এক ব্যবসায়ী দুটি গরু নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পথিমধ্যে গরু দুটি একটা কাদার গর্তে পড়ে গেল এবং দুটি গরুর একটি মরে গেল আর বাকি গরুটা ভীষণভাবে আহত হলো। ব্যবসায়ীও তাকে ফেলে রেখে চলে গেল। আহত গরুটা অনেক চেষ্টা করে ওই কাদার গর্ত থেকে উঠে এলো। কাছেই ছিল তৃণবহুল চমৎকার একটা লন। গরুটা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিলো। কয়েকদিনের মধ্যে সে সুস্থ হয়ে গেল। সবুজ এবং তরতাজা ঘাস লতাপাতা খেয়ে বেশ নাদুসনুদুস হয়ে উঠলো এবং উচ্চস্বরে ‘হাম্বা’ ডাকতে শুরু করলো। এই হাম্বা ছিলো তার জীবন ফিরে পাবার আনন্দ সংগীত।
সবুজ তৃণবহুল লনটি ছিল একটা সিংহের বিচরণ ক্ষেত্র। সিংহ মানে ওই অঞ্চলের সকল প্রাণীর নেতা। পশু সিংহ এর আগে কখনোই তার বিচরণ ভূমিতে ‘হাম্বা’ ডাক শোনে নি। সে জন্য এই শব্দ শুনে সিংহের মনে ভয় ঢুকে গেল। কিন্তু কিছুই সে প্রকাশ করল না। সিংহের দরবারে দুটি শেয়াল বাস করত। একটির নাম কালিলা অপরটির নাম ছিল দিমনা। দিমনা ছিল বেশ লোভী এবং সুযোগ সন্ধানী। সে সারাক্ষণ সিংহের পাশে থাকতে চাইতো এবং চাইতো সিংহের উপদেষ্টার পদটি পেতে। সিংহ যে গরুর হাম্বা রব শুনে ভয় পেয়েছে এই শেয়ালটি মানে দিমনা তা টের পেয়ে গেল। দিমনা গরুর শব্দ শুনে বেরিয়ে গিয়ে গরুকেও দেখতে পেল।
সে গরুর সাথে আলাপ আলোচনা জমিয়ে তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার চিন্তা করলো এবং তাই করলো। বন্ধু বানানোর পর দিমনা গরুকে নিয়ে সিংহের দরবারে হাজির হল। সিংহের ভয় এবং আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে শেয়াল সিংহের কাছে যাবার সুযোগ পেয়ে গেল। দিমনা সিংহের ভয়ের কারণ জানতে চাইলো। তারপর বললো এই সেই গরু যে নতুন এসেছে এই তৃণভূমিতে। ওর হাম্বা ডাক শুনেই তুমি ভয় পেয়েছিলে। তাই ওকে তোমার কাছে নিয়ে এলাম।
গরুকে সিংহের ভালোই লাগলো। সিংহ তাকে কাছে টেনে নিল এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করে কাজ করতে লাগলো। কিন্তু এ বিষয়টা দিমনার মোটেই ভালো লাগলো না। সহ্য হচ্ছিল না তার। হিংসা জেগে উঠল তার মনের গহীনে। কারণটা হলো সে ভাবতো গরু বুঝি তার স্থানটা দখল করে নিলো। তাই সে ভেতরে ভেতরে গরুকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো। কিন্তু কী করে তা সম্ভব! শেয়াল অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো কথায় বার্তায় সিংহের কাজে গরুকে অসহ্য করে তুলবে। গরুর বিরুদ্ধে এভাবে মারাত্মক ষড়যন্ত্র শুরু করে দিলো শেয়াল দিমনা। কিন্তু শেয়াল দিমনা কী বলবে তার বিরুদ্ধে। কিছুই তো বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না।
অবশেষে শেয়াল মিথ্যা অপবাদ দিতে শুরু করলো গরুর বিরুদ্ধে। প্রায়ই সিংহের কাছে বানিয়ে বানিয়ে গরুর বিরুদ্ধে নালিশ করতে লাগলো, অভিযোগ করতে লাগলো। মিথ্যা অভিযোগ করতে করতে এক সময় শেয়াল একেবারে প্রকাশ্যে এমনকি অনেক সময় গরুর সামনেই সিংহের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে শুরু করে দিলো। সিংহের কান ভারি হতে হতে একেবারে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। সিংহের মনের ভেতর গরুর ব্যাপারে এক ধরনের নেতিবাচক চিন্তা জন্ম নিল। এতোই অসহ্য হয়ে পড়লো সিংহ যে একদিন সত্যি সত্যিই গরুকে মেরে ফেললো সে।
দিমনা তো ষড়যন্ত্র করে গরুটাকে মেরে ফেললো। কিন্তু দিমনার বন্ধু কালিলা শুরু থেকেই দিমনার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জানতো। সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। দিমনার এ রকম হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করছিল সে কিন্তু দিমনা সেসব কানেই তুলতো না।
এদিকে নিরীহ গরুটাকে মেরে সিংহ খুব অনুতাপ বোধ করলো। খুবই খারাপ লাগছিলো তার। কিন্তু দিমনা চেষ্টা করছিলো সিংহকে বোঝাতে যে সে যা করেছে ভুল করে নি ঠিকই করেছে। সিংহকে তার অনুতপ্ত অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করলো দিমনা।
ইতোমধ্যে দিমনার বন্ধু কালিলা সে তো এমনিতেই দিমনার শত্রুতামূলক কাজকর্মের জন্যে ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলো এবং দিমনাকে প্রায়ই তিরস্কার করতো এমনকি এইসব মন্দ কাজের পরিণতি যে মারাত্মক বিশেষ করে মিথ্যে কথা চালাচালি করে সিংহকে গরুর বিরুদ্ধে ক্ষেপীয়ে তোলা এবং গরুর বিরুদ্ধে ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী উল্টাপাল্টা কথা লাগানোর কারণে একদিন যে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে সে ব্যাপারেও দিমনাকে সবসময় বলতো। এক রাতে এইসব কথা বলাবলি করছিল কালিলা আর দিমনা।
ঘটনাক্রমে ওইরাতে একটা চিতাবাঘ কালিলা আর দিমনার কথাবার্তা ভালো করে শুনে ফেললো। তাড়াতাড়ি করে চিতাবাঘ সেইসব কথা সিংহের মায়ের কাছে গিয়ে বলে দিলো। সিংহের মা তো চিতাবাঘের কথা শুনে একেবারে তেলেবেগুনে ক্ষেপে গেল। সে অন্যায় একদম সহ্য করতে পারত না। গরুর ওপর যে অন্যায় করা হয়েছে সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না সিংহের মা। দেরি না করে সে তাই তার ছেলে সিংহের কাছে গেল। সিংহ তার মাকে দেখে খুশি হলো কিন্তু মায়ের চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ দেখে জানতে চাইলো ‘কী হয়েছে’। সিংহের মা তখন সমস্ত ঘটনা ছেলের কাছে খুলে বললো।
সিংহ প্রকৃত ঘটনা শুনে যার পর নাই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। উপরন্তু মাও তাকে বললো এই ষড়যন্ত্রের প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে, শেয়াল দিমনাকে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে। এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে আর কেউ কখনো এ রকম ষড়যন্ত্র করার সাহস না পায়। গরুর রক্তমূল্য নিতেই হবে-এরকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে মা সিংহকে উদ্বুদ্ধ করলো। সিংহ উপায়ন্তর না দেখে একটা পরামর্শ বৈঠকের আয়োজন করলো। তার পরামর্শরা, দরবারের সভাসদরা, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা- সকলেই ওই বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত হলো। দিমনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হলো সেইসব অভিযোগের পক্ষে যথাযথ দলিল প্রমাণও হাজির করা হল।
চারদিক থেকে যখন দিমনার বিরুদ্ধে একের পর এক তার অন্যায়ের প্রমাণপঞ্জি পেশ করা হল, পশুরাজ সিংহ তখন বাধ্য হলো দিমনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিতে। দিমনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর কালিলা একবার দিমনার দিকে তাকালো। মনে মনে বললো আগেই বলেছিলাম.. এসব করো না। পাপের শাস্তি একদিন না একদিন ভোগ করতেই হবে, শুনলে না। দিমনাও কালিলার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে মনে মনে কালিলার কথায় সায় দিলো।
অবশেষে দিমনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। কিন্তু গরু তো আর ফিরে পেল না তার প্রাণ।