পর্দাটা সরিয়ে ফেলবে। পর্দা গুটিয়ে নিলেই দেখতে পাবে গুপ্তধন-ভাণ্ডার শামারদাল সিন্দুক একটা চৌকির ওপর বসানো। শামারদালের ওপর গ্লোবের মতো জ্বলজ্বলে একটা বল দেখতে পাবে। গ্লোবের মাঝখানে একটা যাদুর তলোয়ার বাঁধা আছে। ঐ তলোয়ারের হাতলে মণিরত্নের একটা আংটি আছে। আছে একটা চেইন। চেইনে বাঁধা আছে সুরমাদানি। এই চারটি জিনিস নিয়ে তুমি বেরিয়ে আসবে। আমি বাইরে অপেক্ষায় থাকবো।
জুযার উঠে দাঁড়িয়ে বললো: আল্লাহ ভরসা। আমি চললাম’। আব্দুস সামাদ আগুনে ধূপ জ্বালিয়ে দোয়া করতে শুরু করলো। জুযারের চোখ পড়লো নহরের দিকে। দেখলো সেখানে পানির প্রবাহ নেই, শুকিয়ে গেছে। শুকনো সেই নালায় বিরাট একটা সোনালি দরোজা। জুযার দরোজার দিকে এগিয়ে গেল। দরোজার সোনালি কড়াগুলো তিনবার নাড়লো। দরোজার ওপাশ থেকে কেউ একজন চীৎকার করে উঠলো: কে কড়া নাড়ছে?
জুযার বললো: আমি মাছ শিকারি জুযার।
দরোজা খুলে গেল। তারপর আব্দুস সামাদ যেভাবে যা যা করতে বলেছিল জুযার ঠিক তাই করলো। তাই একের পর এক দরোজা খুলতে লাগলো। মোট ছয়টি দরোজার যাদু নষ্ট হয়ে গেল। এরপর গেল সপ্তম দরোজায়। যথারীতি সেই দরোজাতেও কড়া নাড়লো। তারপর ঘটলো মজার ঘটনা।
দরোজা খুলে গেল ঠিকই। কিন্তু জুযার দেখতে পেল তার মায়ের মায়াময় চেহারা। মা দুহাত মেলে জুযারকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো, চুমু খেতে চাইলো। ক্ষণিকের জন্য জুযারের মনটা নরম হয়ে গেল। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল আব্দুস সামাদের কথা। সে চীৎকার করে উঠলো: সরে যাও, তোমার মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসো।
মা বললো: এ কী বলছো বাবা! তুমি আমাকে ভুলে গেছো! আমি তোমার মা!
জুযার তাড়াতাড়ি করে দেয়ালে রাখা তলোয়ার হাতে নিলো। মায়ের দিকে তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললো: তুই আমার মা না! তুই তাড়াতাড়ি তোর মুখোশ খুলে ফেল। নৈলে আমি তোকে এই তলোয়ার দিয়ে আঘাত করবো।
মা কেঁদে ফেললো। বললো: আমি তোকে জন্ম দিয়েছি, দুধ খাইয়েছি, ছোটো থেকে লালন পালন করে বড়ো করেছি। কতো কষ্ট করেছি। আর তুই এখন আমার তার এই পুরস্কার দিতে চাচ্ছিস, মেরে ফেলতে চাস আমাকে? জুযার মায়ের কান্নাজড়িত কণ্ঠে কাকুতি মিনতি শুনে খানিকটা থমকে গেল। মনের ভেতরে তার মায়ের প্রতি দরদ তৈরি হলো। তলোয়ারটা মাটিতে ফেলে দিয়ে বললো: ‘মা! আমাকে মাফ করে দাও! আমার ওপর তোমার’…
জুযারের কথা শেষ না হতেই মায়ের চেহারা পাল্টে গেলো। এক মহিলা, দেখতে যেমন ভয়ংকর তেমনি জবুথবু এক বৃদ্ধা যাদুকর চীৎকার করে বলে উঠলো: জুযার ভুল করেছে। জুযার ভুল করেছে। ওকে মারো, আচ্ছা রকম মারো।
যাদুর বুড়ি একথা বলতে না বলতেই কুৎসিত চেহারার বহু পাহারাদার এসে জুযারকে মারতে শুরু করলো। মারতে মারতে গুপ্তধন ভাণ্ডারের বাইরে ফেলে দিলো। গুপ্তধন ভাণ্ডারের দুয়ার বন্ধ হয়ে গেল। ঝর্ণাধারার পানি আগের মতোই প্রবাহিত হতে লাগলো। জ্ঞান ফেরার পর জুযার তার মাথার কাছে আব্দুস সামাদকে দেখতে পেল। জুযার কাঁদতে কাঁদতে যা যা ঘটেছিল সব খুলে বললো। আব্দুস সামাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো: আমি তোমাকে কতোবার বলেছি ও তোমার মা নয়, তুমি তার প্রতারণার ফাঁদে পা দেবে না। তার যাদুটা যদি নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারতে তাহলে গুপ্তধনের কাছে পৌঁছে যেতে পারতে। এখন আর কিচ্ছু করার নেই। চলো ফিরে যাই। এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। পরের বছর ঠিক এই দিনটা আসুক, তারপর দেখা যাক কী করা যায়। সেদিন পর্যন্ত তুমি আমার সাথেই থাকো।
জুযার আর আব্দুস সামাদ ফিরে গেল শহরে। এরপর এক বছর পর্যন্ত জুযার আব্দুস সামাদের কাছেই থাকলো। এক বছর পর সেই দিনটি পুনরায় যখন এলো তারা তখন সেই ঝর্নাপ্রবাহের তীরে গেল। এবার জুযার বেশ সাহসিকতার সাথে ছয়টি দরোজাই খুলে ফেললো,কোনো যাদুতেই কাজ হয় নি। সব সে বাতিল করে দিয়েছে। সপ্তম দরোজায় আসার পর আগের মতোই তার মা এসে দরোজা খুলে দিল। জুযার এবার আর প্রতারিত হতে চায় না। দেয়াল থেকে তলোয়ার হাতে নিয়ে দৃঢ়তার সাথেই এগিয়ে গেল যাদুময়ী মায়ের দিকে। জুযারের মা আগের মতোই ব্যাপক কাকুতি মিনতি করল তাকে না মারার জন্য। কিন্তু সে এবার আর প্রতারিত হবে না বলেই দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল। অবশেষে যাদুকর মহিলা তার আসল চেহারায় রূপান্তরিত হল। তার বিশ্রী চেহারা বেরিয়ে এলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই তার যাদুর সকল শক্তি হারিয়ে গেল।
যাদুকর মহিলাকে পরাস্ত করে জুযার চলে গেল গুপ্তধন ভাণ্ডারের আসল দরোজায়। দরোজা সহজেই খুলে গেল এবং ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। তলোয়ার, আংটি, সুরমাদানি আর কথা বলতে জানা গ্লোবটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরুবার দরোজার দিকে গেল। হঠাৎ শুরু হয়ে গেল তবলার বাজনা। চারদিকেই বাজছে তবলা। সে কি সাংঘাতিক ব্যাপার। গুপ্তধন ভাণ্ডারের প্রহরীরা বাজাচ্ছিল ওই তবলা। তারা সবাই জুযারকে অভিনন্দন জানাচ্ছিল। সমস্বরে সবাই বললো: হে জুযার! তোমার জন্য এই গুপ্তধন মোবারকবাদ। জুযার বেরিয়ে এলো ওই দরোজা দিয়ে। আব্দুস সামাদ তার দিকে দৌড়ে গেল। জুযারকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল।
জুযার যে চারটি জিনিস গুপ্ত ধনভাণ্ডার থেকে এনেছিল আব্দুস সামাদের হাতে দিল, তারপর দুজনেই চলে গেল শহরে। বাড়িতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে পথের ক্লান্তি দূর করলো। আব্দুস সামাদ জুযারকে বললো: ‘তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছো! এখন বলো, তুমি আমার কাছে কী পুরস্কার চাও’!
জুযার বললো: আমি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে কিছু চাই না। তবে তুমি যদি দিতেই চাও, তাহলে তোমার ওই যাদুর জিনটা আমাকে দিতে পারো!
আব্দুস সামাদ বললো: আহ হা! তুমি যদি আরো মূল্যবান কিছু চাইতে আমার কাছে! এই জিন তো শুধু খাবারের জন্য। ঠিক আছে, আমি তোমাকে ওই জিনের সাথে আরেকটা স্বর্ণভর্তি জিন দিচ্ছি।
এই বলে সে একটা গোলামকে ডেকে বললো: স্বর্ণ রত্ন ভর্তি একটি জিন জুযারকে দাও! তাকে খচ্চরের পিঠে চড়িয়ে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়ে খচ্চর নিয়ে ফিরে আসবে। এরপর আব্দুস সামাদ জুযারকে জিনের ভেতর থেকে খাবার সংগ্রহের রহস্য শিখিয়ে দিলো। গোলাম জুযারকে নিয়ে পৌঁছিয়ে দিলো তার বাড়িতে। বাড়িতে যাবার পথে সে তার মাকে দেখলো ভিক্ষা করছে। চীৎকার করে উঠলো জুযার। দ্রুত মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করলো। মাকে খচ্চরের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে গেল বাড়িতে। যাবার পথে মা জুযারকে বললো: যে স্বর্ণমুদ্রাগুলো তুমি দিয়ে গেছো বাবা! তোমার ভাইয়েরা প্রতারণা করে সেগুলো আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে’।
জুযার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো: ভেবো না মা! আমি তো ফিরে এসেছি।
এই বলে রঙিন একটি দস্তরখান বিছালো জুযার।
জুযারের ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প (৬)
(ষষ্ঠ পর্ব) সপ্তম দরোজার বিপদ কেটে না ওঠার কারণে জুযার এক বছর আব্দুস সামাদের কাছে ছিল পরবর্তী বছরের ঐদিনটির জন্য। এক বছর পর সেই দিনটিতে আবারো একই নিয়মে জুযার ঢুকলো গুপ্তধন ভাণ্ডারের ভেতর। ছয়টি দরোজা ঠিকঠাক পেরিয়ে যাবার পর সপ্তম দরোজায় এবার আর যাদুকর মা তাকে প্রতারিত করতে পারলো না। এবার ঠিকই সফল হলো এবং প্রয়োজনীয় চারটি জিনিস নিয়ে ফিরে এলো। আব্দুস সামাদ তাকে পুরস্কৃত করলো। ওই পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে জুযার দেখলো তার মা পথে ভিক্ষা করছে। মা জানালো, ভাইয়েরা প্রতারণা করে মায়ের কাছ থেকে সবকটি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে গেছে। জুযার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলো: ভেবো না মা! আমি তো ফিরে এসেছি’। বাসায় ফিরে সে একটি দস্তরখান বিছালো, তাতে সাজালো বিচিত্র সব উন্নত খাবার।
জুযার যাদুময় জিনের রহস্যটা মাকে বলে দিয়ে বললো আর কাউকে যেন না বলে। এদিকে জুযারের ভাইয়েরা মায়ের কাছ থেকে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে স্বর্ণমুদ্রাগুলো জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে খরচ করে ফেলে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। কিন্তু যাবে কোথায়! আবার ফিরে এসেছে জুযারের ঘরে। জুযার তার স্বাভাবিক উদারতাবশত ভাইয়ের দোষত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে সাদরে গ্রহণ করে নিলো তাদেরকে। জুযার প্রতিদিন মজার মজার সব খাবার দাবারের আয়োজন করতো আর সবাই মিলে সেগুলো খেত, যেগুলো বাকি থাকতো সেগুলো বিলিয়ে দিতো গরিবদের মাঝে।
এক রাতে জুযার ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে তার ভাইয়েরা মায়ের কাছে ওই খাবারের রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলো। মা তো! কোনোভাবেই লুকিয়ে রাখতে পারলো না। ছেলেদেরকে বলে দিলো সব। তবে তারা যেন আর কাউকে এ ব্যাপারে না বলে সে বিষয়ে সতর্ক করে দিলো। কিন্তু সেলিম এবং সালেম আবারও দুর্বুদ্ধি আঁটলো। কী করে ওই যাদুর জিনটাকে হাত করা যায় তার পেছনে লাগলো তারা। একজন নাবিকের কাছে গিয়ে নৌকা কেরায়া করলো। উদ্দেশ্য হলো জুযারকে ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের সাথে নিয়ে যাওয়া।
মাঝরাতে জুযার যখন গভীর ঘুমে অচেতন সেলিম এবং সালেম তখন নাবিক এবং তার দুই বন্ধুসহ জুযারের ঘরে গিয়ে তার মুখ-হাত বেঁধে ফেললো। এরপর জুযারকে জোর করে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। নাবিক এবং তার সঙ্গীরা জুযারকে তুলে নিয়ে নৗকায় ওঠালো। নৌকা ছেড়ে দিলো। সমুদ্রের উদ্দেশ্যে নাবিক যাত্রা শুরু করলো।
সকালবেলা সেলিম আর সালেম এলো মায়ের কাছে। তারা মা’কে বললো: মা! জুযার তো তার অতিথি বন্ধুদের সাথে চলে গেছে।
মায়ের মন ভারি হয়ে গেল। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। জুযারের অনুপস্থিতির কারণে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। সেলিম ও সালেম বললো: তুমি তো আমাদের চেয়ে জুযারকে বেশি ভালোবাসো!
মা বললেন: তোমরাও আমারই সন্তান। তোমাদেরকেও আমি ভালোবাসি। কিন্তু তোমাদের বাবা মারা যাবার পর তোমাদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই পাই নি।অথচ আমার প্রতি জুযারের মেহেরবানি ছিল সবসময়। কখনোই সে আমার সাথে খারাপ আচরণ করে নি, সদয় ছিল সে।
সেলিম আর সালেম এসব কথা শুনে রেগে গেল। মায়ের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দিল তারা। ঝগড়া করতে করতে মায়ের গায়ে আঘাত করলো। এরপর জুযারের জিন দুটো কেড়ে নিয়ে গেল। একটা জিনে স্বর্ণরত্ন ভর্তি করা ছিল। সেগুলো তারা ভাগ করে নিলো। কিন্তু যাদুকরী জিনটা নিয়ে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। ঝগড়ার মাঝে তারা সিদ্ধান্ত নিলো জিনটাকে কেটে দু’ভাগ করে দু’জনে ভাগ করে নেবে। কিন্তু মা চীৎকার করে উঠলেন। বললেন: ওই গাধারা! এই জিন ভাগ করা যাবে না, ভাগ করলে ওই জিন আর কাজ করবে না, বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাবে। জিনটাকে আমার কাছে রেখে দে! যখন তোদের খাবারের দরকার হবে আমার কাছে এসে নিয়ে যাবি।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! মায়ের কথা কেউই কানে তুললো না। সকাল পর্যন্ত ওই যাদুকরী জিন নিয়ে সেলিম সালেম ঝগড়া করলো। ঘটনাক্রমে তাদের এক প্রতিবেশীর বাসায় বাদশার একজন সৈনিক আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। সে সেলিম সালেমের ঝগড়াঝাঁটি এবং যাদুকরী জিনের বিষয়টি শুনে ফেলে। সকালবেলা ওই সৈনিক বাদশার দরবারে ফিরে গিয়ে ঘটনাটা বলে দিলো। শাহ তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সেলিম সালেমকে ধরিয়ে নিয়ে গেল। তাদের আচ্ছামতো পিটিয়ে যাদুকরী জিনের কথা স্বীকার করতে বাধ্য করলো। বাদশাহ শেষ পর্যন্ত যাদুকরী জিনটা তাদের কাছ থেকে নিয়ে গেল এবং তাদের দু’জনকেই পাঠিয়ে দিলো কারাগারে।
এরপর এক বছর কেটে গেল। সেলিম ও সালেম কারাগারে আর জুযার নৌকায় কাজ করছে। একদিন সমুদ্রে ভীষণ ঝড় উঠলো। তুফানে নৌকা ডুবে গেল সমুদ্রে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো নৌকার সকল যাত্রীই ডুবে গিয়ে মারা গেল কেবল জুযার ছাড়া। জুযার সাঁতরে তীরে উঠে গেল। এরপর ধীরে ধীরে উঠে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে এক কাফেলার সাথে ভীড়ে গেল। ওই কাফেলা সৌদিআরবের দিকে যাচ্ছিলো। কাফেলার নেতা ছিলেন ব্যবসায়ী তবে তার মনটা ছিল বেশ উদার। সে জুযারকে দেখে তার সব ঘটনা শুনলো। ব্যবসায়ী জুযারকে বললো: তুমি আমার সাথে চলো, আমার সাথে কাজ করো! জুযার ব্যবসায়ীর প্রস্তাব মেনে নিলো এবং কাফেলার সাথে রওনা হলো।
তারা একসময় জেদ্দায় গিয়ে পৌঁছলো। ঘটনাক্রমে সেই সময়টা ছিল হজ্বের মৌসুম। ব্যবসায়ী আল্লাহর ঘর কাবা যিয়ারত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি জুযারকেও তাঁর সাথে মক্কায় নিয়ে গেলেন। কাবা শরিফ তওয়াফ করছিল জুযার। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ে গেল একজন চেনা চেনা লোকের ওপর। সে আর কেউ নয় স্বয়ং আব্দুস সামাদ। জুযার দৌড়ে গিয়ে তাকে সালাম করলো। আব্দুস সামাদ জুযারকে দেখে খুশি হলো। একেবারে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। তারপর জানতে চাইলো: কী করছো এখানে?
জুযার সব ঘটনা তাকে খুলে বললো। আব্দুস সামাদ সব শুনে তাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। তাকে খুব আদর যত্ন করে বললো: ‘জুযার! আমার মনে হচ্ছে তোমার কষ্টের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তুমি হজ্বের কাজ শেষ করে আমার সাথে চলো’।
জুযার ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আব্দুস সামাদের সাথে চলে গেল।
আব্দুস সামাদ যে মণিরত্নের আংটিটা গুপ্তধন ভাণ্ডার থেকে জুযারকে দিয়ে এনেছিল ওই আংটিটা তাকে দান করে দিয়ে বললো: ‘যখনই তোমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হবে এই আংটির পাথরের ওপর হাত রাখবে। রা’দ বা বজ্রপাত নামের এক খাদেম তখনই তোমার সবাই হাজির হয়ে যাবে। তাকে তুমি তোমার চাহিদাটা জানাবে। ব্যস’। কথা বলতে বলতে আব্দুস সামাদ নিজেই পাথরের ওপর হাত রাখলো। রাদ এসে হাজির হলো। জুযারকে দেখিয়ে বললো: হে রাদ! আজ থেকে এ হলো তোমার মালিক। রাদ জুযারের দিকে তাকিয়ে বললো: ‘আমি আপনার সেবায় হাজির’।
জুযার খানিক ভেবে বললো: ‘রাদ! আমি চাচ্ছি আমার নিজের শহরে নিজের ঘরে যেতে’।
তারপর আব্দুস সামাদের কাছ থেকে বিদায় নিলো। আংটিটা আঙুলে পরে রাদের ঘাড়ে চড়লো। রাদ তর্জন গর্জন করে শূন্যে উড়াল দিলো। ঘণ্টাখানেক শূন্যে উড়ে জুযারের বাড়ির আঙিনায় তাকে নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।#
জুযারের ভাইয়েরা তাকে নৌকায় ভাসিয়ে দিয়ে মাকে পিটিয়ে যাদুর জিন এবং স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিয়ে নেয়। কিন্তু ওই জিন কাজে লাগাতে পারে না তারা বরং বাদশাইর কারাগারে বন্দী হয়ে যায়। এদিকে ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে হজ্বে গিয়ে আব্দুস সামাদের সাথে দেখা হয় জুযারের। জুযার তাকে সব খুলে বলে এবং আব্দুস সামাদ আবারো তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। তাকে একটা যাদুর আংটি দেয়। আংটিটা আঙুলে পরে রাদের ঘাড়ে চড়ে সে। রাদ তর্জন গর্জন করে উড়াল দিয়ে ঘণ্টাখানেক শূন্যে উড়ে জুযারের বাড়ির আঙিনায় তাকে নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
জুযার বাসায় পৌঁছেই সব ঘটনা শুনে যাদুর আংটির পাথরে হাত রাখলো। রাদ এসে হাজির হয়ে গেল। রাদকে বললো তার দু ভাই সেলিম সালেমকে হাজির করতে। মায়ের সামনেই মাটিতে ফাটল সৃষ্টি হলো। ঐ ফাটলে ঢুকে গেল রাদ। মুহূর্তের মধ্যে তাদের নিয়ে হাজির হয়ে গেল। মায়ের চোখে তো অবাক বিস্ময়। জুযারকে দেখেই ভাইয়েরা কান্নাকাটি করে তাদের অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলো। জুযার আবারো সেলিম সালেমকে ক্ষমা করে দিলো। জুযার বুঝতে পেরেছিলো তার যাদুর জিন এখন বাদশাইর কোষাগারে। সে রাদকে ডেকে বললো শাহের কোষাগারটি যেন নিয়ে আসে। রাদ তাই করলো। কোষাগার থেকে জিনটা নিয়ে নিলো জুযার। তারপর রাদকে বললো এমন একটা জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ বানাতে যেখান বহু খাদেম, পরিচারক, লস্কর থাকবে। রাদ নিমেষেই তা করে ফেললো। ওই প্রাসাদটি জুযারর তার মাকে উপহার দিলো।
এদিকে শাহের প্রাসাদের কোষাগারের দায়িত্বে যে ছিল সে পড়েছে বিপদে। কোষাগারে যখন দেখলো যাদুর জিন নেই সে চীৎকার করতে করতে শাহের কাছে গিয়ে কোষাগার যে শূন্য সে খবর জানালো। শাহ আদেশ দিলো সিপাহিদের হাজির করতে। হাজির করা হলো। কিন্তু কেউই এ ঘটনার কিছুই জানতো না, কেবল যে যাদুর জিনের ব্যাপারে আগে খবর দিয়েছিল সে ছাড়া। সে বললো: হে বাদশাহ! গতরাতে আমি একটা এলাকা পার হচ্ছিলাম। দেখলাম অনেক লোক একটা প্রাসাদ বানাচ্ছে। আজ দেখলাম প্রাসাদ তৈরি হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওই প্রাসাদের মালিক হলো জুযার নামের এক লোক। লোকটা নাকি বহুদিন ভ্রমণ করার পর বহু অর্থসম্পদ নিয়ে এসেছে। নিজের দুই ভাইকেও নাকি কারাগার থেকে মুক্ত করেছে।
বাদশাহ এই কথা শুনে চীৎকার করে বললো: আমার শত্রুকে আমি চিনতে পেরেছি। যে সেলিম এবং সালেমকে কারাগার থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে, আমার কোষাগারও খালি করেছে, সে জুযার ছাড়া আর কেউ নয়। এরপর বাদশাহ জুযারকে ধরে আনার আদেশ দিলো।
বাদশার এক মন্ত্রী ছিল বেশ সচেতন এবং চালাক চতুর। সে বললো: যে এক রাতে প্রাসাদ বানাতে পারে অবশ্যই সে ভীষণ শক্তিশালী লোক। তাকে না ক্ষেপিয়ে বরং প্রাসাদে দাওয়াত করা উচিত। প্রাসাদে এলেই বোঝা যাবে সে দুর্বল নাকি শক্তিশালী। তার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া ভালো।
এই বলে সাদা পোশাকধারী মন্ত্রী একাই জুযারের প্রাসাদে গেল।
জুযারের প্রাসাদে গিয়ে মন্ত্রী সালাম করলো। তার সালামের জবাব দিলো এক দারোয়ান। বললো: হে মানব সন্তান! তুমি কে, কী চাও?
মন্ত্রী দারোয়ানের মুখে ‘মানব সন্তান’ সম্বোধন শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলো। বুঝতে পেরেছে যে দারোয়ানরা জিন। তাই শান্তভাবে বললো: আমি বাদশার মন্ত্রী। এসেছি তোমার মালিককে বাদশার দরবারে আমন্ত্রণ জানাতে।
দারোয়ান জুযারের অনুমতি নিয়ে মন্ত্রীকে নিয়ে গেল প্রাসাদের ভেতর। মন্ত্রী যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে জুযারকে বাদশার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু জুযার বললো: আমি বাদশার দরবারে যাবো না। আমার সাথে বাদশার কোনো কাজ থাকলে এখানে আসতে বোলো!
এরপর রাদ’কে হাজির করে বললো পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট জামাটি মন্ত্রীর জন্য আনতে। রাদ মুহূর্তের মধ্যেই নিয়ে এলো। মন্ত্রী ওই পোশাক পরে বাদশার কাছে গেল।
বাদশা মন্ত্রীর পোশাক দেখে আর জুযারের প্রাসাদের গল্প শুনে সিদ্ধান্ত নিলো নিজেই জুযারের সাথে দেখা করবে। সৈন্য সামন্ত নিয়ে বাদশা রওনা হলো। জুযার এই খবর শুনে রাদ’কে বললো প্রাসাদে জিন এনে ভর্তি করে ফেলতে। জিনদেরকে যুদ্ধের পোশাক পরাতে এবং সারিবদ্ধভাবে প্রস্তুত থাকতে।
বাদশা জুযারের প্রাসাদে এলো। জিন সেনাদের দেখে বাদশা বুঝতে পারলো জুযারের শক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি।
জুযার তার প্রাসাদের ভেতর জাঁকজমকপূর্ণ আসনে বসে ছিল। সেলিম এবং সালেম তার দুই পাশে দুই মন্ত্রীর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। বাদশা সামনে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো। জুযার উঠে দাঁড়িয়ে বাদশার সালামের জবাব দিলো।
একেবারে বাদশাহী খাবারের আয়োজন করলো। মধ্যরাত পর্যন্ত তারা খেলো আর গল্প গুজব করলো। বাদশা যখন উঠতে চাইলো জুযার তখন বাদশার সেনাদেরকে দামি উপহার দিতে আদেশ দিলো। বাদশার সাথে খোদাহাফেজি করলো এবং আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বাদশাকে বিদায় দিলো। বাদশা আবার আসবে বলে কথা দিলো এবং সত্যিসত্যিই এরপর বহুবার বাদশা জুযারের প্রাসাদে গিয়েছিল।
কিছুদিনের মধ্যেই বাদশার সাথে জুযারের বন্ধুত্ব বেশ গভীর হলো। কিন্তু বাদশা তখনো জুযারের শক্তিকে ভয় করতো। একদিন তার মন্ত্রীকে ডেকে বললো: হে মন্ত্রী! আমি ভয় পাচ্ছি জুযারের মনে আমার প্রতি কোনো ক্ষোভ দ্বেষ আছে কিনা; আমাকে মেরে সে নিজে আমার আসন দখল করে কিনা।
মন্ত্রী বললো: আপনি যদি এই আশঙ্কাই করেন তাহলে আপনার মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দিয়ে দিন, ঝামেলা চুকে যাবে। আপনার জামাই হবে জুযার। আর কোনোদিন যদি সে মারা যায় আপনি হবেন তার সকল ধন সম্পদের মালিক।
কথাটা বাদশার মনোপুত হলো। রাজপ্রাসাদে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করে জুযারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কৌশলে বিয়ের ব্যবস্থা করলো। কিন্তু মন্ত্রী বাদশাকে বললো: মেয়ের জন্য প্রচুর পরিমাণ মোহরানা ধার্য করতে। শাহ তখন মেয়ের মোহরানা হিসেবে যাদুর জিনটা দাবি করলো। জুযার মেনে নিলো। এভাবে রাজকন্যাকে বিয়ে করে জুযার রাজার জামাই হয়ে গেল।
বেশ কিছুদিন পর বাদশাহ মারা গেল। জুযার তখন বাদশার আসনে আসীন হলো। সেলিম আর সালেমকে তার মন্ত্রী বানালো। জুযার ছিল ন্যায় পরায়ণ বাদশা। মানুষের কল্যাণ ছাড়া ক্ষতি করতো না। জনগণ ভীষণ খুশি ছিল তার রাজত্বে। তার জন্য সবাই দোয়া করতো। বছর খানেক এভাবে কাটার পর সেলিম ও সালেম জুযারকে মেরে যাদুর জিন, আংটি আর বাদশাহীর মালিক হতে ষড়যন্ত্র করলো। সালেম তার বাসায় জুযারকে দাওয়াত করে নিয়ে বিষাক্ত খাবার খাইয়ে জুযারেক মেরে ফেলে আংটিটা দখল করলো। সে রাদ’কে আদেশ দিলো সেলিমকে মেরে ফেলতে এবং দুই ভাইয়ের লাশ সেনা কমান্ডারের সামনে জাতীয় মর্যাদায় দাফন করতে। রাদ তা-ই করলো। সৈন্যরা এই ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে গেল। সালেম নিজেকে বাদশা বলে ঘোষণা করলো এবং জুযারের স্ত্রীকে বিয়ে করতে চাইলো। কেউ তার বিরোধিতা করার সাহস করলো না।
এই ঘটনা জুযারের স্ত্রীর কানে পৌঁছার পর কিছুই বললো না সে। সালেম যখন স্ত্রীর প্রাসাদে গেল জুযারের স্ত্রী এক গ্লাস শরবত দিয়ে তাকে স্বাগত জানায়। সালেম ওই শরবৎ মজা করে খেয়ে দ্রুত মারা যায়। কারণ ওই শরবতেও বিষ মাখানো ছিল। সালেমের হাত থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়। যাদুর জিনটাও দুই টুকরো করে ফেলে। তারপর দরবারের মুরব্বিদের ডেকে বলে: নতুন বাদশা মারা গেছে। আপনারা নতুন বাদশা নির্বাচন করুন।
এরপর জুযারের স্ত্রী কালো পোশাক পরে স্বামীর জন্য আজাদারিতে বসে পড়ে।