ত্রাতিনা – বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী : ২. দ্বিতীয় পর্ব (ষোল বছর পর)

ত্রাতিনা – বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী : ২. দ্বিতীয় পর্ব (ষোল বছর পর)

দ্বিতীয় পর্ব (ষোল বছর পর)

২.০১

অনাথ আশ্রমের ডাইনিংরুমে ছেলে মেয়েরা হই চই করে রাতের খাবার খাচ্ছে। আশ্রমের ডিরেক্টর ক্লারা নিঃশব্দে ডাইনিং রুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে মুখে এক ধরনের কৌতুকের হাসি নিয়ে ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকিয়েছিল। এই প্রাণোচ্ছল ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে ডিরেক্টর ক্লারা মাঝে মাঝে এক ধরনের হিংসা অনুভব করে। এই কমবয়সী ছেলে মেয়েগুলোর কেমন করে এতো প্রাণশক্তি থাকতে পারে? কেমন করে এতো সহজে তারা জীবনটিকে এতো আনন্দময় করে ফেলতে পারে?

ডিরেক্টর ক্লারার মাঝে মাঝেই মনে হয়, অনাথ আশ্রমের দায়িত্ব পাওয়াটি মনে হয় তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। শুধুমাত্র এজন্যেই বুঝি সারাটি জীবন ছোট ছোট শিশুদের সাথে কাটাতে পেরেছে। তাদেরকে কিশোর-কিশোরী হয়ে উঠতে দেখেছে। তারপর এক সময় তরুণ তরুণী হওয়ার পর বাইরের পৃথিবীতে যাওয়ার জন্যে অশ্রুসজল চোখে তাদের বিদায় দিয়ে এসেছে।

এবারে আরো একটি মেয়েকে বিদায় দেবে। মেয়েটির নাম ত্রাতিনা। ষোল বছর আগে তার মহাকাশচারী মা ক্লারার হাতে এই মেয়েটিকে তুলে দিয়েছিল। এতো বছর পরেও ডিরেক্টর ক্লারা সেই দিনটির কথা ভুলতে পারে না। মহাকাশচারী রায়ীনা তার মেয়েকে রেখে চলে যাচ্ছে, ছোট মেয়েটি কী বুঝেছে কে জানে, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ডিরেক্টর ক্লারা তাকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিল। মহাকাশচারী রায়ীনার কী হয়েছিল কে জানে, সে আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। ত্রাতিনা অনাথ আশ্রমের অন্য দশজন ছেলেমেয়ের সাথে বড় হয়েছে। মেয়েটি কখনো তার বাবা মায়ের কথা জানতে চায়নি। হয়তো ধরেই নিয়েছে তার মা-বাবার কথা কেউ জানে না। তা না হলে কেন সে অনাথ আশ্রমে থাকবে?

ডিরেক্টর ক্লারা ডাইনিং হলে ত্রাতিনাকে খুঁজে বের করল। মাঝামাঝি একটা টেবিলে আরও কয়েকজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে খেতে বসেছে। মেয়েটি মায়ের মতো কালো চুল আর কালো চোখ নিয়ে বড় হয়েছে। হাসিখুশি প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি মেয়ে। ক্লারা লক্ষ্য করল, ড্রিংকিং স্ট্রয়ের ভেতর একটা মটরশুটি ঢুকিয়ে ত্রাতিনা ফুঁ দিয়ে সেই মটরশুটিটি পাশের টেবিলের একজন ছেলের ঘাড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ছেলেটি চমকে উঠে তার ঘাড়ে হাত দিয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। তার ঘাড়ে কী এসে আঘাত করছে বুঝতে না পেরে ছেলেটি ঘাড়ে হাত বুলাচ্ছে এবং পাশের টেবিলে অন্য বন্ধুদের নিয়ে ত্রাতিনা হেসে কুটি কুটি হচ্ছে।

ডিরেক্টর ক্লারা আরো একটু এগিয়ে টেবিল থেকে একটা গ্লাস আর একটা চামুচ তুলে নেয়। তারপর চামুচ দিয়ে গ্লাসটাকে টোকা দিয়ে টুং টুং শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ছেলেমেয়েরা ক্লারার এই শব্দটির সাথে পরিচিত। সবাই প্রথমে থেমে গেল, তারপর ক্লারার দিকে তাকিয়ে আনন্দের মতো একটি শব্দ করল।

ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”

সবাই তখন চুপ করে উৎসুক চোখে তার দিকে তাকায়। ক্লারা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমি তোমাদের একটা সুসংবাদ দিতে এসেছি।”

সুসংবাদটি কী না শুনেই ছেলেমেয়েগুলো আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। ডিরেক্টর ক্লারা হেসে বলল, “সুসংবাদটি না শুনেই তোমরা আনন্দে চিৎকার করছ, ব্যাপার কী?”

একজন বলল, “সুসংবাদটি শুনে আমরা কীভাবে চিৎকার করব, সেটি একটু প্র্যাকটিস করে নিলাম।”

অন্যেরা বলল, “বল, বল সুসংবাদটি বল। শুনতে চাই, আমরা শুনতে চাই।”

ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “কিন্তু তোমরা শান্ত না হলে আমি কীভাবে বলব?”

সবাই তখন শান্ত হয়ে ক্লারার দিকে তাকিয়ে রইল। ক্লারা সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, “তোমাদের ত্রাতিনা কেন্দ্রীয় মহাকাশ ইনস্টিটিউটে পুরো স্কলারশীপ পেয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এই মাত্র আমি তার খবর পেয়েছি।”

ক্লারা কথা শেষ করার আগেই ডাইনিং হলের ছেলেগুলো শুধু চিৎকার করে শান্ত হলো না। তারা ছুটে এসে ত্রাতিনাকে ধরে হুটোপুটি করতে লাগল। সবাই মিলে তাকে মাথার ওপরে তুলে নিয়ে নাচানাচি করতে থাকে।

ক্লারা আনন্দোৎসবে বাধা দিল না। একটু শান্ত হওয়ার পর সে এগিয়ে গিয়ে ত্রাতিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ত্রাতিনা মা, তোমাকে দুই সপ্তাহের মাঝে ইনস্টিটিউটে যোগ দিতে হবে।”

ত্রাতিনা নিঃশব্দে ক্লারার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নিচু গলায় বলল, “দুই সপ্তাহ?”

“হ্যাঁ মা। তোমাকে আমাদের বিদায় দিতে হবে। আমরা সবাই তোমার অভাবটুকু অনুভব করব।”

হঠাৎ করে ডাইনিং হলের সব ছেলেমেয়ে চুপ করে যায়। একটি আনন্দ সংবাদের সাথে সাথে যে এরকম একটি বেদনার সম্পর্ক থাকতে পারে সেটি আগে তারা কখনো অনুমান করেনি।

দুই সপ্তাহ পর একটি শীতল, কুয়াশাচ্ছন্ন, বৃষ্টিভেজা দিনে ত্রাতিনা ডিরেক্টর ক্লারার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেল। তার হাতে একটা ছোট ব্যাগ, অনাথ আশ্রমের গেটে একটা বাইভার্বাল তাকে পাতাল ট্রেন স্টেশনে নেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। সেই বাইভার্বালকে ঘিরে অনাথ আশ্রমের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা ত্রাতিনাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।

ক্লারা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, “বস ত্রাতিনা।”

ত্রাতিনা ক্লারার সামনে চেয়ারটিতে বসল। ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “তোমার জন্যে আমার খুব অহংকার হচ্ছে ত্রাতিনা। কেন্দ্রীয় মহাকাশ ইনস্টিটিউট এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ইনস্টিটিউট। এখানে পড়তে সুযোগ পাওয়া খুব ভাগ্যের কথা।”

ত্রাতিনা কিছু না বলে হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ল।

ক্লারা বলল, “তুমি অবশ্য ভাগ্যের জোরে এই সুযোগ পাওনি। তুমি সুযোগ পেয়েছ নিজের যোগ্যতায়।”

ত্রাতিনা বলল, “তুমি আমাদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছ, আমাদের উৎসাহ দিয়েছ, আমরা সবাই তাই তোমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।”

“ধন্যবাদ ত্রাতিনা। আমি আমার দায়িত্বটুকু শুধু পালন করেছি। তার বেশি কিছু করিনি।” ক্লারা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “তুমি ইনস্টিটিউটে কী নিয়ে পড়াশোনা করবে ঠিক করেছ?”

ত্রাতিনা একটু লাজুক মুখে বলল, “আমি মহাকাশচারী হতে চাই। মহাকাশযানে করে মহাকাশে অভিযান করার আমার খুব ইচ্ছা।”

ক্লারা এক মুহূর্ত ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, “কী আশ্চর্য!”

ত্রাতিনা একটু অবাক হয়ে বলল, “আশ্চর্য! কেন এটি তোমার কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে? আমি কী মহাকাশচারী হতে পারি না?”

ক্লারা বলল, “অবশ্যই হতে পার। তুমি যেটা চাইবে, সেটাই হতে পারবে। আমি সেজন্যে আশ্চর্য হইনি। আমি আশ্চর্য হয়েছি অন্য কারণে।”

ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, “কী কারণে?”।

ক্লারা তার চেয়ার থেকে উঠে ত্রাতিনার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, একটু নিচু হয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, “বাইরে এই অনাথ আশ্রমের ভাই বোনেরা তোমাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি তার মাঝে তোমাকে বলেছি আমার সাথে দেখা করে যাওয়ার জন্যে। সেটি শুধু আনুষ্ঠানিক বিদায় দেওয়ার জন্যে নয়। তার একটি কারণ আছে ত্রাতিনা।”

”কী কারণ?”

“আমি তোমাকে একটি জিনিস দিতে চাই।”

“কী জিনিস?”

“তোমার মা যেদিন তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, সেদিন আমাকে একটা ছোট ক্রিস্টাল দিয়ে বলেছিল, তুমি যখন বড় হবে তখন আমি যেন সেটা তোমার হাতে দিই।”

ত্রাতিনা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, বলল, “মা? আমার মা? তুমি আমার মাকে দেখেছ?”

“হ্যাঁ, দেখেছি।”

“তুমি কখনো সেটি আমাকে বলনি–”

“না, বলিনি। আমার বলার কথা না সেজন্য বলিনি। আমি অপেক্ষা করছিলাম, কখন তুমি বড় হবে-এখন বড় হয়েছ, তাই তোমাকে বলছি।”

“আমার মা দেখতে কেমন ছিল? কী করতো আমার মা? আমাকে নিজের কাছে না রেখে কেন অনাথ আশ্রমে রেখে গেল?”

ক্লারা দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল। বলল, “আমার মনে হয় তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর এই ক্রিস্টালটিতে পেয়ে যাবে। তুমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা কর।”

ডিরেক্টর ক্লারা উঠে গেল। দেওয়ালে লাগানো সেফটি ভল্টে রেটিনা স্ক্যান করিয়ে খুলে নেয়। তারপর ওপরের তাক থেকে ভেলভেটে মোড়ানো ছোট একটা ধাতব বাক্স নিয়ে আসে। সেটি ত্রাতিনার হাতে তুলে দিয়ে বলল, “এই নাও। এর ভেতরে আমি ষোল বছর ধরে তোমার ক্রিস্টালটি বাঁচিয়ে রাখছি। আজকে আমার দায়িত্ব শেষ হল।”

ত্রাতিনা বাক্সটি প্রথমে কিছুক্ষণ নিজের বুকে চেপে ধরে রাখে। তারপর খুব সাবধানে সেটি খোলে, বাক্সের মাঝখানে নিও পলিমারের ফ্রেমে ছোট একটা ক্রিস্টাল চকচক করছে। এই ক্রিস্টালটি ত্রাতিনার মা ত্রাতিনার জন্যে তৈরি করে রেখেছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই, হঠাৎ করে ত্রাতিনার চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো।

ডিরেক্টর ক্লারা ত্রাতিনার পাশে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল, “তুমি যখন বলেছ যে তুমি মহাকাশ ইনস্টিটিউটে মহাকাশচারী হবে, তখন আমি বলেছিলাম কী আশ্চর্য! কেন বলেছিলাম, জান?”

“কেন?”

“তার কারণ, তোমার মাও ছিলেন একজন মহাকাশচারী। মহাকাশচারী রায়ীনা। তোমার মা যেদিন তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, সেদিন খুব জরুরি একটা কাজে তাকে চলে যেতে হয়েছিল। কী কাজ, সেটি আমি জানি না। আর কোনোদিন ফিরে আসেনি, তোমার মা নিশ্চয়ই জানতো আর ফিরে আসবে না।”

ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “মা। আমার মা।”

ডিরেক্টর ক্লারা ত্রাতিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ত্রাতিনা সোনা তোমার যাবার সময় হয়েছে। বাইরে সবাই তোমাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।”

ত্রাতিনা তার ব্যাগটি খুলে সেখানে ভেলভেট দিয়ে মোড়ানো ধাতব বাক্সটি রেখে উঠে দাঁড়াল। ক্লারা ত্রাতিনাকে আলিঙ্গন করে বলল, “যাও মা। প্রার্থনা করি তোমার অপূর্ব একটি জীবন হোক।”

ত্রাতিনা চোখ মুছে বলল, “আমার মায়ের কথা মনে নেই। মায়েরা কেমন করে সন্তানকে ভালোবাসে, সেটি আমি জানি না। কিন্তু তুমি আমাদের সবাইকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসেছ। আমরা সবাই তোমার কাছ থেকে সেই ভালোবাসাটা পেয়েছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্লারা।”

ত্রাতিনা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ডিরেক্টর ক্লারা হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের সামনে একটা বাইভার্বাল দাঁড়িয়ে আছে। সেটি ঘিরে অনাথ আশ্রমের সব ছেলেমেয়ে নিঃশব্দে ত্রাতিনাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।

.

পাতাল ট্রেনটি ম্যাগনেটিক লেভিটেশন ব্যবহার করে ঘণ্টায় দুই হাজার ত্রাতিনা কিলোমিটার বেগে ছুটে যাচ্ছে। যদিও ট্রেনের ভেতরে বসে থেকে সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই। ত্রাতিনা তার সিটে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে আছে। ইনস্টিটিউট থেকে তাকে ট্রেনের টিকিট পাঠিয়েছে ছোট একটা ঘরে সামনাসামনি দু’টি সিট। সামনের সিটে একজন বয়সী মহিলা কানে হেড ফোন লাগিয়ে বসে কিনিস্কির নবম সিম্ফোনি শুনছে। সিম্ফোনির তালে তালে খুব ধীরে ধীরে তার মাথা নড়ছে। এ ছাড়া বোঝার আর কোনো উপায় নেই। ট্রেনের ছোট কামরাটি পুরোপুরি নিঃশব্দ।

ত্রাতিনা ক্রিস্টালটি হাতে নিয়ে বসে আছে। তার হাতে ভিডি গগলস। ক্রিস্টালটি ঢুকিয়ে গগলসটি চোখে লাগালেই সে তার মাকে দেখতে পাবে। মাকে দেখার জন্যে একই সাথে সে নিজের ভেতরে এক ধরনের ব্যাকুলতা এবং পাশাপাশি বিচিত্র এক ধরনের ভীতি অনুভব করছে। কী দেখবে সে? সে কী সহ্য করতে পারবে? নাকি ভেঙে পড়বে?

শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে সে কাঁপা হাতে ক্রিস্টালটি ভিডি গগলসের ছোট স্লটটিতে ঢুকিয়ে ক্লিপটা টেনে দিল। তারপর গগলসটি চোখের উপর লাগিয়ে ত্রাতিনা ট্রেনের সিটে মাথা রাখল। প্রথমে একটা নীল আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। মৃদু একটা যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পেলো। তারপর হঠাৎ করে সে তার মাকে দেখতে পেলো।

ছোট করে কাটা কুচকুচে কালো চুল। গভীর কালো চোখ, সেই চোখে তীব্র একটা দৃষ্টি। মনে হয়, সেই দৃষ্টি দিয়ে তার মা সবকিছু ঝলসে দেবে। ত্রাতিনা কেঁপে উঠল। দেখলো, তার মা সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। এটি তার সত্যিকারের মা নয়, এটি তার মায়ের ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি। তবু ত্রাতিনার মনে হলো সত্যিকারের মা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ত্রাতিনা দেখলো তার মায়ের ঠোঁট নড়ে উঠেছে। সে তখন তার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, স্পষ্ট গলায় তার মা বলল, “ত্রাতিনা, মা আমার। তুই এখন আমার কথা শুনছিস, তার মানে তুই আর আমার ছোট শিশুটি নেই। তুই বড় হয়েছিস। ভালো আছিস মা?”

ত্রাতিনা জানে, এটি তার সত্যিকারের মা নয়। শুধুমাত্র তার মায়ের প্রতিচ্ছবি। তারপরও সে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ মা। ভালো আছি। খুব ভালো আছি।”

“ত্রাতিনা মা, তুই নিশ্চয়ই আমার উপর অনেক অভিমান করে আছিস! তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস, আমি কেমন করে তোকে একটা অনাথ আশ্রমে রেখে চলে গেলাম। মা হয়ে কেমন করে সন্তানকে ছেড়ে গেলাম! তাই না?”

“কিন্তু মা আমার, সোনা আমার! বিশ্বাস কর, তোকে এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমি গিয়েছি। পৃথিবীটা কতো সুন্দর, তুই এখনো দেখিসনি মা, আমি দেখেছি। মহাকাশে আমি রাতের পর রাত মুগ্ধ হয়ে নীল পৃথিবীটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেই পৃথিবীটাতে তুই যেন বেঁচে থাকতে পারিস, তোর মতো আরো লক্ষ কোটি মানুষ যেন বেঁচে থাকতে পারে সে জন্যে আমি গিয়েছি। আমার উপর রাগ করে থাকিস না মা! দোহাই তোর।”

ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “না, মা। আমি তোমার উপর রাগ করে নাই!”

“ত্রাতিনা মা আমার, আমার হাতে সময় নেই। একেবারে সময় নেই। আমার এখনই তোকে নিয়ে অনাথ আশ্রমে যেতে হবে। আমি নিজে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। আমি জানি, সেখানে অনেক ভাইবোনকে নিয়ে বড় হওয়া যায়। সবাই মিলে বিশাল একটা পরিবার হয়, সেখানে সবাই সবার আপনজন। তুই নিশ্চয়ই আপনজনদের নিয়ে বড় হয়েছিস, তাই না মা?”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, মা। আমি আপনজনদের মাঝে বড় হয়েছি।”

“তুই এখন বড় হয়েছিস-কতোটুকু বড় হয়েছিস, সেটা তো জানি না। তোর মাথায় কী ঘন কালো চুল। তোর চোখগুলো কী গভীর কালো? তোর কোন বিষয় পড়তে ভালো লাগে? বিজ্ঞান? গণিত? সাহিত্য? গান শুনিস তুই? কার গান শুনতে ভালো লাগে তোর?”

ত্রাতিনা দেখলো, তার মা হঠাৎ থেমে গেল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “আমার এখন যেতে হবে মা। আমি যাই? তোকে কী একটিবার আমার বুকে চেপে ধরতে পারব? শক্ত করে চেপে ধরে রাখব, যেন তুই চলে যেতে না পারিস…”

ত্রাতিনা দেখলো, তার মা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে থরথর করে কাঁপতে থাকে, কোনোভাবে সে নিজেকে সামলাতে পারে না।

হঠাৎ সে অনুভব করল, কেউ তার মাথায় হাত রেখেছে। ত্রাতিনা চোখ থেকে গগলস খুলে তাকাল। সামনের সিটে বসে থাকা বয়স্ক মহিলাটি তার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “সোনামনি মনে হচ্ছে কোনো কিছু দেখে তুমি খুব বিচলিত হয়েছ। আমি কী কোনোভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না। কেউ না।”

বয়স্ক মহিলা গভীর স্নেহে ত্রাতিনার হাতটি ধরে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

.

২.২

মহাকাশ ইনস্টিটিউটের এক পাশে বিশাল একটি কমপ্লেক্স। উঁচু ছাদ, বড় হলঘর। তার মাঝখানে একটি বড় সেন্ট্রিফিউজ। সেন্ট্রিফিউজের দুই পাশে দুটো ছোট কুঠুরি—যার ভেতরে একজন মানুষকে কোনোভাবে রাখা যায়। মানুষটিকে শক্ত একটা সিট বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সেন্ট্রিফিউজটিকে তখন ধীরে ঘোরানো শুরু হয়। প্রথমে আস্তে তারপর গতিবেগ বাড়তে থাকে। কুঠুরির ভেতরে সিট বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখা মানুষটি তখন ঘূর্ণনের চাপটি অনুভব করতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই চাপ বাড়তে থাকে। মহাকাশচারী হওয়ার ট্রেনিংয়ের এটি হচ্ছে একেবারে প্রথম ধাপ। আজকে এই সেন্ট্রিফিউজের এক পাশে ত্রাতিনা, অন্য পাশে ইনস্টিটিউটের অন্য একটি ছাত্র।

ঘূর্ণনের পূর্ণ মাত্রা পৌঁছানোর পর সেন্ট্রিফিউজের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হল। তখন ধীরে ধীরে সেন্ট্রিফিউজের গতি কমে আসতে থাকে। সেন্ট্রিফিউজ পুরোপুরি থেমে যাবার পর দু’জন টেকনিশিয়ান দুই পাশের দুটো কুঠুরি খুলে দিল এবং তার ভেতর থেকে ত্রাতিনা আর অন্য ছাত্রটি বের হয়ে এলো। ত্রাতিনা বেশ স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে তার সহপাঠী ছাত্রটির দিকে এগিয়ে যায়। অন্য ছাত্রটির চেহারা যথেষ্ট বিধ্বস্ত। সে টলতে টলতে কোনোভাবে এগিয়ে একটা পিলার ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে।

ত্রাতিনা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল”কী খবর কিহি, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার উপর দিয়ে একটা সাইক্লোন বয়ে গেছে।”

কিহি মাথা তুলে বলল, “শুধু সাইক্লোন না ত্রাতিনা, আমার উপর দিয়ে টাইফুন টর্নেডো সুনামি সবকিছু বয়ে গেছে। এই সেন্ট্রিফিউজটা হচ্ছে মানুষের উপর নির্যাতন করার একটা যন্ত্র!”

ত্রাতিনা শব্দ করে হাসল। বলল, “মহাকাশচারীদের ট্রেনিংয়ের প্রথম অংশই হচ্ছে ত্বরণের শক্তিতে অভ্যস্ত হওয়া। এটাকে সকালের ব্রেক ফাস্টের মতো ধরে নাও, প্রতিদিন নিয়ম করে ভোরবেলা এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে।”

কিহি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “কিন্তু তুমি এতো সহজে এটা সহ্য করো কেমন করে?”

ত্রাতিনা বলল, “জানি না!” সে ইচ্ছে করলেই বলতে পারতো আমার মা ছিলেন একজন মহাকাশচারী–হয়তো আমার রক্তের মাঝে মহাকাশচারী হওয়ার রক্ত আছে! কিন্তু সে সেটি বলল না। তার মায়ের ব্যাপারটি একান্ত ভাবেই তার নিজের, কাউকে সে তার কথা বলবে না।

কিহি খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে বলল, “চল যাই।”

“চল।”

দু’জনে সেন্ট্রিফিউজ কমপ্লেক্স থেকে বের হয়ে এলো। বাইরে শরতের শীতল হাওয়া। ক্যাম্পাসের বড় বড় গাছগুলোর পাতার রং বদলাতে শুরু করেছে।

কিহি বলল, “খুব খিদে লেগেছে। কিছু একটা খেতে হবে।”

ত্রাতিনা বলল, “যাও। ক্যাফেটেরিয়া থেকে কিছু একটা খেয়ে এসো।”

“তুমি যাবে না?”

“না। আমার খিদে লাগেনি। খাওয়ার সময় ছাড়া আমার খিদে লাগে।”

“ঠিক আছে, কিছু খেতে না চাইলে নাই–একটু কফি খেতে পার আমার সাথে।”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “না কিহি। আমার একটু লাইব্রেরিতে যেতে হবে।”

কিহি একটু অবাক হয়ে বলল, “আমাদের লেখাপড়া এখনো শুরু হয়নি। তুমি দিন রাত লাইব্রেরিতে বসে কী কর?”।

ত্রাতিনা হাসল। বলল, “লেখাপড়া শুরু হয়নি বলেই তো এখন লাইব্রেরিতে সময় কাটাতে পারছি। একবার শুরু হলে কী আর নিঃশ্বাস নিতে পারব?”

কিহি একটু অবাক হয়ে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী করো তুমি লাইব্রেরিতে?”

“পড়ি। নিরিবিলিতে পড়ার জন্য লাইব্রেরি থেকে ভালো কোনো জায়গা নেই।”

“কী পড়!”

“এইতো, যা ভালো লাগে। ইতিহাস, পৃথিবীর ইতিহাস।” কিহি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ত্রাতিনা কিহির দিকে হাত নেড়ে লাইব্রেরির দিকে হেঁটে যেতে থাকে।

ত্রাতিনা স্পষ্ট করে কিহিকে বলেনি যে লাইব্রেরিতে কী করে। তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ত্রাতিনা তার মায়ের ক্রিস্টালটি থেকে জেনেছে যে, খুব রহস্যময়ভাবে তার মাকে চলে যেতে হয়েছিল। তার মা একজন মহাকাশচারী, কাজেই কোথাও যদি যেতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই মহাকাশে গিয়েছে। কেন গিয়েছে? কী করেছে তার মা? কেন করতে হয়েছে? ত্রাতিনা সেটি বের করতে চায়। ষোল বছর আগের তথ্যগুলো সে খুঁজে খুঁজে বের করছে। সবগুলো একটা পাজলের মতো। টুকরো টুকরো তথ্যগুলো সেই পাজলের একেকটা অংশ। খুব ধীরে ধীরে সেই রহস্যময় সময়টিতে কী হয়েছিল, সেই বিষয়টি ত্রাতিনার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারে তার মায়ের অনেক তথ্য আছে। ত্রাতিনা বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করেছে চতুর্থ বর্ষে ঘূর্ণায়মান মহাকাশ স্টেশনে অবতরণের একটা পদ্ধতি তাদের শেখানো হবে, এই পদ্ধতিটির নাম রায়ীনা পদ্ধতি–তার মায়ের নামানুসারে। কী আশ্চর্য। তার বাবা সম্পর্কে বিশেষ তথ্য নেই। খুব অল্প সময়ের জন্যে তার বাবার সাথে পরিচয় হয়েছিল, ত্রাতিনার জন্ম হওয়ার আগেই তার বাবা হারিয়ে গিয়েছে। কেন হারিয়ে গিয়েছে, কোথায় হারিয়ে গেছে সে সম্পর্ক কোনো তথ্য নেই।

তার নিজের সম্পর্কেও একটা লাইন লেখা আছে, লাইনটা এরকম–রায়ীনার শিশুকন্যার নাম ত্রাতিনা। রায়ীনার ইচ্ছানুসারে সে কোনো একটি অনাথ আশ্রমে বড় হচ্ছে।

তথ্য ভাণ্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, তার মায়ের মৃত্যুর দিনটি, অনাথ আশ্রমে তাকে রেখে আসার পরদিন তার মা মারা গিয়েছে। ত্রাতিনা অনুমান করতে পারে, খুব একটা জরুরি কাজে তার মা মহাকাশে অভিযান করেছিল। কাজটি করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনায় মা মারা গিয়েছে, ব্যাপারটা সেরকম নয়। তার মা নিশ্চিতভাবে জানতো যে সে মারা যাবে। সেজন্যে তার মা ত্রাতিনাকে অনাথ আশ্রমে রেখে গেছে।

ত্রাতিনা তার মায়ের মৃত্যুর দিনটিতে মহাকাশে কী ঘটেছিল, সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। বিষয়টি রহস্যময়। তথ্য ভাণ্ডারে ইচ্ছা করে কিছু তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। মনে হয়, অনেক তথ্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেদিন উত্তরের কয়েকটা শহরে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। কিছু কিছু এলাকায় যোগাযোগ বন্ধ ছিল, এরকম কিছু তথ্য আছে। কিন্তু সেখান থেকে কী ঘটেছিল, অনুমান করা কঠিন। ত্রাতিনা তবু বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

লাইব্রেরিতে বসে বসে সে ষোল বছর আগের সেই রহস্যময় সময়টির খুঁটিনাটি তথ্য খুঁজে বের করে। কোনো তথ্য গোপন করা হলে সেটিও বের হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে বিজ্ঞানীরা। তারা মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে না। তার মা কীভাবে মারা গিয়েছিল, সেই তথ্যটি গোপন করার নিশ্চয়ই একটা কারণ ছিল। কারণটা কী হতে পারে, ত্রাতিনা বুঝতে পারছে না।

.

ত্রাতিনা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর পেয়ে গেল একেবারে হঠাৎ করে। তাদের মহাকাশের ইতিহাসের উপর লেকচার দেওয়ার জন্যে একজন বয়স্ক মহাকাশচারী এসেছেন। দুই ঘণ্টার টানা লেকচার দিয়ে মহাকাশচারী ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করল, তাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি না। সবারই কোনো না কোনো প্রশ্ন, বয়স্ক মহাকাশচারী ধৈর্য ধরে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল। তখন একজন জিজ্ঞেস করল, “তুমি তো অনেক অভিযান করেছ। কখনো কী খুব বিপজ্জনক মিশন করেছ?”

বয়স্ক মহাকাশচারী মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। আমি আমার ক্রুদের নিয়ে একবার খুব বিপদে পড়েছিলাম। মহাকাশে হঠাৎ করে আমাদের মহাকাশযানের সমস্ত কমিউনিকেশন্স বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুরো মহাকাশযানটি হয়ে গেল একটা জড় পদার্থ! অনবোর্ড কোয়াকম্প পর্যন্ত কাজ করছে না। শুধুমাত্র ইঞ্জিন অন অফ করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলাম কোনো যোগাযোগ ছাড়া।”

আরেকজন জানতে চাইল, “কীভাবে কমিউনিকেশন্স বন্ধ হল?”

“রেডিয়েশান। হঠাৎ করে একটা তীব্র গামা রে বার্স্ট এসে ইলেকট্রনিক্স নষ্ট করে দিল।”

“রেডিয়েশান কোথা থেকে এলো?”

“মহাকাশে মাঝে মাঝে রেডিয়েশান বাস্ট আসে। সূর্য থেকেই অনেক ধরনের বাস্ট আসে।”

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “তখন তোমার বয়স কতো ছিল?”

মহাকাশচারী হাসার চেষ্টা করল। বলল, “বয়স কম ছিল। ষোল বছর আগে–আমার বয়স তখন মাত্র ষাট!”

ত্রাতিনা ভিতরে ভিতরে চমকে উঠল। ষোল বছর আগে রেডিয়েশান বাচেঁ মহাকাশযানের ইলেকট্রনিক্স নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? সে হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী তারিখটি মনে আছে?”

“মনে থাকার কথা নয়, আমার দিন তারিখ মনে থাকে না। তবে ঘটনাক্রমে আমার তারিখটা মনে আছে। সেদিন ছিল আমাদের বিবাহ বার্ষিকী, সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ।”

ত্রাতিনা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। তার মায়ের রহস্যজনক মৃত্যুর দিনটিও সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ, ঠিক ষোল বছর আগে।

.

এতোদিন ত্রাতিনা বিচ্ছিনভাবে খোঁজখবর নিচ্ছিল। হঠাৎ করে সে খোঁজ খবর নেওয়ার একটি সুনির্দিষ্ট দিক খুঁজে পেলো। ষোল বছর আগে সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ আরো অন্য মহাকাশযান কী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল? হয়ে থাকলে কোথায়? কীভাবে?

পরের কয়েক সপ্তাহে সে ক্ষতিগ্রস্ত মহাকাশযানের খোঁজ নিতে থাকে। বিভিন্ন মহাকাশচারীর সাথে কথা বলে, তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চায়। পৃথিবীর বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে লগ ঘাঁটাঘাঁটি করে সে অনুমান করতে পারে সেই দিনটিতে মহাকাশে একটা নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তার মা নিশ্চয়ই সেই বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিল। তার মা জানতো সে মারা যাবে, কারণ নিশ্চয়ই বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছিল তার মা। মহাকাশ থেকে একটা গ্রহকণা ছুটে এলে সেগুলোকে ধ্বংস করার জন্যে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটননা হতে পারে। কিন্তু সেটি করার জন্যে কাউকে নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে যেতে হয় না। নিচ থেকে সেটি উড়িয়ে দেয়া যায়। তার মা বোমাটি নিয়ে গিয়েছিল। কেন?

ত্রাতিনা হঠাৎ করে ঠিক করল, সে ব্যাপারটি জানতে চেয়ে সামরিক বাহিনীর সর্ব প্রধানকে একটি চিঠি লিখবে।

ত্রাতিনা লিখল:

কমান্ডার লী,

আমার নাম ত্রাতিনা। আমার মায়ের নাম রায়ীনা। আমার মা ষোল বছর আগে সেপ্টেম্বরের বারো তারিখে মহাকাশে একটি নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণ করার জন্যে নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন।

কারণটি জানার আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে।

বিনীত
ত্রাতিনা

ত্রাতিনা চিঠিটাকে যোগাযোগ মডিউলে প্রবেশ করালো, নিরাপত্তা সূচক মাত্রা দিল, এনক্রিপ্ট করলো। তারপর পাঠিয়ে দিল।

ষোল বছরের একটি মেয়ে হয়ে পৃথিবীর সামরিক বাহিনীর প্রধানের কাছে একটা চিঠি পাঠানোর বিষয়টা ঠিক হল কিনা, সে বুঝতে পারল না। সে অবশ্যি বোঝার খুব বেশি চেষ্টাও করল না।

.

২.৩

ক্যাম্পাসে দুপুর বেলা ট্রলিতে করে নানা ধরনের খাবার নিয়ে আসা হয়। ছাত্রছাত্রীরা সেই খাবার নিয়ে ক্যাম্পাসের খোলা জায়গায় বসে গল্পগুজব করতে করতে খায়। আজকেও ত্রাতিনা খাবারের প্যাকেট নিয়ে কিহি এবং আরো কয়েকজনের সাথে খেতে বসেছে। দক্ষিণ অঞ্চলের খাবার, তুলনামূলকভাবে ঝাল বেশি, খেতে খেতে ত্রাতিনা আহা উঁহু করছে তখন অনেক দূর থেকে সে চাপা এক ধরনের গুম গুম শব্দ শুনতে পেলো। একটু অবাক হয়ে ত্রাতিনা বলল, “কিসের শব্দ?”

কিহি বলল, “আকাশ তো পরিষ্কার। মেঘের ডাক তো হতে পারে না।”

তখন ত্রাতিনা বহু দূরে এক সাথে অনেকগুলো বাইভার্বালকে আসতে দেখলো। এর আগে সে কখনো একসাথে এতোগুলো বাইভার্বালকে উড়তে দেখেনি। ত্রাতিনা বলল, “দেখেছো কতগুলো বাইভার্বাল একসাথে?”

সবাই দেখলো। কিহি বলল, “কোথায় যাচ্ছে কে জানে।”

খেতে খেতে সবাই তাকিয়ে থাকে এবং একটু অবাক হয়ে দেখলো বাইভার্বালগুলো শক্তিশালী ইঞ্জিনের গর্জন করে ঠিক তাদের ক্যাম্পাসের উপর এসে থেমে গেল। একটা বড় বাইভার্বাল মাটি থেকে এক মিটারের কাছাকাছি নেমে এলো। সেটার দরজা খুলে সেনাবাহিনীর পোশাক পরে থাকা অনেকগুলো সশস্ত্র মানুষ লাফিয়ে নেমে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ল। ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “সর্বনাশ! মনে হচ্ছে, আমাদের আক্রমণ করবে।”

কিহি বলল, “না, আক্রমণ করবে না। মনে হয়, সামরিক বাহিনীর বড় কোনো অফিসার এসেছে। এরা তার বডিগার্ড।”

কিহির ধারণা সত্যি। কয়েকটা বাইভার্বাল থেকে সামরিক পোশাক পরে থাকা মানুষগুলো নেমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর বিশাল একটা বাইভার্বাল তাদের কাছাকাছি এসে থামল। নিচে একটা অংশ খুলে যাবার পর সেখান থেকে একটা সিঁড়ি বের হয়ে আসে এবং সিঁড়ি দিয়ে সামরিক পোশাক পরে থাকা একজন ছোটখাটো মানুষ নেমে এলো! কিহি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “এটি কে?”

একজন ফিসফিস করে বলল, “সামরিক বাহিনীর প্রধান। কমান্ডার লী।”

ত্রাতিনা চমকে উঠল এবং সাথে সাথে সে বুঝে গেল, তার চিঠি পেয়ে কমান্ডার লী সরাসরি তার সাথে দেখা করতে চলে এসেছে। কী আশ্চর্য!

কিহি চাপা গলায় বলল, “কমান্ডার লী আমাদের ক্যাম্পাসে কেন এসেছে?”

ত্রাতিনা বলল, “মনে হয় আমার সাথে দেখা করতে।” কথাটাকে একটা কৌতুক মনে করে কিহি হেসে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে হাসি থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কারণ দেখতে পেল, কমান্ডার লী সরাসরি তাদের দিকে হেঁটে আসছে।

ত্রাতিনার সামনে এসে কমান্ডার লী থেমে গেল। তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ত্রাতিনা?”

ত্রাতিনা খাবারের প্যাকেটটা নিচে রেখে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি ত্রাতিনা।”

কমান্ডার লী তার হাত দুটো দুই পাশে ছড়িয়ে বলল, “মা, আমি কি তোমাকে একবার আলিঙ্গন করতে পারি?”

ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে দুই পা এগিয়ে যায়। কমান্ডার লী গভীর ভালোবাসায় তাকে আলিঙ্গন করে। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, “তুমি কি জান তোমার মা পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে?”

ত্রাতিনা বলল, “না জানি না।” কী কারণ কে জানে, ত্রাতিনার চোখ পানিতে ভিজে এলো।

কমান্ডার লী ত্রাতিনাকে শক্ত করে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, “পৃথিবীর মানুষের কাছে তোমার মায়ের কথা বলার সময় এখনো আসেনি। সারা পৃথিবীতে এখন আমরা মাত্র অল্প কয়জন সেটি জানি।”

ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “কখনো কী সেই সময় আসবে?”

কমান্ডার লী বলল, “আমরা আশা করছি আসবে। বিষয়টি অনেক জটিল। আমি তোমাকে একদিন সবকিছু বলব।”

“ধন্যবাদ কমান্ডার লী।”

কমান্ডার লী ত্রাতিনাকে ছেড়ে দিয়ে ঘুরে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবে তার বিশাল বাইভার্বালের দিকে হাঁটতে শুরু করে। বিশাল বাইভার্বালটি থেকে একটা সিঁড়ি নেমে এলো, কমান্ডার লী সেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। গোলাকার দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল এবং দেখতে দেখতে সবগুলো বাইভার্বাল গর্জন করে উপরে উঠে যায়। তারপর ঘুরে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে উড়ে যেতে থাকে।

বাইভার্বালগুলো চোখের আড়াল হয়ে যাবার পর সবাই ত্রাতিনার দিকে ঘুরে তাকালো। তারা তাদের চোখের সামনে যেটা দেখেছে, সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না। কেউ সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছে না। ত্রাতিনা তার খাবারের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে যেন কিছুই হয়নি সেরকম ভঙ্গি করে খেতে শুরু করে।

কিহি সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “কমান্ডার লী তোমার কাছে কেন এসেছিল?”

“আমি তাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। চিঠিটা পড়ে উত্তর না দিয়ে সরাসরি চলে এসেছে।”

“কী লিখেছিলে চিঠিতে?”

“এই তো-ব্যক্তিগত কথা।”

“কমান্ডার লী তোমার কানে ফিসফিস করে কিছু বলেছে। কী বলেছে?”

ত্রাতিনা খুবই শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “বলেছে আমার চিঠিতে কয়েকটা বানান ভুল ছিল। শুদ্ধ বানানগুলো কী হবে সেটা বলে দিয়েছে।”

কিহি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করছ, তাই না?”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। হাসি হাসি মুখে বলল, “তুমি সঠিক অনুমান করেছ কিহি।”

“কেন তুমি ঠাট্টা করছ?”

“কারণ আসলে যে কথাটি বলেছে, সেটা অনেক কম বিশ্বাসযোগ্য! তোমাদেরকে বলা হলে তোমরা কেউ বিশ্বাস করবে না।”

পাশে বসে থাকা একটি মেয়ে কাছে এসে বলল, “আমি কী তোমার সাথে একটা ছবি তুলতে পারি?”

ত্রাতিনা হেসে বলল, “কেন পারবে না! শুধু সেই মেয়েটি নয়, আরো অনেকেই তখন তার সাথে ছবি তুললো।

.

কমান্ডার লী ত্রাতিনাকে কথা দিয়েছিল যে, তার মায়ের পুরো ব্যাপারটি অনেক জটিল। কোনো একদিন তাকে সবকিছু বলবে। কখন বলবে, সে অনুমান করতে পারছিল না। কিন্তু সপ্তাহ শেষ হবার আগেই তার সাথে কমান্ডার লীয়ের দেখা হলো। এবারে দেখা হলো সবার অগোচরে।।

ছুটির দিনগুলোতে ত্রাতিনা মিউজিয়ামগুলোতে ঘুরে বেড়ায়। তার বয়সী ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই কখনো মিউজিয়ামে সময় কাটাতে চায় না। তাই প্রায় সময়েই সে একা একা ঘোরে। সে যখন একটি প্রাচীন ছবির সামনে খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকখানি অবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন হঠাৎ শুনতে পেলো একজন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “ত্রাতিনা?”

ত্রাতিনা ঘুরে তাকালো। মধ্যবয়স্ক সাদাসিধে চেহারার একজন মানুষ।। তাকে আগে কখনো দেখেছে বলে তার মনে পড়ল না। মানুষটি মাথাটা আরেকটু নিচু করে বলল, “কমান্ডার লী আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে। তোমার যদি সেরকম ব্যস্ততা না থাকে, তাহলে তোমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলেছে।”

ত্রাতিনা একটু চমকে উঠল। বলল, “না, মিউজিয়ামে ছবি দেখার মাঝে কোনো ব্যস্ততা নেই।”

“চমৎকার। চল তাহলে।”

ত্রাতিনা মানুষটির সাথে বের হলো। মিউজিয়ামের গেটে দাঁড়ানোর সাথে সাথে উপর থেকে একটা সাদামাটা বাইভার্বাল নিচে নেমে এলো। মানুষটির সাথে বাইভার্বালটিতে উঠে ত্রাতিনা অবাক হয়ে যায়। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু ভেতরে বাইভার্বালটি চমকপ্রদ। এক কথায় অসাধারণ। ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “কী সুন্দর।”

“হ্যাঁ। তোমাকে নেয়ার জন্যে কমান্ডার লী এই বাইভার্বালটি পাঠিয়েছে। তুমি কে আমি জানি না, কিন্তু কমান্ডার লী তোমাকে খুব স্নেহ করে। তার কাছে তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

ত্রাতিনা কী বলবে বুঝতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, “কমান্ডার লীয়ের মতো একজন মানুষের স্নেহ পাওয়া খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি নিশ্চয়ই খুব সৌভাগ্যবান।”

মানুষটি একটুখানি হাসার ভঙ্গি করে বলল, “আসলে সৌভাগ্যের ব্যাপারটি কিন্তু কখনো বিনা কারণে ঘটে না। সৌভাগ্যের কারণ থাকে!”

মানুষটি তখন ত্রাতিনার ইনস্টিটিউট নিয়ে হালকা ভদ্রতার কথা বলতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা সেনাবাহিনীর বড় কমপ্লেক্সে ঢুকে যায়। ত্রাতিনা জীবনেও কল্পনা করেনি সে কখনো এখানে আসতে পারবে।

বাইভার্বাল থেকে নেমে চওড়া সিঁড়ি দিয়ে ত্রাতিনা মানুষটির পিছু পিছু বড় একটা দালানে ঢুকে যায়। কয়েকটা করিডোর পার হয়ে তারা বড় একটা হলঘরে পৌঁছাল। হলঘরের ঠিক মাঝখানে একটি বড় টেবিলে সোনালী চুলের হাসিখুশি একজন মহিলা বসেছিল। ত্রাতিনাকে দেখে খুশি হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই ত্রাতিনা। এসো আমার সাথে। কমান্ডার লী তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”

সাদাসিধে চেহারার মানুষটি ত্রাতিনার দিকে হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেল। ত্রাতিনা সোনালী চুলের হাসিখুশি মহিলার পিছু পিছু হলঘরের শেষ মাথায় একটা বড় দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “কমান্ডার লী, তোমার অতিথি চলে এসেছে।”

কমান্ডার লী জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিল। মহিলার গলায় স্বর শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। ত্রাতিনাকে দেখে আনন্দের ভঙ্গি করে দুই হাত তুলে এগিয়ে এলো। বলল, “এসো ত্রাতিনা। এসো। আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”

ত্রাতিনা বলল, “না কোনো অসুবিধে হয়নি। বাইভার্বালটি খুবই সুন্দর ছিল।”

কমান্ডার লী বলল, “এর থেকেও সুন্দর বাইভার্বাল আছে। কোনো এক জোছনা রাতে তোমাকে নিয়ে বের হবো। দেখবে তোমার ভালো লাগবে।”

“ধন্যবাদ কমান্ডার লী।”

“তুমি কী খাবে বল।”

“আমি খেয়ে এসেছি। কিছু খাব না।”

“কিছু একটা খাও। আমাদের এখানে খুব ভালো উত্তেজক পানীয় তৈরি করে। খেলে মনে হবে বয়স দশ বছর কমে গেছে।”

ত্রাতিনা বলল, “আমার বয়স ষোলো, দশ বছর কমে গেলে একেবারে নাবালক হয়ে যাব।”

কমান্ডার লী হা হা করে হাসল। বলল, “এটা একটা কথার কথা। আক্ষরিকভাবে নিও না।”

কমান্ডার লী কোনো একটা বোতামে চাপ দিয়ে পানীয়ের কথা বলে দিল এবং প্রায় সাথে সাথেই সোনালী চুলের মহিলাটি দু’টি সুন্দর গ্লাসে করে হালকা সবুজ রংয়ের এক ধরনের পানীয় নিয়ে এল। টেবিলে গ্লাস দুটো রেখে বলল, “আর কিছু লাগবে কমান্ডার লী?”

“না আর কিছু লাগবে না।”

“উত্তর অঞ্চলের বাদামী বাদাম আছে।”

”ধন্যবাদ কিকি। লাগবে না।”

“তাহলে মিষ্টি জাতীয় কিছু? দক্ষিণের ফার্মেন্ট করা মিষ্টি।”

কমান্ডার লী ধৈর্য ধরে বলল, “লাগবে না। তুমি এবারে যেতে পার। কিকি।”

“আমি ভেবেছিলাম তোমার কমবয়সী অতিথিকে তুমি আরো একটু বেশি আপ্যায়ন করবে।”

কমান্ডার লী বলল, “আমার মনে হয় যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু আপ্যায়ন করা হয়েছে। তাছাড়া শুধু মাত্র খাবার দিয়ে আপ্যায়ন হয় না। আপ্যায়নের আরো অনেক পদ্ধতি আছে। তুমি আস্তে আস্তে শিখবে।”

সোনালী চুলের মহিলাটি বলল, “আমি আস্তে আস্তে নয়, আমি দ্রুত শিখতে চাই।”

“ঠিক আছে, আমি তোমার কোম্পানীকে সেভাবে রিপোর্ট করব।”

সোনালী চুলের মহিলাটি ঘর থেকে বের হওয়ায় পর কমান্ডার লী হতাশভাবে মাথা নাড়ল। বলল, “তুমি দেখেছ, এর সবকিছু ঠিক আছে, কিন্তু তারপরও কী যেন ঠিক নেই।

“একটু বেশি আগ্রহী–”

“মানুষ আগ্রহী হলে সমস্যা নেই। রবোট বেশি আগ্রহী হলে সমস্যা।”

ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “এই মহিলাটি রবোট?”

“হ্যাঁ। পরীক্ষামূলক রবোট। আমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে দিয়েছে।”

ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “কী আশ্চর্য! আমি শুনেছিলাম মানুষের চেহারার রবোট তৈরি করা বেআইনী।”

“তুমি ঠিকই শুনেছ। কিন্তু আমাদের কিছু দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ অভিযান করতে হবে। সেখানে মহাকাশচারীদের সঙ্গী হিসেবে মানুষের মতো রবোট দেয়া যায় কি না, সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা হচ্ছে। সেজন্য এই রবোটগুলো তৈরি হয়েছে।”

ত্রাতিনা বলল, “কী আশ্চর্য! আমি দেখে একেবারেই বুঝতে পারিনি।” হি হি করে হেসে বলল, “ভেবেছি মহিলাটি একটু বেশি কথা বলে!”

কমান্ডার লী পানীয়ের গ্লাসটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, “নাও, পানীয়টি এক চুমুক খেয়ে দেখো।”

ত্রাতিনা পানীয়টিতে চুমুক দিয়েই বুঝতে পারে, কমান্ডার লী আসলেই ভুল বলেনি। সত্যি সত্যি পানীয়টি এক চুমুক খেতেই তার মনে হলো সারা শরীরে বুঝি এক ধরনের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে।

ত্রাতিনা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট দুটো মুছে বলল, “কমান্ডার লী, তুমি বলেছিলে আমাকে তুমি আমার মায়ের কথা বলবে।”

“হ্যাঁ। বলব। সে জন্যে আজ তোমাকে আমি ডেকে এনেছি। কিন্তু তার আগে আমাকে একটা ছোট আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হবে। আমাকে একজনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।”

“তুমি সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তুমি কার কাছ থেকে অনুমতি নেবে?”

“বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক রিহার কাছ থেকে।”

ত্রাতিনা চমকে উঠল, “মহামান্য রিহা?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি তাকে দেখেছ?”

কমান্ডার লী হাসল। বলল, “দেখেছি। অনেকবার দেখেছি। তুমিও দেখবে। মহামান্য রিহা তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।”

ত্রাতিনা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “আমার সাথে?”

“হ্যাঁ। তোমার সাথে। চল, আমরা যাই।”

হলঘরের ভেতর দিয়ে যাবার সময় রবোট মহিলাটি বলল, “কমান্ডার লী, আমার মনে হয় এই মেয়েটিকে প্রয়োজনের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে যাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তোমার বেসামরিক কিশোর কিশোরীকে এতো গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। অন্য কেউ সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারবে।”

কমান্ডার লী বলল, “কিকি, তুমি এখন একটু বিশ্রাম নাও। মনে হয়, তোমার কপোট্রন উত্তপ্ত হয়ে আছে।”

.

২.৪

ত্রাতিনা ভেবেছিল মহামান্য রিহার বাসভনটি হবে বিশাল। তার ঘরের মেঝে হবে মার্বেল পাথরের। দেওয়াল হবে গ্রানাইটের। ঘরের দরজা হবে মূল্যবান ক্রোমিয়াম এলয়ের। ঘরের ভেতর থাকবে আধুনিক যন্ত্রপাতি। কিন্তু ত্রাতিনা খুবই অবাক হয়ে দেখলো, তার বাসভবনটি আসলে ছোট একটি দোতলা কাঠের বাসা। বাসার চারপাশে বড় বড় গাছ এবং সেই গাছগুলোতে অসংখ্য পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে।

ঘরের সামনে কোনো গার্ড নেই। কমান্ডার লী ত্রাতিনাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। ত্রাতিনা কখনো কাঠের সিঁড়ি ব্যবহার করেনি। সে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করল, সিঁড়িটা তাদের পায়ের নিচে রীতিমত কাঁচক্যাচ শব্দ করে জানান দিচ্ছে।

দোতলায় একটা বড় ঘর। তার পাশে একটা দরজা। সেই দরজাটির অপর পাশে বারান্দা। ত্রাতিনা লক্ষ্য করল, কমান্ডার লী এই বাসাটার সাথে বেশ পরিচিত। দরজাটি অল্প একটু খুলে বলল, “আসতে পারি মহামান্য রিহা?”

বারান্দা থেকে মহামান্য রিহা বললেন, “এসো এসো।”

কমান্ডার লী বলল, “আমি রায়ীনার মেয়েটিকে নিয়ে এসেছি। আপনি তাকে দেখতে চেয়েছিলেন।”

“নিয়ে এসো।”

কমান্ডার লী ত্রাতিনার হাত ধরে বারান্দায় গেল। ত্রাতিনা তখন অল্প অল্প কাঁপছে। এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষটির সাথে তার দেখা হবে। তার হৃৎপিণ্ড ধ্বক ধ্বক করছে, মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডের শব্দে সে আর কিছু শুনতে পাবে না।

মহামান্য রিহা বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শরীরে সাদা একটি ঢিলেঢালা পোশাক। মাথার চুল এলোমেলো, মুখমণ্ডলে বয়সের ছাপ। ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, “এসো মা। কাছে এসো।”

ত্রাতিনা এগিয়ে গেল। মহামান্য রিহার কাছাকাছি আসতেই হাত বাড়িয়ে ত্রাতিনার কনুইটি ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন, “তুমি রায়ীনার মেয়ে ত্রাতিনা?”

ত্রাতিনার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। সে কোনোভাবে তার মাথা নাড়ল।

“তোমার মাকে আমি দেখিনি। আমি শেষবারের মতো তাকে দেখতে চেয়েছিলাম। কমান্ডার বলল, সময় নেই। তাই আর দেখা হল না।” মহামান্য রিহা কথা শেষ করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। নিঃশ্বাসটাকে কেমন জানি দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনালো।

মহামান্য রিহা ত্রাতিনার কনুইটা ছেড়ে দিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “তোমার মা পৃথিবীর সব মানুষকে রক্ষা করেছে, সেটি তুমি জান?”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল।

কমান্ডার লী বলল, “বিস্তারিত কিছু জানে না। সত্যি কথা বলতে কী, কেউ তাকে কিছু বলেনি। ত্রাতিনা নিজেই চিন্তা করে করে অনেক কিছু বের করেছে। সে নিজে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, তা না হলে আমি কিছুতেই তাকে খুঁজে পেতাম না। অনাথ আশ্রমগুলোর নিয়ম খুব কঠিন। তারা কারো তথ্য কাউকে দেয় না।”

মহামান্য রিহা মাথা নাড়লেন। বললেন, “কেন দেবে? একজন মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে সম্মান করতে হয়।”

কমান্ডার লী বলল, “আমার মনে হয় রায়ীনার মেয়ের তার মা সম্পর্কে জানার অধিকার আছে। আপনি অনুমতি দিলে আমি তাকে তার মা সম্পর্কে বলতে পারি!”

মহামান্য রিহা কিছুক্ষণ ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কমান্ডার লীকে বললেন, “মেয়েটি একেবারে বাচ্চা মেয়ে! তাকে কী বলবে? কতোটুকু বলবে?”

কমান্ডার লী বলল, “আমার মনে হয়, সেটি নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করতে হবে না। মহাকাশ ইনস্টিটিউটে রাখা ত্রাতিনার প্রোফাইলটা আমি দেখেছি। ত্রাতিনার বয়স মাত্র ষোল, কিন্তু সে এর মাঝে পুরোপুরি দায়িত্বশীল একজন মানুষ। নিনিষ স্কেলে তার বুদ্ধিমত্তা আট পর্যায়ের।”

মহামান্য রিহা হা হা করে হাসলেন। বললেন, “নিনিষ স্কেলে আমার বুদ্ধিমত্তা কখনো মাপা হয়নি। মাপা হলে এটা টেনে টুনে ছয়ের বেশি হবে। বলে মনে হয় না!”

কমান্ডার লী বলল, “আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমরা বিদায় নিই। আপনি আমাদের সময় দিয়েছেন, সে জন্যে কৃতজ্ঞতা।”

মহামান্য রিহা ত্রাতিনার দিকে তাকালেন। একটুখানি হেসে বললেন, “কিন্তু আমি তো এই মেয়েটির গলার স্বরটুকু শুনতে পেলাম না!”

ত্রাতিনা মাথা নিচু করে বলল, “মহামান্য রিহা, আপনার সামনে কথা বলার সাহস আমার নেই।”

“আমি কোনো বাঘ ভালুক নই। আমাকে এতো ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি কিছু বলতে চাইলে বল।”

ত্রাতিনা বলল, “আমার কিছু বলার নেই মহামান্য রিহা।”

“যে মানুষটি এই পৃথিবীটা রক্ষা করেছে, তুমি তার মেয়ে। তোমার মায়ের কাছে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাতে পারিনি। তোমার কাছে জানাই।”

ত্রাতিনা বলল, “আমাকে লজ্জা দেবেন না মহামান্য রিহা। আমার মা শুধুমাত্র তার দায়িত্ব পালন করেছে। আপনি আমার মায়ের কৃতজ্ঞতাটুকু আমাকে জানিয়েছেন, সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।”

মহামান্য রিহা বললেন, “তুমি আমার কাছে এসেছ, তোমাকে আমার একটা উপহার দেয়া উচিত। বল তুমি কী উপহার চাও।”

ত্রাতিনার গলা কেঁপে উঠল, বলল, “আমি কোনো উপহার চাই না মহামান্য রিহা। আপনি আমার মাথায় হাত রেখেছেন, সেটি আমার সবচেয়ে বড় উপহার।”

কমান্ডার লী বলল, “ত্রাতিনা, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না তুমি কতো বড় সুযোগ পেয়েছ। সারা পৃথিবীতে এর আগে অন্য কেউ এ সুযোগ পেয়েছে বলে মনে হয় না। তুমি যা ইচ্ছা তাই চাইতে পার।”

ত্রাতিনা বলল, “মহামান্য রিহা, আমি শুধু একবার আপনাকে স্পর্শ করতে চাই।”

মহামান্য রিহা হাসলেন। হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “নাও স্পর্শ করো। একজন বৃদ্ধ মানুষের কুঞ্চিত চামড়া স্পর্শ করে তুমি কী পাবে আমি জানি না। জীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের আয়ু বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটি ঠিক হয়েছে কি না, বুঝতে পারছি না! আমার অর্ধশতক বছর আগে মারা যাওয়ার কথা ছিল।”

ত্রাতিনা মহামান্য রিহার হাতটা স্পর্শ করে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করে। এই মানুষটি পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ, সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ। সে তার হাত স্পর্শ করছে। কী আশ্চর্য!

মহামান্য রিহা বললেন, “তুমি এখনো ইচ্ছা করলে আরো কিছু চাইতে পার। বল কী চাও।”

ত্রাতিনা মাথা নিচু করে বলল, “সত্যি চাইব?”

“হ্যাঁ চাও।”

ত্রাতিনা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। তারপর সাহস সঞ্চয় করে এক নিঃশ্বাসে বলল, “মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার জন্যে মহাকাশে যে অভিযান চালানো হবে, আমি সেই অভিযানটি করতে চাই।”

কমান্ডার লী এবং মহামান্য রিহা একই সাথে একইভাবে চমকে উঠলেন। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। কিছুক্ষণ পর কমান্ডার লী বলল, “ত্রাতিনা, তুমি কেমন করে জান মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার জন্য একটি অভিযান হবে?”

ত্রাতিনা বলল, “বিষয়টা অনুমান করা কঠিন নয়। একটি গ্রহকণাকে

ত্রাতিনা ধ্বংস করার জন্যে কাউকে নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে মহাকাশে যেতে হয় না। সেটা খুব সহজে পৃথিবী থেকে ধবংস করা যায়। কিন্তু আমার মা নিজে গিয়েছিল, কারণ যেটি ধ্বংস করতে গিয়েছিল, সেটি গ্রহকণা ছিল না। সেটি নিশ্চয়ই ছিল কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর মহাকাশযান। পৃথিবীর মানুষ আগে হোক পরে হোক, সেই প্রাণীর মুখোমুখি হবে।”

মহামান্য রিহা মৃদু গলায় বললেন, “যুক্তিতে কোনো ভুল নেই।”

কমান্ডার লী বলল, “কিন্তু তুমি কেমন করে অনুমান করলে সে জন্যে মহাকাশ অভিযান হবে?”

“তোমার অফিসে মানুষের মতো দেখতে রবোর্ট দেখে এসেছি। তুমি বলেছ দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানের জন্যে সেগুলো তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানের কারণ আর কী হতে পারে?”

মহামান্য রিহা হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, “কমান্ডার লী, “বুদ্ধির খেলায় তুমি এই মেয়েটির কাছে হেরে গেছ। এই মেয়েটি তোমার গোপন থেকে গোপনতম প্রজেক্টের কথা জেনে গেছে!”

কমান্ডার লী মাথা চুলকে বলল, “ত্রাতিনা জেনে গেলে আমি দুর্ভাবনা করব না, ত্রাতিনা আমাদের নিজেদের মানুষ।”

ত্রাতিনা মহামান্য রিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “মহামান্য রিহা, আপনি কী অনুমতি দেবেন? আমার মা মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সংঘর্ষের একটি অংশের জন্যে দায়িত্ব নিয়েছে। আমি, তার মেয়ে অন্য অংশটির দায়িত্ব নিতে চাই। আমার মায়ের প্রতি সেটিই হবে আমার ভালোবাসা, আমার কৃতজ্ঞতা।”

এই প্রথম মহামান্য রিহার চেহারায় এক ধরনের গাম্ভীর্য নেমে এল। তিনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “মহাজাগতিক প্রাণীর বিরুদ্ধে সেই অভিযানটি হবে একেবারে অন্যরকম। তুমি শত চেষ্টা করেও তার প্রকৃতিটি অনুমান করতে পারবে না। সেই অভিযানটি হবে সময়সাপেক্ষ, একটি মহাকাশযানে টানা বারো বছর থাকা সোজা কথা নয়। যদিও বেশিরভাগ সময় হিমঘরে ঘুমিয়ে কাটাতে হবে। মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সংঘর্ষ শেষে ফিরে আসতে পারবে কি না, সেটি কেউ জানে না। যে যাবে, সে

আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে যাবে।”

ত্রাতিনা বলল, “আমি জানি মহামান্য রিহা। বেঁচে থাকার সময় দিয়ে আমি জীবনের পরিমাপ করি না। কী করেছি, সেটা দিয়ে জীবনের পরিমাপ করি।”

মহামান্য রিহা বললেন, “ঠিক আছে। আজ থেকে চার বছর পর তুমি যদি প্রমাণ করতে পারো তুমি একজন প্রথম শ্রেণীর মহাকাশচারী হতে পেরেছ, আমরা তোমাকে সেই অভিযানে পাঠাব।”

ত্রাতিনার প্রবল একটি ইচ্ছে হল সে ছুটে গিয়ে মহামান্য রিহাকে আলিঙ্গন করে। কিন্তু সে কিছু না করে নিচু গলায় বলল, “আপনাকে ধন্যবাদ রিহা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

গল্পের বিষয়:
সাইন্স-ফিকশন
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত