গতকালকে রাতে গ্রামে আসছে সিফাত। গ্রামে বছরে দুএকবার করে আসা হয়। এসে কয়েকদিন থেকে আবার চলে যায়। এই চলে যাওয়া আসাটা প্রায় সতেরো বছর ধরে। গ্রামে প্রচন্ড শীত চলছে। হাত পা রীতিমত কাঁপছে। একটু আগেই ভোরের আজান দিল মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেব।
বাসা থেকে বের হয়ে সোজা বড় বাড়ির দিকে রওনা দিল। রাতের আঁধার আর কুয়াশায় ছেয়ে গেছে চারপাশ।
দশহাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না কিছুই। খুব সাবধানে এগিয়ে চলছে সিফাত।
-এই কেডায় যায় ওইডা? একটা কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়াল সিফাত।
-আআআমি। আমতা আমতা করে বলল।
-আমিটা কেডা?
কাঁপা গলাটা হালকা কেশে নিয়ে বলল,
-সিফাত।
-মজিবরের পোলা না তুই?
-হ চাচা
-এতো সকালে কই যান আব্বাজান?
পরনে একটা ছেঁড়া কম্বল। আধমুড়ি দিয়ে ঝোপের ভিতর থেকে বের হয়ে সামনাসামনি জিজ্ঞেস করে রহমত পাগলা।
এলাকার সবার কাছে পাগল হলেও সিফাত তাকে মুরব্বীদের মতোই সম্মান করে। জন্মের বছর কয়েক পরেই বাবাকে হারিয়ে নিজের বাবার মতোই
রহমতকে সম্মান করে। রহমতও নিজের ছেলের মত স্নেহ করে তাকে। রহমতকে দেখে ভয়টা কেটে গেছে ততক্ষণে।
জোর গলায় বলল,
-বড়বাড়ি যাব চাচা।
-ওইহানে যাস না আব্বাজান।
-ওইহানে তোরে দেখলে তোর আব্বার মতো তোরেও মাইরা ফালাইবো।
ঠোট দুইটা প্রসারিত করে একটা নির্ভার হাসি হেসে বলল,
-ডরাইয়েন না। আপনের দোয়া সাথে থাকলে কিচ্ছু অইব না।
-সাবধানে যা…
রহমতের কাছে দোয়া নিয়ে সামনে এগোতে থাকে সিফাত। রহমতও যাচ্ছে পিছু পিছু।
মুখে দাঁড়ি।চুলগুলোও উসকো খুসকো। পরনে একটা আধময়লা পান্জাবী। কাঁধে একটা ঝোলা। এগিয়ে চলছে আর কাঁধে থাকা ঝোলাটায় হাত বুলাচ্ছে বারবার।
ঝোলাটায় একটা মাঝারি ধরণের বন্দুক। সামনেই ইলেকশন। রহমান সাহেব ইলেকশন করবেন। সতেরো বছর আগে সিফাতের বাবাও ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন
বিপুল ভাবে জয়ী হয়েছিল সিফাতের বাবা। ভোটের দিন রাতে পার্টি অফিস থেকে একসাথে বের হয়ে বাসার দিকে রওনা দিল মজিবর সাহেব ও রহমত মিয়া।
নীরবে হাঁটতে হাঁটতে নীরবতা ভাঙ্গালো রহমত মিয়া। মজিবর সাহেবকে বললেন,
-যাক, অবশেষে গ্রামের মানুষ একটা যোগ্য নেতা
পাইলেন। হেতেরা খুব খুশি অইছে চেরম্যান সাব।
:সব আল্লাহর ইচ্ছা রহমত মিয়া। দেখি কতদিন ওদের খুশি রাখতে পারি।
-আপনেই পারবেন চেরম্যান সাব।
এইতো স্কুলটার কাছাকাছি চলে এসেছে দুইজনেই। আর কয়েক গজ পরেই মজিবর সাহেবের বাড়ি। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাড়িটা।
-তুমি তাইলে যাও রহমত মিয়া। চলে আসছি তো…তুমি যাও গা…
রহমত মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন মজিবর সাহেব। বলা শেষ করেই রহমতকে বাড়ির দিকে যেতে বলে নিজ বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলেন। হঠাত্ দুমমম করে একটা শব্দ হল। কত্…করে একটা গোঙ্গানির শব্দ শুনতে পেলেন।
পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলেন রহমত পড়ে আছে রাস্তায়। দৌড়ে ছুটে গেলেন রহমতের কাছে। কোথ্থেকে কি হল কিছুই বুঝলেন না। হঠাত্ চারদিক ঝাপসা দেখা শুরু
করলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেখলেন রক্ত। ধপাস করে পড়ে গেলে মজিবর সাহেবও। তারপর তাদের বডি দুটো কে যেন ফেলে রেখে যায় বাড়ির উঠানে। বাবাকে
হারিয়ে ফেলে তখনই আর রহমত মিয়া তখন হয়ে যায় রহমত পাগলা।
চোখ মুছে সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগলো সিফাত। কিছুদূর যেতেই বড় বাড়ির উঠানটা দেখতে পেল। বড় বাড়ির উঠানে অনেক মানুষের ভীড়। ভীড় ঠেলে সামনের
সারিতে বসে রহমান সাহেবের বক্তব্য শুনতে বসে পড়ল সিফাত। পাশে কোথ্থেকে যেন একটা পাগল টাইপের লোক বসে পড়ল। ঝোলাটায় একবার হাত বুলাতেই
সিফাতের সাথে চোখাচোখি হল। একটা খ্যাপাটে হাসি দিল পাগলটা। আপন মনেই বিড়বিড় করে বলে উঠল…আব্বাজান সাবধানে…
-ক্রিং… ক্রিং…
-হ্যালো…
মাইক্রোফোনে উপস্থিত সবাই সব শুনতে পাচ্ছে।
-আপনি রহমান সাহেব বলছেন?
-জ্বী…
-আপনার মেয়েকে কে জানি গুলি করছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আধাঘন্টার মধ্যেই অপারেশন করতে হবে। সদর হাসপাতালে দুর্লভ এবি নেগেটিভ ব্লাড লাগবে এক্ষুণি।
নাহলে আপনার মেয়েকে বাঁচানো যাবে না।
হঠাত্ ভীড়ের মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়াল সিফাত। আমার এবি নেগেটিভ। ঝোলাটা রহমত চাচার কাঁধে দিয়ে গাড়িতে উঠে সদর হাসপাতালে রওনা দিল সিফাত। রহমত
পাগলা বিড়বিড় করে বলে উঠল…. “আব্বাজান সাবধানে…”