শকুন ও শেয়াল

শকুন ও শেয়াল

এক শকুন আর এক শেয়ালের মাঝে বন্ধুত্ব হয়েছিল। একদিন শেয়াল বন্ধু শকুনকে বলল: ‘দোস্ত! তুমি তো সবসময় আকাশেই উড়ে বেড়াও। শুভ্র মেঘ ছাড়া তো আর তেমন কিছুই দেখার সুযোগ তোমার হয় না। এক কাজ করো! তুমি একদিন আমার পিঠে চড়ে বস, তোমাকে আমি পুরো বন জঙ্গল দেখাবো। এখন তো বসন্তকাল। বনের গাছ গাছালি সবুজে শ্যামলে মাখামাখি। আর ফুলে ফুলে চারদিক একেবারে সুশোভিত। তোমার ভালো লাগবে, চলো’।

শকুন চিন্তা-ভাবনা করে দেখল-একেবারে মন্দ হয় না, শেয়ালের প্রস্তাবটা শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করলো এবং শেয়ালের পিঠে চড়ে বসল। মনে তার বনাঞ্চল দেখে বেড়াবার সাধ।

শেয়াল তো এমনিতেই ভীষণ চতুর। শকুন তার পিঠে চড়ে বসার সাথে সাথে সে তার চালাকি শুরু করে দিলো। কাঁটাময় ঝোপ জঙ্গল, গাছ গাছালি যেদিকে বেশি সেদিক দিয়ে সে ভীষণ গতিতে দৌড়াতে লাগল। ডালপালা আর কাঁটার আঘাতে শকুন বেচারার পাখার পালকগুলো একের পর এক ঝরে পড়তে লাগলো। শেয়াল যেদিক দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিল পুরো রাস্তাজুড়ে শকুনের সাদা-কালো আর খয়েরি ঝরা পালক ভর্তি। শকুনের পালক ঝরতে দেখেও শেয়াল তার দৌড় থামালো না। সে দৌড়াতেই লাগল। এদিকে শকুনের পাখার সকল পালক ঝরে পড়ার পর এবার বুকের পালক ঝরতে লাগল। একটা সময় দেখা গেল শকুনের সারা গায়ে একটি পালকও অবশিষ্ট নেই। শেয়াল এবার শকুনের দিয়ে তাকিয়ে তার পালকহীন শরীর দেখে মনে মনে হাঁসলো। শেয়াল শকুনের সাথে ঠাট্টা মশকরা করতে লাগলো। পালকহীন শকুন না পারে উড়তে আর না পারে শিকার করতে।

সে কারণে বন্ধু শেয়ালের ওপর শকুন অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। শেয়াল যা শিকার করতো তা খেয়ে দেয়ে উচ্ছিষ্টটুকু শকুনকে খেতে দিত। কখনো কখনো শেয়াল শকুনের কথা ভুলেই যেত। ফলে শকুন দিনের পর দিন সপ্তার পর সপ্তা না খেয়ে খেয়ে খিদের জ্বালায় চড়ুইয়ের বাসায় হানা দিয়ে বাচ্চাকাচ্চা খেতে বাধ্য হতো। এভাবে দীর্ঘদিন কেটে গেল। ধীরে ধীরে শকুনের পাখায়, বুকে নতুন পালক গজাল। একেবারে আগের মতোই সকল পালক সে ফিরে পেল। ফিরে পেল আকাশ উড়বার এবং শিকার করার আগেকার অবস্থা। এখন সে বরং আগের চেয়েও শক্তিশালী। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবার পর একদিন শকুন তার বন্ধু শেয়ালকে বলল: দোস্ত! আমার তো যাবার সময় হলো। আচ্ছা তুমি কখনো কি ভেবেছ শূন্য আকাশের বিশাল উচ্চতা থেকে নীচের এই যমিন দেখতে কেমন লাগে?

শেয়াল বলল: না তো!

শকুন বলল: অনেক সুন্দর, অনেক! এই জঙ্গলের ভেতর থেকে অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগে। তুমি যদি দেখতে চাও আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি। যাবে কিনা একবার ভেবে দেখো’।

শেয়াল মনে মেন ভাবল সুযোগটা হাতছাড়া করা ঠিক না। সে রাজি হয়ে গেল আর শকুন তার পায়ের নখে শেয়ালকে আটকিয়ে দিলো উড়াল। উপরে উড়ে যেতে যেতে শকুন শেয়ালকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো: দোস্ত যমিনটাকে এখন কেমন দেখতে পাচ্ছো?

শেয়াল বলল: অনেক বড়ো দোস্ত।

শকুন আবারো উপরের দিকে যেতে লাগলো। কিছুটা উপরে উঠে আবার জিজ্ঞেস করল: এখান থেকে কেমন দেখতে পাচ্ছো?

শেয়াল বলল: পুরো পৃথিবীটাকে একটা শহরের মতো মনে হচ্ছে।

শকুন আরো উপরে গিয়ে তৃতীয়বারের মতো জিজ্ঞেস করল: এখন কেমন দোস্ত!?

শেয়াল বলল: এখন তো পৃথিবীটাকে একটা তরমুজের মতো লাগছে।

শকুন বলল: ‘ঠিক আছে হে বীর। এবার তাহলে নীচে চলে যাও’-এই বলে শকুন তার পায়ের নখ থেকে শেয়ালকে ছেড়ে দিলো। এতো উপর থেকে ভীষণ গতিতে পড়তে পড়তে বাতাসের তোড়ে শেয়ালের গায়ের পশমগুলোও ঝরে গেল। কিন্তু শেয়াল একটা কাজ করলো। পড়তে পড়তে আল্লাহর কাছে সে ক্ষমা চেয়ে দোয়া করলো: ‘হে খোদা! আমাকে তুমি একটা নরম শরীর কিংবা চামড়ার তৈরি আলখাল্লার ওপর ফেলো’। আল্লাহর দরবারে তার দোয়া কবুল হয়ে গেল। এক কৃষক নাস্তা খেতে বসেছিলো। তার আলখাল্লাটি পাশেই খুলে রেখেছিল। সামনে ছিল বিচিত্র নাশতা। কৃষকের নজর উপরে পড়তেই দেখল খী যেন একটা ঠিক তার ওপর পড়তে যাচ্ছে। সে সরে গেল আর অমনি শেয়াল এসে পড়লো আলখাল্লার ওপর। বেঁচে গেল শেয়াল। সেইসাথে চমৎকার নাশতাও পেল তৈরি। পেট ভরে খেয়ে আলখাল্লা পরে সে রওনা দিলো বনের ভেতর।

পথেই দেখা হলো সিংহের সাথে। সিংহ জিজ্ঞেস করলো: আলখাল্লা পেলি কাথায়?

শেয়াল: কেন, জানো না আমি সেলাই করি?

সিংহ আশ্চর্য হয়ে বলল: তাহলে আমার জন্যেও একটা সেলাই কর তোরটার মতোই।

শেয়াল বলল: পাঁচটা হৃষ্টপুষ্ট হরিণ লাগবে। এক সপ্তা সময় লাগবে।

সিংহ পাঁচটা হরিণ এনে দিল। শেয়াল তার পরিবার পরিজনকে নিয়ে সেগুলো মজা করে খেলো। সপ্তাশেষে সিংহের সাথে দেখা হলে শেয়াল বলল: আস্তিন আর বেল্টের জন্যে ছোট্ট দুটি ভেড়ার বাচ্চাও লাগবে। সিংহ তাও দিল আর শেয়াল পরিবার আগের মতোই মজা করে সেগুলো খেলো কিন্তু সিংহকে আলখাল্লা বানিয়ে দিতে পারলো না।

সিংহ বলল: ধৈর্যের সীমা ছেড়ে গেছে।

শেয়াল বলল: ওস্তাদ! আলখাল্লা রেডি আছে ঘরে, চলুন।

ঘর মানে গর্তের কাছে গিয়ে শেয়াল পালাতে চাইলো কিন্তু লেজ ধরে ফেললো সিংহ। বেচারা শেয়ালের লেজ ছিঁড়ে গেল। সিংহ বলল: তোকে আমি ঠিকই চিনে নেবো লেজবিহীন শয়তান…।

শেয়াল পরদিন তার গর্ত থেকে বেরিয়ে দেখল তার বন্ধুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে তাদেরকে আঙুর বাগানে নিয়ে গেল। গাছের উপরে উঠে শেয়ালেরা যখন আঙুর খাচ্ছিলো লেজকাটা শেয়াল তখন তার বন্ধুদের একজনের লেজ আরেকজনের লেজের সাথে বেঁধে দিলো। এরপর বাগানের মালিককে খবর দিলো। বাগানের মালিক তাড়াহুড়া করে লাঠি হাতে আসতেই শেয়ালেরা ভয়ে হুড়োহুড়ি করে পালাতে গিয়ে সবাই তাদের লেজ হারাল। এই ঘটনার খানিক পরেই সিংহ এসে হাজির। সিংহ বলল: শেষ পর্যন্ত তুই আমার হাত থেকে আর রিহাই পেলি না লেজকাটা শয়তান।

শেয়াল মুচকি হেসে জোরে চিৎকার দিল। অমনি তার লেজহারানো শেয়াল বন্ধুরা এসে হাজির হলো। সব শেয়ালেরই লেজ কাটা-এ অবস্থা দেখে সিংহ ভাবলো: শেয়াল ভয়ংকর প্রতারণা করেছে। তার সরলতার সুযোগে শেয়াল কদিন তার পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থার জন্যে নিশ্চিন্তমনে কাটিয়েছে। সিংহ শেষ পর্যন্ত শেয়ালকে লক্ষ্য করে বলল:

‘হে বজ্জাত! তোর মতো প্রতারক আর কেউ নেই’।

এরপর থেকে সিংহ সতর্ক হয়ে গেল যেন শেয়ালের মতো কারো কাছে আর প্রতারিত হতে না হয়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত