মঙ্গলে কলোনী স্থাপন করার চিন্তা মানবজাতির মাথায় কখন এসেছিল, জানেন? যখন, পৃথিবীতে আর মানুষের থাকার মত জায়গা ছিল না, তখন একদিন সে এই নি:ষ্প্রাণ লাল গ্রহের দিকে তাকিয়ে ভাবল, আরে ঐ টা ত খালি, এমনিই পড়ে আছে। ওখানেই যাই না কেন? কিন্তু এ ত আর পাশের বাড়ী নয়, যে মন চাইল আর চলে গেলাম!! কত প্রস্তুতি, কত কিছু করে যেতে হবে। অভিবাসীদের অভ্যাস এমনকি গঠনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না আনলে ত, মঙ্গলে টিকতেই পারবে না। কিন্তু, কাজে নেমে দেখা গেল, এই পরিবর্তনের ব্যাপারটা খুব কঠিন হল না। সত্যি বলতে কি, প্রতিটা খুঁটিনাটি দিক সামলানো গেল – একটা বাদে। কি করা যাবে, সেটা যে মানুষের প্রকৃতিগত দোষ।
এত সহজে সব সামলানোর কৃতিত্ব ড্যাপটিনের। প্রথম প্রথম সবাই এ্যাডাপ্টিন বলত, পরে নাম ছোট হয়ে হয়ে ড্যাপটিন। ড্যাপটিনের কাজ? আমাদের এ্যাডাপ্ট মানে মানিয়ে নিতে সাহায্য করা।
আমার মনে আছে, যখন আমাদেরকে প্রথমবার ওরা সব বুঝিয়ে বলেছিল, তখন আমি ১০ বছরের বালক। আমার মনে হয়, ওরা ভেবেছিল এর আগে বললে আমরা কিছুই বুঝব না। কিন্তু আসলে, আমরা অনেক কিছু আগে থেকেই জানতাম। মঙ্গলে যেদিন অবতরণ করি, সেদিনই আমাদের সব খুলে বলেছিল।
’তোমরা তোমাদের আবাসে এসে পড়েছ, বাচ্চারা।’, হেড টীচার এভাবেই শুরু করেছিলেন। আমরা তখন গ্লাসাইটের ডোমের ভিতরে; সকালের দিকে, মানে মঙ্গলের সকাল আর কি, এসে পৌছেছি। আমাদেরকে বলা হয়েছিল, সন্ধ্যায় আমাদের সামনে হেড টীচার কিছু কথা বলবেন।
সেদিন সন্ধ্যায় উনি সব বিস্তারিতভাবে বলেছিলেন – কি, কেন, কিভাবে? আমাদেরকে এক জায়গায় জড়ো করে, একটা স্পেস স্যুট পড়ে, বলেছিলেন। ও হ্যা, সাথে উনার মাথায় হেলমেটও ছিল। কি অদ্ভুত, তাই না? কিন্তু বেচারার আর দোষ কি? মঙ্গলে যে তাপমাত্রা, তাতে আমাদের অসুবিধা নাহলেও, তিনি ত স্যুট না হলে জমে যেতেন। আর উনার গলার যে জোর, তাতে কানের কাছে মুখ নিয়ে গেলেও কেউ কোন কথা শুনতে পেত না। আর বাতাসের কথা কি বলব? তার শ্বাস নেবার জন্য অসম্ভব। মাঝে মাঝে মায়াই লাগে বেচারার জন্য।
’বাচ্চারা,’ তিনি বললেন, ‘এটাই এখন তোমাদের বাড়ী। এই গ্রহের নাম মঙ্গল। তোমরা তোমাদের বাকি জীবন এখানেই থাকবে। তোমরা হলে মঙ্গলের অধিবাসী – মার্শিয়ান, একেবারে প্রথম মার্শিয়ান। তোমরা জীবনের প্রথম পাচ বছর পৃথিবীতে ছিলে, পরের পাচ বছর ছিলে মহাশুণ্যে। এবার এই ডোমে, প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগ পর্যন্ত, মানে পরের দশ বছর থাকবে। অবশ্য শেষের দিকে, আস্তে আস্তে দিনের অনেকটা সময় ডোমের বাইরে কাটাতে পারবে।’
’আর যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাবে, তখন নিজেরাই নিজেদের ঘর বানাবে, নিজদের পরিচালনা নিজেরাই করবে। সংসার করবে, বাচ্চা কাচ্চাদিয়ে গ্রহটাকে ভরিয়ে তুলবে। তারাও হবে তোমাদের মতই মার্শিয়ান। ‘
’সময় এসেছে সব খুলে বলার – এই পরীক্ষাটা কেন করা হচ্ছে, উদ্দেশ্য কি, কি আশা করছি আমরা এখান থেকে, সব।’
সবকিছুই তিনি খুলে বললেন। বললেন, ১৯৮৫ সনে মানুষ প্রথমবারের মত মঙ্গলে পৌছে। সে দেখতে পায়, বুদ্ধিমান প্রাণীহীণ একটা গ্রহ। কিছু গাছ-গাছড়া আর পোকা-মাকড় দেখলেও, বুদ্ধিমান প্রাণী নজের পড়েই নি। সে বুঝতে পারে যে, এই গ্রহ এখন পর্যন্ত বসবাসের অনুপযোগী। কেবলমাত্র গ্লাসাইটের ডোমের ভিতরে থাকা ছাড়া সে এই গ্রহে টিকতে পারবে না। বাইরে গেলেও স্যুট পড়া ছাড়া গতি নেই। কেননা, গরমের মৌসুমেও, তাপমাত্রা মানুষের টিকে থাকার জন্য অনেক কম, বাতাস শ্বাস নেবার জন্য অপর্যাপ্ত। এমনকি সুর্যের আলো তার জন্য ক্ষতিকর, কেননা পৃথিবীর মত ওজোন স্তর এখানে নেই। এই গ্রহে জন্মানো গাছ-গাছড়া সে খেলে, বিষ ক্রিয়ায় মারা যাবে। তাই পৃথিবী থেকে খাবার আনা বা ডোমের ভিতর ফলানো ছাড়া গতি নেই।
পঞ্চাশ বছর ধরে বার বার চেষ্টা করলেও, সফলতা এসে হাতে ধরা দেয় নি। এই যে, আমাদের জন্য বানানো এই ডোম বাদে কেবল আর একটা আউটপোস্ট আছে মঙ্গলে। সেটাও গ্লাসাইটের তৈরী, এক মাইলও দূরে হবে না।
একসময় মনে হচ্ছিল, মানবজাতির বোদহয় পৃথিবী বাদে অন্য কোন গ্রহে বসতি স্থাপন করা হবে না। কারণ, মঙ্গল হচ্ছে, সব গ্রহের মাঝে বসবাসের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। সেখানেই যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অন্য কোন গ্রহের কথা কল্পনাও করা যায় না।
কিন্তু প্রায় ত্রিশ বছর আগে, ২০৩৪ সালে, এমন একটা ঘটনা ঘটল, যা সবার চিন্তা-ভাবনাকেই পাল্টে দিল। এক ব্রিলিয়ান্ট বায়োকেমিস্ট, ওয়েমথ, ড্যাপটিন আবিষ্কার করলেন। এমন এক ওষুধ, যেটি কেউ খাবার পর, নির্ধারিত সময়ের মাঝে যতই সন্তানের জন্ম দিক না কেন, তাদের উপরেও কাজ করবে।
মানুষ এই মিরাকল ওষুধটিকে লুফে নিল। কেননা, এই ওষুধ মানুষের উত্তরসূরিকে দিল, প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেবার অভাবনীয় ক্ষমতা। অবশ্যই, খাপ খাওয়াবার এই পদ্ধতি ধীরে ধীরেই কাজ করে। কিন্তু কাজ ত করে…
ড. ওয়েমথ তার প্রথম পরীক্ষাটা চালান এক জোড়া গিনিপিগের উপর। এদের উপর ড্রাগ প্রয়োগ করেন তিনি। পরে এই জোড়া পাচটা বাচ্চার জন্ম দেয়। তিনি এই পাচটা বাচ্চাকে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিকুল পরিবেশে রেখে অসাধারণ এক গবেষণা চালান, ফলাফলও হয় অসাধারণ। দেখা গেল কি, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় একটি -৪০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় আরামে বাস করছে। আরেকটির ১৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইটেও কোন সমস্যা হচ্ছে না। তিন নম্বরটা আবার অন্যরকম, এমন বিষমিশ্রিত খাবার হজম করে ফেলছে যে, অন্য কোন প্রাণী তা খেয়ে বাঁচতে পারত না। চার নাম্বারটা এমন রেডিয়েশনে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে, এর এক-দশমাংশ রেডিয়েশনে, এরই বাবা-মা মরে ভূত হয়ে যেত!
পরবর্তি গবেষণায় আরও দেখা গেল যে, এই কয়জনের বংশধর জন্ম থেকেই যার যার পূর্বসুরির এই অসাধারণ টিকে থাকার ক্ষমতা নিয়েই জন্মেছে। ’দশ বছর, আজ থেকে ঠিক দশ বছর পূর্বে,’ হেড টীচার আমাদেরকে বললেন, ‘তোমরা জন্মেছিলে। তোমাদের পিতা মাতাকে আমরা খুব সাবধানতার সাথে বেছে নিয়েছিলাম। তোমাদের পিতা মাতারা নিজে থেকেই এই মহান উদ্দেশ্যসাধনের জন্য রাজী হয়েছিলেন। জন্ম থেকেই তোমাদের খুব সাবধানতার সাথে আমরা বড় করে তুলেছি। আস্তে আস্তে করে তোমাদেরকে প্রতিকুল পরিবেশের সম্মুখীন করেছি।’
’তোমরা যে বাতাসে শ্বাস নিচ্ছ, তা আমরা তোমাদের জন্ম থেকেই একটু একটু করে হালকা করে সাপ্লাই দিয়েছে। আর একটু একটু করে তাতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছি। এতে তোমাদের ফুসফুসে পরিবর্তন এসেছে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। আর তাই তোমাদের বুকও এই ডোমের অন্যান্য টীচার আর অধিবাসীদের চেয়ে বড়। তোমরা যখন আরও বড় হবে, বাইরে বেরোবে, শ্বাস নেবে মঙ্গলের হালকা বাতাসে, পার্থক্যটা আরও বড় হয়ে উঠবে।’
’তোমাদের দেহে লোমের পরিবর্তে পশম উঠছে, যাতে মঙ্গলের তীব্র ঠান্ডায় তোমাদের কোন কষ্ট না হয়। তোমরা এমন পরিবেশে অভ্যস্ত, যে পরিবেশে সাধারণ যে কোন মানুষের মরতে এক মিনিটও লাগবে না। তোমাদের বয়স যখন চার, তখন থেকেই তোমাদের সেবিকা আর টীচারদের বিশেষভাবে নির্মিত স্যুট পড়তে হয়েছে। অথচ সেই পরিবেশে তোমাদের কোন কষ্টই হয় নি।’
’আরও দশ বছর পর, যখন তোমরা প্রাপ্তবয়স্ক হবে, মঙ্গলের পরিবেশের সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে কোন অসুবিধাই হবে না। মঙ্গলের বাতাসই হবে তোমাদের বাতাস, মঙ্গলের খাবারই তোমাদের খাবার। এই গ্রহের তীব্র শীত বা গরমে কোন কষ্টই হবে না। এর স্বাভাবিক তাপমাত্রা তোমাদের কাছে মনে হবে আরামদায়ক। স্পেস শীপে গত পাচ বছরে আমরা অভিকর্ষও আস্তে আস্তে কমিয়ে এনেছি। তাই মঙ্গলের স্বল্প টান তোমাদের কাছে স্বাভাবিক লাগবে।’
’মঙ্গলে হবে তোমাদের গ্রহ, এই গ্রহে তোমরা বাস করবে, এই খানেই তোমরা বংশ বিস্তার করবে। তোমারা পৃথিবীর সন্তান, কিন্তু একই সাথে প্রথম মার্শিয়ান।’ বলাই বাহুল্য, এসবের অনেক কিছু আমরা আগে থেকেই জানি।
শেষ বছরটা যেন চোখের পলকে কেটে গেল। ততদিনে ডোমের ভিতরের বাতাস, ঘনত্ব আর অক্সিজেনের দিক থেকে প্রায় বাইরের মতই করে ফেলা হয়েছে। অবশ্য যে এলাকায় টীচাররা আর অন্য অধিবাসীরা থাকেন, সেই দিকের বাতাস পৃথিবীর মতই। আমাদেরকেও আর বন্ধি থাকতে হচ্ছে না, আগের চেয়ে অনেক বেশী সময় ধরে আমরা বাইরে থাকার সুযোগ পাচ্ছি। আহ, স্বাধীনতা কত মজার।
শেষের দিন গুলোতে, ছেলে-মেয়ে আলাদা রাখার কড়াকড়িটা বলতে গেলে প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল ওরা। অবশ্য, আমরা যাতে আমাদের জোড়া খুঁজে নিতে পারি, সে জন্য ব্যাপারটা জরুরীও ছিল বটে। তবে, তারা আমাদেরকে শক্তভাবেই জানিয়ে দিয়েছিল – একেবারে শেষ দিনের আগে কোন বিয়ে হবে না। আমি অবশ্য সহজেই আমার জোড়া খুঁজে পেয়েছি। মেয়েটিও আমাকে পছন্দই করে বলেই জানি, মনে হয় না আপত্তি করবে।
আগামীকাল থেকে আমরা স্বাধীন, আগামীকাল থেকে আমাদের পরিচয় হবে – আমরা মার্শিয়ান। আগামীকাল থেকে আমরাই এ গ্রহের রাজা। আমাদের মধ্যে অনেকেই অধৈর্য হয়ে পড়েছে, আসলে বেশ কিছু সপ্তাহ আগেই। কিন্তু, আমাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান, তারা ঐ অধৈর্য ভাই-বোনদের বোঝাতে পেরেছে। তাই আমরা এখন অপেক্ষা করছি। আসলে অপেক্ষা করছি ২০ বছর ধরেই, এক দিন আর বেশি কি?
কালকেই ত অবসান হবে সব অপেক্ষার।
কালকে, সিগন্যাল পেতেই, আমরা এই ডোমের সব টীচার আর পৃথিবীবাসীকে মেরে ফেলব। মার্শিয়ান হিসেবে এটাই হবে আমাদের প্রথম কাজ। ঐ গর্দভ পৃথিবীবাসীরা এমনটা ঘটার কথা আঁচও করতে পারবে না। বিশ বছর হল, আমরা আমাদের আসল অনুভুতি লুকিয়ে রেখেছি। ওদের কোন ধরণাই নেই যে, আমরা ওদেরকে কতটা ঘৃণা করি। ওদেরকে দেখতে যে কতটা কদর্য আর বিভৎস লাগে, তা আমরাই জানি। শরীরের গঠনটাই যেন কেমন – আকার ঠিক নেই, ছোট বক্ষ, সরু কাধ…. ছি। গলা দিয়েও যেন কেমন কেমন আওয়াজ বের হয় – তীক্ষ্ণ, ক্ষীণ। এ্যামপ্লিফায়ার বাদে শোনাই যায় না। সবচেয়ে বাজে লাগে ওদের লোমদীন, চকচকে চামড়া।
আমরা শুরু করব, আমাদের ডোম দিয়ে। এরপর, একে একে অন্য ডোমগুলোও ভেংগে ফেলব। আমাদের মঙ্গলে কোন পৃথিবীবাসিই থাকতে পারবে না। আর, পরে কখনও আমাদের সাজা দিতে আরও পৃথিবীবাসী এলেই বা কি? আমরা পাহাড়ে এমনভাবে লুকিয়ে থাকব, যেন আমাদের খুজেই না পায়। আর যদি কখনো নতুন ডোম বানাতে চায়, তাহলে স্যাবটাজ করে ফেলব। আমরা আমাদের গ্রহে কোন পৃথিবীবাসী চাই না।
এই গ্রহ, আমাদের গ্রহ। আমাদের গ্রহে আমরা কোন এলিয়েন চাই না। দয়া করে দূরে থাকুন। নইলে কিন্তু…