নপুংসক বাদশার সন্তানের গল্প

নপুংসক বাদশার সন্তানের গল্প

পুরনো দিনের কথা। এক বাদশার ছিল তিন স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর সন্তান হতো না বলে দ্বিতীয় স্ত্রীকে বিয়ে করে বাদশা। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রীরও কোনো সন্তানাদি হচ্ছে না দেখে আবারও বিয়ে করতে হলো বাদশাকে। কিন্তু খোদার এমনই হুকুম যে এই স্ত্রীরও কোনো সন্তান হলো না। বাদশা কত দূর দূরান্ত থেকে এই ওষুধ সেই দাওয়া এনে স্ত্রীদের দিলো কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। কোনো স্ত্রীরই সন্তান হলো না। বাদশার মনে তাই সবসময়ই কষ্ট ছিল।

একদিন এক দরবেশ এলো প্রাসাদের দরোজায়। বাদশার দুই স্ত্রী ছিল বেশ চালাক চতুর। তারা দুজন দরবেশকে দেখে একে অপরকে বললো: চলো দরবেশের কাছে গিয়ে দোয়া চাই। এমনও তো হতে পারে এই দরবেশের ফুঁ পবিত্র। আর ওই পবিত্র ফুঁতে কাজ হতে পারে, আমরা সন্তান সম্ভবা হতে পারি! দুজনই শলাপরামর্শ করে দরবেশের কাছে গেল এবং তাদের মনের গহীনে লুকানো কষ্টের কথা দরবেশকে খুলে বললো। দরবেশ তাদের কথা শুনে তার জামার পকেট থেকে একটা আনার বের করলো। কী একটা দোয়া পড়ে দরবেশ ওই আনারের ওপর ফুঁ দিলো এবং আনারটি বাদশার স্ত্রীদের হাতে দিয়ে বললো: এই আনারটি খাবেন এবং আল্লাহর ওপর আস্থা ও ভরসা রাখবেন। আল্লাহর কাছে অসাধ্য বলে কিছু নেই। তিনি যা চাইবেন তা অবশ্যই হবে।

বাদশার ওই দুই স্ত্রী ভীষণ খুশি হয়ে গেল। দরবেশকে বিদায় দিয়েই তারা দ্রুত প্রাসাদে ফিরে গেল। দুজন মিলে আনারটাকে ছুলে বিচিগুলো বের করলো এবং মনে প্রবল আশা নিয়ে আনারের দানাগুলো খেতে লাগলো। তৃতীয় যে স্ত্রী প্রাসাদেই থেকে গিয়েছিল সে আনার খাওয়ারত দুই স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো: কী খাচ্ছো তোমরা!

দুই স্ত্রীই এমন ভাব করলো যে মনে হলো তারা যেন কিছুই জানে না। বললো: কই কিছু খাচ্ছি না তো!

তৃতীয় স্ত্রী সরল মনে চলে গেল। কিন্তু দূর থেকে তাকিয়ে দেখলো মাটিতে আনারের বিচি পড়ে আছে। ফিরে এসে ওই বিচি তুলে নিয়ে সে খেয়ে ফেললো।

কিছুদিন পর আল্লাহর ইচ্ছায় তিন স্ত্রীই সন্তান সম্ভবা হলো। নয় মাস নয়দিন যখন পূর্ণ হলো দুই স্ত্রী গর্ভ থেকে জন্ম হলো নাদুস নুদুস লাল সাদা দুই ছেলে। আর তৃতীয় স্ত্রী অর্থাৎ যে কুড়িয়ে পাওয়া আনারের বিচি খেয়েছিল সে জন্ম দিলো হালকা পাতলা হলুদ ও দুর্বল একটা ছেলে সন্তান। তিন সন্তানই আদরে সোহাগে বড়ো হতে লাগলো।

দিনের পর কাটতে লাগলো দিন, রাতের পর রাত। এভাবে মাস আর বছর কাটতে কাটতে বার্ধক্যে পৌঁছে গেল বাদশাহ। বুড়ো হলে যা হয়। চোখে কম দেখতে শুরু করলো বাদশা। কম দেখতে দেখতে একসময় অন্ধই হয়ে গেল। যত ডাক্তার কবিরাজ ছিল রাজ্যে সবাইকে ডাকা হলো, কিছুতেই কাজ হলো না। বাদশা এক সময় জানতে পেলেন যে কোনো এক পাহাড়ে একজন বৃদ্ধ বাস করেন। হাত দেখায় ব্যাপক পারদর্শী সে। রোগীর হাত দেখে রোগের দাওয়া বলে দিতে পারে। বাদশা সেই বৃদ্ধকে নিয়ে আনতে খবর দিলো। বৃদ্ধ এসে বাদশার হাত দেখে বললো: ‘পরীদের বাদশার ঘোড়ার দুধই হলো বাদশার চিকিৎসা’। একথা শুনে বাদশা তার ছেলেদের ডেকে বললেন: ‘তোমরাই আমার আশার স্থল। যাও আমার চোখের দাওয়া নিয়ে আসো’!

বাদশার তিন ছেলেই সামনে এসে হাজির হলো। বাদশা তাঁর দুই ছেলেকে-যারা বেশ চটপটে ছিল-তাদেরকে দ্রুতগামী ঘোড়াসহ পথের প্রয়োজনীয় রসদ বা পাথেয় দিয়ে পাঠালো। কিন্তু বাদশা তাঁর দুর্বল এবং হালকা পাতলা গড়নের ছেলেটিকে এই সফরে যেতে দিতে কিছুতেই রাজি হলো না। ছেলেটা যতই আগ্রহ দেখালো ভাইদের সাথে যেতে বাদশা কবুল করলেন না। বললেন, এই পথ ভীষণ দুর্গম, অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে, দুর্বল ছেলেটি এ কাজের উপযুক্ত নয়। কিন্তু দুর্বল ছেলে খুব কষ্ট পেল। মন খারাপ করে সে মায়ের কাছে গেল। মা ছেলের মনমরা ভাবের কারণ জানতে চাইলো এবং ছেলে যথাযথ জবাব দিলো। সেইসাথে মাকে বললো: তুমি বাবাকে গিয়ে বলো যে আমিও ভাইদের সঙ্গে যেতে চাই। হতে পারে আমার বাবার জন্য কিছু একটা করতেও পারি।

মা ছেলের কথায় বাদশার কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে অনুমতি নিলো এবং তৃতীয় ছেলেও তার দু’ভাইয়ের সফরসঙ্গী হলো। তিন ভাই রওনা হয়ে গিয়ে পৌঁছলো এক তেমুহনিতে। সেখানে একটা পাথরের গায়ে খোদাই করে লেখা রয়েছে: ‘এই তেমুহনিতে আসার পর ডানে গেলে কোনো বিপদ নেই তবে রাস্তা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। আর বাঁয়ে মোড় নিলে দ্রুত যাওয়া যাবে কিন্তু পথটা বেশ বিপদসঙ্কুল’। দুই ভাই যারা আগে রওনা হয়েছিল তারা ডানে যেতে সম্মত হলো। কিন্তু ছোটো ভাইটা বললো ‘যা হবার হবে, বিপজ্জনক পথেই যাবো, তাতে দ্রুত যাওয়া যাবে’। একটা তলোয়ার মাটিতে গেড়ে রাখা হলো। যে আগে ফিরবে সে তলোয়ারটি তুলে নিয়ে বোঝাবে যে সে-ই সবার আগে পৌঁছেছে। তারপর খোদাহাফেজি করে যে যার পথে পাড়ি জমালো।

বাদশার হালকা পাতলা ছেলেটা যেতে যেতে পথে সন্ধ্যা হয়ে গেলে দেখলো পাহাড়ের উপরে ধোঁয়া উড়ছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো ওখানেই রাতটা কাটিয়ে দেবে। উপরে গিয়ে দেখলো একটা গুহা থেকে ধোঁয়া উঠছে। গুহার ভেতর এক বুড়ি বসে আছে। সালাম করলো সে। বুড়ি জিজ্ঞেস করলো: এখানে কী করছো! কোথায় যাবে তুমি?

ছেলে সব কথা বুড়িকে খুলে বললো। বুড়ি সব শুনে বললো: ‘আমি সেই পরীদের বাদশার ধাইমা। তাকে তো আমি বড়ো করেছি। সে এখন পাহাড়ের উপরে গেছে। ঘোড়াগুলোও নিয়ে গেছে সাথে’।

বাদশার ছেলে বললো: তো, আমি এখন কী করবো…?

বুড়ি বললো: “একটিমাত্র পথ আছে.

এক নপুংসক বাদশার তিন স্ত্রী ছিল। দরবেশের দেওয়া আনার খেয়ে সবারই সন্তান হলো। সন্তানরা যখন বড় হলো বাদশা অন্ধ হয়ে গেল। পর্বতবাসী অভিজ্ঞ এক বুড়ো বললো এর ওষুধ হলো ‘পরীদের রানীর ঘোড়ার দুধ’। ছেলেরা শুনতে পেয়ে যার যার মতো রওনা হলো। ছোট এবং হালকা গড়নের ছেলেটা দুর্বল একটা ঘোড়া পেল। তাতেই চড়ে সে অগ্রসর হয়ে গেল।

যেতে যেতে গিয়ে উঠলো এক তেমুহনীতে। সেখানে লেখা ছিল একটি রাস্তা বেশ দূরের তবে নিরাপদ আর অপর পথটি হলো কাছের কিন্তু বিপদ-সঙ্কুল। বাদশার অন্য দুই ছেলে নিরাপদ পথ বেছে নিলো আর দুর্বল ছেলে বেছে নিলো বিপদপূর্ণ কাছের পথ। যাবার সময় সবাই একটি তলোয়ার পুঁতে রাখলো মাটির নীচে। বলা হলো যে আগে পৌঁছবে সে এই তলোয়ার নিয়ে যাবে। দুর্বল ছেলেটা বিপদের পথে অগ্রসর হয়ে পৌঁছলো এক গুহায়। সেখানে এক বুড়ির সাথে পরিচিত হলো। সেই বুড়ি বললো: আমি ওই পরীদের রানীর ধাইমা। পরীদের রানী এখন রূপকথার পাহাড়ে গেছে। বুড়ি ছেলের নিয়ত জেনে সিদ্ধান্ত নিলো তাকে সাহায্য করবে। বুড়ি বলেছিল: ‘একটিমাত্র পথ আছে সেখানে যাবার’।

বুড়ি সেই পথটির কথা বললো এভাবে: ‘এখানে কাছেই একটি ঝরনা আছে। প্রতিদিন সেখানে এক পাল ঘোড়া আসে। ঘোড়াগুলো এক এক করে ওই ঝর্ণাধারা থেকে পানি খায়। সবশেষে ঘোড়াটি বেশ দুর্বল এবং শুকনো। তুমি ওই ঘোড়াটিকে আটক করবে। যখন ওই ঘোড়া বাছুর দেবে এবং বড়ো হবে তখন তার পিঠে চড়বে। ওই ঘোড়ার পিঠে চড়েই তুমি যাবে রূপকথার পর্বতে। এছাড়া তুমি এইসব ঘোড়ায় চড়ে কোনোভাবেই ওই পাহাড়ে যেতে পারবে না’।

ছেলে দেখলো এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। সুতরাং কী আর করা! শেষ পর্যন্ত সে একাজ করতে রাজি হয়ে গেল। বুড়ি যখন দেখলো যে ছেলে রাজি, তাকে ঘোড়ার একটা লাগাম দিয়ে বললো: ‘এটা ওই ঘোড়ারই লাগাম। যেভাবেই হোক ওর মুখে এই লাগাম লাগাতে হবে’। বুড়ি আরও বললো: ‘এখন থেকে চল্লিশ দিন পর ঘোড়ার বাচ্চা হবে। বাচ্চাটার খুব যত্ন নেবে। এই বাচ্চা দৈনিক এক বছরের সমান বড়ো হবে। সাতদিনের মাথায় তুমি ওই ঘোড়ায় চড়বে। ওই ঘোড়ার বাঁ কান মোচড়ালে ঘোড়া শূন্যে উড়বে আর ডান কান মোচড়ালে মাটিতে নেমে আসবে। পরীদের রানী চল্লিশ দিন ঘুমায় আর চল্লিশ দিন জেগে থাকে। এখন সে জেগে আছে। তুমি গিয়ে পৌঁছবে যখন তখন সে ঘুমে থাকবে। আর তুমি সহজেই তার ঘোড়া নিয়ে দুধ দুইতে পারবে এবং তোমার বাবার চোখে মাখতে পারবে। তবে সাবধান! পরীদের রানী যখন জাগবে, তোমার খোঁজে আসবে, তখন কী হবে জানি না’।

রূপকথার পাহাড়ে যাবার পুরো পথের ঠিকানা এবং যা যা করণীয় সবকিছুই বুড়ি ছেলেকে বলে দিলো। তারপর তিনটি আনার আর একটা আয়না দিয়ে বললো: ‘এগুলো রাখো! কাজে আসবে’। বাদশার ছেলে ওই রাতটা বুড়ির গুহাতেই কাটালো। সকালে গেল ঝরনার কাছে। বুড়ির কথামতো ওই ঘোড়াটিকে আটকালো এবং গুহায় নিয়ে গেল। চল্লিশ দিন ঘোড়ার ভালো করে যত্নআত্তি করলো। যথাসময়ে তার বাচ্চাও হলো। সাতদিনেই বুড়ির কথামতো বাচ্চা ঘোড়াটি সাত বছরের ঘোড়ার মতো হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠলো। সপ্তম দিনে শাহজাদা ঘোড়ার পিঠে চড়লো এবং বাঁ কান মোচড়াতেই ঘোড়া শূন্যে উড়তে শুরু করলো। উড়তে উড়তে ঘোড়া গিয়ে পৌঁছে গেল সেই রূপকথার পাহাড়ে। শাহজাদা ঘোড়ার ডান কান মোচড়াতেই সে পাহাড়ের ওপর একটা দুর্গের কাছে মাটিতে নেমে গেল।

শাহজাদার মনে বিন্দুমাত্র ভয়-ডর নেই। সে সোজা চলে গেল কেল্লার ভেতর। কেল্লা বটে। দেখামাত্রই যে-কেউ বেহুশ হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু শাহজাদা নির্বিঘ্নে কেল্লার ভেতরের সবকিছু দেখতে দেখতে গিয়ে পৌঁছলো এক ঝরনার কাছে। অপেক্ষা করতে করতে একসময় পরীদের রানীর মাদি ঘোড়া এসে পৌঁছলো। বুড়ির কথামতো শাহজাদা আয়নাটা ওই ঘোড়ার সামনে ধরলো। আয়নার ভেতর নিজেদের দেখতে পেয়ে ঘোড়া বলে উঠলো: বাহ বাহ! কী সুন্দর আমি। একটা জিন আর লাগাম যদি পরতে পারতাম তাহলে তো আরও সুন্দর লাগতো। শাহজাদা সাথে সাথে বুড়ির দেওয়া জিন আর লাগাম বের করে ঘোড়ার পিঠে আর মুখে পরিয়ে দিলো। এবার ঘোড়া বললো: ‘যদি একজন সওয়ার এখন আমার পিঠের জিনে বসতো’। শাহজাদা দেরি না করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো এবং চলতে শুরু করলো। ঘোড়া এমনভাবে দৌড়তে লাগলো যে বোঝা গেল কেমন পাগলাঘোড়া সে।

শাহজাদা ওই পাগলাঘোড়ার সামনে খানিক দূরত্বে একটা আনার ছুঁড়ে মেরে বললো: ‘আমি মানব। তুমি যদি আবারো এরকম পাগলামো করো তাহলে এই আনারের মতো করে তোমার মগজ বের করে আনবো’। কিছুক্ষণ ভালোই দৌড়লো ঘোড়া। কিন্তু ধীরে ধীরে আবারও সে পাগলামো শুরু করে দিলো। এবার শাহজাদা দ্বিতীয় আনারটা ছুঁড়ে মারলো তার সামনে। ঘোড়া এবারও কিছুটা দমলো তবে বেশিক্ষণ না। কিছুক্ষণ পরেই পুনরায় সে পাগলামো শুরু করলো। শাহজাদা তৃতীয় আনারটাও ছুঁড়ে মারলো। ঘোড়া এইবার লাইনে আসলো। যেতে যেতে ঘোড়া গিয়ে পৌঁছলো পরীদের রানীর কেল্লায়। শাহজাদা মনে মনে বললো: ‘রূপকথার পাহাড়ে যেহেতু এসেই পড়েছি তাহলে পরীদের রানীকে একবার দেখে গেলে মন্দ হয় না। প্রতিদিন তো আর এখানে আসা হবে না! আমার বাবার প্রাসাদ তো নয়’।

সে ঠিকই গেল। দেখলো পরীদের রানী ঘুমোচ্ছে। কিন্তু পরীদের রানীর ওপর শাহজাদার নজর পড়তেই থ’ মেরে গেল সে। মনে মনে বললো: ‘কেউ এরকম সুন্দর হতে পারে! আশ্চর্য’!

এরপর ঘোড়ায় চড়ে বসলো। যেভাবে বুড়ি তাকে নির্দেশনা দিয়েছিল সেভাবেই সে ফিরে গেল। যেতে যেতে যখন ওই সেই তেমুহনীতে পৌঁছলো-যেখান থেকে ভাইদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল সে-মাটি খুঁড়ে দেখলো তলোয়ারটা সেখানেই পড়ে আছে, যেমন রেখে গিয়েছিল। তার মানে বোঝা গেল তার ভাইয়েরা এখনো ফেরে নি। শাহজাদা একাকি ফিরতে চায় নি বলে পায়ে হেঁটে রওনা হলো। যে পথে ভাইয়েরা গিয়েছিল, সে পথে।

ভাইদের যাবার পথে খানিকটা গিয়ে দেখলো আলুথালু হয়ে জীর্ণ আর ছিন্ন পোশাক পরা এক যুবক আসছে। শাহজাদা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো তারই এক ভাই সে। তাড়াতাড়ি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো: ‘কী হয়েছে তোমার’! ভাই বললো: ‘আমি আমার ভাইয়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছি। চোর আমাদের সব কেড়ে নিয়ে গেছে। এখন কী করবো জানি না। ভাবছি কাঁটাগাছ তোলার কাজ করবো। সেগুলো তুলে বিক্রি করে খরচের ভার বহন করবো’। এই বলে দু’ভাই একসাথে যাত্রা করলো এবং শহর-নগর ব্যাপক ঘুরলো। অন্য ভাইকেও তারা খুঁজে পেলো।

খুঁজে পাওয়া ভাইও যাঁতাকলের মালিকের শাগরেদ হিসেবে কাজ করছিল। তার চুলও অপর ভাইয়ের মতো মাথা থেকে একেবারে কোমর পর্যন্ত লম্বা হয়ে গেল। নখগুলো তাদের কাস্তের মতো বড়ো বড়ো। যে ছোট ভাইটা পরীদের রানীর মাদি ঘোড়া নিয়ে এসেছিল সে অন্য ভাইদের চুল নখগুলো কেটে দিলো। মোটামুটি তাদেরকে মানব সন্তানের মতো মনে হয় এরকম একটা অবস্থায় নিয়ে এলো। তবে ভাইদের কাটা চুল আর নখগুলো তাদের অগোচরে রুমালে বেঁধে ঘোড়ার জিনের ভেতর রেখে দিলো। এবার তিন ভাই একসাথে রওনা হলো নিজেদের শহরের দিকে।

হ্যাঁ! তিন ভাই নিজেদের শহরের দিকে রওনা দিলো। যেতে যেতে পথে প্রথম ভাই দ্বিতীয় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো: ‘আমরা কোন্‌ মুখে শহরে ফিরবো? আমরা যাকে মানুষ বলেই গণ্য করি নি সে ঠিকঠাক মতো মাদি ঘোড়াও নিয়ে এসেছে আবার আমাদেরকেও আমাদের দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি দিয়েছে। মানুষ যদি এটা জানতে পারে আমাদের মান-সম্মান তো আর থাকবে না। এদিকে বাবার চোখেও সে আদরের দুলালী হয়ে উঠবে। কে জানে হয়তো বাবা তার সিংহাসন তাকেই দিয়ে বসতে পারে’। দ্বিতীয় ভাই এ কথা শুনে বললো: ‘তাকে মেরে ফেললে ভালো হয় না! তাহলে সবকিছুই হবে আমাদের’। প্রথম ভাই বললো: ‘না, তাকে মারবো না। মারলে হত্যার দায়-দায়িত্ব পড়বে আমাদের ঘাড়ে। তারচে ভালো তার কাছ থেকে মাদি ঘোড়াটা নিয়ে নেবো, ফলে সে যাবে তার পথে’। এরকম কথাবার্তার পর ঘনিয়ে এলো রাত।

রাতের বেলা তিন ভাই ঘুমিয়ে পড়লো। মাঝরাতে দু’ভাই ‘চোর’ ‘চোর’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। ছোট ভাই মাদি ঘোড়ার দিকে দৌড়ে যেতে চাইলো কিন্তু তার অপর দু’ভাইয়ের একজন তার পায়ে তলোয়ার দিয়ে জোরে আঘাত করলো। কাপুরুষের মতো দু’ভাই ছোট ভাইকে ফেলে রেখে ঘোড়ায় চড়ে রওনা দিলো নিজেদের শহরের দিকে। কয়েকদিন পর গিয়ে পৌঁছলো তারা শহরে। বাবার কাছে মাদি ঘোড়া নিয়ে গেল এবং তার দুধ দুইয়ে নিয়ে বাদশার চোখে মেখে দিতেই বাদশার চোখ ভালো হয়ে গেল। দুই ছেলেকে দেখতে পেয়ে বাদশাহ ভীষণ খুশি হলো। পুরো শহরে আলোকসজ্জা করে উৎসবমুখর করা হলো।

এদিকে পা কাটা ছোটো ভাই সকাল পর্যন্ত কষ্টে কাটালো। ভোর হতেই চারদিক যখন ফর্সা হলো দেখলো দুটি ইঁদুর ঝগড়া করছে। একটার পায়ে আঘাত লেগেছে। কাছেই একটা জায়গায় সাদা মাটি ছিল। আহত ইঁদুর সেই মাটিতে গিয়ে তার পায়ে মাখালো আর অমনি ইঁদুরের পা ভালো হয়ে গেল। শাহজাদা এই কাণ্ড দেখে ইঁদুরের মতো নিজেও একই কাজ করলো এবং সুস্থ হয়ে গেল, একটু ব্যথাও আর রইলো না তার পায়ে। দেরি না করে শাহজাদা এবার পাড়ি জমালো শহরের দিকে। শহরে গিয়েই দেখলো উৎসবমুখর সাজ সাজ অবস্থা চারদিকে। বুঝতে বাকি রইলো না যে তার ভাইয়েরা কী করেছে। মনে মনে বললো: এখন যদি বলি সব আমি করেছি, কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই সে এক কোণে সাধারণ মানুষের সাথে বসে নীরবে উৎসব দেখতে লাগলো।

এদিকে চল্লিশ দিন শেষ হবার পর পরীদের রানী জেগে উঠেই বুঝতে পারলো যে কোনো মানুষ তার প্রাসাদে এসেছে। যেভাবেই হোক এখন ওই মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে কেননা পরীদের মাঝে আর সে বাস করতে পারবে না। তার মাদি ঘোড়ার খোঁজে গিয়ে বুঝলো ঘোড়াটাকেও নিয়ে গেছে। দ্রুত সে তার বাহিনী জড়ো করলো এবং যেখানে তার মাদি ঘোড়া রয়েছে সেই শহরে গিয়ে পৌঁছলো। বাদশার কাছে পাঠালো একজনকে। সে বাদশাকে বললো: হয় মাদি ঘোড়া এবং যে তাকে এনেছে তাকেও দিতে হবে না হয় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এই ঘটনা সারা শহর হয়ে গেল। বাদশার কাছে এসে হাজির হলো সবাই। বাদশাকে বললো: পরীদের সাথে যুদ্ধ করে পারবে না কেউ। তারচেয়ে ভালো ঘোড়া আর যে তাকে এনেছে উভয়কে ফেরত দেওয়া।

বাদশা এবার ভড়কে গেল। সে এক বার্তায় জানালো যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা তার নেই। তার দুই ছেলে কেন একাজ করেছে তাও বললো। এই বলে দুই ছেলেকে মাদি ঘোড়াসহ পাঠালো পরীদের রানীর কাছে। দুই ছেলে তো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। তারা বুঝতে পারলো চরম ভুল করেছে তারা। এখন তো বলতেও পারবে না যে তারা এ কাজ করে নি বরং তাদের ছোট ভাই কাজটি করেছে। রাণী তাদের দেখে বললো: এরা আমার মাদি ঘোড়া চুরি করে নি। মূল কাজটি যে করেছে তাকে পাঠাতে বললো। এবার তো সমস্যা দেখা দিলো। কে করেছে তাহলে কাজটি।

এক সপ্তা সময় দিল পরীদের রানী। এর মধ্যে না পাঠালে পুরো শহর চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে। বাদশা তো হতবাক। সে বলতে লাগলো এ অবস্থা দেখার চেয়ে অন্ধ থাকাটাই তো ভালো ছিল। এভাবে ছয় দিন কেটে গেল। সবাই থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নাজানিকী হয়। শেষ পর্যন্ত শাহজাদা বাদশার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বললো সে-ই কাজটা করেছে। এরপর যা হয়েছিল সবই বাদশাকে বললো। বাদশা তাড়াতাড়ি তাকে পরীদের রানীর সামনে পাঠালো। পরী তাকে দেখেই বুঝলো কাজটা এ-ই করেছে। রানী এবার শাহজাদার দিকে ফিরে বললো: তুই যেহেতু আমার ঘোড়া এনেছিস এখন আমি আর পরীদের মাঝে ফিরে যেতে পারবো না। সুতরাং আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে এবং আমরা একসাথে জীবন যাপন করবো। শাহজাদা মনে মনে বললো: খোদা আমার মনোবাসনা পূর্ণ করেছে।

এরপর যা হবার তাই হলো। সাত দিন সাত রাত ধরে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে বিয়ের আয়োজন হলো। যে দু’ভাই বাদশাকে মিথ্যে বলেছিল তাদেরকে শাস্তি দিতে চাইলো বাদশা। কিন্তু শাহজাদা বললো: তারা যে অপমানিত হলো সেটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। তাদেরকে আর শাস্তি দেওয়ার দরকার নেই।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত