আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে নিজেকে বললাম এটি একটি পরাবাস্তব জগৎ এটি আসলে কিছু বিচিত্র তথ্যের কৌশলী উপস্থাপনা, এখানে যা আছে তার কোনোটিই সত্যি নয় তাই আমি এর কিছুই দেখে অবাক হব না। তারপরও আমি চোখ খুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আমার চারপাশে একটি বিচিত্র কুয়াশা ঢাকা আবছা জগৎ। কোথাও কোনো শব্দ নেই, মনে হয় নিজের নিশ্বাসের শব্দ আর হৃৎস্পন্দনও শুনতে পাব। জিগি বলেছিল এখানে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন পরাবাস্তব জগৎ রয়েছে কিন্তু এখানে একটি সুবিস্তৃত প্রান্তর ছাড়া আর কিছু নেই।
আমি খুব সাবধানে হাঁটতে থাকি, তখন মনে হল অনেক দূরে কোথাও একটি ঘণ্টা বাজছে শোনা যায় না এরকম একটি শব্দ। ঘণ্টাটি খুব গুরুগম্ভীর, মনে হয় কোনো একটি প্রাচীন মন্দিরের উপাসনার ঘণ্টা। আমি হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগুতে থাকি, ঠিক তখন দূরে কিছু জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হয় একটি অতি প্রাচীন উপাসনালয়, আরো কাছে যাবার পর দেখলাম সেখানে মিটমিট করে বাতি জ্বলছে। আমি আরো কাছে এগিয়ে এলাম এবং তখন এই উপাসনালয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠল। অত্যন্ত বিচিত্র কারুকাজ করা দেওয়াল, পুরো স্থাপত্যটি একেবারেই অচেনা। আমি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, ভেতরে ঢোকার কোনো দরজা নেই। আমি একটু কাছে এসে দেওয়ালটা স্পর্শ করতেই সেটা পেছনে সরে গেল, ভালো করে তাকিয়ে দেখি ভেতরে ঢোকার মতো ছোট একটা জায়গা উন্মুক্ত হয়েছে। আমি সাবধানে ভেতরে ঢুকেছি তখন হঠাৎ করে মনে হল সরসর শব্দ করে কিছু একটা পেছনে সরে যাচ্ছে। ভেতরে বিশাল একটি কক্ষ, তার কারুকাজ করা দেওয়াল। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম এবং আমার মনে হল কারুকাজ করা দেওয়ালটি আস্তে আস্তে নড়ছে। আমার হঠাৎ করে মনে হল আমি জীবন্ত কোনো প্রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার স্পষ্ট মনে হল আমি একটা প্রাণীর নিশ্বাস নেবার শব্দও শুনছি। নিশ্বাসের সাথে সাথে তার হৃৎস্পন্দন, দেহের সংকোচন, শরীরের কম্পনের শব্দ শোনা যেতে থাকে। জীবন্ত প্রাণীর এক ধরনের জৈবিক ঘ্রাণ আমার নাকে আসে, মনে হয় অশরীরী কোনো প্রাণী আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে।
আমি চোখ বন্ধ করে নিজেকে বললাম, এটি একটি পরাবাস্তব জগৎ এটি সত্যি নয়। জিগি আমার শরীরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, ভয়ংকর কিছু ঘটলেই সে আমার ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস টেনে খুলে দেবে, তখন আমি আবার সত্যিকারের জগতে ফিরে যাব। আমি চোখ বন্ধ করেই পায়ে পায়ে পিছিয়ে এসে দেওয়াল স্পর্শ করলাম। হাতের নিচে শীতল পিচ্ছিল জীবন্ত এক ধরনের অনুভূতি– আমি নিশ্বাস বন্ধ করে ধাক্কা দিতেই সেটি উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং আমি নিশ্বাস বন্ধ করে প্রায় ছুটে বের হয়ে এলাম। আমার অস্তিত্বকে কি এরকম কোনো একটি জায়গায় বন্দি করে রেখেছে? আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর কুলকুল করে ঘামতে থাকে।
সে আমি চোখ খুলে তাকালাম, নিজের অজান্তেই ছুটে অনেক দূরে চলে এসেছি। উপাসনালয়ের মতো দেখতে প্রাচীন স্থাপত্যটিকে আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, শুধু বহুদূর থেকে এক ধরনের অস্পষ্ট রহস্যময় ঘণ্টার আওয়াজটি শোনা যাচ্ছে। আমি বুকভরে একবার নিশ্বাস নিলাম, কোথায় যেতে হবে কী করতে হবে কিছু বুঝতে পারছি না। এই পরাবাস্তব জগৎটি সত্যিকার জগতের মতো–এর থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
ঠিক এরকম সময় বহু দূরে কোথাও একটি আলো জ্বলে আবার নিবে গেল। হয়তো এটি আমার জন্যে কোনো সংকেত, হয়তো আমার ওদিকে যাবার কথা। আমি বুকের মাঝে সাহস সঞ্চয় করে সেদিকে হাঁটতে থাকি।
আলোটি জ্বলে এবং নিবে আমাকে খানিকটা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল। হয়তো আলোটার দিকে সোজাসুজি যাচ্ছি হঠাৎ করে দেখতে পেলাম আলোটা ডানদিকে সরে গিয়ে জ্বলে উঠেছে। ডানদিকে হাঁটছি, তখন আলোটা আবার বামদিকে সরে গিয়ে জ্বলে উঠল।
হেঁটে হেঁটে শেষ পর্যন্ত আমি আলোটা খুঁজে পেলাম। খুব আধুনিক ধরনের একটা ছোট বাসা, সেই বাসার ওপর একটি এন্টেনা এবং এন্টেনার ওপর একটি আলো–যেটি জ্বলছে এবং নিবছে, যে আলোটা দেখে আমি এখানে এসেছি। বাসাটির বাইরে একটি সাজানো লন, তার ভেতর দিয়ে নুড়ি বসানো রাস্তা চলে গেছে। আমি সাবধানে সেই রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে বাসাটির কাছে চলে এলাম। বাসার ভেতর আলো জ্বলছে, মনে হয় সেখানে কেউ আছে। আমি দরজা স্পর্শ করতেই ভেতরে কোথাও শব্দ হল। আমি একজনের পদশব্দ শুনতে পেলাম, কেউ একজন এসে দরজা খুলে দিল, আমার দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, কে?
আমি মানুষটিকে ভালো করে লক্ষ করলাম, এটি পরাবাস্তব জগতের পরাবাস্তব মানুষ, কিন্তু তার সাথে সত্যিকার মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। মানুষটি মধ্যবয়স্ক, মাথার চুল সোনালি এবং চোখ নীল। গায়ের রঙ রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে, মুখে বয়স এবং অভিজ্ঞতার চিহ্ন। মানুষটি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?
আমি বললাম, তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
মানুষটার মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে দরজা থেকে সরে গিয়ে বলল, এস।
আমি ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম, কী চমৎকার করে সাজানো ঘরটি, কোথাও এতটুকু বাহুল্য নেই, এতটুকু অসামঞ্জস্য নেই, শুধুমাত্র পরাবাস্তব জগতেই বুঝি এরকম চমৎকার একটি ঘর খুঁজে পাওয়া যায় আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। সোনালি চুল, নীল চোখের মধ্যবয়স্ক মানুষটি এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মুখে হতচকিত এক ধরনের বিস্ময় ধরে রেখে বলল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? এখানে কারো আসার কথা নয়।
আমি জানি।
তা হলে তুমি কোথা থেকে এসেছ? কে তুমি?
আমার পরিচয় দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমার নাম ত্রাতুল–কিন্তু সেটাও প্রমাণ করতে পারব না। তার চাইতে বলো তুমি কে? তোমার নিশ্চয়ই একটা পরিচয় আছে, তুমি নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।
হ্যাঁ। আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আমি এত গুরুত্বপূর্ণ যে আমার একটা অস্তিত্বকে আলাদা সরিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে বেঁচে থাকার আনন্দের সবরকম উপকরণ আছে–তার মাঝে বাইরের কারো আসার কথা নয়। তুমি কেমন করে চলে এসেছ?
সম্ভবত ভুল করে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু এসে যখন পড়েছি তোমার কাছ থেকে কিছু তথ্য নিয়ে যাই।
মানুষটার মুখে এক ধরনের উপহাসের হাসি ফুটে উঠল, বলল, কী তথ্য?
তুমি কে? তুমি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
মানুষটি মনে হল ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না যে তাকে এই প্রশ্নটি করা হয়েছে। সম্ভবত কেউ তাকে এভাবে প্রশ্ন করে না। সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি আবার বললাম, কে তুমি?
আমার নাম খ্রাউস। আমি এই পরাবাস্তব জগতের সৃষ্টিকর্তা।
আমি কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তুমি এই পরাবাস্তব জগৎ সৃষ্টি করেছ?
আমি কাউকে এই প্রশ্নের জবাব দিই নি। কিন্তু তোমাকে দেব। কারণ তুমি সত্যিকারের মানুষ নও, তুমি পরাবাস্তব মানুষ। তোমাকে বললে কিছু আসে–যায় না।
কেন কিছু আসে–যায় না?
খ্রাউস হঠাৎ করে হেসে উঠল। হাসি অত্যন্ত বিচিত্র একটি প্রক্রিয়া, মানুষের ভেতরের রূপটি হাসির সাথে কেমন করে জানি প্রকাশিত হয়ে যায়। স্বাউসের হাসি দেখে আমি তাই শিউরে উঠলাম। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম মানুষটি অসম্ভব নিষ্ঠুর। আমার মনে হল মানুষ নয়, আমি বুঝি একটি দানবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। খ্রাউস যেরকম হঠাৎ করে হেসে উঠেছিল সেরকম হঠাৎ করে থেমে গিয়ে বলল, কারণ তুমি কিছু বোঝার আগেই তোমাকে নিশ্চিহ্ন করা হবে! এই অস্তিত্বকে এবং তোমার সত্যিকার অস্তিত্বকে।
আমার ভয় পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু কেন জানি ভয় না পেয়ে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলাম, বললাম, কে আমাকে নিশ্চিহ্ন করবে? তুমি?
না যুবক, তুমি বুঝতে পারছ না। তুমি কেমন করে এখানে ঢুকেছ আমি এখনো জানি, কিন্তু সেজন্য তোমাকে খুঁজে বের করে হত্যা করা হবে।
বেশ! তা হলে আমাকে হত্যা করে ফেলার আগেই আমি জেনে নেই–তুমি তা হলে বলো, কেন তুমি একটা পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করেছ?
আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রায় এক মিলিয়ন বুদ্ধিমান প্রাণী থাকার কথা। এতদিন তাদের কারো সাথে আমাদের যোগাযোগ হয় নি কারণ আমরা যোগাযোগ করার মতো স্তরে পৌঁছাই নি। পিঁপড়ার সাথে মানুষ যেরকম যোগাযোগ করতে পারে না, অনেকটা সেরকম। শেষ পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, বছর দুয়েক আগে।
পিঁপড়া থেকে উন্নত হয়েছে? পিঁপড়ার পাখা উঠেছে?
আমার টিটকারিটা উপেক্ষা করে খ্রাউস বলল, সেই উন্নত প্রাণীর সাথে আমাদের এক ধরনের শুভেচ্ছা বিনিময়ও হয়েছে। তারা আমাদের পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করার মতো প্রযুক্তি দিয়েছে, তার বদলে আমরা তাদেরকে–
পৃথিবীর মানুষ দিচ্ছ?
খ্রাউস খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিকই অনুমান করেছ।
সেই মানুষটি হতে হবে পৃর্থিবীর নিখুঁততম মানুষ? সেজন্যে পৃথিবীর নিখুঁত মানবী তৈরি করছ?
খ্রাউস আবার চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তুমি যে এই পরাবাস্তব জগতে ঢুকে পড়েছ সেটা দেখে আমি এখন আর খুব অবাক হচ্ছি না।
এই পরাবাস্তব জগৎ সেই বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে যোগাযোগের ইন্টারফেসঃ প্রাচীন উপাসনালয়ের মতো দেখতে জায়গাটির ভেতর থেকে মহাকাশের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করা হয়?
খ্রাউস এবারে হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, তোমাকে আমি নতুন কিছুই বলতে পারলাম না। তুমি দেখছি সবই জান।
আমি শুধু একটি জিনিস জানি না।
কী জিনিস?
মানুষকে কোনো এক বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দেওয়ার সাথে তাদেরকে পরাবাস্তব জগতে সৃষ্টি করার সম্পর্ক কী?
তুমি কখনো চিড়িয়াখানায় গিয়েছ?
হ্যাঁ গিয়েছি।
চিড়িয়াখানায় বন্যপশু নিয়ে আসার আগে বনে–জঙ্গলে সেই পশুদের জীবনযাত্রা দেখে আসতে হয়। এখানেও তাই। যেসব মানুষকে পাঠানো হবে তাদের জীবনযাত্রা দেখা হচ্ছে। তাদেরকে নিয়ে খানিকটা গবেষণা করা হচ্ছে। তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমি কিছুক্ষণ খ্রাউসের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, খ্রাউস।
পৃথিবীতে আমাকে মহামান্য খ্রাউস ডাকা হয়।
এটা পৃথিবী না। তা ছাড়া আমি কখনো কাউকে মহামান্য ডাকি না। আমি মুখের মাংসপেশি শক্ত করে বললাম, খ্রাউস, তোমার কি কখনো মনে হয়েছে যে এই কাজটি পৃথিবীর মানুষের কাছে অন্যায় এবং অমানবিক বলে মনে হতে পারে?
খ্রাউস আবার শব্দ করে হেসে উঠল, নিষ্ঠুর নীল দুটি চোখ দেখে আবার আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। খ্রাউস হাসতে হাসতে বলল, পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কথা ভাবলে পৃথিবীতে কখনো সভ্যতা গড়ে উঠত না! মানুষ এখনো গুহায় বসে পাথরে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে বুনো শূকর পুড়িয়ে পুড়িয়ে খেত। কিন্তু তা হয় নি। কেন হয় নি জান?
কেন?
কারণ পৃথিবীতে স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের জন্ম হয়েছে। তারা সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করে, প্রয়োজনে ধ্বংস করে বড় বড় সভ্যতা গড়ে তুলেছে। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাস–একটি সভ্যতা ধ্বংস করে সব সময় আরেকটি সভ্যতা গড়ে উঠেছে। আমরা এখন ঠিক সেরকম একটা মুহূর্তের কাছাকাছি আছি। পৃথিবীর এই সভ্যতা ধ্বংস করে আমরা নতুন একটা সভ্যতা গড়ে তুলব। সে
ও! আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বুঝতে পেরেছি।
কী বুঝতে পেরেছ?
তুমি হচ্ছ ইতিহাসের সেই বিশ্বাসঘাতক। যে সব সময় নিজের জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
তোমার এসব কথা হচ্ছে অসভ্য মানুষের অশালীন ভাষা। অশালীন ভাষা ব্যবহার। করে তুমি আমাকে বিচলিত করতে পারবে না।
আমি জানি। কিন্তু তবু চেষ্টা করতে চাই।
নির্বোধ যুবক। তুমি জান তোমার জীবন শেষ হয়ে এসেছে।
সম্ভবত। আমি চোখ ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালাম। দেওয়ালে চমৎকার একটি শেলফ তৈরি করে তার ওপর কিছু প্রাচীন পুরাকীর্তি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু মূর্তি, কিছু অলংকার। তৈজসপত্রের সাথে একটি লম্বা ধাতব দও সম্ভবত কখনো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। আমি এগিয়ে সেটি হাতে তুলে নিলাম।
খ্রাউস প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার করে বলল, তুমি কী করছ?
আমার এটা কৌতূহল। অশালীন ভাষা ব্যবহার করে তোমাকে বিচলিত করা যায় না, কিন্তু এই ভোঁতা দণ্ডটি দিয়ে তোমাকে ঠিকমতো আঘাত করে বিচলিত করা যায় কি না দেখতে চাই!
খ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, প্রথমে তার চোখে বিস্ময় এবং একটু পরে সেখানে এক ধরনের আতঙ্ক ফুটে ওঠে। আমি দুই হাতে ভোঁতা ধাতব দণ্ডটি শক্ত করে ধরে তার দিকে এগিয়ে গেলাম, খ্রাউস পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই আমি সমস্ত শরীরের জোর দিয়ে তাকে আঘাত করলাম। সে মাথা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার পরও দণ্ডটি তার মুখে এসে আঘাত করল। সাথে সাথে চোখের নিচে খানিকটা জায়গা ফেটে রক্ত বের হয়ে আসে।
খ্রাউস কাতর আর্তনাদ করে বলল, কী করছ? কী করছ তুমি?
আমি হিংস্র গলায় বললাম, দেখছি। পরাবাস্তব জগতে কাউকে খুন করা যায় কি না দেখছি।
আমি সত্যি সত্যি উন্মত্তের মতো আবার ধাতব দণ্ডটি তুলে তাকে আঘাত করার চেষ্টা করলাম, ঠিক তখন মনে হল আমার মাথার ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটল। হঠাৎ করে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যায় এবং আমি জিগির ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম–কী হয়েছে ত্রাতুল? কী হয়েছে তোমার?
আমি মাথা চেপে ধরে কোনোমতে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কিছু হয় নাই। একজনকে খুন করার চেষ্টা করছিলাম।
কাকে?
আমি উত্তর দেবার আগেই খুট করে দরজা খুলে গেল। দেখলাম সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
পেছন থেকে একজন মানুষ হেঁটে আসছে। মানুষটির সোনালি চুল এবং নীল চোখ। মানুষটি মধ্যবয়স্ক এবং সুদর্শন।
মানুষটি খ্রাউস এবং আমি কয়েক মুহূর্ত আগে তাকে পরাবাস্তব জগতে খুন করার চেষ্টা করেছি।