জিগির বাসাটি খুঁজে পেতে আমার খুব কষ্ট হল। সে নানা ধরনের বেআইনি এবং অবৈধ কাজে লেগে থাকে বলে নিজের থাকার জায়গাটি কখনো কাউকে জানাতে চায় না। দরজায় শব্দ করার পরও সে দরজা খোলার আগে নানাভাবে নিশ্চিত হয়ে নিল মানুষটি সত্যিই আমি।
আমাকে দেখে সে প্রয়োজন থেকে জোরে চিৎকার করে বলল, আরে ত্রাতুল–সত্যিই দেখি তুমি! আমি ভেবেছি একটা নিরাপত্তা বাহিনীর এন্ড্রয়েড।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না, আমি এন্ড্রয়েড না।
তোমাকে দেখতে এরকম লাগছে কেন? জিগি ভুরু কুঁচকে বলল, দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন তোমাকে কেউ কিছু খেতে দেয় নি?
আমাকে কেন এরকম দেখাচ্ছে তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু মুখ খোলার আগেই জিগি চোখ বড় বড় করে বলল, কী মজা হয়েছে জান?
আমি জিজ্ঞেস করার আগেই জিগি বলতে শুরু করল, চতুর্থ মাত্রার হাইব্রিড সাইবর্গের কপোট্রনের বাইরের শেলে দুইটা মডিউলে ক্রস কানেক্ট!
জিগি হা–হা করে আনন্দে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করল। সাইবর্গের কপোট্রনের ক্রটিতে জিগি যেরকম আনন্দ পেতে পারে আমি সেরকম পেতে পারি না–কিন্তু জিগি সেটা লক্ষ করল বলে মনে হল না। হঠাৎ করে আমাকে ঘরের কোনায় টেনে নিয়ে একটা মাঝারি এন্টেনাকে অনুরণিত করতে শুরু করে বলল, দেখো কী মজা হয়?
সবুজ স্ক্রিনে কিছু সংখ্যা ছোটাছুটি করতে থাকে, আমি সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী মজা হবে?
নেটওয়ার্কে একটা ফাঁক খুঁজে পেয়েছি। আমি এখন মূল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়তে পারি।
সে তো সবাই পারে।
জিগি হাত নেড়ে বলল, কিন্তু সেটা তো আইনসম্মতভাবে আমি পুরোপুরি বেআইনিভাবে ঢুকছি! জিগি আবার আনন্দে হা–হা করে হাসতে থাকে।
জিগি নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে একটা গোপন তথ্য ভাণ্ডারের কিছু মূল্যবান তথ্য নষ্ট করে দিয়ে বলল, দেখেছ? আমি কী করেছি? আমাকে ধরতে পারল?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না পারে নি।
কখনো পারবে না। জিগি বুকে থাবা দিয়ে বলল, কখনো না!
কেন?
আমার ট্রাকিওশান ভুয়া! জিগি আবার আনন্দে হা–হা করে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলল, নতুন এন্ড্রয়েডগুলোর মেটা ফাইলগুলো বের করেছি। তুমি নেবে?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, নেব।
আসো–তোমাকে একটা ক্রিস্টালে লোড করে দেই।
আমি জিগিকে থামিয়ে বললাম, জিগি। আমি তোমার কাছে একটা বিশেষ কাজে এসেছি।
আমার কাছে? বিশেষ কাজে? জিগি খুব অবাক হল। তার কাছে কেউ কখনো বিশেষ কাজে আসে না। সে ভুরু কুঁচকে বলল, কী কাজ?
আমি পকেট থেকে একটা ছোট ক্রিস্টাল বের করে জিগির হাতে দিয়ে বললাম, এটা দেখ।
জিগি ক্রিস্টালটি তার ঘরের অসংখ্য যন্ত্রপাতির কোনো একটিতে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে কোথায় কোথায় সুইচ টিপে দিতেই ঘরের মাঝামাঝি একটা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে আমাকে দেখতে পেলাম। এলোমেলো চুল, দিশেহারা শূন্য দৃষ্টি, কাতর কণ্ঠস্বর। গম্ভীর হতাশায় ডুবে গিয়ে সে বলল, ভ্রাতুল, আমি ত্রাতুল।
জিগি খুব কৌতূহল নিয়ে পরপর তিনবার ভিডিও ক্লিপটি দেখল। সুইচ টিপে ভিডি মডিউল বন্ধ করে সে আমার দিকে তাকাল, তার চোখ অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো জ্বলজ্বল করছে। খানিকক্ষণ সে কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে সে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এসে আমার চুল খামচে ধরে ঘুরিয়ে মাথার পেছনে তাকাল, তারপর শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, এন্ড্রোমিডার দোহাই! তোমার মাথায় ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস লাগিয়েছে?
হ্যাঁ।
তোমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে নিয়েছে?
হ্যাঁ।
তার মানে তোমার আরেকটা অস্তিত্ব তৈরি করে পরাবাস্তব জগতে আটকে রেখেছে?
হ্যাঁ।
কত বড় সাহস! জিগি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, জানোয়ারের বাচ্চাদের মিউটেশান হোক। ক্লচ ভাইরাস রক্তনালিকে ছিন্ন করে দিক। গামা রেডিয়েশনে হিমোগ্লাবিন ফেটে যাক।
আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। জিগি মুখ পাথরের মতো শক্ত করে বলল, রিয়া নামে আরেকজনকে ম্যাপিং করেছে?
হ্যাঁ।
সেটা কে?
আমি জানি না।
নামটা আমার কাছে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে–আগে কোথাও শুনেছি।
এটি একটি সাধারণ নাম, না শোনার কোনো কারণ নেই।
না–না তা নয়। জিগি মাথা নাড়ল, বলল, এই নামের একজন বিশেষ মানুষ আছে। জিগি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল, তারপর তার অসংখ্য যন্ত্রপাতির মাঝে কোনো একটিতে মাথা ঢুকিয়ে কিছু তথ্য প্রবেশ করিয়ে ফিরে এসে বলল, পৃথিবীতে রিয়া নামে দুই লক্ষ তিরানব্বই হাজার সাত শ বিয়াল্লিশটি মেয়ে আছে। তার মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত মেয়েটিকে আদর করে ডাকা হয় রাজকুমারী রিয়া।
রাজকুমারী রিয়া?
হ্যাঁ। তার বয়স বাইশ। উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে তার মায়ের সঙ্গে থাকে।
আমি মাথা চুলকে বললাম, কেন সে বিখ্যাত? কেন তাকে রাজকুমারী রিয়া ডাকা হয়?
কারণ রিয়া হচ্ছে পৃথিবীর নিখুঁততম মানবী। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তার শরীরের প্রত্যেকটা জিন আলাদা আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে।
ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি ভাবছ এই রিয়াকেই আটকে রেখেছে!
জিগি মাথা নাড়ল, বলল, সম্ভবত।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। আমি কী বলেছি লক্ষ করেছ? আমি বলেছি, আমাদের খুব বিপদ, আমার আর রিয়ার। আমি বলি নি আমার আর রিয়া নামের একটি মেয়ের খুব বিপদ–আমি ধরেই নিয়েছি রিয়াকে সবাই চেনে।
হ্যাঁ।
এভাবে বলার একটা অর্থ আছে। এর মাঝে একটা বড় তথ্য লুকিয়ে আছে।
জিগি ঘরে কয়েকবার পায়চারি করে এক বোতল উত্তেজক পানীয় ঢকঢক করে খানিকটা খেয়ে বলল, এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। কিছুতেই না!
আমি বললাম, আমি সেজন্যে তোমার কাছে এসেছি। তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
জিগি মাথা নাড়ল, তা ঠিক। নেটওয়ার্কে ঢোকা যার–তার কাজ নয়।
জিগির চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, মুখের মাংসপেশি টানটান হয়ে থাকে, চোখ জ্বলজ্বল করতে শুরু করে অনেক দিন পর সে তার মনের মতো একটা কাজ পেয়েছে। তখন তখনই সে মাথায় হেলমেটের মতো একটা নিউরাল ইন্টারফেস পরে কাজে লেগে যায়।
জিগি ঘণ্টাখানেক নেটওয়ার্কের সাথে ধস্তাধস্তি করল তারপর কেমন যেন বিধ্বস্তভাবে মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে ঘরের এক কোনায় ছুঁড়ে দিয়ে কয়েকবার মেঝেতে পা দিয়ে লাথি দিল। আমি বললাম, কী হয়েছে?
পারছি না। নেটওয়ার্কের যোগাযোগটা পাচ্ছি না।
পাচ্ছ না?
না। আমার মনে হয় মূল কেন্দ্রে আলাদা করে রেখেছে। এখান থেকে ভেতরে ঢোকা যাবে না।
ত্তা হলে?
জিগির মুখে ক্রুদ্ধ অস্থির এক ধরনের ভাব ফুটে ওঠে–ঢকঢক করে আবার কয়েক ঢোক উত্তেজক পানীয় খেয়ে মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই কোনো উপায় আছে।
আমি বললাম, যে বাসাটিতে আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করছে সেখানে গেলে–
জিগি কাছাকাছি একটা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ! সেই বাসাটি নিশ্চিতভাবে নেটওয়ার্কের সাথে জুড়ে দেওয়া আছে।
কিন্তু সেখানে ঢুকব কেমন করে? কত রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা!
জিগি হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, সেটা দেখা যাবে। চল যাই।
আমি বললাম, রাজকুমারী রিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে কেমন হয়?
জিগি খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, পাবে না।
কী পাব না?
রিয়াকে।
চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?
ঠিক আছে চেষ্টা কর।
আমি ভিডি মডিউলে চেষ্টা করতে থাকি। প্রথম দুবার যোগাযোগ করা গেল না– তৃতীয়বার আমাকে অবাক করে দিয়ে ভিডি স্ক্রিনে অপরূপ রূপসী একটি মেয়ের ছবি ভেসে উঠল, মেয়েটি কৌতূহলী চোখে বলল, কে? কে তুমি?
আমি থতমত খেয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তুমি কি রাজকুমারী রিয়া?
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, কেউ যখন খুব গম্ভীর হয়ে আমাকে রাজকুমারী রিয়া বলে ডাকে তখন আমার খুব হাসি পায়।
আমি–আমি–আসলে বুঝতে পারছি না তোমাকে কী বলে ডাকব।
ছেড়ে দাও ওসব। বলো তুমি কে?
তুমি আমাকে চিনবে না। আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি!
রিয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, প্রয়োজনটা সত্যি না হলে কিন্তু ভালো হবে না আগেই সাবধান করে রাখছি। প্রতিদিন কতশত মানুষ আমার সাথে যোগাযোগ করে তুমি জান?
আমি অনুমান করতে পারি। তুমি নিশ্চিত থাক। প্রয়োজনটা খুব জরুরি।
বলো।
তোমার মাথার পেছনে কি একটা ধাতব টিউব লাগানো?
রিয়া হতচকিত হয়ে বলল, কী বললে? কী বললে তুমি?
তোমার মাথায় কি গত এক-দুইদিনের মাঝে কোনো ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস লাগানো হয়েছে?
রিয়া নিজের মাথার পেছনে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলল, হ্যাঁ। লাগিয়েছে। তুমি কেমন করে জান? এটি কারো জানার কথা না।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, আমারও লাগিয়েছে। আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে আমার একটি অস্তিত্ব তৈরি করা হয়েছে। সেই অস্তিত্ব আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। করে বলেছে সে খুব কষ্টে আছে। তার সাথে কে আছে জান?
কে?
তুমি।
রিয়া এক ধরনের হতচকিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কিন্তু তারা যে বলল আমার অস্তিত্বটি সুপ্ত থাকবে, কখনো জাগাবে না–শুধু নিরাপত্তার জন্যে তৈরি করেছে।
মিথ্যা কথা বলেছে। আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ। তোমার ভেতরে সম্ভবত কোনো খারাপ প্রবৃত্তি নেই–তুমি মনে হয় খারাপ কিছু দেখতে শেখ নি। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি–পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে। তারা তোমার সাথে মিথ্যা কথা বলছে।
রিয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল–তার মুখ দেখে মনে হল, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে, কেউ তার সাথে মিথ্যা কথা বলতে পারে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কেন?
আমি জানি না। তু
মি তুমি তুমি কি নিশ্চিত?
হ্যাঁ। আমি নিশ্চিত।
তুমি কে? তোমার পরিচয় তো আমি জানি না।
আমার নাম ব্রাতুল। আমার কোনো ট্রাকিওশান নেই তাই আমার আর কোনো পরিচয় নেই।
রিয়া আরো কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে জিগি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ভিডি মডিউলটি বন্ধ করে চিৎকার করে বলল, সাবধান ব্রতুল।
কী হয়েছে?
ধরতে আসছে।
ধরতে আসছে? কাকে?
তোমাকে আর আমাকে।
কে ধরতে আসছে?
জিগি শুষ্ক মুখে বলল, নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ স্কোয়াড। ঐ দেখ–
আমি ঘরের এক কোনায় স্ক্রিনে দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে বড় বড় বাইভার্বাল থামছে আর সেখান থেকে পিলপিল করে কালো পোশাক পরা নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ স্কোয়াড নেমে আসছে। মানুষগুলোর পোশাক কালো, চোখে কালো চশমা এবং কোমরে বীভৎস স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝুলছে। যন্ত্রের মতো তারা সারিবদ্ধভাবে ছুটে আসছে। আমি জিগির দিকে তাকালাম, এরা কেন আসছে?
আমাদের ধরতে।
কেন?
একটু আগে নেটওয়ার্কে ঢোকার চেষ্টা করলাম মনে নেই?
কিন্তু তুমি বলেছিলে কেউ তোমাকে ধরতে পারবে না। তোমার ট্রাকিওশান তুমি পাল্টে ফেলেছ। তুমি
জিগি মুখ খিঁচিয়ে বলল, এখন থামো–আগে পালাই।
কেমন করে পালাবে? সব ঘেরাও করে ফেলেছে না?
আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম কয়েকটা কালো বাইভার্বাল এই দুই হাজার তলা বিল্ডিংটিকে ঘিরে উড়ছে। ভালো করে লক্ষ করলে ভেতরে বসে থাকা মানুষগুলোকেও দেখা যায়। জিগি আমার কথার উত্তর না দিয়ে ছোট একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে তার যন্ত্রপাতির মাঝে ছোটাছুটি করে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে বলল, চলো।
আমি দরজার দিকে এগুতেই জিগি ধমক দিয়ে বলল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?
বাইরে যাবে না?
দরজা দিয়ে? তুমি কি ভেবেছ সিঁড়ি, লিফট আর বের হবার পোর্ট তোমার জন্যে রেডি করে রেখেছে? সব জায়গায় বিশেষ স্কোয়াড এখন কিলবিল করছে।
তা হলে?
এই যে, এদিক দিয়ে।
আমি জিগির পেছনে পেছনে গেলাম, তার বিছানাটা টেনে তুলতেই নিচে একটা ছোট চৌকোনা দরজা বের হল। সেটা খুলতেই একটা গোলাকার ডাক্ট দেখা গেল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এদিক দিয়ে?
হ্যাঁ। ডানদিকে দশ মিটার মতো গেলে মূল তথ্য সরবরাহের লাইনটা পাবে, ঝুলে নেমে যেতে হবে। তোমার উচ্চতাভীতি নেই তো?
আমি শুষ্ক গলায় বললাম, আছে কি না কখনো পরীক্ষা করে দেখি নি।
বেশ! আজকে পরীক্ষা হয়ে যাবে। নামো।
তুমি?
আমি হলোগ্রাফিক ভিডিওটা চালিয়ে দিয়ে আসি।
জিগি ভেতরে গিয়ে কিছু যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করে কয়েকটা সুইচ টিপে দিতেই ঘরের ভেতরে একটা হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি ভেসে এল–সেখানে দেখা যাচ্ছে ভয়ংকর কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে জিগি দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরপর দরজার দিকে তাক করে গুলি করে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে বলে ভয় দেখাচ্ছে। জিগি নিজের হলোগ্রাফিক ছবিটার দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আমার কাছে ফিরে এসে বলল, নিরাপত্তার লোকজন যখন দেখবে আমাকে পাওয়া গেছে খানিকটা নিশ্চিন্ত হবে। এত সব অস্ত্র দেখে সহজে ঢুকবে না– ততক্ষণে আমরা হাওয়া হয়ে যাব।
ছোট খোপটার ভেতরে ঢুকে জিগি উপরের অংশটুকু ঢেকে দিল, এই দিক দিয়ে যে বের হয়ে এসেছি সেটা আর কেউ বুঝতে পারবে না।
জিগির পিছু পিছু আমি সরু একটা টানেলের মতো স্থায়গা দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে থাকি। খানিক দূর যাওয়ার পর একটা বড় শ্যাফট পাওয়া গেল। নানা আকারের অসংখ্য তার বহু নিচে নেমে গেছে। জিগি মোটা একটা তার ধরে ঝুলে ঝুলে নিচে নামতে নামতে বলল, সাবধান ত্রাতুল। লাল রঙের তারগুলো ধরো না–ভেতরে ইনফ্রারেড আলো যাচ্ছে, কয়েক মেগাওয়াট–কোনোমতে ভেঙে গেলে মুহূর্তের মাঝে ভাজা কাবাব হয়ে যাবে।
আমি লাল রঙের তারগুলো স্পর্শ না করে সাবধানে কালো রঙের মোটা একটা তার ধরে ঝুলতে ঝুলতে নিচে নামতে শুরু করলাম–হাত ফসকে গেলে প্রায় দুই কিলোমিটার নিচে পড়ে থেঁতলে যাব– পৃথিবীর কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না! মাথা থেকে জোর করে সেই চিন্তা দূর করে দিলাম–যা হয় হবে, কোনো কিছুতেই আর পায়রায়া করি না এই ধরনের একটা ভাব নিজের ভেতরে নিয়ে এসে সরসর করে একটা সরীসৃপের মতো জিগির সাথে সাথে নিচে নামতে থাকি। জিগির মুখে দুশ্চিন্তার কোনো চিহ্ন নেই, তাকে দেখে মনে হয় এই ধরনের কাজ সে আগে অনেকবার করেছে এবং এই মুহূর্তে সে ব্যাপারটা খানিকটা উপভোগ করতে শুরু করেছে।
শ্যাফটের নিচে পৌঁছে জিগি দরজার দিকে এগিয়ে গেল, পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজার তালাটা খুলে প্রথমে এলার্ম সিস্টেমটা অচল করে দিল, তারপর দরজাটা একটু ফাঁক করে প্রথমে নিজের মাথাটা একটু বের করে বাইরে পুরোপুরি নিরাপদ নিশ্চিত হওয়ার পর সে সাবধানে বের হয়ে আমাকেও বেরিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল। আমি বের হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আগেও এদিক দিয়ে বের হয়েছ!
অবিশ্যি। এসব ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নেওয়া যায় নাকি? শিখে রাখো আমার কাছ থেকে কোনো জায়গায় থাকতে চাইলে প্রথমেই পালিয়ে যাবার রাস্তাটি ঠিক করে রাখবে।
আমি কোনো কথা বললাম না। দুজনে রাস্তার পাশ দিয়ে সাবধানে হেঁটে যেতে থাকি। দ্বিতীয় এপার্টমেন্ট বিন্ডিংটার পাশে আসার পর হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম, কিছুক্ষণ টানা গুলির শব্দ হল এবং অনেক উপর থেকে কিছু আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হয়ে আসতে দেখা গেল। জিগি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, বেকুবগুলো আমার হলোগ্রাফিক মূর্তিটাকে গুলি করছে। হা–হা–হা–
আমি পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে একটু শিউরে উঠি–এর মাঝে হাসার মতো কোনো বিষয় খুঁজে পাই না।