০১. প্রথম পর্ব
বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক মহামান্য রিহা দুই হাতে তার মাথার ধবধবে সাদা চুল এক মুহূর্তের জন্যে খামচে ধরলেন। তারপর মাথা তুলে কমান্ডার লীয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বলছ তুমি?”
এটি একটি প্রশ্ন। কিন্তু তার কথাটি প্রশ্নের মতো না শুনিয়ে অনেকটা হাহাকারের মতো শোনালো। কমান্ডার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মাথা তুলে নিচু গলায় বলল, “আমি দুঃখিত মহামান্য রিহা।”
মহামান্য রিহা শূন্য দৃষ্টিতে কমান্ডারের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “সারা পৃথিবীর মানুষ আমাকে তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছে, আর আমি তাদের রক্ষা করতে পারছি না?”
কমান্ডার লী নরম গলায় বলল, “এখনো আমাদের হাতে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় আছে। ঠিক করে বললে বলা যায় আটচল্লিশ ঘন্টা সতেরো মিনিট।”
“আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় থাকা আর সময় না থাকার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই কমান্ডার। শেষবার যখন এরকম ঘটনা ঘটেছিল, তখন আমরা ছয়মাস সময় পেয়েছিলাম। তারপরও সেটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন। প্রথম দুটো মিসাইল টার্গেট মিস করল। তিন নম্বরটা আঘাত করতে পারল, সেটাও আংশিক—”
কমান্ডার লী মাথা নিচু করে বলল, “আমি আমার পুরো বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত, আমাদের কী করতে হবে আদেশ করেন মহামান্য রিহা। আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করব।”
মহামান্য রিহা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “তুমি কমান্ড কাউন্সিলের সবাইকে ডেকে আনে। আধা ঘন্টার মাঝে আমি সবাইকে নিয়ে বসতে চাই। আর তুমি এর মাঝে তোমার পুরো বাহিনীকে নিয়ে টার্গেট লক করো। প্রয়োজন হলে বৃষ্টির মতো মিসাইল পাঠাও-”
“মহাকাশে অনেক উপগ্রহ মহামান্য রিহা, বৃষ্টির মতো পাঠালে অনেক প্রাণহানি হবে।”
মহামান্য রিহা মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, “না, না, একটাও প্রাণহানি হতে পারবে না। পৃথিবীর মানুষ আমাকে তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের একজনের প্রাণও নেয়ার অধিকার দেয়নি।”
কমান্ডার লী ইতস্তত করে বলল, “কয়েক বিলিয়ন প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যদি কিছু প্রাণ দিতে হয়, সেটি খুব বড় একটি অন্যায় নয় মহামান্য রিহা।”
মহামান্য রিহা হেঁটে জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন। মাথা নেড়ে বললেন, “না। না কমান্ডার, একজন মানুষের প্রাণও আমি নিতে পারব না। তুমি যাও, যত দ্রুত সম্ভব সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিলের সভার আয়োজন করো।”
কমান্ডার লী মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মহামান্য রিহা তার ছোট দোতালা কাঠের ঘরের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ ভরা নক্ষত্র তার মাঝে একটি দুটি বাই ভার্বোল মাঝে মাঝে চাপা গুঞ্জনের মতো শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। তার বাড়ির চারপাশে গাছ, সেখানে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। ঝিঁঝি পোকার চোখে ঘুম নেই, কিন্তু এখন মধ্যরাত, শহরের সব মানুষ তাদের ঘরে নিশ্চিন্ত নিরাপদে ঘুমাচ্ছে। কেউ জানে না, মহাকাশ থেকে একটি গ্রহকণা সরাসরি পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। যদি সেটাকে থামানো না যায়, সেটি আটচল্লিশ ঘন্টা পর আফ্রিকার সাহারাতে আঘাত করবে। পঁয়ষটি মিলিয়ন বছর আগে এরকম একটি গ্রহকণা পৃথিবীকে আঘাত করেছিল। পৃথিবীর বুক থেকে তখন ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। যদি এই গ্রহকণাটি পৃথিবীকে আঘাত করে, তাহলে মানব প্রজাতি ডাইনোসরের মতো পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
.
আধাঘণ্টার আগেই কমান্ড কাউন্সিলের সবাই শহর কেন্দ্রের বড় হলঘরটাতে। হাজির হলো। গভীর রাতে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আনা হয়েছে। কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যদের চেহারায় তার একটা ছাপ পড়েছে। উশকু খুশকু চুল, চোখে এক ধরনের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, শুকনো মুখ। নিজেদের আসনে সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। কোনো একটা কারণে আজ কেউ নিজেদের ভেতরেও কথা বলছে না।
মহামান্য রিহা হলঘরে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রতি সম্মান দেখালো। মহামান্য রিহা সেটা লক্ষ্য করলেন বলে মনে হল না। নিজের বড় চেয়ারটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তোমাদের সবাইকে এই গভীর রাতে ডেকে আনতে হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে পৃথিবী এর আগে এতো বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বলে মনে হয় না।”
কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যরা কেউ কোনো কথা বলল না। মহামান্য রিহা বললেন, “তোমরা সবাই জান, কী জন্যে আমি তোমাদের ডেকেছি। প্রায় সতুর কিলোমিটার চওড়া একটা গ্রহকণা আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর পৃথিবীতে আঘাত করবে। কক্ষপথ নির্ভুলভাবে বের করা হয়েছে, আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিতে সেটি ঘন্টায় প্রায় ষাট হাজার কিলোমিটার বেগে আঘাত করবে। আঘাতটি হবে তিন লক্ষ মাঝারি সাইজের হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের কাছাকাছি। আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড আঘাতের সাথে সাথে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। গ্রহকণাটি যখন আঘাত করবে, তখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে তার কক্ষপথে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হবে। সেই শূন্যতার ভেতর দিয়ে ধুলোবালি পাথর ধোঁয়া কয়েক সেকেন্ডের ভেতর বায়ুমণ্ডলের ওপরের অংশে ঢুকে যাবে। কয়েক মিনিটের ভেতর পুরো আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে।
কয়েক ঘণ্টার ভেতর সারা পৃথিবীর আকাশ কুচকুচে কালো হয়ে যাবে। পৃথিবী হবে একটি ঘন অন্ধকার গ্রহ। দুই থেকে তিন বছর আকাশ এভাবে অন্ধকার থাকবে। ধুলোবালি পৃথিবীতে ঝরে পড়তে আরো সময় নেবে। সূর্যের আলো ঢুকতে পারবে না বলে সমস্ত পৃথিবী হিমশীতল হয়ে যাবে। পৃথিবীর যত জীবিত প্রাণী, তার শতকরা নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই অংশ মারা যাবে। পৃথিবী হবে একটা প্রাণহীন গ্রহ।”
মহামান্য রিহা একটু থেমে টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক সেঁক পানি খেয়ে বললেন, “আমরা পৃথিবীতে এটা হতে দিতে পারি না। সেজন্যে তোমাদের ডেকে এনেছি। তোমরা বল আমরা কীভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারি?”
কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যরা একে অপরের দিকে তাকালো। জীব বিজ্ঞানী লিয়া সোজা হয়ে বসে বলল, “আমাদের হাতে সময় নেই। তাই আমি একেবারে সময় নেব না। যেটা বলতে চাই, সোজাসুজি সেটা বলছি। আমি সব সময় প্ল্যান বি প্রস্তুত রাখার পক্ষপাতী। প্ল্যান এ বা মূল প্ল্যানটি কাউন্সিলের সদস্যরা বের করে নিয়ে আসুক, সেই পরিকল্পনাটি যদি কাজ না করে, তাহলে কী করতে হবে আমি সেটি বলি।”
জীববিজ্ঞানী লিয়া একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “যদি আমাদের পরিকল্পনা কাজ না করে, তাহলে পৃথিবীটা অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে। শেষবার যখন এটা হয়েছিল, তখন ডাইনোসর ধ্বংস হয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণী পৃথিবীতে বংশ বিস্তার শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্ম নিতে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর সময় লেগেছিল। আমি মনে করি, এবারে সেটা হতে দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমি কয়েক হাজার নারী-পুরুষ এবং কয়েক লক্ষ মানব ভ্রুণ সংরক্ষণের পক্ষপাতী। পাহাড়ের গভীরে টানেল খুঁড়ে সেখানে হিমঘরে আমরা এভাবে মানব প্রজাতিকে রক্ষা করব। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার কয়েক বছর পর যখন আবার সেটা মানুষের বসবাসের উপযুক্ত হবে, পৃথিবীর মানুষ তখন আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবে। নতুন করে মানব সভ্যতার জন্ম হবে।”
ত্রাতিনা জীববিজ্ঞানী লিয়া তার কথা শেষ করে অন্যদের মুখের দিকে তাকালো, কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। লিয়া একটু ইতস্তত করে বলল, “আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলে মানবপ্রজাতি সংরক্ষণের এই দায়িত্বটুকু আমি নিতে পারি।”
মহামান্য রিহা তার চেয়ারে হেলান দিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, “লিয়া, তোমাকে ধন্যবাদ। মূল পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে কী করতে হবে, সেটা তুমি যথেষ্ট স্পষ্ট করে বলেছ এবং তোমাকে সেই দায়িত্ব দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে পছন্দ করি। মূল পরিকল্পনা কী হবে, সেটি ঠিক করার পর আমি তোমার প্ল্যান বি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”
মহামান্য রিহা চুপ করা মাত্রই পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বললেন, “গ্রহকণার খবরটি শোনার পর থেকে আমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব, আমি সেই তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। আমার বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু আমি খোলাখুলি বলে ফেলি। আমার ধারণা, আমরা এইবার পৃথিবী রক্ষা করতে পারব না।”
সবাই ঘুরে পদার্থবিজ্ঞানী রিশির দিকে তাকালো। পরিবেশ বিজ্ঞানী নিহি জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেন এটা মনে করছ?”
“গ্রহকণাটি কীভাবে পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে, আমি সেটা বিশ্লেষণ করেছি। এটা শুরু হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। সৌরজগতের বাইরে থেকে একটা অখ্যাত ধূমকেতু প্রথম এই গ্রহকণাটুকুকে তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করেছে। বৃহস্পতি গ্রহের আকর্ষণে প্রথম এটি কক্ষপথের বাইরে যাবার শক্তি পেয়েছে। মঙ্গল গ্রহ এটিকে স্লিং শট প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর দিকে পাঠিয়েছে। এই গ্রহকণাটির পৃথিবী থেকে কমপক্ষে এগারো মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে দিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খুবই বিচিত্র কারণে এটি আরেকটা খুবই বৃহৎ গ্রহকণার সাথে সংঘর্ষে তার কক্ষপথ পরিবর্তন করেছে। ঠিক এই সময় সূর্যের বিশাল একটা করোনা ডিসচার্জ হয়েছে। সূর্য থেকে বের হওয়া চার্জড পার্টিকেলে এটা আটকা পড়ে পৃথিবীর কাছে এসেছে। আমরা মাত্র আটচল্লিশটা ঘন্টা আগে এটি সম্পর্কে জেনেছি। কারণ এর আগে এটি ছিল নিরীহ একটি গ্রহকণা, অনেক দূর দিয়ে এর চলে যাবার কথা ছিল। গতিপথ পাল্টে সরাসরি পৃথিবীর দিকে আসার জন্যে অনেকগুলো বিচিত্র ঘটনা ঘটতে হয়েছে এবং সবগুলো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম, সোজা কথায় এগুলো ঘটার কথা না। কিন্তু আমরা জানি, এটা ঘটেছে, কাজেই আমার ধারণা–”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি কথা থামিয়ে মহামান্য রিহার দিকে তাকালো। মহামান্য রিহা বললেন, “তোমার কথা শেষ করো রিশি।”
রিশি বলল, “আমার ধারণা, এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি কাকতালীয় ঘটনা নয়।”
“তাহলে এটি কী?”
“কোনো একটি বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে যেভাবে এর একটা পরিবর্তন এনেছিল, এখন আবার সেই পরিবর্তন আনতে চাইছে। কাজেই আমার ধারণা, আমরা এটি থামাতে পারব না।”
মহামান্য রিহা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ক্লান্ত গলায় বললেন, “সম্ভবত তোমার সন্দেহ সত্যি। সম্ভবত কোনো একটি বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলার প্রস্তুতি হিসেবে এই গ্রহকণাটিকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি সেজন্যে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব না। আমি পৃথিবীকে রক্ষা করার চেষ্টা করব। সেটি কীভাবে করা যায়, আমি তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব শুনতে চাই।”
পরিবেশ বিজ্ঞানী নীহা বলল, “আসলে কী করতে হবে, আমরা সেটা সবাই জানি। গ্রহকণাটির কক্ষপথে পরিবর্তন আনতে হবে যেন সেটি পৃথিবীতে আছড়ে না পড়ে। এটি যেন পৃথিবীকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি মাথা নেড়ে বলল, “কাজটি এতো সহজ নয় নীহা। যদি কক্ষপথে যথেষ্ট পরিবর্তন আনতে না পার, তাহলে এটা হয়তো আফ্রিকাতে আঘাত না করে সাইবেরিয়াতে আঘাত করবে। আমাদের কোনো লাভ হবে না।”
নীহা বলল, “সেই হিসেবটুকু নিশ্চয়ই করা হবে। আমরা নিশ্চয়ই শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করে গ্রহকণাটির কক্ষপথ পাল্টানোর চেষ্টা করব না। কাজটা নিখুঁতভাবেই করব। কিন্তু সেই কাজটুকু নিখুঁতভাবে করার জন্যে আমাদের যে প্রযুক্তির প্রয়োজন, সেটি কী আছে? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?”
প্রযুক্তিবিদ কিরি বলল, “আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি।”
মহামান্য রিহা বললেন, “চমৎকার। উত্তর দাও কিরি।”
কিরি এক মুহূর্তে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হল, তার হাতের মাঝে কোথাও যেন প্রশ্নের উত্তরটি লেখা রয়েছে। এক মুহূর্ত পর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের কাছে এক সময় এই প্রযুক্তি খুব ভালোভাবে ছিল। পৃথিবী যখন নানা দেশে বিভক্ত ছিল, নিজেদের ভেতর যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল, তখন সব দেশই একে অপরকে আক্রমণ করার জন্যে এই প্রযুক্তি তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু পুরো পৃথিবীটা শান্তির দিকে এগিয়েছে। এখন পৃথিবীতে আলাদা আলাদা দেশ নেই, পুরো পৃথিবী মিলে একটি দেশ। শুধু তাই না, পৃথিবী পরিচালনার জন্যে পৃথিবীর মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমাদের মতো বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা এখন পৃথিবীকে পরিচালনা করি। আমরা অস্ত্রগুলো অকেজো করেছি। এখন যখন প্রয়োজন হয়েছে, আমাদের হাতে সেই প্রযুক্তি নেই। যেটি আগে নিশ্চিতভাবে করা যেতো, এখন সেটি করার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। আমরা গ্রহকণাটিকে আঘাত করতেও পারি, আবার নাও করতে পারি।”
মহামান্য রিহা বললেন, “তাহলে আমরা এখন কী করতে পারি?”
“আমাদের হাতে দুটি ভিন্ন পথ খোলা আছে। আমার মনে হয়, আমাদের একই সাথে দুটি পথেই চেষ্টা করতে হবে। একটি হচ্ছে, পৃথিবী থেকে মিসাইল দিয়ে গ্রহকণাটিকে আঘাত করার চেষ্টা করা। যদি আঘাত করে ধ্বংস করে দিতে পারি, আমাদের বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু আমি শুধু এটুকুর উপর ভরসা করতে চাই না। গ্রহকণাটির আকার বিদঘুঁটে এবং সেটি
খুবই বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খেতে খেতে আসছে। মিসাইলটি গ্রহকণাটিকে ঠিকভাবে আঘাত করতে পারবে কী না, আমি সে বিষয়ে তত নিশ্চিত নই। আমার মনে হয়, আমাদের দ্বিতীয় আরেকটা পথে কাজ করতে হবে।”
“সেটি কী?”
“একটা টিমকে নিউক্লিয়ার বোমাসহ মহাকাশযানে করে পাঠাতে হবে। তারা এই গ্রহকণার উপর নামবে। সেখানে বোমাটি বসাবে এবং বিস্ফোরণ ঘটাবে। এই কাজটি অসম্ভব কঠিন, কিন্তু এটি নিশ্চিতভাবে কাজ করবে।”
মহামান্য রিহা কিছুক্ষণ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “টিমের সদস্যরা কেউ বেঁচে ফিরে আসবে না?”
“না। যেটুকু সময় আছে, সেই সময়ে তারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারবে না। যারা যাবে, তারা পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে যাবে।”
মহামান্য রিহা আবার কিছুক্ষণ নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তারপর মাথা তুলে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে, যদি এটাই একমাত্র উপায় হয়ে থাকে, তাহলে এটাই আমাদের করতে হবে। এসো তোমাদের নিয়ে পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করে ফেলি।”
পনেরো মিনিটের ভেতর কমান্ড কাউন্সিল পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করে নিল। সাথে আরো একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, পৃথিবীর মানুষকে এই ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে কিছু জানানো হবে না। সত্যিই যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়, সেটি ঘটুক সবার অগোচরে।
.
১.০২
কমান্ডার লী তার সামনে বসে থাকা কুড়িজন মহাকাশচারীর উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “আমাদের এখন কী করতে হবে, তোমরা সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।”
মহাকাশচারীরা মাথা নাড়ল। কেউ মুখে কোনো কথা বলল না। কমান্ডার লী গলার স্বরকে একটুখানি উঁচু করে বলল, “সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে তোমাদের ভেতর থেকে একটি টিম তৈরি করার জন্যে। যে টিমটি গ্রহাণুটিকে ধ্বংস করতে যাবে।”
মহাকাশচারীরা এবারেও কোনো কথা বলল না। পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল। কমান্ডার লী বলল, “আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের কয়েকজনকে নিয়ে সেই টিম তৈরি করে দিতে পারি। কিংবা তোমরা চাইলে নিজেদের ভেতরে আলোচনা করে আমাকে একটা টিম তৈরি করে দিতে পার। এখন তোমাদের কী ইচ্ছা, বল।”
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, “আমাদের পাঁচ থেকে দশ মিনিট সময় দেয়া হলে আমরা নিজেদের ভেতর কথা বলে তোমাকে টিমের সদস্যদের তালিকা তৈরি করে দিতে পারব।”
পিছন থেকে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তার প্রয়োজন নেই কমান্ডার। আমি এই মিশনের দায়িত্ব নিতে চাই।”
সবাই মাথা ঘুরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটির নাম রায়ীনা। মহাকাশচারীদের এই দলটির মাঝে সবচেয়ে অভিজ্ঞ কয়েকজনের একজন।
কমান্ডার একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “রায়ীনা, তুমি জান এটা হচ্ছে একটা সুইসাইড মিশন।”
রায়ীনা শান্তভাবে বলল, “হ্যাঁ আমি জানি। কিন্তু আমার কাছে এই কারণটি এতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে এই মিশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সঠিকভাবে করা না হলে পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষকে বাঁচানো যাবে না। আমি এই দায়িত্বটি নিতে চাই।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী রায়ীনার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “রায়ীনা, তুমি বিষয়টাকে যেভাবে দেখছ, আমরা সবাই ঠিক একইভাবে দেখছি। কাজেই আমরা কি সবাই মিলে এটা নিয়ে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না?”
রায়ীনা বলল, “অবশ্যই পারি। কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুব কম, প্রত্যেকটা সেকেন্ড মূল্যবান। তাই আমি একটু সময় বাঁচানোর চেষ্টা করছি, আর কিছু নয়। তা ছাড়া আমার ধারণা, আমরা সবাই মিলে আলোচনা করলে তোমরা আমাকেই দায়িত্বটা দেবে। এ ধরনের মিশনে আমার অভিজ্ঞতা সবচাইতে বেশি।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী বলল, “মহাকাশে একটা গ্রহাণুতে মহাকাশযান নামানোতে আমাদের কারো অভিজ্ঞতা নেই। আমরা কেউ আগে এটা করিনি।”
“কিন্তু আমি নিয়মিতভাবে মহাকাশ স্টেশনে রসদ নিয়ে যাই। আমি চোখ বন্ধ করে মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশযান ডক করতে পারি। একটা জটিল মহাকাশ স্টেশন আর গ্রহাণুর মাঝে বড় কোনো পার্থক্য নেই।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী বলল, “আছে। এই গ্রহকণার বেলায় পার্থক্য আছে। মহাকাশ স্টেশন বিচিত্রভাবে তার তিন অক্ষে ঘুরপাক খায় না। এই গ্রহাণুটি বিচিত্রভাবে তার তিন অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে।”
রায়ীনা একটু হাসির মতো ভঙ্গি করে বলল, “আমি জানি। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, একটি মহাকাশ স্টেশন একবার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সবাই সেটির আশা ছেড়ে দিয়েছিল। আমি তখন নিজ দায়িত্বে সেই মহাকাশ স্টেশনে ডক করে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম!”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী হাসল। বলল, “হ্যাঁ। অবশ্যই মনে আছে। তোমার সেই কাজটুকু এখন মহাকাশ অভিযানের টেক্সট বইয়ে ঢোকানো আছে। মহাকাশ ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের সেটা পড়ানো হয়।”
“কাজেই তোমরা আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পার। আমি তোমাদের নিরাশ করব না। মূল কাজটি করবে মহাকাশযানের অন বোর্ড কোয়াকম্প। গ্রহাণুটির গতি বিশ্লেষণ করে মহাকাশযানটিকে তার সাপেক্ষে স্থির করে আনতে হবে। আমি শুধু ম্যানুয়েল কন্ট্রোলে থাকব।”
কমান্ডার লী এতোক্ষণ কোনো কথা বলেনি। রায়ীনার কথা শেষ হবার পর তার দিকে তাকিয়ে বলল, “শুধু ডক করা নয়, ডক করার পর একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা ডেটনেট করার ব্যাপার আছে।”
রায়ীনা হেসে বলল, “সেটি হচ্ছে একটা লাল বোতাম টিপে ধরা। দেখিয়ে দেয়া হলে একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও এটা করতে পারে। সেটি করার আগে রেটিনা স্ক্যান করিয়ে সিকিউরিটি কোড ঢোকাতে হবে। আমি সেটা ঢোকাতে পারব। কোনো সাহায্য ছাড়াই আমি সিকিউরিটি কোড মনে রাখতে পারব। পাইয়ের মান দশমিকের পর তেতাল্লিশ ঘর পর্যন্ত আমার এমনিতেই মনে থাকে।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী বলল, “রায়ীনা। আমার মনে হয়, তোমাকে দায়িত্বটি দেবার আগে আমরা সবাই মিলে বিষয়টা একটুখানি আলোচনা করি।”
রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “যদি তোমাদের কারো মনে হয়, আমি এই কাজটি করার উপযুক্ত নই, তোমরা সেটি প্রকাশ্যে সবার সামনে বলতে পার। আমি মেনে নেব। কিন্তু যদি আমার কর্মক্ষমতা নিয়ে তোমাদের কোনো সন্দেহ না থাকে, তাহলে আমি এই দায়িত্ব পালন করতে চাই। পৃথিবীতে খুব কম মানুষের জীবনে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করার সুযোগ আসে। আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করব, যদি আমাকে এই সুযোগটি দেয়া হয়।”
মহাকাশচারীরা কোনো কথা বলল না। কমবয়সী একজন বলল, “রায়ীনা, তোমার কর্মদক্ষতা নিয়ে আমাদের কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমরা, তরুণেরা সব সময় তোমার মতো একজন হওয়ার চেষ্টা করি–”
তরুণ মহাকাশচারীর কথা শেষ হওয়ার আগেই রায়ীনা বলল, “তোমরা সত্যিই যদি এটি বিশ্বাস করো, তাহলে আমাকে দায়িত্ব দেয়া নিয়ে তোমাদের কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমি দায়িত্বটি নিতে চাই।” রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কমান্ডার, আমাকে দায়িত্বটুকু দিন।”
কমান্ডার কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে রায়ীনা। আমি তোমাকে দায়িত্ব দিচ্ছি। এই দায়িত্ব নেবার জন্য পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
রায়ীনা বলল, “ধন্যবাদ কমান্ডার।” তারপর যেভাবে হঠাৎ উঠে
দাঁড়িয়েছিল, ঠিক সেভাবে তার জায়গায় বসে পড়ল।
কমান্ডার বলল, “আমরা টিম লিডার পেয়েছি। এখন আমাদের আরো দু’জন সদস্য দরকার। যারা রায়ীনার সাথে যাবে।”
একজন তরুণ মহাকাশচারী প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাব।”
সাথে সাথে অন্য সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, “আমি। আমি। আমি যাব।”
যে তরুণ মহাকাশচারী সবার আগে উঠে দাঁড়িয়েছিল, সে গলা উঁচিয়ে বলল, “আমি রায়ীনার সাথে অনেকবার রসদ নিয়ে মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছি। রায়ীনার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার সবচেয়ে বেশি। আমি রায়ীনার মিশনে চমৎকার একজন সহকর্মী হব।”
সাথে সাথে অন্যেরাও কথা বলতে শুরু করল এবং ঘরের ভেতর একধরনের হট্টগোলের মতো অবস্থা হল। তখন রায়ীনা আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমরা আমাকে আরেকবার কথা বলার সুযোগ দাও।”
কমান্ডার মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমার মনে হয়, রায়ীনাকে আমরা তার টিমের অন্য দু’জন সদস্যকে বেছে নিতে দিই।”
রায়ীনা বলল, “আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই। এই মিশনটি সবচেয়ে ভালোভাবে শেষ করার জন্যে আমি একাই যথেষ্ট। আমার প্রয়োজন একটি ইলন শাটল, সেখানে থাকবে একটি অনবোর্ড কোয়াকম্প। পৃথিবীর মূল ডাটা সেন্টারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ থাকবে প্লিক্সি নেটওয়ার্ক দিয়ে। ইলন শাটলকে উৎক্ষেপণ করে ট্রিটন রকেট দিয়ে, তাহলেই আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হবে না।”
কমান্ডার লী একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি একা যেতে চাও?”
“হ্যাঁ কমান্ডার। আমি একা গেলে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে পারব। আমাকে তাহলে অন্যের কাজকর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। অন্যের কাজকর্মের উপর নির্ভর করতে হবে না। অন বোর্ড একটা কোয়াকম্প থাকলে আমার কোনো মানুষের সাহায্যের দরকার হবে না।”
“কিন্তু এতো বড় একটা মিশনে শুধু একজনের উপর নির্ভর করা ঠিক হবে না।”
রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “সেটি সত্যি। আমার মনে হয়, আমি রওনা দেয়ার পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় এমনকি দরকার হলে চতুর্থ এবং পঞ্চম মিশনও প্রস্তুত থাকা দরকার। কোনো কারণে আমি যদি ব্যর্থ হই, একটির পর আরেকটি মিশন পাঠানোর প্রস্তুতি থাকতে হবে।”
কমান্ডার লী মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। সেটি আমাদের পরিকল্পনার মাঝে আছে।”
রায়ীনা এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, “আমার মিশনটি প্রস্তুত করতে মিশন কন্ট্রোলের খুব কম করে হলেও এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় দরকার হবে। আমি কী এই সময়টুকু নিজের জন্যে পেতে পারি?”
কমান্ডার লী বলল, “অবশ্যই পেতে পারো। মিশন শুরু করার আগে তোমার সাথে দশ থেকে পনেরো মিনিট সময় পেলেই চলবে।”
“ধন্যবাদ কমান্ডার। আমি কী এখনই বিদায় নিতে পারি?”
“অবশ্যই।”
রায়ীনা ঘরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকা মহাকাশচারীদের দিকে এক নজর তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “তোমাদের সাথে সম্ভবত আমার আর দেখা হবে না। তোমাদেরকে বলছি তোমরা হচ্ছ আমার সত্যিকারের পরিবার। আমাকে চমঙ্কার একটা আনন্দময় জীবন দেওয়ার জন্যে তোমাদের ধন্যবাদ।”
মহাকাশচারীরা মাথা নাড়ল। একজন বলল, “আমাদের বেঁচে থাকার অর্থ শেখানোর জন্যে তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা রায়ীনা। আমাদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি যাও রায়ীনা। যার কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে, তুমি তার কাছে যাও।”
রায়ীনা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। পিছনের সারিতে বসে থাকা একজন তরুণ তার পাশের তরুণীকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “রায়ীনা কার কাছ থেকে বিদায় নেবে?”
“তার দুই বছরের মেয়েটির কাছ থেকে।”
.
অনাথ আশ্রমের গেটে বাইভার্বালটি থামিয়ে দরজা খুলে রায়ীনা নেমে এল। সে তার বাম হাত দিয়ে তার দুই বছরের মেয়েটিকে আলগোছে ঝুলিয়ে রেখেছে। মেয়েটিকে দেখে মনে হতে পারে, তাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার কারণে সে বুঝি খুব অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, সে মোটেও অস্বস্তিতে নেই এবং এভাবে ঝুলে থাকায় সে খুবই অভ্যস্ত। মেয়েটি ঝুলন্ত অবস্থায় অনেকটা আপন মনে নিজের হাত দুটি নিয়ে খেলছে।
রায়ীনা কয়েক পা অগ্রসর হতেই অনাথ আশ্রমের দরজা খুলে এর ডিরেক্টর ক্লারা–হাসিখুশি মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা বের হয়ে এল। দুই হাত ওপরে তুলে আনন্দের একটা ভঙ্গি করে ক্লারা বলল, “আমাদের কী সৌভাগ্য, একজন সত্যিকারের মহাকাশচারী আমাদের দেখতে এসেছে। আমার বাচ্চারা আনন্দে পাগল হয়ে যাবে!”
রায়ীনা হাসিমুখে বলল, “তারা যদি মহাকাশচারী দেখতে চায়, আমাদের সেন্টার থেকে ডজন ডজন মহাকাশচারী পাঠাতে পারব। আজকে আমি একটা কাজে এসেছি। সেই কাজটুকু আগে সেরে নেই।”
“অবশ্যই। অবশ্যই। চলে এসো।”
আশ্রমের ডিরেক্টর ক্লারার অফিসটা খোলামেলা। এখানে নিশ্চয়ই অনেক শিশু আসে। অফিসটিকে শিশুদের জন্যে আনন্দময় করে রাখা আছে। রায়ীনা তার বাম হাতে ঝুলিয়ে রাখা মেয়েটিকে মেঝেতে নামিয়ে দিল। মেয়েটি সাথে সাথে ঘরের কোনায় স্কুপ করে রাখা খেলনাগুলোর দিকে ছুটে গেল। রায়ীনা এক নজর সেদিকে তাকিয়ে থেকে একটা চেয়ার টেনে বসে ডিরেক্টর ক্লারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার হাতে একেবারে সময় নেই। যে কথাটি বলতে এসেছি, আগে বলে নিই?”
রায়ীনার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। আশ্রমের ডিরেক্টর ক্লারার হাসি হাসি মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য নেমে এলো। সে মাথা নেড়ে বলল, “অবশ্যই রায়ীনা।”
রায়ীনা কোনোরকম ভূমিকা না করে বলল, “আমি আমার মেয়ে ত্রাতিনাকে তোমার হাতে দিতে এসেছি। আমার ইচ্ছা, সে এই আশ্রমে তার মতো আরো অনেকের সাথে বড় হোক।”
ডিরেক্টর ক্লারার চোখে এক ধরনের বিস্ময়ের ছায়া পড়ল। কিন্তু সে কোনো কথা বলল না। রায়ীনা শান্ত গলায় বলল, “তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন করো না। কারণ প্রশ্ন করলেও আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।”
ডিরেক্টর ক্লারা কোনো প্রশ্ন করলো না। একদৃষ্টে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে রইল। রায়ীনা শান্ত গলায় বলল, “আমি মায়ের দায়িত্ব পালনে কোনো অবহেলা করিনি। পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আনন্দময় সময় ছিল ত্রাতিনার সাথে কাটানো সময়টুকু।” রায়ীনা হঠাৎ করে থেমে গেল। রায়ীনার ইস্পাতের মতো শক্ত নার্ভ, কিন্তু সে আবিষ্কার করল, সে আর কথা বলতে পারছে না। তার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে পড়ছে।
ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “রায়ীনা, তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। অমি কিছু জানতেও চাই না। একজন মা নিজে এসে তার সন্তানকে এই আশ্রমে দিয়ে গেলে আর কিছু করতে হয় না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তোমার মেয়ে ত্রাতিনা এখানে অন্য সব শিশুদের নিয়ে গভীর এক ধরনের ভালোবাসা নিয়ে একটা বিশাল পরিবারে বড় হবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। রায়ীনা।”
রায়ীনা খুব সাবধানে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তার চোখের কোনা মুছে নিয়ে ত্রাতিনার দিকে তাকালো। ত্রাতিনা তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা খেলনা ভালুকের মাথাটি ধড় থেকে টেনে আলাদা করার চেষ্টা করছিল।
রায়ীনা আবার ডিরেক্টর ক্লারার দিকে তাকালো। তারপর পকেট থেকে ছোট একটা ক্রিস্টাল তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি জানি প্রথম প্রথম ত্রাতিনা আমাকে খুঁজবে, আমার জন্যে কাঁদবে। তারপর সে আস্তে আস্তে আমাকে ভুলে যাবে। বহুদিন পর সে যখন বড় হবে, তখন হঠাৎ একসময় হয়তো তার কৌতূহল হবে, সে জানতে চাইবে সে কোথা থেকে এসেছে। তার মা কে, বাবা কে, তার পরিচয় কী। তখন তুমি এই ক্রিস্টালটি ত্রাতিনার হাতে দিও। এখানে আমি তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলেছি। আমার ধারণা, সে যদি এটা শোনে, তাহলে হয়তো তার মাকে সে ক্ষমা করে দেবে।”
ডিরেক্টর মহিলাটি হাত বাড়িয়ে ক্রিস্টালটি নিয়ে বলল, “আমি এটা এখনই আমাদের সেফ ডিপোজিটে রেখে দিচ্ছি। ত্রাতিনা যখন পূর্ণ বয়সে পৌঁছাবে, তখন সেটি তার হাতে দেয়া হবে।”
“ধন্যবাদ তোমাকে।” রায়ীনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার হাতে সময় খুব কম। আমি কী ত্রাতিনাকে তোমাদের অন্য শিশুদের মাঝে রেখে আসতে পারি? তাহলে আমার বিদায় নেওয়া সহজ হবে।”
ডিরেক্টর মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “অবশ্যই সেটি করতে পারবে। এসো আমার সাথে।”
রায়ীনা তখন হেঁটে ত্রাতিনার কাছে গিয়ে বলল, “এসো ত্রাতিনা, আমরা তোমার আপনজনের কাছে যাই।”
ত্রাতিনা কী বুঝল কে জানে, আপনজনের কাছে যাওয়ার জন্যে প্রায় লাফিয়ে রায়ীনার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রায়ীনা তাকে বুকে চেপে উঠে দাঁড়াল। ডিরেক্টর মহিলার পিছনে পিছনে সে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। করিডোরের শেষ মাথায় একটা বড় হলঘর। হলঘরের দরজা খুললেই দেখা গেল, ভেতরে অনেকগুলো নানা বয়সী শিশু হুটোপুটি করে খেলছে। তাদের ভেতর থেকে বেশ কয়েকজন মাথা ঘুরিয়ে ডিরেক্টর মহিলা এবং রায়ীনার দিকে তাকাল। তাদের চোখ মুখ হঠাৎ আনন্দে জ্বলজ্বল করে ওঠে এবং এক সাথে সবাই তাদের দিকে ছুটে আসে।
শিশুগুলো তাদের ঘিরে দাঁড়াল এবং অকারণে খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। রায়ীনা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে ত্রাতিনাকে নামিয়ে দিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “ত্রাতিনা, এই যে, এরা তোমার ভাই বোন! তুমি যাবে তাদের কাছে?”
ত্রাতিনা একবার খানিকটা সন্দেহের চোখে মায়ের দিকে তাকালো, তারপর তাদের ঘিরে থাকা শিশুগুলোর দিকে তাকালো। তার চোখে মুখে দুর্ভাবনার একটা ছাপ পড়ল। সে বুঝতে পারছে না, হঠাৎ করে তার চারপাশে তার সমবয়সী এতোগুলো শিশু কোথা থেকে এসেছে।
একটি সোনালী চুলের মেয়ে ত্রাতিনার কাছে এসে সাবধানে তার হাতটি ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে চেষ্টা করল। ত্রাতিনা প্রথমে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। তারপর হঠাৎ কী মনে করে অন্য হাত দিয়ে মেয়েটির সোনালী চুলগুলো স্পর্শ করে দেখল। কী কারণ কে জানে কেন, হঠাৎ করে ত্রাতিনার মুখ থেকে দুর্ভাবনার চিহ্নটি সরে গিয়ে মুখটি হাসি হাসি হয়ে যায়। রায়ীনা নিচু গলায় বলল, “যাও ত্রাতিনা, যাও। তোমার ভাই বোনের কাছে যাও।”
ত্রাতিনা তখন খুব সাবধানে শিশুদের সাথে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যেতে থাকে।
রায়ীনা কিছুক্ষণ তার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ডিরেক্টর ক্লারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কি কিছুক্ষণ এই ঘরটিতে থাকতে পারি?”
“অবশ্যই। তোমার বসার জন্যে একটা চেয়ার এনে দিই।”
“তার কোনো প্রয়োজন নেই।” রায়ীনা একটু পিছিয়ে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর ক্লারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার হাতে একেবারে সময় নেই। দশ কী পনেরো মিনিটের ভেতর আমার ডাক পড়বে। তখন আমাকে যেতে হবে। যতক্ষণ আমাকে না ডাকছে, আমি ততক্ষণ এখানে বসে থাকতে চাই।”
ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “ছোট বাচ্চাদের চেঁচামেচি যদি তোমার নার্ভের উপর উঠে না যায়, তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা এখানে বসে থাকতে পার। তুমি সম্ভবত নিরিবিলি একা বসে থাকতে চাও। আমি তোমাকে একা থাকতে দিই?”
রায়ীনা একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আসলেই আমি একটু সময় একা বসে থাকতে চাইছিলাম।”
রায়ীনা দেওয়ালে হেলান দিয়ে একা একা বসে রইল। বড় হলঘরের এক পাশে ত্রাতিনা অন্য শিশুদের সাথে খেলতে শুরু করেছে। রায়ীনা বিচিত্র এক ধরনের লোভাতুর দৃষ্টিতে তার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। আর কোনোদিন সে তার এই সন্তানটিকে বুকে চেপে ধরতে পারবে না। এই শিশুগুলো যেন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে, সে জন্যে সে তার প্রাণটি দিতে যাবে। সেটি নিয়ে তার ভেতরে কোনো হতাশা নেই। কোনো জ্বালা কিংবা ক্ষোভ নেই। একটুখানি দুঃখ হয়তো আছে, কিন্তু সেরকম দুঃখ কার জীবনে নেই?
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় রায়ীনার ট্রাকিওশানটি তাকে সংকেত দিল, তার যাবার সময় হয়েছে। রায়ীনা উঠে দাঁড়াল, তার দুই বছরের মেয়েটির কাছ থেকে এখন তাকে বিদায় নিতে হবে। সে কী পারবে বিদায় নিতে?
রায়ীনা নরম গলায় ডাকল, “ত্রাতিনা, মা আমার।”
ত্রাতিনা ঘুরে তাকাল। তারপর তার দিকে ছুটে এলো। রায়ীনা দুই হাত বাড়িয়ে ত্রাতিনাকে জড়িয়ে ধরল। তাকে বুকে চেপে রেখে ফিসফিস করে বলল, “ত্রাতিনা, মা আমার। তুই ভালো থাকিস মা। তোর এই মায়ের ওপর কোনো রাগ পুষে রাখিস না মা। এই পৃথিবীতে তোরা যেন বেঁচে থাকিস, সে জন্যে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে সোনামনি।”
ত্রাতিনা তার মায়ের কথাগুলো বুঝতে পারল না। কিন্তু গলার স্বরের আকুতিটুকু বুঝতে পারল। সে অবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল। রায়ীনার চোখে পানি টলটল করছে, সে খুব সাবধানে তার চোখ মুছে এবার ত্রাতিনাকে স্পষ্ট গলায় বলল, “যাও মা। তোমার ভাইবোনের কাছে যাও।”
ত্রাতিনা চলে গেল না। মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রায়ীনা আবার বলল, “যাও ত্রাতিনা। ওই দেখো, সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
ত্রাতিনা খপ করে রায়ীনাকে ধরে বলল, “না। না।”
রায়ীনা হতাশভাবে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে দেখল কাছাকাছি ডিরেক্টর ক্লারা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ীনা নিচু গলায় তাকে বলল, “তুমি কী আমার মেয়েটিকে ধরে রাখবে? আমার এখন যেতে হবে।”
ডিরেক্টর ক্লারা ত্রাতিনার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “মাকে ছেড়ে দাও ত্রাতিনা, তোমার মায়ের এখন যেতে হবে।”
ত্রাতিনা তার মাকে ছেড়ে দিল। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
.
১.০৩
রায়ীনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মহাকাশযানের চেয়ারটিতে বেল্ট দিয়ে তাকে এমনভাবে বেঁধে রাখা আছে যে, সে নিচের দিকে দেখতে পাচ্ছে না। তার সামনে নীল আকাশ, সেখানে সাদা মেঘ। সে পৃথিবীটিকে আর কখনো দেখতে পাবে না, এই নীল আকাশ আর সাদা মেঘও কখনো দেখতে পাবে না। কিন্তু সে এই ধরনের ভাবালুতাকে তার চিন্তার মাঝে স্থান দিল না। মাথার ভেতর থেকে সব ধরনের চিন্তা সরিয়ে দিয়ে সে তার মিশনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।
রায়ীনা সামনের প্যানেলটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। কোয়াকম্পের সুইচ অন করল। জ্বালানি পরীক্ষা করল। কারগো বে’তে রাখা নিউক্লিয়ার বোমাটির নিয়ন্ত্রণ শেষবারের মতো দেখে নিল। মহাকাশযানের বাতাসের চাপ পরীক্ষা করল, বায়ু নিরোধক সিল পরীক্ষা করল। যোগাযোগ মডিউল চালু করল। তারপর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে কথা বলল, “আমি প্রস্তুত।”
রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পায়, “চমৎকার রায়ীনা। তোমার মিশন সফল হোক। আমরা কাউন্ট ডাউন শুরু করছি।”
“করো।”
প্রায় সাথে সাথেই আলোর ঝলকানির সাথে সাথে সে কাউন্ট ডাউন শুনতে পায়। ভরাট পুরুষ কণ্ঠে কোনো একজন গুনতে শুরু করেছে, “দশ, নয়, আট…।”
রায়ীনা একটা ঝাঁকুনি এবং তারপর একটা কম্পন অনুভব করে। তার মহাকাশযানটিকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বিশাল ক্ল্যাম্পগুলো ধীরে ধীরে দুই পাশে সরে যাচ্ছে। রায়ীনা টের পেলো, তার ইঞ্জিনটি চালু হতে শুরু
ত্রাতিনা করেছে। এক ধরনের ধাতব গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
“সাত…ছয়…পাঁচ…চার…”
পানি দিয়ে সিক্ত করে রাখা কংক্রিটের বেস থেকে ইঞ্জিনের উত্তাপে সাদা জলীয় বাষ্প চারদিক ঢেকে ফেলছে।
“তিন….দুই….এক…”
রায়ীনা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং হঠাৎ পুরো মহাকাশযানটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। রায়ীনা বাইরে তাকালো, মহাকাশযানটা ওপরে উঠতে শুরু করেছে। রায়ীনা তার সিটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণের ভেতরেই অদৃশ্য একটা শক্তি তাকে তার সিটের সাথে চেপে ধরবে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে বের হওয়ার সময় সব মহাকাশচারীদের এই অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। ট্রিটন রকেটের শক্তিশালী ইঞ্জিন প্রচণ্ড গর্জন করে তার ইলন শাটলকে মহাকাশে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। গতি বাড়তে শুরু করার সাথে সাথে রায়ীনা অনুভব করল, অদৃশ্য একটা শক্তি তার বুকের উপর চেপে বসেছে। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, মনে হয় চোখের সামনে একটা লাল পদা থরথর করে কাঁপছে। রায়ীনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে সমস্ত শরীরকে টান টান করে রাখে। সে বুঝতে পারছে, তার মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে বুঝি কিছু চিন্তা করতে পারছে না। রায়ীনা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। প্রতিবার মহাকাশ অভিযানে তাকে এই অদৃশ্য শক্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সে জানে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে পৃথিবীকে ঘিরে একটা কক্ষপথে ঢুকে যাবে। তখন হঠাৎ করে তার বুকের ওপর ভেসে থাকা জগদ্দল পাথরটি সরে যাবে। ইলন শাটলের ভেতর পুরোপুরি ভরশূন্য হয়ে সে ভেসে বেড়াবে।
রায়ীনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে এবং প্রায় হঠাৎ করেই তার মনে হয় তার বুকের ওপর চেপে বসে থাকা অদৃশ্য শক্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। নিজেকে মনে হয় হালকা এবং ভরশূন্য। রায়ীনা তার সিট বেল্ট খুলে নিজেকে মুক্ত করে নিল। তারপর ভেসে ভেসে জানালার কাছে এসে বাইরে তাকালো, নিচে নীল পৃথিবী। পৃথিবীটি কী সুন্দর, এটি মনে হয় শুধু মহাকাশে এলেই সত্যিকার অর্থে অনুভব করা যায়।
রায়ীনা জানালাটিতে ধাক্কা দিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে এসে ভিডিও স্ক্রীনটা চালু করল। সাথে সাথেই প্লিক্সি নেটওয়ার্কে সে পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টার দেখতে পায়। কমান্ডার লী বড় একটা স্ক্রীনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ীনাকে দেখতে পেয়ে মুখে একটা হাসি টেনে এনে বলল, “চমৎকার ট্র্যাজেক্টরি। তুমি কক্ষপথে পৌঁছে গেছ।”
রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ।”
কমান্ডার লী বলল, “গ্রহকণাটা এখনো এগারো ঘন্টার পথ।”
রায়ীনা বলল, “বুঝতে পারছি।”
“প্রোগ্রাম লোড করা আছে। পৃথিবীটা একবার ঘুরে এসে ঠিক জায়গায় এলে তোমার রকেট চালু হবে।”
রায়ীনা একটু হাসল। বলল, “মহাকাশে ওপরে নিচে অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু এই মিশনটা অন্যরকম।”
“হ্যাঁ, অন্যরকম।”
“প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান।”
“যদি সময় থাকতো, তাহলে তোমাকে পৃথিবী কয়েকবার ঘুরিয়ে এনে ছেড়ে দিতাম। এখন একবারে এক্সেলেরেট করতে হবে-কষ্ট বেশি হবে।”
রায়ীনা হাসল। বলল, “আমার কষ্ট নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি জড় পদার্থের মতন, আমার কষ্ট হয় না।”
রায়ীনা কন্ট্রোল প্যানেলটাতে ধাক্কা দিয়ে আবার নিজেকে ভাসিয়ে জানালার কাছে নিয়ে আসে। জানালার হ্যাঁন্ডেলটা ধরে সে আবার নিচে পৃথিবীর দিকে তাকালো। নীল পৃথিবীটা ঘিরে সাদা মেঘ, অর্ধেক পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে এসেছে। আর কিছুক্ষণের মাঝে সেও পৃথিবীর অন্ধকার ছায়ার মাঝে ঢুকে যাবে। তখন পৃথিবীর অন্য একটা রূপ দেখা যাবে। বড় বড় শহরগুলোতে স্ফটিকের মতো আলো জ্বলজ্বল করছে, মহাকাশ থেকে কী অপূর্ব দেখায়।
রায়ীনা ঘড়ির দিকে তাকালো। পুরো পৃথিবীটা ঘুরে আসতে নব্বই মিনিটের মতো সময় নেয়। যার অর্থ, আর দশ মিনিটের মাঝেই সে পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে গ্রহকণার দিকে ছুটে যাবে। তার এখন মহাকাশচারীর সিটে বসা দরকার। তা না হলে একটু পরেই কর্কশ এলার্ম বাজতে শুরু করবে।
রায়ীনা ভেসে ভেসে তার সিটে গিয়ে বসল। দুই পাশ থেকে স্ট্র্যাপ এসে তাকে সিটের সাথে বেঁধে নেয়। সে হাত বাড়িয়ে কোয়াকম্পের সুইচটি অন করে দিল। এখন থেকে সে সরাসরি কোয়াকম্পের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায়।
রায়ীনা আবার কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পেল। কমান্ডার নিচু গলায় ডাকল, “রায়ীনা।”
“বল।”
“তুমি প্রস্তুত?”
“হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত।”
“তোমার সাথে আমরা যোগাযোগ রাখব, কিন্তু এখন থেকে তোমার মহাকাশযানের দায়িত্ব তোমার।”
“আমি জানি।”
“আমরা অপেক্ষা করব। শুধু তুমি ডাকলে আমরা সাড়া দেব। আমরা নিজে থেকে তোমার সাথে আর কথা বলব না।”
“ঠিক আছে কমান্ডার। মিশনের এই পর্যায়ে এটাই হচ্ছে প্রোটোকল।”
“তাহলে বিদায় রায়ীনা।”
“বিদায়।” অভ্যাস মতো আবার দেখা হবে” বলতে গিয়ে রায়ীনা থেমে গেল। আবার দেখা হবে না। পৃথিবীর কারো সাথে আর দেখা হবে না।
.
রায়ীনা প্রথমে একটা গর্জন শুনতে পেলো। তারপর তীব্র একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। প্রায় সাথে সাথেই রায়ীনার মনে হলো, একটা ভারী পাথর বুঝি তার বুকের ওপর চেপে বসেছে। সে দাঁত দাঁত চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই এই অদৃশ্য চাপটা সহনীয় হয়ে যাবে। হলোও তাই, রায়ীনা তখন সিট বেল্ট খুলে বের হয়ে এলো। জানালার কাছে এসে সে নিচের দিকে তাকালো। দূরে পৃথিবীটা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসবে। এই প্রথমবার পৃথিবীর জন্যে সে এক ধরনের বেদনা অনুভব করে। হঠাৎ করে তার ত্রাতিনার কথা মনে পড়ে যায়। এই মুহূর্তে সে কী করছে? যে শহরটি থেকে সে এসেছে, সেটি এখন পৃথিবীর উল্টোপিঠে। সেখানে এখন গভীর রাত। ত্রাতিনা কী তার জন্যে কাঁদছে? কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে? নাকি এখনো জেগে আছে? নূতন জায়গায় নূতন পরিবেশে সে কী ভয় পাচ্ছে? রায়ীনা জোর করে তার মাথা থেকে ভাবনাটা সরিয়ে দিল। তার এখন আবেগপ্রবণ হলে চলবে না। সে পৃথিবীকে রক্ষা করার মিশনে এসেছে। তার এখন অন্য কিছু নিয়ে ব্যাকুল হবার সময় নেই।
ঘণ্টা দুয়েক পর হঠাৎ এলার্ম বেজে উঠল। রায়ীনা মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। কোয়াকম্প জানাচ্ছে, তার ইলন শাটলের জ্বালানি বিপজ্জনক মাত্রায় কমে আসছে। পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরে যেতে হলে তার জ্বালানি হিসেব করে খরচ করতে হবে। রায়ীনাকে আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে না। তাকে তার জ্বালানি বাঁচিয়ে রাখতেও হবে না। কোয়াকম্প সেটি জানে না!
রায়ীনা এলার্মটি স্পর্শ করে বন্ধ করে মনিটরের দিকে তাকালো। সে গ্রহকণাটির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। এখন তাকে খুব সাবধানে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গ্রহকণাটির পাশাপাশি তাকে যেতে হবে এবং খুব সাবধানে গ্রহকণাটির ওপর নামতে হবে। কাজটি সহজ হবে না। কারণ গ্রহকণাটির আকার খুবই বিচিত্র এবং সেটি আরো বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। রায়ীনাকে এখন আর পৃথিবীর তথ্য ব্যবহার করতে হবে না, সে নিজেই তার ইলন শাটল থেকে গ্রহকণাটির বিচিত্র গতিটাকে বিশ্লেষণ করতে পারবে। কোয়াকম্প তাকে সাহায্য করবে।
রায়ীনা আবার মহাকাশচারীর সিটে গিয়ে বসল। সাথে সাথে দুই পাশ থেকে নিরাপত্তা বন্ধনী আবার তাকে সিটের সাথে আটকে ফেলল। রায়ীনা তখন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে, কন্ট্রোল প্যানেলটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসে।
গ্রহকণাটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কী বিচিত্র এই গ্রহকণাটি! একটি গ্রহকণার আকার যদি কুৎসিত হওয়া সম্ভব হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে এটাকে কুৎসিত বলা যেতো। শুধু কুৎসিত নয়, অশুভ এবং বিপজ্জনক।
রায়ীনাকে তার ইলন শাটলের বেগ কমাতে কমাতে গ্রহকণাটির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ঠিক যখন গ্ৰহকণাটির পাশে পৌঁছাবে, তখন গ্রহকণাটির তুলনায় তাকে স্থির হয়ে যেতে হবে। কোয়াকম্প তার অনেকখানিই করে ফেলতে পারবে, কিন্তু শেষ কাজটি তার নিজের হাতে করতে হবে।
দেখতে দেখতে সে গ্রহকণাটির কাছাকাছি চলে এলো। ইলন শাটলটির থেকে দূরত্ব এখন পাঁচ শ’ মিটার থেকে কম। এখান থেকে জানালা দিয়ে খালি চোখেই রায়ীনা দেখতে পেল গ্রহকণাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখে মনে হয়, সেটি বুঝি মহাকাশে স্থির হয়ে আছে। আসলে সেটি স্থির নয়, সেটি অচিন্ত্যনীয় বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে যদি গ্রহকণাটিকে ধ্বংস করতে না পারে, তাহলে এই গ্রহকণাটি পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলবে।
রায়ীনা কোয়াকম্পকে গ্রহকণাটির বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খেতে থাকার গতিটি বিশ্লেষণ করতে দিয়ে ধীরে ধীরে ইলন শাটলটিকে সেটির কাছাকাছি নিতে থাকে। একশ মিটারের কাছাকাছি এসে সে থেমে গেল। কোয়াকম্প গতিপথটি বিশ্লেষণ করে মনিটরে দেখাচ্ছে এবং সেদিকে তাকিয়ে রায়ীনা চমকে উঠল। একটা গ্রহকণার গতিপথ এরকম হতে পারে না। গ্রহকণার সেন্টার অফ এ্যাভেটি ইলন শাটলের তুলনায় স্থির থাকতে হবে। কিন্তু এটি স্থির নয়, এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়ছে। এটি কোনোভাবেই হওয়া সম্ভব নয়।
রায়ীনা ভুরু কুঁচকে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের চোখকে সে কীভাবে অবিশ্বাস করবে? কোয়াকম্পের বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই গ্রহকণার ওপর নামা প্রায় অসম্ভব। শেষ মুহূর্তে গ্রহকণাটির একটা অংশ ঘুরপাক খেতে খেতে ইলন শাটলকে আঘাত করে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলতে পারে। থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি বিস্ফোরিত না হয়ে উড়ে যাবে!
রায়ীনা আবার মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনিটরটির বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই গ্রহকণাটি একটি নিরীহ গ্রহকণা নয়। হয়তো এর ভেতরে অবরুদ্ধ গ্যাস আছে। সেই গ্যাস হয়তো এর ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে এসে গ্রহকণাটাকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। কিংবা এটি–
রায়ীনা তার মাথা থেকে চিন্তাটাকে সরিয়ে দিল। এরকম নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে একটা গ্রহকণা যদি ঘুরপাক খেতে থাকে, তাহলে এটি যা হতে পারে সেটি হওয়া সম্ভব নয়। কিছুতেই সম্ভব নয়। সেই সম্ভাবনার কথা রায়ীনা তার মাথায় আনতে চায় না। রায়ীনা এখন কোয়াকম্পের ওপর নির্ভর না করে পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে ইলন শাটলকে গ্রহকণাটির ওপর নামিয়ে আনবে। তারপর ইলন শাটলে রাখা নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণে গ্রহকণাটিকে ভস্মীভূত করে দেবে।
ইলন শাটলকে নামানোর জন্যে রায়ীনা গ্রহকণার ওপর একটা জায়গা বেছে নেয়। জায়গাটি মসৃণ নয়। খানিকটা এবড়োথেবড়ো, কিন্তু আশেপাশে বড় কোনো উঁচুনিচু জায়গা নেই। রায়ীনা খুব সাবধানে ইলন শাটলকে নামাতে থাকে। গ্রহকণাটি যখন হঠাৎ ঘুরে যায় কিংবা নড়ে যায়, রায়ীনাও তখন ইলন শাটলকে ঘুরিয়ে নেয়, নড়িয়ে নেয়। উঁচু হয়ে বের হয়ে থাকা কোনো অংশ হঠাৎ করে ঘুরে ইলন শাটলের দিকে ছুটে এলে রায়ীনাকেও দ্রুত সরে যেতে হয়। এর আগে ইলন শাটলকে কেউ এইভাবে ব্যবহার করেনি, করার প্রয়োজন হয়নি।
রায়ীনা এক সময়ে তার ইলন শাটলের শক্তিশালী ইঞ্জিনের ধোঁয়া দেখতে পায়। ইঞ্জিনের উত্তপ্ত গ্যাস গ্রহকণায় আঘাত করে ধুলোবালি উড়িয়ে নিতে শুরু করেছে। হঠাৎ গ্রহকণাটি জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ে ওঠে। উঁচু হয়ে থাকা একটা অংশের আঘাতে গুঁড়িয়ে যাবার আগেই রায়ীনা প্রচণ্ড গতিতে নিচে নেমে গ্রহকণাটির ওপর আক্ষরিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রায়ীনা একটা প্রচণ্ড সংঘর্ষ অনুভব করে, পুরো শাটলটি কেঁপে ওঠে, যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে যায়। ইলন শাটলের ভেতর বিপদ সংকেতের তীব্র এলার্ম বাজতে থাকে।
প্রচণ্ড সংঘর্ষে রায়ীনা সিট ভেঙে বের হয়ে নিচে ছিটকে পড়েছিল। সে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ভাসতে ভাসতে জানালার পাশে দাঁড়াল। সে গ্রহকণাটির ওপর নামতে পেরেছে। সংঘর্ষে ইলন শাটলের কতোটুকু ক্ষতি হয়েছে, সে জানে না। সেটি নিয়ে তার মাথা ঘামাতে হবে না। তার আগে। ইলন শাটলটিকে এই গ্রহকণার সাথে যুক্ত করে নিতে হবে। রায়ীনা কাঁপা হাতে একটা সুইচ স্পর্শ করে। সাথে সাথে যেন এক ধরনের গুঞ্জন শুনতে পায়। ইলন শাটলের নিচ থেকে অতিকায় স্কু বের হয়ে গ্রহকণার মাঝে গেঁথে যেতে শুরু করেছে। এখন শুধু তার নিউক্লিয়ার বোমাটিকে বিস্ফোরণের জন্যে চালু করে দিতে হবে।
রায়ীনা মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ভেসে ভেসে ইলন শাটলের পিছনে যায়। সুইচ টিপে পিছনের গোল দরজাটি খুলতেই থামো নিউক্লিয়ার বোমাটি চোখে পড়ল। একশ কিলোটনের একটি বোমার আকার এতো ছোট হতে পারে, নিজের চোখে দেখেও রায়ীনার বিশ্বাস হয় না।
রায়ীনা বোমাটার পিছনে সুইচ প্যানেল খুলে সেখানে বোতামটি স্পর্শ করে। সাথে সাথে একটা নীল আলো ঝলসে ওঠে। ছোট চতুষ্কোণ একটা জায়গায় রায়ীনা তার চোখ রাখল। সেখানে তার রেটিনা স্ক্যান করা হলো এবং সাথে সাথে স্ক্রীনে একটা ছোট কী বোর্ড স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রায়ীনা কাঁপা হাতে ষোলটি সংখ্যা প্রবেশ করানোর সাথে সাথে কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজতে থাকে। মনিটরে একটা লেখা ভেসে ওঠে, “এই বোমাটি বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। দশ মিনিটের ভেতর এটি বিস্ফোরিত হবে।”
রায়ীনা তার বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিল। সে পৃথিবীটাকে রক্ষা করতে পেরেছে। পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষকে রক্ষা করতে পেরেছে। তার আদরের ত্রাতিনাকে রক্ষা করতে পেরেছে। রায়ীনা ভেসে ভেসে কন্ট্রোল ঘরে ফিরে আসে। তাকে এখন দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। দশ মিনিট অনেক সময়। এই দশ মিনিট সময় সে কেমন করে কাটাবে?
রায়ীনা তার সিটে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। তারপর প্রায় হঠাৎ করেই ঠিক করল, সে গ্রহকণাটিতে নামবে। যে কোনো হিসেবে কাজটি অনেক বিপজ্জনক। কিন্তু যখন দশ মিনিটেরও কম সময়ে একশ কিলোটনের একটা থামো নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণে সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে যাবে, তখন বিপজ্জনক আর নিরাপদ অবস্থার কোনো অর্থ নেই।
রায়ীনা ইলন শাটলের দরজা খুলে একটা লাফ দিয়ে নিচে নেমে এলো। গ্রহকণার সাথে ধাক্কা খেয়ে সে প্রায় উড়ে যাচ্ছিল। কোনোভাবে একটা সুচালো পাথরকে ধরে সে নিজেকে থামাল এবং কোনোভাবে নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। শেষ পর্যন্ত সে যখন নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারল, তখন হঠাৎ করে সে অত্যন্ত বিচিত্র একটা জিনিস লক্ষ্য করল। গ্রহকণাটি থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে, এর ভেতরে একটা শক্তিশালী ইঞ্জিন কাজ করছে। কী আশ্চর্য! সে যে চিন্তাটি জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, সেই চিন্তাটিই সঠিক। এটি একটি গ্রহকণা নয়। এটি পৃথিবীর দিকে ছুটে যাওয়া বিশাল একটি মহাকাশযান।
রায়ীনা কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ঠিক ভাবে চিন্তা করতে পারছিল না, কষ্ট করে সে নিজেকে শান্ত করল। তারপর নিচু গলায় ডাকল, “কমান্ডার।”
প্রায় সাথে সাথে রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পেলো।”বল রায়ীনা।”
“থামো নিউক্লিয়ার বোমাটি বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি আর সাত মিনিট তেতাল্লিশ সেকেন্ডের মাঝে বিস্ফোরিত হবে।”
কমান্ডার লী বলল, “আমরা জানি। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা রায়ীনা। পৃথিবীর মানুষ হয়তো কখনোই জানতে পারবে না তুমি কেমন করে তাদের রক্ষা করেছ।”
“তার প্রয়োজনও নেই কমান্ডার।” রায়ীনা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “আমি অন্য একটি কারণে তোমার সাথে কথা বলতে চাই।”
“বল রায়ীনা।”
“আমি শুধুমাত্র তোমার সাথে কথা বলতে চাই। সর্বোচ্চ গোপন চ্যানেলে।”
কমান্ডার লী এক মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করল। তারপর বলল, “ঠিক আছে রায়ীনা। আমি গোপন চ্যানেল চালু করেছি। তোমার কথা আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পারবে না। বল তুমি কী বলতে চাও।”
“কমান্ডার লী, আমরা সবাই যেটাকে একটি গ্রহকণা ভেবে আসছি, সেটি আসলে গ্রহকণা নয়।”
কমান্ডার লী কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে এটা কী?”
“এটা একটা মহাকাশযান। আমি এর উপর দাঁড়িয়ে আছি এবং এর ইঞ্জিনের কম্পন অনুভব করছি।”
“কী বলছ তুমি?”
“আমি কোনো প্রস্তুতি ছাড়া নেমে এসেছি। তাই ভিডিও চ্যানেলটি চালু করতে পারিনি, তাই তোমাকে দেখাতে পারছি না।”
“তুমি বল, তোমার কথা শুনেই আমি বুঝে নেবার চেষ্টা করছি।”
রায়ীনা অনেকটা ধারাবর্ণনা দেওয়ার মতো করে বলল, “আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেই জায়গাটা মোটামুটি সমতল, একটু সামনে অনেকগুলো উঁচু নিচু পাথর। আমি সেদিকে এগিয়ে যাই। কারণ—
“কারণ কী?”
“কারণ আমার মনে হচ্ছে ওদিক দিয়ে একটু আলো বের হয়ে আসছে।”
“আলো?”
“হ্যাঁ। নীলাভ আলো। সম্ভবত ওটা এই মহাকাশযানের কন্ট্রোল রুম।”
কমান্ডার লী কাঁপা গলায় বলল, “কন্ট্রোল রুম?”
রায়ীনা একটা বড় পাথর ধরে সামনে এগিয়ে যায়। সাবধানে নিচে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার অনুমান সঠিক। একটা চতুষ্কোণ গর্ত থেকে আলো বের হচ্ছে। এটা সম্ভবত ভেতরে ঢোকার দরজা।”
কমান্ডার লী কোনো কথা বলল না। রায়ীনা বলল, “আমি নিচে নামছি।”
“নামো। কী দেখো আমাকে জানাও।”
“জানাব।”
রায়ীনা চতুষ্কোণ ফুটো দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। একটা সুড়ঙ্গের মতো জায়গা। রায়ীনা হেঁটে যেতেই জায়গাটা আলোকিত হয়ে গেল। সে বড় একটা হলঘরে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশের দেওয়ালে বিচিত্র এক ধরনের কারুকার্য। সেগুলো নড়ছে এবং আকার পরিবর্তন করছে। মাঝে মাঝে কোনো কোনো অংশ আলোকিত হয়ে উঠছে।
হঠাৎ রায়ীনার মাথাটা ঘুরে উঠল। শুনতে পেল কমান্ডার লী তাকে ডাকছে, “রায়ীনা। রায়ীনা, তুমি কোথায়?”
রায়ীনা কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। বলল, “আমি সম্ভবত কন্ট্রোল রুমে। চারপাশে যেগুলো দেখছি সেগুলো সম্ভবত যন্ত্রপাতি, যদিও দেখতে একেবারে অন্যরকম।”
“কোনো এলিয়েন? কোনো প্রাণী?”
রায়ীনা হঠাৎ অনুভব করলো তার পিছনে কিছু একটা এসে দাঁড়িয়েছে। রায়ীনা ঘুরে দাঁড়ালো, এবং সাথে সাথে একটা আর্ত শব্দ করল। রায়ীনা হতবাক হয়ে দেখল, ঘরটার মাঝামাঝি ত্রাতিনা দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ত্রাতিনা! তার মেয়ে ত্রাতিনা।
কমান্ডার লী জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রায়ীনা? তুমি কী দেখছ?”
“হ্যালুসিনেশান। এই মহাকাশযানের প্রাণী আমাকে নিয়ে খেলছে।”
“কেন? তুমি কী দেখছ?”
“আমার মেয়ে ত্রাতিনা।”
কমান্ডার লী চিৎকার করে বলল, “তোমার মেয়ে ত্রাতিনা?”
“হ্যাঁ। একটু আগে আমার মাথা ঘুরে উঠেছিল। তখন নিশ্চয়ই আমার মস্তিষ্ক থেকে তথ্য নিয়েছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে ত্রাতিনাকে তৈরি করেছে। অবিকল ত্রাতিনা।”
“কী বলছ তুমি?”
“হ্যাঁ কমান্ডার লী। আমি ত্রাতিনাকে একটু আদর করি? আমি জানি এটা হ্যলুসিনেশান। আমি জানি এটি সত্যি নয়, কিন্তু তবু আমি একটু আদর করি ত্রাতিনাকে?”
কমান্ডার লী কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে একশ কিলোটন থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটির প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মুহূর্তে সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে গেল।