অনেক অনেক বছর আগের কথা। তিনদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা আর একপাশে নীল রঙের একটা হ্রদ, সেখানে একটি ছোট্ট চায়না ছেলে ছিল, তার নাম ছিল ‘’লিউ চিউ’’। সে তার বাবা মায়ের সাথে বাঁশের তৈরি একটা ছোট ঘরে থাকতো। তারা ছিল অনেক সুখি। সারাদিন লিউ চিউ বালি নিয়ে খেলা করত, সূর্যের নিচে বসেথাকত ,পাখি এবং ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকত। আর তার যখন খিদা লাগত তখন তার মা বড় একটা বাটিতে তাকে ভাত খেতে দিত।সে হাত দিয়েই তার খাবার খেত, কাঠি ব্যবহার করত না, কিন্তু কেউ কিছুই মনে করত না। একদিন তার মা বলল ‘’লিউ চিউ, ঘরে যথেষ্ট চাল নেই। যাও হ্রদ থেকে রাতের খাবারের জন্য কিছু মাছ ধরে নিয়ে আস’’। লিউ চিউ ঘরের পেছন থেকে মাছ ধরার জাল নিয়ে মাছ ধরতে চলে গেল। তখন ছিল অনেক গরম কিন্তু সে গরমে অভ্যস্থ তাই তার কোন সমস্যা হয়না। সে শিস দিতে দিতে হ্রদের পাড়ে চলে গেল। সে তার জাল পানিতে ছড়িয়ে দিল। যখন সে জাল টেনে তুলল তখন দেখল যে তার জালে লাল, নীল ও রূপালি রঙের অনেক সুন্দর ও বড় বড় মাছ ধরা পড়েছে। লিউ চিউ অনেক খুশি হল কিন্তু এই লাল,নীল আর রূপালি মাছেরা বলল ‘’লিউ চিউ, দয়া করে আমাদের যেতে দাও, আমরা ওয়াদা করছি যদি তুমি আমাদের যেতে দাও তাহলে আমরা তোমাকে দুইটি জাদুর কাঁচি দিব, আর এই কাঁচি দিয়ে তুমি যা কিছুই কাটবে তাই প্রাণ ফিরে পাবে।‘’ একথা শুনে লিউ চিউ লাল, নীল আর রূপালি মাছেদের ছেড়ে দিল এবং বিনিময়ে এক জোড়া যাদুর কাঁচি পেল। সে একটি সোনালি কাগজ নিয়ে তা কাঁচি দিয়ে রাজার বাড়ির মত করে কাটল। আর অমনি লিউ চিউ অবাক হয়ে দেখতে পেল আর এই কাটা কাগজ বিরাট বড় সোনালি রঙের একটা রাজার বাড়ি হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর সে কাগজে আঁকা বাগান, গাছ আর ফুল কাটতেই থাকল আর এগুলো সব জীবিত হয়ে আর সুন্দর বাড়ির চারপাশে ঘিরে ফেলল। সে কাগজে আঁকা কিছু পাখি কাটল আর এগুলি জীবিত পাখি হয়ে সুন্দর সুরে গান গাইতে লাগলল লিউ চিউ দৌড়ে তার বাঁশের ছোট্ট ঘরে গেল। সে চিন্তা করল তার বাবা মাকে এই সুন্দর বাড়িতে নিয়ে আসবে। যখন সে তার বাবা মায়ের গায়ে পুরনো ছেঁড়া কাপড় দেখল তখন সে ভাবল যে তাদের আগে নতুন কাপড় দিতে হবে। সে কাগজ নিয়ে জামার মত করে কাটতে লাগল আর এগুলি সব সুন্দর সুন্দর সিল্কের কাপড় হয়ে গেল। লিউ চিউ ও তার বাবা মা সুন্দর সুন্দর কাপড় পড়ে সোনালী রঙের বিশাল বাড়িতে থাকার জন্য চলে এল। লিউ লিউ এখন সারাদিন একা একা বাগানে ঘুরে বেড়ায় , তার খুব একা একা লাগে। তাই সে চিন্তা করল কিছু খেলার সাথি বানাবে। সে কিছু কাপড়ের পুতুল নিয়ে কেটে ফেলল আর এগুলি সব জীবিত ছেলে মেয়ে হয়ে গেল। সে খুশিতে কেঁদে ফেলল। সে বলল ‘’ তোমরা আমার বন্ধু হবে, আমার সাথে খেলা করবে?’’ তারা সবাই বন্ধু হয়ে খেলা করে, গান গায়। লিউ চিউ’র নতুন বাড়িতে অনেক কামরা । সব কামরা দামি দামি জিনিসে ভরতি।এত বেশি কামরা যে কারো সাথে কারোর খুব একটা দেখা হয়না। তার বাবা মা তার জন্য অনেক বই আর দামি দামি খেলনা নিয়ে এল। তারপরও সে আগের মত সুখি মনে করেনা। তার কাছে মনে হতে লাগল তার আগের সব সুখ দূরে সরে যাচ্ছে । সে যদি তার হাত দিয়ে খাবার খায় তখন তার বাবা তাকে বকা দিয়ে বলে ‘’তুমি হাত দিয়ে খাচ্ছ কেন, খাবার কাঠি দিয়ে খাও, বোকা ছেলে একটা ।‘’সে বালি দিয়ে খেলা করতে চাইলে তার মা বলে ‘’ লিউ চিউ তুমি তোমার সুন্দর জামা নষ্ট করছ কেন? বালি দিয়ে আর খেলবে না ।‘’ এত কিছু থাকার পরও সকালের নাস্তা থেকে রাতের খাবার পর্যন্ত সে কোন সময় পাই না। একবার অংকের শিক্ষক , একবার বিজ্ঞানের শিক্ষক আবার ভূগোলের সিক্ষক, ইতিহাসের শিক্ষক, একজনের পর একজন তাকে পড়াতে আসে। এত বেশি পড়া যে সে কিছুই মনে রাখতে পারেনা। বাইরে সে তার আগের বন্ধুদের খেলার শব্দ শুনতে পাই আর সে আগে কি সুন্দর দিন কাটাত বালি নিয়ে, পাখি দেখে, ফুল দেখে তা মনে করে মন খারাপ করে থাকে। দিনে দিনে লিউ চিউ’র মন আরও খারাপ হতে লাগ্ল।একদিন রাতে সে অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারেনি। তখন সে চুপিচুপি ঘর থেকে বের হয়ে বাগানে গিয়ে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করল তারপর সে গেইট খুলে বাইরে চলে এল। যখন সে বাইরে এল তখন চাঁদের আলো ঝিকমিক করছিল। তার খুব ঠাণ্ডা লাগছিল তারপরও সে সাহস করে হ্রদে যাবার রাস্তা খুঁজে বের করে সেখানে চলে গেল। সে হ্রদের পাড়ে গিয়ে কান্না করে লাল, নীল আর রূপালি মাছদের ডাকছে আর বলছে, ‘’ তোমরা কি জান আমি এখন আর সুখি না, আমাকে তোমরা কি সাহায্য করবে না ?’’ তার কান্না শুনে মাছে পানির নিচ থেকে মাথা উঁচু করে বলল, ‘’ ছোট্ট বন্ধু এখন তুমি অনেক ধনী ,তোমার সব কিছুই আছে, তারপরও তুমি সুখি না। সব কিছু থাকা মানেই সুখ না। তুমি এক কাজ কর , সূর্যের আলো ফুটার সাথে সাথে জাদুর দুইটি কাঁচি পানিতে ফেলে দাও। তখন তোমার ধন সম্পত্তি সব চলে যাবে কিন্তু তুমি আগের মত সুখে থাকবে।‘’ এই কথা বলে মাছেরা অদৃশ্য হয়ে গেল। লিউ চিউ সূর্যের আলোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। অবশেষে সে সূর্যের আলো দেখতে পেল এবং তার জাদুর কাঁচি দুইটি পানিতে ফেলে দিয়ে সে এবং মাছেদের কথা যেন সত্যি হয় সে এই আশা নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল । বাড়ির কাছে গিয়ে সে দেখতে পেল তাদের সেই বাঁশের ছোট্ট ঘর। তার মা ময়লা কাপড় পড়ে বড় এক বাটি ভাত নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। লিউ চিউ মনে মনে হাসল । সে তার ভাতের বাটি নিয়ে বালির উপর বসে খেতে লাগল, আর তার কাছে মনে হতে লাগল সে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখি একটা ছেলে।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প