ত্রাতিনা – বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী : ৩. তৃতীয় পর্ব (চার বছর পর)

ত্রাতিনা – বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী : ৩. তৃতীয় পর্ব (চার বছর পর)

৩. তৃতীয় পর্ব (চার বছর পর)

কমান্ড কাউন্সিলের বড় হলঘরটাতে সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। মহামান্য রিহা এখনো এসে পৌঁছাননি। তাই তার চেয়ারটা খালি। টেবিলের উল্টোদিকে আরো তিনটি চেয়ার খালি। এই তিনটি চেয়ারে কে বসবে, কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যদের জানানো হয়নি।

বিকেল তিনটার সময় সভা ডাকা হয়েছিল এবং একেবারে কাঁটায় কাঁটায় তিনটার সময় মহামান্য রিহা হলঘরটিতে ঢুকলেন। সবাই দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান দেখালো। মহামান্য রিহার চেহারায় বয়সের ছাপ ফুটে উঠেছে। এবং তিনি শেষ পর্যন্ত বয়সের ভারে একটু কুঁজো হয়ে হাঁটছেন। নিজের চেয়ারে বসে বললেন, “বস। তোমরা সবাই বস।”

সবাই তাদের চেয়ারে বসল। মহামান্য রিহা সবার দিকে এক নজর তাকালেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন, “আমি তোমাদের সাথে এই ঘরে অসংখ্যবার বসেছি। অসংখ্য বিষয় নিয়ে কথা বলেছি এবং অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আজকের এই সভাটিতে এসে আমার কুড়ি বছর আগের একটা সভার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।”

মহামান্য রিহার কথা শুনে বেশ কয়েকজন মাথা নাড়ল। তারা বুঝতে পেরেছে, মহামান্য রিহা কোন সভাটির কথা বলেছেন।

মহামান্য রিহা বললেন, “তোমরা যারা সেই সভাটিতে ছিলে তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সেদিন আমরা ভয়ঙ্কর একটি বিপদের মুখে ছিলাম। সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুখোমুখি হয়েছিল। পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে কখনো জানানো হয়নি, কিন্তু তোমরা জানো, তখন পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে একজন মহাকাশচারী আত্মাহুতি দিয়েছিল। একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে মহাকাশে সেই গ্রহকণাটিকে ধ্বংস করেছিল। সেই মহাকাশচারীর নাম ছিল রায়ীনা।

“পৃথিবীর মানুষ জানে না, কিন্তু সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে তোমরা জানো, সেই গ্রহকণাটি আসলে ছিল মহাজাগতিক কোনো একটি প্রাণীর মহাকাশযান। এরপর এক যুগ থেকে বেশি সময় আমরা সেই মহাজাগতিক প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে অনুসন্ধান করেছি। তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রচেষ্টা থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সেই মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। এটি সাধারণ যোগাযোগ হতে পারে, এটি একটি সংঘর্ষও হতে পারে, শেষ পর্যন্ত এটি কী হবে, আমরা জানি না। শুধু জানি, আমরা প্রথমবারের মতো মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করার জন্যে একটি অভিযান করতে যাচ্ছি।

“আমি সেই অভিযানের সদস্যদের সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাদের ডেকেছি। তোমাদের কারো কিছু বলার থাকলে বল, তারপর আমি অভিযানের সদস্যদের ডাকব।”

জীববিজ্ঞানী লিয়া সবার আগে কথা বলল, “মহামান্য রিহা, বুদ্ধিমত্তা খুবই বিচিত্র একটা বিষয়। যদি শুধুমাত্র বেঁচে থাকার কৌশলটি লক্ষ্য করি, তাহলে একটা ভাইরাস যথেষ্ট বুদ্ধিমান, কিন্তু আমরা কখনোই ভাইরাসের সাথে তথ্য বিনিময় করতে পারব না। কাজেই মহাজাগতিক প্রাণীটির বুদ্ধিমত্তা যদি আমাদের বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি হয় এবং অন্যরকম হয়, তাহলে আমরা কখনোই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারব না!”

মহামান্য রিহা শব্দ করে হাসলেন। বললেন, “লিয়া, ভাইরাসের সাথে তুলনা করার উপমাটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ভাইরাস আমাদের সাথে তথ্য বিনিময় করতে পারে না, কিন্তু আমাদের অসুস্থ করে তাদের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেয়। প্রয়োজন হলে আমরাও সেটা করব।”

পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, “এই অভিযানের কিছু বিষয়ে আমি কাজ করেছি। যোগাযোগটি করা হবে নিউট্রিনো বীম দিয়ে। আশা করছি, নতুন এই প্রযুক্তিটি আমাদের হতাশ করবে না।”

মহামান্য রিহা বললেন, “রিশি তুমি কখনোই পৃথিবীর মানুষকে কিংবা আমাকে হতাশ করোনি। আমি নিশ্চিত, এবারেও তুমি হতাশ করবে না। তোমার প্রযুক্তিটি নিশ্চয়ই কাজ করবে।”

পরিবেশ বিজ্ঞানী নীহা বলল, “সৌরজগতের বাইরে যাওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ একটি অভিযান। আশা করি, আমাদের অভিযাত্রীরা এই দীর্ঘযাত্রায় সুস্থ থাকবে।”

মহামান্য রিহা বললেন, “আমি আমাদের অভিযাত্রী দল সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। তোমরা নিজেরাই দেখবে এবং আমি নিশ্চিত, একটুখানি বিস্মিত এবং অনেকখানি অনুপ্রাণিত হবে।”

পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, “আমার মনে হয়, তাদেরকে এখন ডাকা যেতে পারে।”

মহামান্য রিহা তখন তার সামনে রাখা ঘণ্টাটিতে টোকা দিয়ে অভিযাত্রীদের ডাকার জন্যে সংকেত দিলেন। প্রায় সাথে সাথেই ত্রাতিনা এবং তার সাথে আরো দু’জন অভিযাত্রী হলঘরে এসে ঢুকল। গত চার বছরে ত্রাতিনার চেহারা থেকে কিশোরীসুলভ ভাবটি সরে গিয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন নেই। অন্য দু’জনের একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। তাদের বয়স কুড়ি থেকে চল্লিশের ভেতর যা কিছু হতে পারে।

মহামান্য রিহা তাদের বসতে বললেন এবং তারা তাদের জন্যে আলাদা করে রাখা চেয়ারে বসল।

মহামান্য রিহা বললেন, “প্রিয় সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ, আমি তোমাদের সাথে এই তিনজন অভিযাত্রীর পরিচয় করিয়ে দিই। দলপতি হচ্ছে ত্রাতিনা, তোমরা ত্রাতিনাকে কখনোই না দেখে থাকলেও তার মায়ের পরিচয় সবাই জান। সে মহাকাশচারী রায়ীনার মেয়ে।”

কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য সবাই এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকালো। পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, “ত্রাতিনা, তোমাকে অভিনন্দন। এরকম একটি অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া অনেক বড় দায়িত্ব।”

ত্রাতিনা বলল, “আমি আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করব। আমাদের উপর এই দায়িত্ব দেয়ার জন্য আমরা আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, আমার সাথে রুখ এবং গিসাকে দেয়া হয়েছে।”

জীববিজ্ঞানী লিয়া বলল, “এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযান, কিন্তু তোমার সাথে দু’জন মানুষ না দিয়ে দু’জন এনড্রয়েড দেয়া হয়েছে কেন, সেটা বুঝতে পারলাম না।”

ত্রাতিনা বলল, “সিদ্ধান্তটি আমার নয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই আনন্দিত যে আমার সাথে রুখ এবং গিসা রয়েছে। মানুষ হিসেবে আমি খুবই কোমল একটি প্রজাতি। তাপ, চাপ, রেডিয়েশান কিংবা পরিবেশের একটুখানি তারতম্য হলেই আমি ধ্বংস হয়ে যাব। সে তুলনায় রুখ এবং গিসা অত্যন্ত কঠোর পরিবেশেও টিকে থাকতে পারবে। আমাদের অভিযানের জন্যে এটি খুবই জরুরি একটি ব্যাপার।”

জীববিজ্ঞানী লিয়া হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, “আমি জানি। আমি আগের যুগের মানুষ, যন্ত্রকে কখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। সেটা রবোট হোক, আর এনড্রয়েড কিংবা সাইবর্গই হোক।”

রুখ হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, “আপনারা আমাদের বিশ্বাস। করতে পারেন।”

গিসা বলল, “যদি আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি তাহলে বলা যায় মানুষও একটি যন্ত্র। জৈবরাসায়নিক যন্ত্র। সত্যি কথা বলতে কী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জৈব রাসায়নিক যন্ত্র থেকে সাধারণ যন্ত্র বেশি কার্যকর।”

মহামান্য রিহা হাত তুলে বিতর্কটি থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ত্রাতিনা, রুখ এবং গিসা আমরা তোমাদের সফল একটি অভিযান কামনা করি।”

ত্রাতিনা বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মহামান্য রিহা।”

মহামান্য রিহা বললেন, “আমি শেষ পর্যন্ত বয়সের ভারে ক্লান্ত হতে শুরু করেছি। তুমি যখন তোমার অভিযান শেষে ফিরে আসবে, আমি তখন আর বেঁচে থাকব না। ত্রাতিনা, তোমার সাথে আজকেই হয়তো আমার শেষ দেখা।”

.

সেদিন রাত্রিবেলা মহামান্য রিহা ঘুমের মাঝে মারা গেলেন। মনে হয়, ত্রাতিনার সাথে শেষ দেখা করার জন্যেই বুঝি তিনি এতোদিন বেঁচে ছিলেন।

.

৩.২

ছোট মহাকাশযানটিতে ত্রাতিনা তার সিটে বসে আছে। তার দুইপাশে রুখ এবং গিসা। এই ছোট মহাকাশযানটি তাকে মূল মহাকাশযান পেপিরাতে পৌঁছে দেবে। এই মুহূর্তে পেপিরা চাঁদের একটি উপগ্রহ হয়ে ঘুরছে। প্রায় এক যুগ থেকে ধীরে ধীরে এটিকে প্রস্তুত করা হয়েছে। ত্রাতিনা তার দু’জন এনড্রয়েড ক্রু নিয়ে সেটাতে ওঠার পর তাদের সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া হবে। তারপর মহাকাশযান পেপিরা তার যাত্রা শুরু করবে। মহাকাশযানটির নাম পেপিরা প্রাচীন ভাষায় যার অর্থ যোগাযোগ। ত্রাতিনা কিংবা তার কু দু’জন এখনো পেপিরাকে দেখেনি। কিন্তু গত কয়েকমাস তারা পেপিরার একটি মডেলের ভেতর কাজ করেছে। কাজেই অনুমান করছে, তারা যখন সত্যিকারের পেপিরাতে পা দেবে, তখন সেটাকে খুব অপরিচিত একটা আবাসস্থল মনে হবে না।

ত্রাতিনা তার পাশে বসে থাকা রুখ এবং গিসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা প্রস্তুত?”

গিসা বলল, “আমরা অনেকদিন থেকে প্রস্তুত!”

ত্রাতিনা বলল, “এক্ষুনি কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে যাবে।”

গিসা বলল, “হ্যাঁ। আর মাত্র এক মিনিট।”

ঠিক তখন ত্রাতিনা কমান্ডার লীয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, “ত্রাতিনা আমি তোমাকে এই অভিযানের জন্যে বিদায় জানাচ্ছি। প্রায় বিশ বছর আগে আমি তোমার মাকে বিদায় জানিয়েছিলাম। সেটি ছিল সত্যিকারের বিদায়। কারণ আমরা সবাই জানতাম, তার সাথে আর দেখা হবে না। তবে তোমার বিদায়টি মোটেও সে রকম নয়। তোমার সাথে আবার দেখা হবে। আমাদের এই অভিযানটি শুরু করার জন্যে আমরা কয়েক বছর বেশি সময় নিয়েছি, শুধুমাত্র তোমাদের আবার নিরাপদে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যে।”

ত্রাতিনা বলল, “অনেক ধন্যবাদ, কমান্ডার লী।”

“তোমার সাথে আমাদের দেখা হবে আজ থেকে চব্বিশ বছর পর। চব্বিশ বছর দীর্ঘ সময়, এই দীর্ঘসময়ে পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন হবে। আমি বেঁচে থাকব কি না, আমি জানি না। কিন্তু আমরা নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছি, যেন এই দীর্ঘ সময়টি তোমার কাছে দীর্ঘ মনে না হয়। দিন শেষে তুমি যখন তোমার স্লিপিং ব্যাগে ঘুমুতে যাবে, তুমি জানতেও পারবে না যে তোমার ঘুমটি হবে দীর্ঘ। তুমি ঘুম থেকে উঠবে এক বছর পর! কাজেই বারো বছর তোমার কাছে মনে হবে মাত্র বারো দিন। কাজেই তোমার হিসেবে তুমি পৃথিবীতে ফিরে আসবে তিন থেকে চার সপ্তাহের ভেতর!”

ত্রাতিনা বলল, “আমি জানি কমান্ডার লী। আমার যাত্রাকে সহনশীল করার জন্যে তোমরা অনেক কিছু চিন্তা করেছ।”

কমান্ডার লী বলল, “তোমাকে অভিযানের অভিনন্দন!”

কমান্ডার লীয়ের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন শোনা গেল এবং সাথে সাথে একটি সুরেলা নারী কণ্ঠে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেল। সাদা জলীয় বাষ্পে চারপাশ ঢেকে যায় এবং ইঞ্জিনের কম্পন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে।

“নয়–আট–সাত–ছয়-”

ত্রাতিনা শেষ বার তার পরিচিত কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ বুলিয়ে নেয়।

”চার–তিন–দুই–এক-”

ত্রাতিনা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে এবং মহাকাশযানটি ওপরে উঠতে শুরু করে। কয়েক মুহূর্ত পরে সে তীব্র ত্বরণের জন্যে নিজের বুকের ওপর একটা চাপ অনুভব করে। ত্রাতিনা শরীরটিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ করে সে শুনতে পেলো রুখ এবং গিসা সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে কথা বলছে। তাদের শরীর জৈবিক শরীর নয়, তাদের যান্ত্রিক দেহ তীব্র ত্বরণের চাপ অনুভব করে না! এনড্রয়েড সম্ভবত কোনো ধরনের শারীরিক কষ্ট অনুভব করে না।

.

ত্রাতিনাদের ছোট মহাকাশযানটি পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছানোর পর দুইবার সেটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করলো। মহাকাশ থেকে সে এক ধরনের মুগ্ধ দৃষ্টিতে পৃথিবী নামের নীল গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নিচের গ্রহটি জীবন্ত, ওপর থেকে সেটি বোঝা যায় না। পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা অসংখ্য প্রাণকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সে সৌর জগতের দ্বিতীয় জীবন্ত প্রাণের সাথে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। কেমন হবে তার অভিজ্ঞতাটি? সে কী তার অভিজ্ঞতাটি পৃথিবীতে জানানোর জন্যে জীবন্ত ফিরে আসতে পারবে?

।ত্রাতিনা জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটি সরিয়ে, চাঁদের দিকে তার অভিযানটিকে নির্দিষ্ট করে নিল। তারপর আবার তার সিটে নিজেকে নিরাপত্তা বন্ধনী দিয়ে বেঁধে নিল। ত্রাতিনা চোখ বন্ধ করে শুনতে পেলো রুখ এবং গিসা তর্ক করছে, কিনিস্কীয় নবম নাকি সপ্তম সিম্ফোনিটির মাঝে কোনটি বেশি কালোত্তীর্ণ হয়েছে!

আঠারো ঘণ্টা পর ত্রাতিনাদের ছোট মহাকাশযানটি পেপিরার সাথে ডক করল। বাতাসের চাপ সমম্বিত হওয়ার পর বায়ু নিরোধক হ্যাঁচ খুলে ত্রাতিনা ভাসতে ভাসতে পেপিরার ভেতরে ঢোকে। ভেতরে একজন লাল তারকা কমান্ডার তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। ত্রাতিনাকে দেখে সে এগিয়ে এসে বলল, “এসো ত্রাতিনা, আমরা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি।” কমান্ডার ত্রাতিনাকে আলিঙ্গন করে বলল, “আমাকে অনেকবার সতর্ক করে বলা হয়েছে তোমার বয়স খুব কম; কিন্তু এতো কম আমি বুঝতে পারিনি।”

ত্রাতিনা বলল, “চেহারায় বয়সের ছাপটি পড়েনি বলে বয়স কম মনে হচ্ছে, কিন্তু আসলে আমার বয়স এমন কিছু কম নয়। আমার থেকে কমবয়সী মহাকাশচারী এর আগে আমার থেকে বড় অভিযান করেছে।”

ত্রাতিনা রুখ এবং গিসার সাথে কমান্ডারের পরিচয় করিয়ে দিল। কিন্তু এনড্রয়েড বলেই হয়তো কমান্ডার তাদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত হলো না।

ত্রাতিনা ঘুরে ঘুরে মহাকাশযান পেপিরাটি দেখলো। পৃথিবীতে সে এর মডেলের ভেতর কাজ করেছে, কিন্তু আসল মহাকাশযানটি যে এতো বড়, সে কখনো কল্পনা করেনি।

বারোজনের একটা টিম ত্রাতিনাকে পুরো মহাকাশযানটি ঘুরিয়ে দেখালো। তার যন্ত্রপাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সুযোগ সুবিধাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল। তথ্যভাণ্ডারের সাথে যুক্ত করে দিল। বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ব্যবহার করার জন্যে অস্ত্রগুলো দেখিয়ে দিল। এই পুরো সময়টুকু রুখ এবং গিসা একটি প্রাচীন কালোত্তীর্ণ সাহিত্য নিয়ে নিজেদের ভেতর আলোচনা করে সময় কাটাচ্ছিল। তাদের আলাদাভাবে এই তথ্যগুলো জানতে হবে না। সব তথ্য সরাসরি তাদের কপোট্রনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

পেপিরাটির দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর ত্রাতিনার শেষবারের মতো পুরো মেডিকেল চেক করে বারোজনের টিমটি বিদায় নিল। বায়ু নিরোধক হ্যাঁচটি বন্ধ করে দেবার পর সে দেখলো স্কাউটশীপটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। নিচে চাঁদে বেস স্টেশনটি দেখা যাচ্ছে, এই মানুষগুলো এখানে কিছুদিন কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাবে।

ত্রাতিনা কিছুক্ষণ নিজের মতো করে এই মহাকাশযানটিতে ঘুরে বেড়ালো। মূল ইঞ্জিন চালু করার আগে সে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ তৈরি করার জন্যে পেপিরাকে মূল অক্ষের সাপেক্ষে ধীরে ধীরে ঘোরাতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা আবার নিজের দেহের ওজন অনুভব করতে শুরু করে। ত্রাতিনা তখন মহাকাশযানের একাধিক কন্ট্রোল সেন্টারের একটিতে বসে কন্ট্রোল প্যানেলের তথ্যগুলো যাচাই করে নিল। কোয়াকম্পটির সুইচ অন করে সে রুখ এবং গিসার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী প্রস্তুত?”

গিসা হেসে বলল, “হ্যাঁ আমরা তো আগেই তোমাকে বলেছি আমরা অনেকদিন থেকে প্রস্তুত।”

“তাহলে আমরা মূল ইঞ্জিন চালু করি?”

“করো।”

ত্রাতিনা নিজের চোখের স্ক্যানিং করে ইঞ্জিনের নিয়ন্ত্রণটি নিয়ে নেয়, তারপর সুইচ টিপে একটি একটি করে ছয়টি ইঞ্জিন চালু করে দিল। ছয় ছয়টি শক্তিশালী ইঞ্জিন, তারপরও মহাকাশযানটিতে খুব সূক্ষ্ম একট কম্পন ছাড়া সে আর কিছুই অনুভব করল না।

দেখতে দেখতে প্রথমে চাঁদের মহাকর্ষণ থেকে এবং কিছুক্ষণের ভেতর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে পেপিরা সৌরজগতের শেষ প্রান্তের দিকে রওনা দেয়। ত্রাতিনা এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে তখনো কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না একুশ বছরের একটি মেয়ে হয়ে সে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহাকাশ অভিযানটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

ত্রাতিনা মহাকাশযানটির ভেতরে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরে বেড়ালো। একদিন নয় দুইদিন নয়, বারো বছর সে এই মহাকাশযানটিতে কাটাবে। তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সে যন্ত্রপাতিগুলো দেখলো, ইঞ্জিন ঘরে উঁকি দিল। কোয়াকম্পের হিমশীতল চৌকোণা বাক্সটি হাত দিয়ে স্পর্শ করল। অস্ত্রপাতির ঘরে ভয়াবহ অস্ত্রগুলো দেখে সে ছোট লাউঞ্জ থেকে এক কাপ কফি নিয়ে কন্ট্রোল রুমে ফিরে এলো।

রুখ এবং গিসা খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা আলোচনা করছিল। ত্রাতিনাকে দেখে তারা মুখ তুলে তাকালো। রুখ খুব গম্ভীর মুখে ত্রাতিনাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ত্রাতিনা তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”

ত্রাতিনা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “করো।”

“আমরা আমাদের দুজনের প্রোফাইল দেখছিলাম। আমাদের দু’জনের প্রোফাইল অনুযায়ী আমাদের মানবিক সত্তা হচ্ছে আটানব্বই পার্সেন্ট। যার অর্থ, আমাদের দুই পার্সেন্ট ঘাটতি আছে।”

ত্রাতিনা হাসার চেষ্টা করে বলল, “ওটা নিয়ে দুর্ভাবনা করো না। আমি নিশ্চিত, আমার প্রোফাইল পরীক্ষা করলে দেখবে আমার মানবিক সত্তা টেনে টুনে আশি পার্সেন্ট!”

“তুমি যেহেতু নিজেই মানুষ, তোমার মানবিক সত্তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কখনো মাপার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা যেহেতু মানুষ নই, আমাদের মাপটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তুমি কী বলতে পারবে, ঠিক কোন কারণে আমাদের দুই পার্সেন্ট ঘাটতি?”

ত্রাতিনা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি ঠিক অনুমান করতে পারছি না। হতে পারে যেমন আমি এখন কফি খাচ্ছি সেটা দেখেও তোমাদের কফি খেতে ইচ্ছে করছে না! তোমরা মানুষ হলে এখন নিশ্চয়ই লাউঞ্জ থেকে কফি নিয়ে আসতে।”

গিসা মাথা নাড়ল, বলল, “না। খাওয়ার ব্যাপারটি এর মাঝে নেই, আমাদের যেহেতু খেতে হয় না, তাই ওটা হিসেবে ধরা হয় না।”

ত্রাতিনা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “তোমাদের দুজনের সাথে আমি গত কয়েকমাস সময় কাটিয়েছি। তোমাদের কখনো কোনো কিছু নিয়ে রাগ হতে দেখিনি! রাগ খুবই বড় একটা মানবিক সত্তা। মানুষ কথায় কথায় রাগ হয়।”

“রাগ?” রুখ এবং গিসা একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। তারপর বলল, “তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। কিন্তু রাগ তো একটি নেতিবাচক অনুভূতি।”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। রাগ একটি নেতিবাচক অনুভূতি, কিন্তু তোমাকে কে বলেছে মানুষের সব অনুভূতি ইতিবাচক? মানুষের ভেতর ইতিবাচক আর নেতিবাচক দুই অনুভূতিই আছে। যে মানুষ তার নেতিবাচক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে ইতিবাচক অনুভূতিটি দেখাতে পারে, আমরা তাদের ভালো মানুষ বলি।”

গিসা বুঝে ফেলার ভঙ্গি করল। তারপর বলল, “তার মানে আমাদের রাগ থাকতে হবে, কিন্তু সেটা প্রকাশ করা যাবে না?”

ত্রাতিনা বলল, “প্রকাশ করা যাবে না তা নয়, প্রয়োজনে রাগ প্রকাশ করা যায়। অনেক সময় রাগ প্রকাশ করতে হয়।”

রুখ এবং গিসাকে খুবই চিন্তিত দেখালো। ত্রাতিনা মনে মনে একটু কৌতুক অনুভব করে। এই দু’টি এনড্রয়েড এই মহাকাশযানের সকল খুঁটিনাটি জানে, মহাকাশযানটিকে নিখুঁতভাবে পরিচালনা করে সৌরজগতের শেষ প্রান্তে তারা নিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু তাদের আচরণ অনেকটা শিশুর মতো!

ত্রাতিনা মহাকাশযানের কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মহাকাশটি কুচকুচে কালো, শুধু বাইরে বহু দূরে পৃথিবীটা দেখা যাচ্ছে, এর মাঝে অনেক ছোট হয়ে এসেছে। শুধু পৃথিবী নয়, সূর্যটাকেও বেশ ছোট দেখাচ্ছে।

মহাকাশযানের এই ইঞ্জিনগুলো অসাধারণ শক্তিশালী। সে যেহেতু জেগে আছে, ত্বরণটি একটা সহ্যসীমার মাঝে রাখা হয়েছে। সে ঘুমিয়ে যাবার পর যখন তাকে হিমশীতল করে ফেলা হবে, তখন ত্বরণ আরো বাড়িয়ে দেয়া হবে।

ত্রাতিনা মহাকাশযানের তথ্যভাণ্ডার থেকে মহাজাগতিক প্রাণীর সম্ভাব্য আচরণ নিয়ে গবেষণাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল। তার হয়তো সৌরজগতের শেষপ্রান্তে পৌঁছাতে বারো বছর লেগে যাবে, কিন্তু প্রায় বেশিরভাগ সময়টুকুই তার হিমঘরেই কাটাতে হবে।

ত্রাতিনা দীর্ঘ চব্বিশ ঘণ্টা একটানা কাজ করে ঘুমুতে গেল। এখনো সে পৃথিবীর কাছাকাছি আছে, তাই পৃথিবীর ভিডি মডিউলের অনুষ্ঠান সে দেখতে পাচ্ছে। পৃথিবীতে কখনোই ছেলেমানুষি এই অনুষ্ঠানগুলো দেখার আগ্রহ অনুভব করেনি। কিন্তু পৃথিবী থেকে লক্ষ মাইল দূরে থেকে হঠাৎ সে এই ছেলেমানুষি অনুষ্ঠানগুলো গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখল।

দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে, নিজেই জানে না।

ত্রাতিনার ঘুম ভাঙল ঠিক এক বছর পর। ঘুমটি যেহেতু দৈনন্দিন ঘুম ছিল না, তাই তাকে বেশ কিছু নিয়ম মেনে তারপর উঠতে হলো। তাকে প্রথমে হাত, তারপর পা নাড়াতে হলো, মাথা ঘোরাতে হলো, বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে হলো। চোখ খুলতে হলো, বন্ধ করতে হলো মাথার ভেতরে ছোট একটা গাণিতিক হিসেব করে উত্তরটা বলতে হলো তারপর ক্যাপসুলের ঢাকনা খুলে বের হতে পারল।

ক্যাপসুলের ঢাকনার দুই পাশে রুখ এবং গিসা দাঁড়িয়েছিল। তারা উল্লসিত গলায় বলল, “পেপিরাতে শুভাগমনের শুভেচ্ছা ত্রাতিনা।”

ত্রাতিনা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমার কাছে মনে হচ্ছে গতরাতে ঘুমিয়ে আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি! তোমাদের শুভকামনা একটু বেশি মনে হচ্ছে।”

“মোটেও বেশি নয়। গত এক বছরে অনেক কিছু ঘটেছে তাই আমরা আগ্রহ নিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।”

ত্রাতিনা ভুরু কুঁচকে বলল, “অনেক কিছু ঘটেছে?”

“হ্যাঁ।”

“কোনো সমস্যা?”

“না, কোনো সমস্যা হয়নি। পেপিরার যন্ত্রপাতি নিখুঁত, এখানে সমস্যা হবার কিছু নেই।”

“গ্রহকণাদের বেল্টের ভেতর ঢোকার সময় নাটকীয় কিছু ঘটেনি?”

“না, ঘটেনি। আমরা এখনো গ্রহকণা বেল্টের ভেতর আছি, তুমি ইচ্ছে করলে দেখতে পারো নাটকীয় কিছু ঘটানো যায় কি না।”

ত্রাতিনা বলল, “আমরা অনেক বড় অভিযানে যাচ্ছি। যদি তা না হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে আমি একটি গ্রহকণায় নেমে তার ওপরে লিখে আসতাম, ত্রাতিনা এই গ্রহকণায় এসেছিল!”

ত্রাতিনার কথা শুনে রুখ এবং গিসা শব্দ করে হাসল। ঠিক কী কারণে জানা নেই ত্রাতিনার কাছে তাদের হাসিটি সবসময়েই খানিকটা কৃত্রিম শোনায়। এই দুইটি এনড্রয়েড মানুষ হওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, দেখে মাঝে মাঝেই ত্রাতিনার এক ধরনের মায়া হয়।

ত্রাতিনা মহাকাশযানের কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। গ্রহকণা বেল্টটি আলাদাভাবে দেখতে পেলো না। কিন্তু বৃহস্পতি গ্রহটিকে বেশ স্পষ্ট দেখাতে পেলো। কয়েকদিন কাজ করে সে আবার ঘুমিয়ে যাবে। পরের বার যখন উঠবে, তখন বৃহস্পতি গ্রহটার খুব কাছে চলে আসবে। সত্যি কথা বলতে কী, বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষণ বল ব্যবহার করে পেপিরার গতিকে বাড়ানো হবে। মহাকাশচারীদের উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্যে মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত অনেককেই আসতে হয়, কিন্তু এর পর বড় অভিযান ছাড়া আর কেউ আসার সুযোগ পায় না। বছর দুয়েক আগে বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাতে একটা অভিযানে এসে একটা মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে সব মহাকাশচারী মারা গিয়েছিল। কারণটি কখনো জানা যায়নি।

ত্রাতিনা রুখ আর গিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “গত এক বছরে কী ঘটেছে বল।”

“এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তুমি প্রস্তুত হয়ে এসো। নাস্তা করো। কফি খাও, তখন তোমার সাথে কথা বলব।”

“নিউট্রিনো ফ্লাক্স মেপেছ?”

“এটা প্রতিদিন একবার করে মাপছি।”

“পৃথিবী থেকে কোনো তথ্য? কোনো নির্দেশ?”

“না। কোনো তথ্য নেই। কোনো নির্দেশ নেই। জন্মদিনের শুভেচ্ছা আছে।”

“পৃথিবী ঠিক আছে? কোনো ঘূর্ণিঝড় ভূমিকম্প?”

“ওসব কিছু আছে। কিন্তু যেহেতু আগে থেকে ভবিষ্যৎবাণী করা যাচ্ছে, তাই ক্ষয়ক্ষতি বলতে গেলে নেই। বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন পৃথিবীতে উৎসবের মতো!”

“নূতন কোনো আবিষ্কার?”

“নূতন কিছু প্রাণী তৈরি হয়েছে। নিরীহ গোবেচারা ধরনের, কিন্তু সাইজ অনেক বড়। চিড়িয়াখানায় বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য!”

ত্রাতিনা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে নিজের ঘরে গেল। বরফের মতো কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে ঢিলেঢালা কাপড় পরে লাউঞ্জে এলো। খাওয়ার ট্রেতে গরম খাবার, তরল পানীয় আর গরম কফি নিয়ে সে কন্ট্রোল সেন্টারে এসে বসল। রুখ আর গিসা তার দুই পাশে বসে ত্রাতিনার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। ত্রাতিনা মাথা নেড়ে বলল, “তোমরা ঠিকই অনুমান করেছ, কন্ট্রোল টেবিলে গরম খাবার নিয়ে বসা সপ্তম মাত্রায় অপরাধ।”

“তাহলে?”

“জোরে হাঁচি দেওয়াও সপ্তম মাত্রার অপরাধ। তাছাড়া এখানে আমাকে শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই। তোমরা এনড্রয়েড–এনড্রয়েড মানুষকে শাস্তি দিতে পারে না। কাজেই আমি এই ছোট বেআইনী কাজটি করছি”–বলে ত্রাতিনা তার প্লেট থেকে এক টুকরো ছোট কিন্তু সুস্বাদু প্রোটিন কেটে নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে বলল, “এবারে বল গত এক বছরে অনেক কিছু কী কী ঘটেছে?”

রুখ বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল, “মনে আছে তোমাকে বলেছিলাম আমাদের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে আমাদের মানবিক সত্তা আটানব্বই পার্সেন্ট, অর্থাৎ দুই পার্সেন্ট ঘাটতি আছে?”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “মনে আছে।”

“তুমি বলেছিলে আমাদের ভেতরে রাগ নেই। রাগ হচ্ছে খুব জরুরি একটি মানবিক সত্তা।”

ব্রাতিনা বলল, “হ্যাঁ মনে আছে।”

“তোমার কথা সত্যি। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি শুধু রাগ নয়, হিংসা, ঘৃণা এবং লোভ এগুলোও মানবিক সত্তা। তাই গত এক বছর আমরা নিজেদের ভেতরে এই মানবিক সত্তাগুলো তৈরি করেছি।”

ত্রাতিনা চোখ কপালে তুলে বলল, “কী করেছ?”

গিসা বলল, “আমরা এখন রাগ হতে পারি, হিংসা করতে পারি, ঘৃণা করতে পারি এবং লোভ করতে পারি।”

ত্রাতিনা হতাশার ভঙ্গি করে বলল, “তোমরা জান তোমরা কী করেছ?”

“কী করেছি?”

“তোমরা ছিলে উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মতো। সাধারণ মানুষের নিচতা হীনতা তোমাদের মাঝে ছিল না। এখন তোমরা হওয়ার চেষ্টা করছ নিচু শ্রেণীর মানুষ-”

গিসা বলল, “আমরা উঁচু নিচু বুঝি না। আমরা পুরোপুরি মানুষের মতো হতে চাই।”

“সেটা কখনো হতে পারবে কি না, আমি জানি না। মানুষ খুবই জটিল একটা প্রাণী। শুধু জটিল না, বলতে পার পুরোপুরি জগাখিচুড়ি একটা প্রাণী। বিবর্তনের কারণে কোনো একটা দিকে পরিবর্তিত হয়েছে। তারপর অন্য একটা প্রয়োজনে আবার অন্য একদিকে পরিবর্তন হয়েছে। একটা স্তরের উপর আরেকটা স্তর, পুরোপুরি এলোমেলো। খুব ঠাণ্ডা মাথায় যদি মানুষকে নূতন করে ডিজাইন করা যেতো, তাহলে মানুষ হতো খুব সহজ সরল দক্ষ একটা প্রাণী! কিন্তু সেটা তো হতে পারবে না।”

রুখ বলল, “কেন হতে পারবে না?”

ত্রাতিনা তার কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “কীভাবে হবে?”

“মানুষ বলতে তুমি নিশ্চয়ই মানুষের পাকস্থলী, কিডনি কিংবা হৃৎপিণ্ড বোঝাও না। মানুষ হচ্ছে তার মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ককে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে

অন্য সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়েছে। ঠিক কি না?”

ত্রাতিনা বলল, “ঠিক আছে। তর্কের খাতিরে মেনে নিই।”

“তাহলে আমরা যদি মানুষের মস্তিষ্কের মতো জটিল একটা সিস্টেম দাঁড়া করি এবং সেটাকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে সহজ সরল কিছু যন্ত্রপাতি দাঁড়া করি, তাহলে সেটা কী মানুষ থেকে ভালো হল না?”

“কিন্তু সেটা কীভাবে হবে?” রুখ গলা উঁচিয়ে বলল, “কীভাবে হবে মানে? হয়ে গেছে!”

ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ। এই যে আমরা দুইজন তোমার সামনে বসে আছি। আমরা হচ্ছি ভবিষ্যতের মানুষ। আমাদের ভেতর মানুষের মানবিক সত্তা আছে, বুদ্ধিমত্তা আছে। কিন্তু আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে স্নায়ুতন্ত্র, রক্ত সঞ্চালন, কিডনি পরিবহন, পুষ্টিতন্ত্র, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কোনো কিছু লাগে না। আমরা হচ্ছি ভবিষ্যতের মানুষ।”

ত্রাতিনা হাসি হাসি মুখে বলল, “আর আমরা?”

“তোমরা হবে অতীতের মানুষ।”

ত্রাতিনা তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। অতীতের মানুষ ভবিষ্যতের মানুষকে স্বাগত জানাচ্ছে। যদি মহাজাগতিক প্রাণী সত্যি সত্যি পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়, তাহলে ভবিষ্যতের মানুষ এই পৃথিবীর ইতিহাস, কালচার ঐতিহ্য জ্ঞান বিজ্ঞানকে বাঁচিয়ে রাখবে।”

গিসা বলল, “তুমি আমাদের নিয়ে কৌতুক করছ। কিন্তু এক সময় নিশ্চয়ই আমাদের গুরুত্বটা বুঝতে পারবে। পারবেই পারবে।”

.

ত্রাতিনা কয়েকদিন মহাকাশযানটিতে কাটিয়ে আবার ঘুমুতে চলে গেল।

এবারে তার ঘুম ভাঙলো এক বছরের আগেই, কারণ তাকে জাগিয়ে তোলা হলো। ক্যাপসুলের ভেতর চোখ খুলেই সে বুঝতে পারলো, সময়ের আগেই তাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে, কারণ মাথার কাছে ছোট একটা লাল বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। ত্রাতিনা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, নিয়ম মাফিক হাত পা এবং মাথা নাড়িয়ে, চোখ খুলে এবং বন্ধ করে শেষে মাথার ভিতরে ছোট একটা হিসেব করে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এলো। ক্যাপসুলের বাইরে রুখ এবং গিসা দাঁড়িয়ে আছে, এর আগেরবার তাদের চেহারায় একটা উৎফুল্ল ভাব ছিল, এবারে সেটি নেই। দুজনেই একটু গম্ভীর।

ত্রাতিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কোনো সমস্যা?”

রুখ মাথা নাড়ল, “না, সমস্যা না। তবে–”

“তবে কী?”

“একটা স্কাউটশীপ আমাদের মহাকাশযান পেপিরাকে ধরার চেষ্টা করছে।”

ত্রাতিনা চোখ বড় করে তাকালো, “কী বললে? একটা স্কাউটশীপ?”

“হ্যাঁ।”

“যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছ?”

”করেছি। মনে হয় চ্যানেল খোলা নেই। কোনো উত্তর নেই।”

“পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করেছ?”

“চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা বৃহস্পতি গ্রহের ছায়ার মাঝে আছি, এখান থেকে বের হবার আগে যোগাযোগ হচ্ছে না।”

“কী আশ্চর্য! বৃহস্পতি গ্রহের কাছে একটা স্কাউটশীপ?”

গিসা বলল, “আমি জানি না এটাকে স্কাউটশীপ বলা ঠিক হবে কি না। এটা খুব ছোট অত্যন্ত বিচিত্র একটা মহাকাশযান।”

ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলে গিয়ে মহাকাশযানটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। গিসা ঠিকই বলেছে, এটাকে স্কাউটশীপ কিংবা মহাকাশযান বলা যায় কিনা সন্দেহ আছে। মনে হচ্ছে অত্যন্ত বিচিত্র কিছু যন্ত্রপাতি জুড়ে দিয়ে কিছু একটা দাঁড় করানো হয়েছে। শুধু তাই না, এই মহাকাশযানটার যাত্রাপথ একটি সুইসাইড মিশন। এটি সরাসরি মহাকাশযান পেপিরার সাথে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে, পেপিরার যেটুকু ক্ষতি হবে, সেটা সারিয়ে নেয়ার উপায় আছে, কিন্তু এই মহাকাশযানটার রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই।

ত্রাতিনা কোয়াকম্প দিয়ে হিসেব করে পেপিরার সাপেক্ষে এই বিচিত্র মহাকাশযানটার যাত্রাপথ বের করলো। তাদের মহাকাশযানে আঘাত করার আগে এখনো হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় আছে।

রুখ বলল, “এটি একটি বিপজ্জনক বস্তু। যেহেতু এটি কোনো রকমভাবে যোগাযোগ করছে না, কাজেই ধরে নেয়া যায় এটি একটি মহাজাগতিক জঞ্জাল। আমাদের নিরাপত্তার জন্যে এটা ধ্বংস করে দেয়া সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কাজ।”

গিসা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ ধ্বংস করে দিই।”

রুখ বলল, “আমরা যেখানে আছি তার আশেপাশে কয়েক লক্ষ কিলোমিটারের ভেতর কোনো মানুষের বসতি নেই। এর ভেতরে কোনো মানুষ নেই।”

ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়েছিল, দেখতে পেলো মহাকাশযানটির একটি অংশ হঠাৎ করে ভেঙে উড়ে গেল। রুখ সেটা দেখে মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের হয়তো এটা ধ্বংস করতে হবে না; এটি নিজে থেকেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একটা অংশ ভেঙে উড়ে গেছে।”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “না। তোমরা বিষয়টি ধরতে পারনি।”

“কেন? কী হয়েছে?”

“মহাকাশযানের একটা অংশ এমনি এমনি ভেঙে উড়ে যায়নি। এটি ইচ্ছে করে করা হয়েছে।”

“কেন?”

“যাত্রাপথটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে। দেখেছ এর যাত্রাপথ এখন আর সাংঘর্ষিক না। এটি এখন আমাদের সমান্তরালভাবে আসছে।”

গিসা বলল, “এটি কাকতালীয় ব্যাপার। মহাকাশযানের অংশ ভেঙে কেউ মহাকাশযানের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে না। মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাশের ইঞ্জিন দিয়ে।”

“যদি মহাকাশযানে ইঞ্জিন না থাকে?”

গিসা একটু হাসল। বলল, “যদি ইঞ্জিন না থাকে, সেটাকে কেউ মহাকাশযান বলে না।”

ত্রাতিনা মনিটরটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। বলল, “দেখেছ কী হয়েছে?”

“কী হয়েছে?”

“মহাকাশযানের আরেক টুকরো বের হয়ে গেছে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। গতি একটু বাড়িয়েছে, যেন আমাদের স্পর্শ করতে পারে।”

“তুমি কী বলতে চাইছ?”

“আমি বলতে চাইছি, এই বিচিত্র মহাকাশযানটিকে আমাদের মহাকাশযানে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তুত হও।”

রুখ বলল, “তুমি এটাকে ডক করতে দেবে? এর ভেতরে কী আছে তুমি জানো না। হতে পারে এই কোনো দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো মহাকাশযানের অংশ।”

“যেটাই হোক, আমি সেটা দেখতে চাই।”

মহাকাশযানটি অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। এখন এটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুখ ভালো করে দেখে বলল, “ত্রাতিনা।”

“বল। এটি কোনোভাবে আমাদের মহাকাশযানে ডক করতে পারবে।। এটির বায়ু নিরোধক কোনো হ্যাঁচ নেই।”

ত্রাতিনাকে খুব বিচলিত হতে দেখা গেল না। বলল, “আমি অনুমান করেছিলাম।”

“তাহলে?”

“মহাকাশযানটাকে সরাসরি পেপিরার ভেতরে নিয়ে আসব।”

“কী বলছ তুমি?”

“হ্যাঁ। একটা অংশ সিল করে সেটা খুলে দেব। মহাকাশযানটা ভেতরে ঢুকবে। তারপর মহাকাশযান বন্ধ করে বাতাসের চাপ সমন্বয় করব।”

“কী বলছ তুমি? এটা দ্বিতীয় মাত্রার বিপজ্জনক পরিস্থিতি।”

“না। এটা একেবারে প্রথম মাত্রার বিপজ্জনক পরিস্থিতি। এই বিচিত্র মহাকাশযানটার ভেতরে একজন মানুষ রয়েছে। আমাদের তাকে উদ্ধার করতে হবে। যে কোনো মূল্যে–”

“কিন্তু।”

ত্রাতিনা হাসল। বলল, “তোমরা পুরোপুরি মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছ। পুরোপুরি মানুষ হওয়ার এটা প্রথম শর্ত অন্য একজন মানুষকে বাঁচাতে হয়। যে কোনো মূল্যে। যাও, তোমরা পেপিরার লোডিং ডক খুলে দাও। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে আছি।”

ত্রাতিনা তার মহাকাশচারী জীবনের পুরো অভিজ্ঞতাটুকু ব্যবহার করে বিচিত্র মহাকাশযানটিকে পেপিরার ভেতরে নিয়ে এলো। প্রাণপণ চেষ্টা করেও মহাকাশযানটিকে ঠিকভাবে নামাতে পারলো না। একেবারে শেষ মুহূর্তে মহাকাশযানটি পেপিরার দেয়ালে আঘাত করল। বিচিত্র মহাকাশযানটি স্থির হবার পর পেপিরার লোডিং ডকের বিশাল ঢাকনাটি ধীরে ধীরে নেমে এলো। বাতাসের চাপ সমান করার সাথে সাথে গিসাকে কন্ট্রোল প্যানেলে রেখে ত্রাতিনা রুখকে নিয়ে ভিতরে ছুটে গেল।

বিচিত্র মহাকাশযানটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এর কোনো দরজা নেই। ভেতর থেকে বের হওয়ার কোনো জায়গা নেই। ত্রাতিনা লেজার দিয়ে সাবধানে একপাশে কেটে একটা গর্ত করে ভেতরে মাথা ঢোকালো। দেখলো মহাকাশযানটির সামনে ছিন্নভিন্ন পোশাকে একজন মানুষ যন্ত্রপাতির নিচে চাপা পড়ে আছে। তার লম্বা মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। ত্রাতিনাকে দেখে মানুষটি হাত নেড়ে বলল, “এটা কী সত্যি ঘটেছে, নাকি এটা কোনো হ্যাঁলুসিনেশন?”

ত্রাতিনা বলল, “আমিও এটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে চাই। এটা কি সত্যি ঘটেছে?”

যন্ত্রপাতির ভেতর থেকে মানুষটা নিজেকে টেনে বের করে আনতে আনতে বলল, “একসাথে দুইজনের একই হ্যাঁলুসিনেশান হতে পারে না। মনে হয়, সত্যিই এটা হচ্ছে।”

ত্রাতিনা বলল, “হ্যাঁ সত্যি এটা হচ্ছে। তোমার নাম কী?”

“নাম?”

“হ্যাঁ।”

মানুষটি হাসল, দাড়ি গোঁফের জঙ্গলের ভেতর থেকে তার ঝকঝকে দাঁত বের হয়ে আসে।”অনেকদিন নামটা ব্যবহার হয়নি তো, তাই মনে করতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় আমার নাম গ্রাহা।”

“তুমি কী জান, একসময়ে টেক্সট বইয়ে একটা চ্যাপ্টার লেখা হবে যার শিরোনাম হবে গ্রাহা উদ্ধার প্রক্রিয়া?”

গ্রাহা নামের মানুষটা এবারে শব্দ করে হাসল। বলল”আসলে একটা চ্যাপ্টার নয় মনে হয় পুরো একটা বই লেখা সম্ভব। সেটার নাম হতে পারে, ‘হতভাগা গ্রাহার জীবন কাহিনী’।”

রুখ নিচু গলায় বলল, “ত্রাতিনা, আমার মনে হয় তোমরা মহাকাশযানের ভেতরে গিয়ে এই কথাবার্তা বলতে পারবে। তার অনেক সময় আছে।”

.

৩.৩

মহাকাশযান পেপিরার ভেতরে ঢুকে গ্রাহা এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকালো। তারপর নিচু গলায় বলল, “এ রকম একটি মহাকাশযান হতে পারে আমি সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।”

ত্রাতিনা বলল, “আমিও করিনি।”

“তোমাদের কমান্ডারের সাথে দেখা করার আগে আমার মনে হয় একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া দরকার।”

ত্রাতিনা বলল, “তার প্রয়োজন হবে না। তোমার এর মাঝে কমান্ডারের সাথে দেখা হয়েছে।”

গ্রাহা অবাক হয়ে বলল, “দেখা হয়েছে?”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। আমি এই মহাকাশযানের কমান্ডার। এবং ঝাড়দার এবং নিরাপত্তাকর্মী। এবং বাবুর্চি। এক কথায় সবকিছু।”

গ্রাহা বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “কী আশ্চর্য! এতো বড় মহাকাশযানের দায়িত্বে এতো কমবয়সী একজন? অন্য মহাকাশচারীরা কোথায়?”

ত্রাতিনা বলল, “আর কেউ নেই। আমরা তিনজন এর দায়িত্বে।”

“কী আশ্চর্য! মাত্র তিনজন মানুষ এর দায়িত্বে?”

গিসা বলল, “আসলে তিনজন মানুষ নয়। একজন মানুষ। ত্রাতিনা। আমরা মানুষ নই। আমরা এনড্রয়েড।”

গ্রাহা রীতিমত চমকে উঠল এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে গিসার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “আমি নিজের চোখে দেখে এবং নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করছি না।”

রুখ বলল, “এই অভিযানের জন্যে আমাদের বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। আমরা মূলত ত্রাতিনাকে নিরাপত্তা দেই, কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রায় ত্রাতিনা যেন নিঃসঙ্গ অনুভব না করে সেজন্যে আমাদের রয়েছে প্রায় পূর্ণাঙ্গ মানবসত্তা।”

গিসা বলল, “এছাড়াও আমাদের আরো একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে। যেটি এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না।”

গ্রাহা মাথা নাড়ল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। সে সম্ভবত এর আগে কখনোই একটা এনড্রয়েডের সাথে কথা বলেনি। তাদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে, সে জানে না।

ত্রাতিনা ব্যাপারটা খানিকটা বুঝতে পারল। সে গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা, তুমি কীভাবে কোথা থেকে কীভাবে এখানে এসে হাজির হয়েছ, সেটা জানার জন্যে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব। তোমার সম্ভবত একটা মেডিকেল চেকআপ করা উচিত। তারপর গরম পানিতে একটা দীর্ঘ গোসল, নূতন কাপড়, ভালো ডিনার, উত্তেজক পানীয় ইত্যাদি। যারা এই মহাকাশযানটি ডিজাইন করেছে, তারা সবকিছু চিন্তা করেছে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি এখানে আরো একজন মানুষ এসে হাজির হবে। কাজেই এখানে দ্বিতীয় মানুষের কোনো ব্যবস্থা নেই। তোমাকে সবকিছু আমার সাথে ভাগাভাগি করতে হবে।”

গ্রাহা বলল, “আমি তুলনামূলকভাবে বেশি খাই। এখন হয়তো আমি আরো বেশি খাব। তোমার খাবার সরবরাহে সমস্যা হতে পারে।”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “সেটা নিয়ে তোমার দুর্ভাবনা করতে হবে না। এই অভিযানে আমি বেশিরভাগ সময়ে ঘুমিয়ে থাকি। সময় কাটানোর এটা সবচেয়ে সহজ উপায়।”

গ্রাহা বলল, “তোমার অভিযান সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। আমি হাজির হয়ে তোমার অভিযানের কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেছি কি না, সেটাও বুঝতে পারছি না।”

ব্রাতিনা বলল, “আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করব। আমার ধারণা, আমার অভিযানটি সম্পর্কে জানার পর তুমি তোমার বিদঘুঁটে মহাকাশযানে করে যেখান থেকে এসেছ আবার সেখানে ফিরে চলে যাবে।”

.

মেডিকেল চেক আপে গ্রাহার শরীরে রক্তশূন্যতা, অপুষ্টি, হৃৎপিণ্ডের প্রদাহ, স্নায়ু বৈকল্য এরকম গুরুতর অনেকগুলো সমস্যা ধরা পড়ল। কিন্তু সেগুলো দেখে কেউই বিচলিত হলো না। এই মানুষটি বেঁচে আছে সেটি পুরোপুরি একটি অলৌকিক বিষয়। সে তুলনায় কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যাকে বিবেচনায় আনার কোনো প্রয়োজন নেই।

পেপিরার মেডিকেল সেবা নিয়ে গ্রাহা ত্রাতিনার সাথে ডিনার করার সময় তার ইতিহাসটুকু বলল। গ্রাহা একজন প্রথম শ্রেণির মহাকাশচারী। তিন বছর আগে সে বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ ইউরোপাতে একটি অভিযানে এসেছিল। একেবারেই দুর্ঘটনাক্রমে একটা উল্কার আঘাতে তাদের মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে যায়। কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই তাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে ইউরোপাতে নামতে হয়। মূল ইঞ্জিন ছাড়া সেটি ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। মহাকাশযানের কেউই বাঁচেনি। গ্রাহা কীভাবে বেঁচে গিয়েছে, সেটি সব সময়েই রহস্য হিসেবে থেকে যাবে।

তাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপা উপগ্রহটি মানুষের বসবাসের কতোটুকু উপযোগী, সেটা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়া–গ্রাহা এখন সেই ধারণাটি নিজের জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই উপগ্রহে জীবন ধারণের মূল উপাদান পানি এবং অক্সিজেন দু’টিই আছে। এর সাথে অল্পকিছু সাহায্য পেলে একজন মানুষ অনির্দিষ্টকাল ইউরোপাতে বেঁচে থাকতে পারবে।

গ্রাহার দুর্ভাগ্য, তাদের মহাকাশযানের মূল যোগাযোগ মডিউলটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই পৃথিবীর সাথে আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেনি। অনেক কষ্ট করে সে তার আংশিক চালু করেছিল, যে কারণে মহাকাশের কিছু সিগন্যাল সে পেতো, কিন্তু কিছুই পাঠাতে পারত না।

সময় কাটানোর জন্যে সে বিধ্বস্ত মহাকাশযানের অংশগুলো জোড়াতালি দিয়ে এই মহাকাশযানটি তৈরি করেছিল। সেটি দিয়ে কখনোই কোনো মহাকাশযানে নামতে পারবে আশা করেনি। কিন্তু বিশাল একটা উপগ্রহে পুরোপুরি একাকী বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার থেকে প্রায় অসম্ভব কিছু একটা চেষ্টা করতে গিয়ে মারা যাওয়াটাই তার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তাই যখন তার যোগাযোগ মডিউলে পেপিরার সংকেত ধরা পড়েছে, সে সেটাকে ধরার চেষ্টা করেছে। বৃহস্পতি গ্রহের এতো কাছে দিয়ে সত্যিকারের মহাকাশচারী নিয়ে একটি মহাকাশযান উড়ে যাবে, সেটি সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। সে যে সত্যি সত্যি এই মহাকাশযানের ভেতরে নিরাপদে আশ্রয় পেয়েছে, সেটি সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।

গ্রাহা তখন ত্রাতিনার কাছে তার অভিযানের উদ্দেশ্যটি জানতে চাইল। ত্রাতিনা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “তোমাকে এক কথায় যদি বলতে হয় তাহলে বলব যে আমরা একটা মহাজাগতিক প্রাণীর কাছে একটা মেসেজ নিয়ে যাচ্ছি।”

গ্রাহা কিছুক্ষণ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “মহাজাগতিক প্রাণী?”

ত্রাতিনা বলল, “মহাজাগতিক প্রাণী শব্দটা হয়তো ঠিক হলো না, প্রাণী বললেই আমাদের মনে হাত পা চোখ মুখ আছে এরকম একটা জীবন্ত কিছুর ছবি ভেসে ওঠে! আমার শুদ্ধ করে বলা উচিত মহাজাগতিক অস্তিত্ব।”

“অস্তিত্ব? মহাজাগতিক অস্তিত্ব?” এবারে গ্রাহাকে আরো বেশি বিভ্রান্ত দেখালো।

ত্রাতিনা বলল, “আরো শুদ্ধ করে বলা যাক, একটি বুদ্ধিমান মহাজাগতিক অস্তিত্ব!”

গ্রাহা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো একটা জায়গায় একটা বুদ্ধিমান মহাজাগতিক অস্তিত্ব ঘাপটি মেরে বসে আছে? তুমি তার কাছে একটা চিঠি নিয়ে যাচ্ছ?”

ত্রাতিনা হাসল, বলল, “ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।”

”তুমি কেমন করে জান এই মহাবিশ্বে একটা বুদ্ধিমান মহাজাগতিক অস্তিত্ব আছে?”

ত্রাতিনা বুকে হাত দিয়ে বলল, “আমি ত্রাতিনা সেটা জানি না পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানী গবেষকরা সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। কারণ আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে একটা মহাজাগতিক কণা পৃথিবীটাকে ধ্বংস করার জন্যে ছুটে গিয়েছিল, যেটাকে শেষ মুহূর্তে একটা থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে ধ্বংস করে পৃথিবীকে রক্ষা করা হয়েছে।”

গ্রাহা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, বিষয়টা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমরা মহাকাশচারীদের অনেকে সেটা শুনেছি। রায়ীনা নামে একজন মহাকাশচারী–”

ত্রাতিনা হঠাৎ শব্দ করে হাসল। গ্রাহা থেমে গেল, ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি হাসলে কেন?”

“তোমার মুখে আমার মায়ের নাম শুনে!”

গ্রাহা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, তারপর খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “তুমি রায়ীনার মেয়ে?”

“হ্যাঁ। আমার ক্রোমোজমের তেইশটি রায়ীনার কাছ থেকে এসেছে!”

গ্রাহা উঠে দাঁড়িয়ে ত্রাতিনার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ত্রাতিনা, আমি তোমাকে একটু আলিঙ্গন করি?”

ত্রাতিনা কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল এবং গ্রাহা তাকে গভীর ভালোবাসায় আলিঙ্গন করল। রুখ এবং গিসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে তাকিয়েছিল। তারা এবারে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। রুখ গলা নামিয়ে গিসাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী অনুমান করেছিলে গ্রাহা হঠাৎ করে এতো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বে?”

“না।” গিসা মাথা নাড়ল, বলল, “না আমি অনুমান করিনি। সত্যি কথা বলতে কী আমার কাছে আবেগের এ ধরনের বহিঃপ্রকাশকে খানিকটা বাহুল্য মনে হয়।”

রুখ বলল, “সেটাই হচ্ছে আমাদের সমস্যা। এ কারণেই আমাদের প্রোফাইলের মানবিক সত্তা পুরো একশ ভাগ হতে পারছে না!”

গ্রাহা আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার পর ত্রাতিনা বলল, “যাই হোক যেটা বলছিলাম, পৃথিবীর বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা যখন নিশ্চিত হলেন যে, কোনো একটা মহাজাগতিক প্রাণী পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য এই গ্রহকণারূপী মহাকাশযানটি পাঠিয়েছে, তখন তারা বিষয়টা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা শুরু করলেন। তারা যেটা খুঁজে বের করলেন, সেটা খুবই বিচিত্র।”

গ্রাহা একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “সেটা কী?”

“সেটা হচ্ছে মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তার এই অস্তিত্ব পৃথিবীকে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কারণে ধ্বংস করছে না। তারা এটা করছে নিছক একটা কৌতূহল থেকে। বুদ্ধিমান হওয়ার প্রথম শর্ত কৌতূহল।”

“কৌতূহল?”

“হ্যাঁ, যেহেতু কাছে আসতে পারছে না, তাই দূর থেকে এটা পর্যবেক্ষণ করার সবচেয়ে সোজা উপায় হচ্ছে সেখানে কিছু একটা ছুঁড়ে দেয়া। বিজ্ঞানীরা যেভাবে প্রোটন প্রোটন সংঘর্ষ করে ভেতরে কোয়ার্কেরা কী রকম আছে সেটা বের করে নেয়!”

গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না। তুমি বলছ তারা কাছে আসতে পারছে না। যদি আসলেই বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, কাছে আসতে সমস্যা কী?”

“সূর্যের জন্য কাছে আসতে পারে না।”

“সূর্য?”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ সূর্য। আমাদের সূর্যের প্রধান বিক্রিয়া হচ্ছে প্রোটন প্রোটন বিক্রিয়া, সেখান থেকে নিউট্রিনো বের হয়, পৃথিবীতে তার ফ্লাক্স বিশাল। পৃথিবীর পৃষ্ঠে যদি আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, প্রতি সেকেন্ডে শুধু আমাদের চোখের মণি দিয়ে এক বিলিয়ন নিউট্রিনো যায়। আমরা সেটা টের পাই না, কারণ নিউট্রিনোর বিক্রিয়া বলতে গেলে কিছু নেই।”

গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ আমরা হাইস্কুলে এগুলো পড়েছি।”

”আমাদের শরীর নিউট্রিনোর সাথে বিক্রিয়া করে না, কিন্তু আমি যে মহাজাগতিক অস্তিত্বের কথা বলছি, সেটা করে। তাই সেটা সূর্যের কাছে আসতে পারে না। আমরা সূর্য থেকে যত দূরে যাব, নিউট্রিনো ফ্লাক্স তত কমতে থাকবে। শনি গ্রহের কাছাকাছি নিউট্রিনো ফ্লাক্স হবে পৃথিবীর এক শত ভাগের এক ভাগ। সৌর জগতের শেষ মাথায় যদি যাই, নিউট্রিনো ফ্লাক্স পৃথিবীর এক হাজার ভাগের এক ভাগ। কাজেই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বের করেছেন, মহাজাগতিক অস্তিত্ব শুরু হয়েছে সৌরজগতের বাইরে থেকে। বুঝেছ?”

গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “তুমি যেটা বলেছ, সেটা বুঝেছি। কিন্তু কী বলতে চাইছ সেটা এখনো বুঝিনি।”

ত্রাতিনা বলল, “আপাতত এটুকু বুঝলেই চলবে। যেহেতু মহাজাগতিক অস্তিত্বটুকু সৌরজগতের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু, তাই আমি সেখানে যাচ্ছি।”

গ্রাহা মাথা চুলকে বলল, “সেই হাইস্কুলে যেটুকু পদার্থবিজ্ঞান পড়েছিলাম এবং যতটুকু মনে আছে, সেটা থেকে বলতে পারি এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব যেহেতু নিউট্রিনোর সাথে বিক্রিয়া করে, অর্থাৎ সেটা তৈরি উইম্পস দিয়ে। কাজেই সে তোমাকে দেখবে না!”

ত্রাতিনা আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, “এই তো তুমি পুরোটাই বুঝে গেছ! এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব আমাকে দেখতেই পাবে না! কাজেই সেখানে পৌঁছে গিয়ে আমার নিজেকে জানাতে হবে, বলতে হবে, আমি এসেছি।”

“কীভাবে বলবে?”

“একটা দশ মেগাটন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা পাঠাব! সেটা যখন বিস্ফোরিত হবে সেখান থেকে বিশাল নিউট্রিনো ফ্লাক্স বের হবে–এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব জানবে আমি এসেছি!”

গ্রাহা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, “এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব নিশ্চয়ই একটা প্রাণীর মতো না, তার নিশ্চয়ই হাত পা নেই, মাথা নেই, চোখ নেই।”

ত্রাতিনা বলল, “না, নেই।”

“শুধু মস্তিষ্কের মতো কিছু?”

“হ্যাঁ। আমাদের যে রকম অসংখ্য নিউরন, একটার সাথে আরেকটা, সংযোগ, এটাও তাই। বিশাল মহাবিশ্ব জুড়ে ওই রূপ ছড়িয়ে আছে, একটার সাথে আরেকটা যোগাযোগ রাখছে। বলতে পারো বিশাল এলাকায় যেন বুদ্ধিমত্তা ছড়িয়ে পড়ছে!”

“তার মানে তুমি যখন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমাটা ফাটাবে, সেটা অনেকটা এই মহাজাগতিক প্রাণীর মস্তিষ্কের ভেতর গুলি করার মতো?”

ত্রাতিনা শব্দ করে হাসল। বলল, “তোমার উপমাটা ভালো, আমার পছন্দ হয়েছে। আমরা এই মহাজাগতিক প্রাণীর মস্তিষ্ক বল, বুদ্ধিমত্তার আস্তরণ বল সেখানে গুলি করতে যাচ্ছি!”

গ্রাহা বলল, “কেউ আমার মাথায় গুলি করলে আমি যথেষ্ট বিরক্ত হব।”।

“ভয় নেই, এই প্রাণী বিরক্ত হবে না।”

“কেন?”

“কারণ, বিরক্তি, ক্রোধ, আনন্দ, হতাশা এগুলো মানুষের অনুভূতি। মানুষের বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমত্তা হলে তারা মানবিক এই বুদ্ধিমত্তার অনেক ঊর্ধ্বে চলে যায়।”

গ্রাহা ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি নিশ্চিত?”

“আমি এসব জানি না, তাই আমার নিশ্চিত হওয়া না হওয়ায় কিছু আসে যায় না। যারা বিশেষজ্ঞ, তারা অনেক গবেষণা করে এই বিষয়টা বের করেছেন।”

“তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো, তুমি এই মহাজাগতিক প্রাণী বা অস্তিত্বের মস্তিষ্কের ভেতর বোমা ফাটিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে। তারপর কী করবে?”

“পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তখন তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে একটা যন্ত্র তৈরি করে দিয়েছেন, তখন সেই যন্ত্র দিয়ে যোগাযোগ করব।”

গ্রাহা বলল, “তাদের সাথে যোগাযোগ করবে? তাদের ভাষায় কথা বলবে?”

“অনেকটা সে রকম। তখন কী হবে, কেমন করে হবে সেটা আমি জানি না। তখন দেখা যাবে। মোটামুটি বলা যায়, আমি বলব তোমাদের জন্যে পৃথিবীর বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন একটা উপহার দিতে এসেছি।”

“পৃথিবী থেকে উপহার? কী রকম উপহার? এদের জন্যে নিশ্চয়ই সোনার আংটি কিংবা হীরার নেকলেসের কোনো গুরুত্ব নেই।”

“না নেই।”

“তাহলে, তাদের কী উপহার দেবে?”

ত্রাতিনা হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই যে তোমাদের সামনে বসে আছে, রুখ এবং গিসা। তাদেরকে ঠিক এই উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে।”

রুখ এবং গিসা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। রুখ বলল, “সে জন্যে আমাদের ভেতরের মানবিক সত্তাকে যতদূর সম্ভব মানুষের মানবিক সত্তার কাছাকাছি আনা হয়েছে। আর আমাদের শরীরটা তৈরি হয়েছে এমনভাবে যেন এখান থেকে বেটা ডিকে হয়, নিউট্রিনো বের হয়। যেন সহজে বিশ্লেষণ করতে পারে।”

গ্রাহা কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তোমাদের দু’জনকে দিয়ে দেয়া হবে?”

“হ্যাঁ।”

“তোমাদের ভেতরে যদি সত্যিকারের মানবিক সত্তা থাকতো, তাহলে তোমরা নিশ্চয়ই আপত্তি করতে।”

“আপত্তি? আপত্তি কেন করব? আমাদের কপোট্রন স্ক্যান করে রাখা হবে, কাজেই আবার আমাদের সৃষ্টি করা হবে।”

গ্রাহা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। বলল, “কিন্তু তোমরা তো সত্যিকারের মানুষ নও। মানুষের ডিকয়।”

ত্রাতিনা বলল, “আমাদের কিছু করার নেই। রুখ এবং গিসা শুধু যে মানুষের কাছাকাছি একটা সহজ যান্ত্রিক রূপ তা নয়, তাদের ভেতর পৃথিবীর সব তথ্য দিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে তথ্য আর অন্য কোনোভাবে দেয়া সম্ভব নয়।।

গ্রাহা মাথা নেড়ে বলল, “কেউ যদি আমাকে বলতো যে তোমাকে মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দেব, আমি কিন্তু কিছুতেই রাজি হতাম না!”

গিসা বলল, “আমরা আনন্দের সাথে রাজি হয়েছি। পৃথিবীর মানুষের জন্যে আমরা কিছু একটা করতে পেরেছি, সেজন্যে আমরা গর্বিত।”

গ্রাহা বেশ খানিকটা বিস্ময়ের সাথে এই পরিতৃপ্ত এবং গর্বিত এনড্রয়েড দুটির দিকে তাকিয়ে রইল।

.

৩.৪

দু’দিন পর ত্রাতিনা গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা আমাদের দু’জনের একটু কথা বলা দরকার।”

গ্রাহা বলল, “কী বিষয় নিয়ে কথা বলবে?”

“তোমার বিষয়ে।”

গ্রাহা বলল, “আমার বিষয়ে? আমি কী বেশি খেয়ে তোমার রসদ ফুরিয়ে ফেলছি?”

ত্রাতিনা হাসল। বলল, “না, সেরকম কোনো আশংকা নেই।”

“তাহলে তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও?”

“তোমার নিশ্চয়ই পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া দরকার। তুমি প্রাণে রক্ষা পেয়েছ, এখন সেই প্রাণটুকু নিয়ে যদি পৃথিবীতে ফিরে না যাও, তাহলে কেমন হবে? পৃথিবীতে নিশ্চয়ই তোমার পরিবার আছে, আপনজন আছে।”

গ্রাহার মুখটা হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কয়দিন থেকে আমারও আমার পরিবারের কথা মনে হচ্ছিল। পৃথিবীতে আমার স্ত্রী আছে, আমার ছোট একটি মেয়ে আছে। আমি যখন এই অভিযানে রওনা দিয়েছি, তখন আমার মেয়ের বয়স ছিল এক বছর। এখন নিশ্চয়ই সে একটু বড় হয়েছে।”

ত্রাতিনা বলল, “বৃহস্পতির ছায়া থেকে সরে গেলেই আমরা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারবো। তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারবে। তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে।”

গ্রাহা বলল, “আমি জানি না আমি সেটা আসলেই করতে চাই কি না, তিন মিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে কথা বলার ব্যাপারটি আমার কাছে কৃত্রিম মনে হয়।”

“কিন্তু তোমার স্ত্রী যখন জানতে পারবে তুমি বেঁচে আছ, সে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।”

গ্রাহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “সেটা নাও হতে পারে।”

ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “নাও হতে পারে?”

“হ্যাঁ। আমার স্ত্রী জানে, আমি মারা গেছি। ছোট একটি সন্তান নিয়ে সে কি একাকী নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকবে? থাকবে না। সে নিশ্চয়ই এতোদিনে নতন একজন সঙ্গী খুঁজে নিয়েছে। এখন হঠাৎ করে যদি জানতে পারে আমি বেঁচে আছি, সেটি তার জীবনে আনন্দের বদলে জটিলতা তৈরি করবে।”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, গ্রাহার কথায় যুক্তি আছে। গ্রাহাকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তুমি কী করতে চাও?”

“আমি পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার পর তাদের সাথে যোগাযোগ করব। তার আগে নয়।”

ত্রাতিনা বলল, “ঠিক আছে, তাহলে তোমাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলি।”।

“বল।”

“আমাদের এই মহাকাশযান পেপির ভবিষ্যৎ কী, কেউ জানে না। আমি পৃথিবীতে প্রাণে বেঁচে ফিরে যেতে পারব কিনা সেটিও জানি না। যদি প্রাণে বেঁচে ফিরে যেতেও পারি, তাহলে সেটি হবে আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর পর। বাইশ বছর অনেক দীর্ঘ একটি সময়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানোর জন্যে এখনই আমাদের কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”

“কী ব্যবস্থা?”

ত্রাতিনা বলল, “আমি ঠিক জানি না। তুমি একজন অভিজ্ঞ মহাকাশচারী। তুমি বল।”

গ্রাহা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “একটা মাত্র উপায়। সেটি হচ্ছে প্রথমে পৃথিবীতে খবর পাঠাই যে আমি বেঁচে আছি। তারপর তোমার মহাকাশযান থেকে প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে একটা স্কাউটশীপে ইউরোপাতে আমার ঘাঁটিতে ফিরে যাই। সেখানে দুই বছর অপেক্ষা করি, এর মাঝে পৃথিবী থেকে উদ্ধারকারী দল চলে আসবে। আরো দুই বছর পর আমি পৃথিবীতে ফিরে যাব। যার অর্থ আজ থেকে চার বৎসর পর আমি পৃথিবীর মাটিতে পা দেব। আমার মেয়ে ততদিনে একটি কিশোরী বালিকা হয়ে যাবে।”

ত্রাতিনা হাত বাড়িয়ে বলল, “চমৎকার পরিকল্পনা। আমিও ঠিক এই সমাধানটির কথা ভাবছিলাম।”

গ্রাহা বলল, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাইলে এটি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

ত্রাতিনা বলল, “তাহলে আমরা ব্যবস্থা করি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার যাওয়া উচিত। কারণ প্রতি ঘণ্টায় আমরা পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার দূরে চলে যাচ্ছি!”

গ্রাহা বলল, “তোমার ব্যস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।”

“কেন?”

“আমি এটি করতে রাজি নই।”

ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “রাজি নও? কেন?”

“আমার এক বছরের নিঃসঙ্গ জীবনটি ছিল ভয়ঙ্কর। আমি আসলে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কোনোভাবেই সেই জীবনে ফিরে যেতে চাই না। একদিন নয় দুইদিন নয়, টানা দুই বছর নিঃসঙ্গ পরিবেশে একটি গ্রহে একাকী দিন কাটানো থেকে মরে যাওয়া ভালো।”

ত্রাতিনা কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, “ঠিক আছে। তাহলে আমি একটুখানি জটিল কিন্তু তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা পরিকল্পনা দিই।”

গ্রাহা মাথা নাড়ল, বলল, “না রাজি না।”

ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “আমি আমার পরিকল্পনাটি এখনো বলিনি।”

“কিন্তু আমি জানি, তুমি কী বলবে?”

“আমি কী বলব?”

“তুমি বলবে আমাকে একটা ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। তারপর ইউরোপার কক্ষপথে আমাকে ছেড়ে দেবে। পৃথিবীর উদ্ধারকারী দল এসে আমার ক্যাপসুলটি উদ্ধার করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সেখানে আমার ঘুম ভাঙানো হবে। আমার কাছে মনে হবে আমি আজ ঘুমিয়ে গেছি এবং কাল ভোরে পৃথিবীতে জেগে উঠেছি।”

ত্রাতিনা হাসল। বলল, “তুমি ঠিকই অনুমান করেছ।”

“এর মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। আমাদের মহাকাশ অভিযানের কোর্সে এগুলো শেখানো হয়। তুমি আমি সবাই এক জায়গা থেকে এগুলো শিখেছি।”

“কিন্তু এগুলো কার্যকর পদ্ধতি।”

“কিন্তু গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি না। আমি একটা ক্যাপসুলের ভেতর জড় পদার্থ হয়ে বছরের পর বছর একটা উপগ্রহকে ঘিরে ঘুরতে চাই না।”

“কিন্তু তুমি সেটা জানবে না।”

“তাতে কিছু আসে যায় না।” তাহলে তুমি কী করবে?”

“আমি তোমার সাথে পেপিরাতে থাকব।”

“পেপিরাতে থাকবে? পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে কি না, সেটা তুমি জান না।”

“তুমি যদি ফিরে যেতে পার, তাহলে আমিও ফিরে যাব।”

“তুমি যখন পৃথিবীতে ফিরে যাবে, তখন তোমার মেয়ে আর শিশু থাকবে না। বড় হয়ে যাবে।”

“আমি জানি। বড় হয়ে তোমার বয়সী একটা মেয়ে হবে।”

“হ্যাঁ। আমার বয়সী।”

গ্রাহা একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে তোমার বয়সী একটা মেয়ে খুব চমৎকার একটি অভিজ্ঞতা। একটি শিশু বা কিশোরীর সাথে হঠাৎ করে দেখা করার থেকে তোমার বয়সী মেয়ের সাথে দেখা করা সহজ। সে তার বাবাকে অনেক সহজে গ্রহণ করতে পারবে।”

ত্রাতিনা চুপ করে বসে রইল। গ্রাহা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “শুধু তাই নয়, আরো একটি ব্যাপার আছে।”

“কী ব্যাপার?”

“মহাজাগতিক এই প্রাণী কিংবা অস্তিত্বের সাথে তুমি মুখোমুখি হবে, কী হবে কেউ জানে না। অভিজ্ঞতাটা অনেক ভয়ঙ্কর হতে পারে।”

“হ্যাঁ হতে পারে।”

“তখন আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।”

“আমি একা নই। আমার সাথে রুখ এবং গিসা আছে।”

গ্রাহা কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠল। তারপর বলল, “রুখ আর গিসার কথা বলো না। মানুষ চমৎকার একটি বিষয়। যন্ত্রও চমৎকার বিষয়। কিন্তু মানুষের মতো যন্ত্র কিংবা যন্ত্রের মতো মানুষ চরম নির্বুদ্ধিতা। তোমাকে একা পাঠানোর সিদ্ধান্তটি ঠিক হয়নি। সাথে আরো মানুষ দেয়া উচিত ছিল।

“এটি আমার সিদ্ধান্ত। আমি অন্য কোনো মানুষ আনতে রাজি হইনি। আমার মা একা গিয়েছিল, অন্য কারো জীবন বিপন্ন করেনি। আমিও কারো জীবন বিপন্ন করতে চাই না।”

“সেটি ঠিক আছে। তুমি সেভাবে চেয়েছিলে। কিন্তু আমি যেহেতু ঘটনাক্রমে এখানে চলে এসেছি, এখন তোমার আর কিছু করার নেই। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।”

ত্রাতিনা কিছু না বলে গ্রাহার দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রাহা একটু পর বলল, “আমি জানি তুমি এই মহাকাশযানের কমান্ডার। তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমাকে সেটাই মেনে নিতে হবে। আমি সেটাই মেনে নেব। কিন্তু আমি তোমার কাছে অনুরোধ করছি, আমাকে তোমার সাথে থাকতে দাও।”

ত্রাতিনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে।” গ্রাহা বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কমান্ডার!” ত্রাতিনা গ্রাহার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। গ্রাহা বলল, “কমান্ডার ত্রাতিনা, এবারে আমার মেয়ের বয়সী মানুষ ত্রাতিনার কাছে একটি অনুরোধ করতে পারি?”

“করো।”

“আমি জানি তোমার এখন শীতল গ্রহে গিয়ে ঘুমানোর কথা। আমি অনুরোধ করছি, তুমি কয়েকদিন পরে ঘুমুতে যাও। আমি বহুদিন মানুষের সাথে কথা বলিনি। কয়েকটা দিন তুমি আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে দাও।”

ত্রাতিনা বলল, “কথা বলার ব্যাপারে আমার দক্ষতা খুব কম। তবে আমি খুব ভালো শ্রোতা। বিশেষ কোনো কথা বলতে না পারলেও আমি তোমার সব কথা শুনতে রাজি আছি।”

“মাঝে মাঝে হু হা করবে, তাহলেই হবে। আমি একটানা কথা বলে যাব।”

ত্রাতিনা হাসল। বলল, “ঠিক আছে।”

.

মহাকাশযান বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষ ব্যবহার করে স্লিং শট প্রক্রিয়ায় তার গতিবেগ বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতি গ্রহের ছায়া থেকে বের হয়েছে। ত্রাতিনা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করেছে এবং নিয়মিত তথ্য বিনিময় শুরু করেছে।

কয়েকদিন পর ত্রাতিনা গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা, তোমার জন্যে আমি একটি উপহার সংগ্রহ করেছি।”

গ্রাহা একটু অবাক হয়ে বলল, “উপহার? আমার জন্যে?”

“হ্যাঁ।”

“কোথা থেকে সংগ্রহ করেছ?”

“পৃথিবী থেকে।”

“পৃথিবী থেকে?” গ্রাহা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “দেখি আমার উপহার।”

ত্রাতিনা হাতে ধরে রাখা ছোট মডিউলটি স্পর্শ করতেই তাদের সামনে ছোট একটা জায়গা আলোকিত হয়ে উঠল। সেই আলোকিত জায়গাটিতে ছোট একটা শিশুর ত্রিমাত্রিক ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ত্রাতিনা বলল, “গ্রাহা এটি তোমার মেয়ে।”

গ্রাহা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। ত্রাতিনা নরম গলায় বলল, “মহাকাশযান পেপিরার কমান্ডার হিসেবে আমার অনেক ক্ষমতা। আমি আমার সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে তোমার মেয়ে রিয়ার এই হলোগ্রাফিক ছবিটি নিয়ে এসেছি।”

“আমার মেয়ে? রিয়া?”

“হ্যাঁ। আমরা প্রায় ছয় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে, তাই সিগন্যাল আসতে প্রায় তিরিশ মিনিট সময় লাগছে।

রিয়ার হলোগ্রাফিক ছবিটি ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। সে নড়তে থাকে, কথা বলতে থাকে, খিলখিল করে হাসতে থাকে।

গ্রাহা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, হলোগ্রাফিক ছবি স্পর্শ করা যায় না জেনেও সে ধীরে ধীরে তার হাতটি দিয়ে হলোগ্রাফিক ছবিটি স্পর্শ করার চেষ্টা করল। কিন্তু ছবিটির ভেতর দিয়ে তার হাতটি বের হয়ে এলো। ত্রাতিনা দেখলো গ্রাহার চোখ প্রথমে অশ্রু সজল হয়ে উঠল, তারপর ফোঁটা ফোঁটা পানি বের হয়ে এলো। সে নরম গলায় বলল, “গ্রাহা! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি তোমার মেয়ের কাছে পৌঁছে দেব। হলোগ্রাফিক ছবি নয়, তুমি তোমার রক্ত মাংসের মেয়ের মাথায় হাত বুলাবে।”

গ্রাহা বলল, “আমি জানি, তুমি সেটি করবে। আমি জানি।”

গল্পের বিষয়:
সাইন্স-ফিকশন
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত