সূদন ছিল ভারী গরীব, তার একমুঠো অন্নের সংস্থান নাই। রোজ রোজ জুয়া খেলে লোককে ঠকিয়ে যা পাওয়া, তাই দিযে কোনরকমে তার চলে যায়। যেদিন যা উপায় করে, সেইদিনই তা খরচ করে ফেলে, একটি পয়সাও হাতে রাখে না। এই রকম কয়েক বছর কেটে গেল; ক্রমে সূদনের জ্বালায় গ্রামের লোক অস্থির হয়ে পড়ল, পথে তাকে দেখলেই সকলে ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা দেয়। সে এমন পাকা খেলোযাড় যে কেউ তার সঙ্গে বাজি রেখে খেলতে চায় না।
একদিন সূদন সকাল থেকে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, গ্ৰামময় ঘুরেও কাউকে দেখতে পেল না। ঘুরে ঘুরে নিরাশ হয়ে সূদন ভাবল – “শিব মন্দিরের পুরুতঠাকুর ত মন্দিরেই থাকে—যাই, তার সঙ্গেই আজ খেলব।” এই ভেবে সূদন সেই মন্দিরে চলল। দূর থেকে সূদনকে দেখেই পুরুত ঠাকুর ব্যাপার বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি মন্দিরের অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ল।
মন্দিরের পুরুতকে না দেখতে পেয়ে সূদন একটু দমে গেল বটে ; কিন্তু তখনই স্থির করল —যাঃ—তবে আজ মহাদেবের সঙ্গেই খেলব। তখন মূর্তিব সামনে গিয়ে বলল—
“ঠাকুর। সারাদিন ঘুরে ঘুরে এমন একজনকেও পেলাম না, যার সঙ্গে খেলি! রোজগারের আর কোন উপায়ও আমি জানি না, তাই এখন তোমার সঙ্গেই খেলব। আমি যদি হারি, তোমার মন্দিরের জন্য খুব ভালো একটি দাসী এনে দিব, আর তুমি যদি হার , তবে তুমি আমাকে একটি সুন্দরী মেয়ে দিবে—আমি তাকে বিয়ে করব” এই বলে সূদন মন্দিরের মধ্যে খুঁটি পেতে খেলতে বসে গেল। খেলার দান ন্যায়মত দুই পক্ষই সুদন দিচ্ছে –
একবার নিজের হয়ে একবার দেবতার হয়ে খেলছে। অনেকক্ষণ খেলার পর শেষে সুদনেরই জিত হল। তখন সে বলল—“ঠাকুর। এখন ত আমি বাজি জিতেছি, এবার পণ দাও।” পাথরের মহাদেব কোনো উত্তর দিলেন না। একবোরে নির্বাক রইলেন। তা দেখে সূদনের হল রাগ। “ বটে ! কথার উত্তর দাও না কেমন দেখে নেব”—এই বলেই সে করল কি, মহাদেবের সম্মুখে যে দেবীমূর্তি ছিল সেটি তুলে নিয়েই উঠে দৌড়।
সূদনের স্পর্ধা দেখে মহাদেব ত একেবারে অবাক! তখনি ডেকে বললেন “ আরে , আরে, করিস কি? শীগগির দেবীকে বেখে যা। কাল ভোরবেলা যখন মন্দিরে কেউ থাকবে না, তখন আসিস, তোকে পণ দিব।” এ কথায় সূদন দেবীকে ঠিক জায়গা রেখে চলে গেল।
এখন হয়েছে কি , সেই রাতে একদল স্বর্গেরা অন্সরা এল মন্দিরে পুজো করতে। পূজোর পর সকলে স্বর্গে ফিরে যাবার অনুমতি চাইলে, মহাদেব রম্ভা ছাড়া সকলকে যেতে বললেন, সকলেই চলে গেল, রইল শুধু রম্ভা। ক্রমে রাত্রি প্রভাত না হতে সূদন এসে হাজির ৷ মহাদেব রম্ভাকে পণস্বরূপ দিয়ে তাকে বিদায দিলেন।
সূদনের আহ্লাদ দেখে কে! অন্সরা স্ত্রীকে নিয়ে অহংকারে বুক ফুলিয়ে সে বাড়ি ফিরে এল। সূদনের বাড়ি ছিল একটা ভাঙাকুড়ে , অন্সরা মায়াবলে আশ্চর্য সুন্দর এক বাড়ি তৈরী করল। সেই বাড়িতে তারা পরম সুখে থাকতে লাগল। এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল!
সপ্তাহে একদিন, রাত্রে অন্সরাদের সকলকে ইন্দ্রেব সভায হাজিব থাকতে হয়। সেই দিন উপস্থিত হলে, রম্ভা যখন ইন্দ্রের সভায় যেতে চাইল, তখন সূদন বললে—“আমাকে সঙ্গে না নিলে কিছুতেই যেতে দেব না।” মহা মুশকিল। ইন্দ্রেব সভায় না গেলেও সর্বনাশ—দেবতাদেব নাচ গান সব বন্ধ হয়ে যাবে— আবার সূদনও কিছুতেই ছাড়ছে না। তখন রম্ভা মায়াবলে সূদনকে একটা মালা বানিয়ে গলায় পরে নিয়ে ইন্দ্রের সভায় চলল। সভায় নিয়ে সূদনকে মানুষ করে দিলে পরে, সে সভার এক কোণে লুকিযে বসে সব দেখতে লাগল। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হলে, নাচগান সব থেমে গেল। রম্ভা সুদনকে আবার মালা বানিয়ে গলায় পরে চলল তার বাড়িতে। ক্রমে সূদনকে বাড়ির কাছে একটা নদীর কাছে এসে রম্ভা তাকে আবার মানুষ করে দিল, তখন সূদন বলল –“ তুমি বাড়ি যাও, আমি এই নদীতে স্নান ও আহ্নিক করে পরে যাচ্ছি।
এই নদীর ধারে ছিল ত্ৰিভূবন তীর্থ। এখানে দেবতারা পর্যন্ত স্নান করতে আসতেন।
সেদিন সকালেও ছোটখাটো অনেক দেবতা নদীর ঘাটে স্নান করছিলেন। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখে সূদন চিনতে পারল— তারা রাত্রে ইন্দ্রের সভায় রম্ভাকে খুব খাতির করছিলেন। সূদন ভাবল –আমার স্ত্রীকে এরা এত সম্মান করে তাহলে আমাকে কেন করবে না?” এই ভেবে সে খুব গম্ভীর ভাবে তাদের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল—যেন সেও ভারি একজন দেবতা। কিন্তু দেবতারা তাকে দেখে অত্যন্ত অবজ্ঞা করে তার দিকে ফিরেও চাইলেন না। —তারা তাদের স্নান ও আহ্নিকেই মন দিলেন। এ তাচ্ছিল্য সূদনের সহ্য হল না। সে করল কি, একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে দেবতাদের বেদম প্রহার দিয়ে বলল—“এতবড় আস্পর্দ্ধা ! আমি রম্ভার স্বামী, আমাকে তোরা জানিস নে?” দেবতারা মার খেয়ে ভাবলেন “কি আশ্চর্য। রম্ভা কি তবে মানুষ বিয়ে করেছে? তারা তখনই স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রের কাছে সব কথা বললেন।
এদিকে সূদন বাড়ি গিয়েই হাসতে হাসতে স্ত্রীর কাছে তার বাহাদুরির কথা বলল। শুনে রম্ভার ত চক্ষুস্থির, স্বামীর নিবুদ্ধিতা দেখে লজ্জায সে মরে গেল, আর বলল-—“তুমি সর্বনাশ করেছ। এখনি আমাকে ইন্দ্রের সভায যেতে হবে।” দেবতারা ইন্দ্রের কাছে গিয়ে নালিশ করলে পর ইন্দ্রের যা রাগ। এতবড় স্পর্দ্ধা। স্বর্গের অঙ্গরা হয়ে রম্ভা পৃথিবীর মানুষ বিয়ে করেছে? ঠিক সয়য রত্তাও গিয়ে সেখানে উপস্থিত! তাকে দেখেই ইন্দ্রের রাগ শতগুণ বেড়ে উঠল। আর তিনি তৎক্ষণাৎ শাপ দিলেন, “ তুমি স্বর্গের অন্সরা হয়ে মানুষ বিয়ে করেছ, আবার তাকে লুকিয়ে স্বর্গে এনে আমার সভায় নাচ দেখিয়েছ এবং স্পর্দ্ধা করে সেই লোক আবার দেবতাদের গায়ে হাত তুলেছেঃ অতএব, আমার শাপে তুমি আজ হতে দানবী হও। বাবাণসীতে বিশ্বেশ্বরের যে সাতটি
মন্দির আছে সেই মন্দির চুবমার করে আবার যতদিন কেউ নতুন করে গড়িয়ে না দেবে, ততদিন তোমার শাপ দূব হবে না।
রম্ভা তখনি পৃথিবীতে এসে সূদনকে শাপের কথা জানিযে বলল—“আমি এখন দানবী হয়ে বারাণসী যাব। সেখানে বারাণসীর বাজকুমারীর শবীরে ঢুকব, আর লোকে বলবে রাজকুমারীকে ভূতে পেযেছে। রাজা নিশ্চয়ই যত ওঝা কবিবাজ ডেকে চিকিৎসা করবেন , কিন্তু আমি তাকে ছাড়ব না, তাই কেউ রাজকুমারীকে ভালো করতে পারবে না। এদিকে তুমি বারাণসী গিয়ে বলবে যে, তুমি বাজকুমারীকে আরাম করতে পারো। তারপর তুমি বুদ্ধি করে ভূত ঝাড়ানোর চিকিৎসা আরস্তু করলে আমি একটু একটু করে রাজকুমাবীকে ছাড়তে থাকবো। তাবপর তুমি রাজাকে বলবে যে, তিনি বিশ্বেশ্বরের সাতটা মন্দির চুর্ণ করে, আবার যদি নুতন করে গড়িয়ে দেন। তবেই রাজকুমারী সম্পূর্ণ আরাম হবেন। রাজা অবশ্য তাই করবেন আর তাহলেই আমার শাপ দূর হবে। তুমিও অগাধ টাকা পুরস্কার পেয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে।” এই কথা বলতে বলতেই রস্তা হঠাৎ দানবী হয়ে, তখনই চক্ষের নিমেষে বারাণসী গিয়ে একেবারে রাজকুমারীকে আশ্ৰয করে বসল।
রাজকুমারী একেবারে উন্মাদ পাগল হয়ে, বিড় বিড় করে বকতে বকতে সেই যে ছুটে বেরুলেন, আর বাড়িতে ঢুকলেনই না। তিনি শহরের কাছেই একটা গুহার মধ্যে থাকেন, আর রাস্তা দিয়ে লোকজন যারা চলে তাদের গায়ে ঢিল ছুড়ে মারেন। রাজা কত ওঝা বদ্যি ডাকলেন, রাজকুমারীর কোন উপকারই হলো না। শেষে রাজা ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন, — “যে রাজকুমারীকে ভাল করতে পারবে, তাকে অর্ধেক রাজত্ব দিব—রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে দিব।”
রাজবাড়ীর দরজার সামনে ঘন্টা ঝুলান আছে, নতুন ওঝা এলেই ঘন্টায় ঘা দেয়, আর তাকে নিয়ে গিয়ে রাজকুমারীর চিকিৎসা করান হয়। সূদন রম্ভার উপদেশ মতো বারাণসী গিয়ে রাজকুমারীর পাগল হওয়ার কথা শুনে ঘন্টায় ঘা দিল। রাজা তাকে ডেকে বললেন— “ ওঝার জ্বালায় অস্থির হয়েছি বাপু তুমি যদি রাজকুমাবীকে ভাল করতে না পার, তবে কিন্তু তোমার মাথাটি কাটা যাবে।” এ কথায় সূদন রাজী হয়ে তখনই রাজকন্যার চিকিৎসা, আরম্ভ করে দিল।
ভূতের ওঝারা ভড়ংটা করে খুব বেশী , সূদনও সেসব করতে কসুর করল না। ঘি, চাল, ধুপ, ধূনা দিয়ে প্রকাণ্ড যজ্ঞ আরস্ত করে দিল, সঙ্গে সঙ্গে বিড় বিড় করে হিজিবিজি মন্ত্র পড়াও বাদ দিল না। যজ্ঞ শেষ করে সকলকে সঙ্গে নিয়ে সেই পৰ্বতের গুহায় চলল, যেখানে রাজকন্যা থাকে। সেখানে গিয়েও বিড় বিড় করে খানিকক্ষণ মন্ত্র পড়ল— ‘‘ভূতের বাপ— ভূতের মা—ভূতের ঝি,—ভূতের—ছা—দুর দুর দূর, পালিয়ে যা”। ক্রমে সকলে দেখল যে, ওঝার ওষুধে একটু একটু করে কাজ দিচ্ছে। কিন্তু ভূত বাজকুমারীকে একেবাবে ছাড়ল না। তিনি তখনও গুহার ভিতরেই থাকেন, কিছুতেই বাইরে আসলেন না। যা হোক, রাজা সূদনকে খুব আদর যত্ন করলেন, আর, যাতে ভূত একেবারে ছেড়ে যায়, সেটার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। দুদিন পর্যন্ত সুদন আরো কত কিছু ভড়ং করল। তৃতীয় দিনে সে রাজার কাছে এসে বলল—“ মহারাজ রাজ কুমারীর ভূত বড় সহজ ভূত নয়— এ হচ্ছে দৈবী ভূত। মহারাজ যদি এক অসম্ভব কাজ করতে পারেন—বিশ্বেশ্বরের সাতটা মন্দির চুরমার করে, আবার নুতন করে ঠিক আগের মত গড়িয়ে দিতে পারেন, —তবেই আমি রাজকন্যাকে আরাম করতে পারি।”
রাজা বললেন– “এ আর অসম্ভব কি?” রাজার হুকুমে তখনই হাজার হাজার লোক লেগে গেল। দেখতে দেখতে মন্দিরগুলি চুরমার হয়ে গেল। তারপর এক মাসের মধ্যে আবার সেই সাতটি মন্দির ঠিক যেমন ছিল তেমনটি করে, নতুন মন্দির গড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীও সেরে উঠলেন, অঙ্গরাও শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে গেল। তারপর খুব , ঘটা করে সূদনের সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে হল আর রাজা বিয়েব যৌতুক দিলেন তাব অর্ধেক রাজত্ব।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প