যুগে যুগে মানুষ যখন অমরত্বের সন্ধানে
অমরত্ব লাভের নেশায় মানুষ সেই আদিম কাল থেকেই বিভোর রয়েছে আজও পর্যন্ত। কারও কাছে অনন্ত কালের জন্য জীবন প্রত্যাশাই হলো অমরত্ব, কারও কাছে মৃত্যুর পর তাঁর কীর্তি দিয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার নামই হলো অমরত্ব আর কারও কাছে তার বয়স ধরে রাখার মাঝেই অমরত্বের স্বাদ কিংবা মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম লাভের প্রত্যাশাই হয়তবা কারও কাছে অমরত্ব।
মানুষের মরদেহকে মমি করে রাখার সময়কাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের ক্রিওনিক্স পদ্ধতি স বই মানুষের অমরত্ব লাভের নেশার প্রতিফলন স্বরূপ। এমনকি র্যাপামাইসিন নামের এক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষকে চিরযৌবন দেয়ার প্রত্যয়ে যা মানবদেহের কোষের উপর ক্রিয়াশীল। অসংখ্য কল্প কাহিনী লেখা হয়েছে এই অমরত্বকে কেন্দ্র করে। এমনকি বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছে সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। জেমস ক্যামেরুন নির্মিত এভাটার চলচ্চিত্রটির কথাও ধরা যেতে পারে, যেখানে মানুষকে যন্ত্রের সাহায্যে দেয়া হয়েছে এক ভিন্ন মানব রূপের। যার পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে যন্ত্রের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল।
হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড তার বিখ্যাত নোভেল শী এবং রিটার্ণ অফ শী-তেও দেখিয়েছেন অমরত্ব লাভের নেশায় আয়েশা নামক এক চরিত্রের, যে কিনা বেঁচে থেকেছে অনন্ত কাল ধরে শুধু মাত্র তার ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে পাওয়ার জন্য। কবি জীবনানন্দ দাশ প্রিয় স্বদেশ ভূমিকে ভালোবেসে লিখেছেন; আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হ’য়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে…  
হিন্দু পুরাণ এবং মিশরীয় পুরাণের দুইজন দেবতার মূর্তির মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান হিন্দু ধর্মে দেবতা বিষ্ণু তাঁর দশটি রূপে আবির্ভূত হয়েছেন মানুষের কল্যাণে ব্রত হয়ে। বিষ্ণুর দশ অবতার হলো;
১. মৎস্য – মাছের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
২. কূর্ম – কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৩. বরাহ – শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৪. নৃসিংহ – অর্ধনরসিংহ রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৫. বামন – বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৬. পরশুরাম – পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৭. রাম – রামচন্দ্র অযোধ্যার রাজপুত্রের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৮. কৃষ্ণ – দ্বাপরযুগে ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে অবতীর্ণ
৯. বুদ্ধ – কলিযুগে অবতীর্ণ
১০. কল্কি – সর্বশেষ অবতার, হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কলিযুগের অন্তে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে।
আবার, শয়তান মানুষের অনিষ্ট সাধন করে তাদেরকে আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যূত করার প্রত্যয়ে খোদ মহান আল্লাহ্ তাআলার কাছেই চেয়েছে কেয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার শক্তি। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই চলে আসছে অমরত্বের নেশা। অমরত্বের সন্ধানে মানুষ বহু প্রাচীন কাল থেকেই করে আসছে আলকেমি নামক এক বিশেষ শাস্ত্রের চর্চা।
আলকেমি শব্দের উৎপত্তি আরবি আল কিমিয়া শব্দ থেকে যার প্রাচীন গ্রিক রূপ কেমিয়া। আলকেমি হচ্ছে সেই শাস্ত্র যার চর্চার মাধ্যমে লাভ করা যায় পরিপূর্ণতা, ধাতুকে পরিণত করা যায় স্বর্ণে, আর মানুষ লাভ করতে পারে অমরত্ব। আলকেমিতে দরকার একটি অদৃশ্য আধ্যাত্মিক শক্তির অতিপ্রাকৃত সাহায্য যেটা ছাড়া কোন আলকেমিক্যাল কাজ সম্পূর্ণ হবে না। এ আধ্যাত্মিক সাহায্য আসতে পারে ভাল দিক থেকে অথবা খারাপ দিক থেকে। যখন খারাপ শক্তি ব্যবহার করে করা হয় তখন তাকে বলা হয় ডার্ক আর্টস। 
গ্রীসে মারিয়া ইতিহাসের প্রথম আলকেমিস্ট হিসেবে পরিচিতি। জন্মসূত্রে ইহুদী হওয়ায় ডার্ক আর্টস সম্পর্কে তাঁর জানা ছিলো। মিশরের মেমফিস নগরীতে তাঁর সাথে পরিচয় হয় ডেমোক্রিটাস নামের একজনের সাথে, যাকে তিনি বাস্তব রসায়ন নিয়ে হালকা ধারণা দেন। ইতিহাসে ডেমোক্রিটাসের নাম এখনও স্মরণীয়। মারিয়া স্বর্ণ বানাতে পারতেন।
মুসলিম বিশ্বে আলকেমি সূচনা করেন জাবির ইবনে হাইয়ান এবং প্রথমবারের মতো তিনি আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে আল্লাহর সাহায্যের কথা উল্ল্যেখ করেন। তারপরের সময়টা আরেক কিংবদন্তী নিকোলাস ফ্লামেলের। যিনি তাঁর বইয়ের দোকানে একদিন এক হকারের কাছে পান আলকেমির উপর লেখা ইহুদী যুবরাজ আব্রাহাম এর একটি পান্ডুলিপি। তারপর তিনি ছুটতে থাকেন অমরত্বের সন্ধানে। একটা সময় তিনি গবেষণা করে পারদকে রূপোয় পরিণত করতে সক্ষম হন। তারপর পরিণত করতে সক্ষম হন নিখাদ স্বর্ণে। তাঁর আলকেমি গবেষণার আসল লক্ষ্য ছিলো অমরত্ব লাভ।
তাঁর স্ত্রী পেরেনেল এর মৃত্যুর পর জীবনের শেষ কয়েকটা দিন তিনি আলকেমির বই লিখেই কাটিয়েছেন। এই সময়ে তিনি কবরস্থানে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে লিখে দিলেন, তাঁকে কোথায় কীভাবে কবর দিতে হবে। তাঁর কবরের এপিটাফে কী লেখা থাকবে সেটাও প্রস্তুত করে ফেললেন তিনি। সেই পাথরের ফলকে থাকবে অনেক অনেক চিহ্ন, আর একটি সূর্যের ছবি, একটি চাবির ছবি আর একটি বন্ধ বই এর ছবি সাথে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনারত ভঙ্গিতে আছেন এমন অবস্থায়। অবশেষে একদিন জানা গেলো ফ্লামেল মারাই গিয়েছেন।