ছাগল তো সবাই চেনেন। তবে যে ছাগলের গল্প আমরা এখন শুনবো তার নামটি একটু ভিন্নরকমের। সবার কাছেই সে পরিচিত ছিল ‘বোযে যাঙ্গুলে প’ হিসেবে। ফার্সি ভাষায় বোয মানে ছাগল, যাঙুলে মানে ঘণ্টি আর প মানে পা। তার মানে হলো যে ছাগলের পায়ে ঘন্টি বাঁধা। নাম থেকেই বুঝতে পারা যায় ছাগলের বাহ্যিক অবস্থা। এই ছাগলটির তিনটি বাচ্চা ছিল। একটির নাম শাঙুল, আরেকটির নাম মাঙুল আর তৃতীয়টির নাম ছিলো হাব্বে আঙুর। ফার্সিতে শাঙুল ও মাঙুল দুষ্টু অর্থে ব্যবহৃত হয় আর হাব্বে মানে হলো দানা। হাব্বে আঙুর অর্থ দাঁড়াবে আঙুরের দানা। তো তিনটি বাচ্চাই তাদের মায়ের সাথে একটি চারণভূমির পাশে অবস্থিত ঘরে বসবাস করত।
একদিন ওই ছাগল শুনতে পেল যে একটা হিংস্র এবং ধারালো নখ বিশিষ্ট নেকড়ে এসে আস্তানা গেড়েছে তাদেরই ঘরের পাশে। প্রতিবেশি যাকে বলে আর কি! ছাগল উদ্বিগ্ন হয়ে বাচ্চাদের ডেকে বলল: সাবধান! অসতর্কভাবে কোনো কিছু করবে না। কেউ যদি দরোজায় টোকা দেয়, চাবির ফাঁক দিয়ে কিংবা অন্য কোনো ফোকর দিয়ে দেখে নেবে কে এসেছে! যদি দেখো যে আমি এসেছি, তাহলে তো দরজা খুলে দেবে, আর যদি দেখ কোনো নেকড়ে কিংবা শেয়াল এসেছে কিছুতেই দরোজা খুলবে না। বাচ্চারা একসাথে বলল: ঠিক আছে।
এভাবে বাচ্চাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে ছাগল চলে গেল।
কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। নেকড়ে এসে দরোজায় টোকা দিল। বাচ্চারা একসাথে চীৎকার করে বলে উঠলো: কে ওখানে দরোজায় টোকা দিচ্ছে?
নেকড়ে বলল: আমি, তোমাদের মা! দরোজা খোল!
বাচ্চারা বলল: মিথ্যা বলছো! আমাদের মায়ের কণ্ঠ অনেক মিষ্টি, মোলায়েম এবং নম্র। তোমার কণ্ঠ রুক্ষ এবং কর্কশ।
নেকড়ে এ কথা শুনে তাড়াতাড়ি ফিরে গেল। একটু পরে আবারও এল। দরোজায় শব্দ করল। বাচ্চারাও আগের মতোই বলল: কে দরোজায় টোকা দিচ্ছে। নেকড়ে এবার তার কণ্ঠটাকে নরম করে বলল: আমি, তোমাদের মা মনি! তোমাদের জন্যে খাবার নিয়ে এসেছি, দরোজা খোল।
বাচ্চারা দরোজার ফাঁকফোঁকর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল। এরপর বলল: তুমি মিথ্যা বলছো! আমাদের মায়ের হাতগুলো সাদা, সুন্দর! কিন্তু তোমার হাত কালো! তুমি আমাদের মা নও, তুমি চলে যাও!
নেকড়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল একটা ফ্লাওয়ার মিলে মানে গম ভাঙার দোকানে। সেখানে গিয়ে আটার একটা বস্তার ভেতর তার হাত দুটো ঢুকিয়ে দিয়ে সাদা করে নিলো। এবারও ফিরে এসে আগের মতোই দরোজায় টোকা দিল। বাচ্চারাও আগের মতোই ফাঁকফোকর দিয়ে দেখে নিয়ে বলল: আমাদের মায়ের পাগুলো কতো সুন্দর, লা..ল। তোমার পা নোংরা এবং কালো। তুমি আমাদের মা নও, তুমি চলে যাও!
নেকড়ে এবার ফিরে গিয়ে পায়ে মেহেদির রং লাগিয়ে লাল করে নিলো। পা লাল করে এবার নেকড়ে দরোজায় এসে টোকা দিতেই বাচ্চারা আগের মতোই দেখে নিল এবং এবার ভুল করে বসল। বুঝতেই পারে নি যে এটা নেকড়ের চালাকি। দরোজা খুলে দিল। নেকড়ে ভেতরে ঢুকেই শাঙুল আর মাঙুলকে ধরে খেয়ে ফেললো। আর হাব্বে আঙুর গিয়ে লুকিয়ে পড়ল পানির লাইনের একটা গর্তে। সন্ধ্যা গড়িয়ে এল। যাঙুলে প ছাগলের এবার ঘরে ফেরার পালা।
যাঙুলে প ছাগল বাসায় ফিরতেই দেখল ঘরের দরোজা খোলা। তার তো পিলে চমকে গেল। একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল সে। বাচ্চাদের ডাকল। কোনো সাড়াশব্দ পেল না। আরো জোরে ডাকল। হাব্বে আঙুর গর্ত থেকেই মায়ের কণ্ঠ বুঝতে পেল এবং বেরিয়ে এসে খুলে বলল যা যা ঘটে গেছে। মা জিজ্ঞেস করল: নেকড়ে এসেছিলো না শেয়াল!
হাব্বে আঙুর বলল: আমি এতো বেশি উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম যে বুঝে উঠতে পারি নি, শেয়াল না নেকড়ে ছিল ওটা।
ছাগল গেল শেয়ালের কাছে। জিজ্ঞেস করল: আমার শাঙুল মাঙুলকে তুই খেয়েছিস?
শেয়াল বলল: না, আমি খাইনি। তুমি আমার ঘরে এসে দেখো, কিছুই নাই। আমার পেটটা দেখো, খিদেয় কেমন পিঠের সাথে লেগে গেছে। এটা নেকড়ের কাজ।
যাঙুলে প গেল নেকড়ের কাছে। গিয়েই সে উঠে গেল ছাদের পরে। নেকড়ে তখন তার বাচ্চার জন্যে অশ্ মানে এক ধরনের সব্জি স্যুপ বানাচ্ছিল। যাঙুলে প এখানে ওখানে সবখানে খুঁজতে লাগল। তার পায়ের শব্দ শুনে নেকড়ে চীৎকার করে বলল: ছাদের ওপর কে ফুটবল খেলছে? অশে ময়লা বালি পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে…
ছাগল কবিতার মতো করে বলল:
আমি আমি যাঙুলে পা, লাফাচ্ছি দু পা, দু পা..
চার পায়ের ক্ষুর মাটির ওপর, দুই শিং আমার শূণ্যে তোলা
কে নিয়েছে শাঙুল আমার খেয়েছে মাঙুল কে
যুদ্ধ করবো তার সাথে, কবে আসবে সে?
নেকড়ে জবাব দিল:
আমি আমি, ধারালো দাঁতের নেকড়ে যে।
শাঙুল তোর খেয়েছি আমি খেয়েছি তোর মাঙুলে
তোর সাথে লড়বো আমি রেডি থাকিস জুমাবারে
ছাগল নিজের বাসায় ফিরে গেল। সেখান থেকে গেল চারণভূমিতে। পেট ভরে একেবারে ঠেঁসে ঘাস লতাপাতা খেল। পরদিন গেল দুধ দোহনকারীর কাছে যেন তার দুধগুলো দোহন করে দেয়। প্রচুর মালাই, মাখন তৈরি করল সেই দুধ থেকে। সেগুলো নিয়ে সে গেল শানওয়ালার কাছে। শানওয়ালাকে ছাগল বলল: আমার শিং দুটোকে ভালো করে শানিয়ে চোখা করে দাও। শানওয়ালা তার জন্যে দুটো ইস্ফাতের শিংই তৈরি করে দিল। সেগুলো সেঁটে দিল যাঙুলে প’র শিঙর ওপর।
এদিকে, নেকড়ে গেল দাঁতের ডাক্তারের কাছে। বলল আমার দাঁতগুলোকে তীক্ষ্ণধার করে দাও! ডাক্তার বলল আমার মজুরি কই?
নেকড়ে বলল: মজুরি দিতে হবে?
ডেন্টিস্ট বলল: তেল ছাড়া ভাজা মচমচে হয় না।
অগত্যা নেকড়ে ঘরে ফিরে গিয়ে একটা বস্তা ভর্তি করে আবার এল। ডেন্টিস্টকে বস্তাটা দিল। ডেন্টিস্ট কৌতূহলবশত বস্তার মুখ খুলতেই ভেতর থেকে বাতাস বেরিয়ে এল, আর কিছুই ছিল না বস্তার ভেতর। ডেন্টিস্ট রেগে গেল কিন্তু প্রকাশ করল না। ভেতরেই জমিয়ে রাখলো রাগ। শুরু হলো দাঁতের চিকিৎসা। ডেন্টিস্ট নেকড়ের সব দাঁত তুলে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে জমাট তুলা ভরে রেখে দিল। বাতাস ভর্তি বস্তার বিনিময় পুরস্কার।
জুমার দিন দু’পক্ষই গেল যুদ্ধের ময়দানে। ঘোষণা করা হলো, লড়াই শুরু করার আগে পানি খেয়ে নেওয়ার নিয়ম। ছাগল পানিতে মুখ রাখল ঠিকই, কিন্তু খেল না। নেকড়ে একেবারে পেট ভরে পানি খেল। গোল এবং ভারি হয়ে গেল তার পেট। তারপর শুরু হলো যুদ্ধ। নেকড়ে ছাগলের গলায় কামড় দিতে ছুটে গেল। কিন্তু কামড় দিতে পারল না। পাল্টা আঘাতে ছাগল নেকড়ের থলথলে পেটে ঢুকিয়ে দিল ইস্পাতের শিং। শিং দিয়ে টান মারতেই চিরে গেল পেট। ফরফর করে বেরিয়ে এল তার পেট থেকে শাঙুল আর মাঙুল।যাঙুলে প শাঙুল আর মাঙুলকে নিয়ে গেল তার ঘরে। হাব্বে আঙুরকেও ডেকে বলল: বাচ্চারা! এরপর থেকে সতর্ক থেকো, কে শত্রু আর কে মিত্র বোঝার চেষ্টা করবে! শত্রুর জন্যে কখনোই দরোজা খুলবে না।