প্রাচীন লোকগল্পগুলোর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন যাদুর ব্যবহার, চরিত্রভেদে ভাষাভঙ্গির তারতম্যহীনতা। সাধারণত রাজার ছেলে শাহজাদা যে কিনা অভিজাত পরিবেশে বেড়ে উঠেছে তার মাঝে স্বাভাবিকভাবেই যে শিষ্টাচার বোধ গড়ে উঠেছে তার ফলে একজন সাধারণ মানুষের কথাবার্তার সাথে তার কথাবার্তার একটা পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু প্রাচীন রূপকথার গল্পগুলোতে এ ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। প্রাচীন লোকগল্পগুলোর চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ভাগ্য। এই ভাগ্য বা যাকে সহজভাবে বলা হয় ‘কপালের ফের’ তাকে কোনোভাবেই প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়। কোনো না কোনোভাবে ভাগ্য চরিত্রকে তাড়া করে ফিরবেই। প্রাচীন লোকগল্প বিশারদগণ সেজন্যে বলেছেন এইসব গল্পের প্রকৃত বীরত্বপূর্ণ চরিত্র হলো তাদের ‘ভাগ্য’। ভাগ্য বা গোপন শক্তির হাতের ক্রীড়নক হচ্ছে গল্পের চরিত্রগুলো। যাই হোক আমরা বরং জটিল আলোচনায় না গিয়ে আজকের গল্পের দিকে নজর দেই। এক রাজার এক কন্যা ছিল খুবই সুন্দরী। এই সুন্দরী রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যে-ই আসতো তাকেই মহাবিপদে পড়তে হতো। একদিন এক ন্যাড়া-মানে মাথায় চুলবিহীন লোক-ভাবলো রাজকন্যাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ন্যাড়া তার পুটলিতে পাঁচটি রুটি পুরে রওনা দিলো রাজকন্যাকে বিয়ে করতে। পথে পড়লো একটা বন। বনের ভেতর বসে ছিল একটা দৈত্য। দৈত্য এমনভাবে দাঁতে দাঁত পিষাচ্ছিল যে মনে হলো অনেক দিনের ক্ষুধার্ত সে। ন্যাড়া তার পুটলি থেকে রুটিগুলো বের করে দিয়ে দিলো দৈত্যকে। তারপর যখন রওনা দিলো, তখন দৈত্য বললোঃ এই ন্যাড়া! আমার একটা চুল নিয়ে যা, কাজে লাগবে। ন্যাড়া একটা চুল নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। যেতে যেতে গিয়ে দেখলো আরেকটি দৈত্য ঝর্ণার উৎসের পাশে বসে শীতে কাঁপছে। ন্যাড়া তার কোর্টটা খুলে দৈত্যের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আবার রওনা দিলো। এমন সময় দৈত্য বললো আমার একটা চুল নিয়ে যা কাজে আসবে। ন্যাড়া একটা চুল নিয়ে রওনা হলো। যেতে যেতে পৌঁছলো এক নদীর তীরে। সেখানে গিয়ে দেখলো একদল পিঁপড়া চাচ্ছে পানি পার হতে কিন্তু পারছে না। ন্যাড়া একটা কাঠের টুকরো পানিতে ফেলে সেতু নির্মাণ করে দিলো আর পিঁপড়ারা নিশ্চিন্তে পার হয়ে গেলো। যাবার সময় পিঁপড়ার রাজা ন্যাড়াকে তার একটা চুল দিল। ন্যাড়া এই চুলটিও রুমালে যত্ন করে রেখে তার পথে পা বাড়ালো। যেতে যেতে গিয়ে পৌঁছলো রাজপ্রাসাদে। ন্যাড়া শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেল প্রাসাদে। দরোজায় নক করতেই একজন এসে জিজ্ঞেস করলো: কী চাও? ন্যাড়া বললো: এসেছি রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। দারোয়ান: কার জন্যে? ন্যাড়া: কেন আমার জন্যে! লোকটা ভেতরে গিয়ে বাদশাকে ঘটনাটা জানালো। বাদশা বললো হাম্মাম রেডি করো। ন্যাড়াকে ঐ হাম্মামে ফেলে দাও। শ্রোতাবন্ধুরা! এই হাম্মামটিকে সাত দিন সাত রাত ধরে গরম করা হয়। যারা রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে তাদেরকে এখানে ফেলা হয়। আর এখানে ফেলা মানেই হলো নিশ্চিত মৃত্যু। বাদশার লোকটা ন্যাড়াকে হাম্মামটা দেখিয়ে বললো যারা রাজকন্যার প্রার্থী হয় তাদেরকে এই হাম্মামে গোসল করে আসতে হয়। ন্যাড়া হাম্মামের কাছে যেতেই বুঝতে পারলো এটা মরণফাঁদ। হাম্মামের দেয়ালগুলো তাপে লাল হয়ে গেছে। ফুটন্ত পানির কলধ্বনিও তার কানে এলো। ন্যাড়ার মনে পড়লো দ্বিতীয় দৈত্যের কথা। তার দেওয়া চুলটাতে আগুন লাগাতেই সে এসে হাজির। ন্যাড়া তাকে বিপদের কথা বলতেই দৈত্য বললো: চিন্তা করো না। এই বলে দীর্ঘ এক শ্বাস নিলো আর হাম্মামের সকল তাপ তার বুকে গিয়ে জমা হলো। হাম্মাম ঠাণ্ডা হয়ে গেল। পরদিন সকালে বাদশার লোক এসে দেখলো ন্যাড়া সুন্দরমতো গোসল করে বসে আছে। হাম্মামও ঠাণ্ডা। বাদশাকে গিয়ে বলতেই বাদশা দ্বিতীয় ফাঁদ পাতলো। বললো ওকে তিন শ কিলো চালের ভাত আর তিন শ কিলো মাংসের খাবার দিয়ে বলো: পুরোটা না খেতে পারলে গর্দান যাবে। ন্যাড়া এবার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রথম দৈত্যের চুলটি পুড়লো। দৈত্য তো এসে হাজির হয়ে গেল। ঘটনাটা দৈত্যকে বলতেই দৈত্য সব খাবার ঠিকঠাকমতো খেয়ে নিলো। এবারো ন্যাড়াকে আটকানো গেল না। বাদশা এবার ন্যাড়াকে মারার নতুন ফন্দি আঁটলো। একটি গাধা টানতে পারে সেই পরিমাণের তিনগুণ গম, যব আর ডাল একসাথে মিশ্রিত করে দিয়ে বললো এগুলোকে আলাদা করতে হবে সকাল হবার আগে। সকাল পর্যন্ত যদি শেষ না হয় গর্দান যাবে। ন্যাড়া এবার মুসিবতেই পড়ে গেল। হঠাৎ তার মনে পড়লো পিঁপড়াদের রাজার কথা। চুল পুড়তেই পিঁপড়ারা এসে হাজির। পিপড়াদেরকে শস্যপণ্যের স্তুপ দেখিয়ে সমস্যার কথা বললো। পিঁপড়েরা বললো: এটা তোমার কাজ না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। ন্যাড়া সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লো। শেষরাতে ঘুম ভাংতেই দেখলো, পিঁপড়েরা চলে গেছে। আর তিন স্তুপ শস্যদানা আলাদা আলাদাভাবে সাজানো। সকালে এই ঘটনা দেখে বাদশা ভাবলো এতো কঠিন কঠিন শর্ত যে সহজেই উত্তীর্ণ করে গেলো, তাকে আর নতুন শর্ত দিয়ে লাভ নেই। রাজকন্যা তারই প্রাপ্য। বাদশা এরপর রাজকন্যার বিয়ের আয়োজন করলো। ব্যাপক ধুমধামের সাথে এক সপ্তাহ ধরে বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। জাঁকজমকপূর্ণ এই আয়োজনের কথা শুনতে পেয়েছিল অপর এক দৈত্য। সে রাজকন্যাকে ভালোবাসতো। রাজকন্যাকে নিয়ে যখন ন্যাড়া নিজ বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে ঐ দৈত্য এসে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাজকন্যাকে। ন্যাড়া সেখানেও বিপদে পড়েছিল। অবশেষে রাজকন্যার সহযোগিতায় ঐ দৈত্যের হাত থেকেও রেহাই পেল। দৈত্য মারা গেল আর ন্যাড়া রাজকন্যাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে লাগলো।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প