আমি চোখ খুলে তাকালাম, দেখতে পেলাম আমাকে ঘিরে তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, নিরানন্দ চেহারার সরীসৃপের মতো মানুষ, লালচে চুলের বিরক্ত চেহারার মানুষ এবং পুরুষ না নারী বোঝার উপায় নেই সেই মহিলা। চিকিৎসক রোবটটিকে দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু আমার মাথার পেছনে খুটখাট শব্দ শুনে বুঝতে পারছি সে কাছেই আছে।
নিরানন্দ চেহারার মানুষটি বলল, তুমি এখন উঠে বসতে পার।
আমি উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাথার পেছনে কোথায় জানি যন্ত্রণা করে উঠল। সেখানে হাত দিতেই অনুভব করলাম, একটা ধাতব টিউব লাগানো। আমি দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, জানোয়ারের বাচ্চা।
নিরানন্দ চেহারার মানুষটি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, কী বললে? কী বললে তুমি?
আমি সাবধানে উঠে বসতে বসতে বললাম, বলেছি জানোয়ারের বাচ্চা। এটা একটা গালি। তবে যদি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর তা হলে বুঝবে আসলে এটা ভুল গালি।
তুমি কী বলতে চাইছ!
আমি কী বলতে চাইছি সেটা তুমি বুঝবে বলে মনে হয় না। তবু যদি শুনতে চাও তা হলে শোন–পৃথিবীতে শুধু মানুষই অন্য মানুষকে অপ্রয়োজনে কষ্ট দেয়। অন্য কোনো পশুপাখি অপ্রয়োজনে নিজের প্রজাতিকে কষ্ট দেয় না। কাজেই তোমাদের জানোয়ারের বাচ্চা গালি দেওয়া হলে জানোয়ারকে অপমান করা হয়।
মানুষটি আমার কথা শুনে এত অবাক হল যে বলার মতো নয়–আরেকটু হলে হয়তো তেড়ে এসে আমাকে আঘাত করে বসত কিন্তু অন্য দুজন তাকে থামাল। মহিলাটি খনখনে গলায় বলল, ছেড়ে দাও। মাত্র নিউরাল কানেকশান ম্যাপিং হয়েছে, এখনো সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আসে নি। কী বলছে নিজেও জানে না।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, কী বলছি, আমি খুব ভালো করে জানি। আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করার তোমাদের কোনো অধিকার নেই।
লাল চুলের বিরক্ত চেহারার মানুষটি বলল, অধিকার, দায়িত্ব, ন্যায়–অন্যায় এসব বড় বড় ব্যাপার নিয়ে কথাবার্তা তোমার মুখে মানায় না। তুমি একজন ফালতু মানুষ–তোমার। মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে তবুও তোমাকে কোনোভাবে কাজে লাগানো গেছে।
আমার অস্তিত্বটিকে তোমরা কী করেছ?
সেই উত্তর আমরা তোমাকে দেব কেন? নেটওয়ার্কে করে তাকে তার জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কোথায় পাঠিয়েছ? কোথায় রেখেছ? তাকে কি কষ্ট দিচ্ছ?
দিলেই কী আর না দিলেই কী? সেটা আর তুমি নও।
আমি চিৎকার করে বললাম, সে আমি। তাকে তোমরা কষ্ট দিতে পারবে না।
মহিলাটি এতক্ষণ কোনো কথা বলছিল না, এবারে কঠোর গলায় বলল, দেখ যুবক, তুমি বাড়াবাড়ি করছ। আমরা তোমার প্রতি অনুকম্পা করে তোমাকে মানুষ হিসেবে বাচিয়ে রেখেছি। ইচ্ছে করলেই তোমার মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সরিয়ে সেখানে কপোট্রন বসিয়ে একটা সাইবর্গে পাল্টে দিতে পারতাম। সেটা করি নি–তার অর্থ এই নয় যে, ভবিষ্যতে করব না।
তোমরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
হ্যাঁ! আমরা তোমাকে ভয় দেখাচ্ছি। তোমাকে ভয় দেখাতে কোনো সমস্যা নেই। একটা পোষা কুকুরের অধিকার তোমার থেকে বেশি।
আমি মহিলাটির শীতল চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে রইলাম–একটি ভালো সঙ্গীত শুনলে বা চমৎকার একটা শিল্পকর্ম দেখলে যেরকম আনন্দ হয় মহিলাটির হৃদয়হীনতা দেখে আমার হঠাৎ সেরকম এক ধরনের আনন্দ হল–নিজের অজান্তেই হঠাৎ করে আমার মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। মহিলাটি জিজ্ঞেস করল, তুমি হাসছ কেন?
আনন্দে।
আনন্দে? কীসের আনন্দে?
আমি তোমাকে সেটা বলব না। এটা আমার ব্যক্তিগত আনন্দ। তুমি সেটা বুঝতে পারবে না।
অনেক হয়েছে। এখন তুমি যাও।
ঠিক আছে যাচ্ছি। আবার দেখা হবে।
মহিলাটি মাথা নাড়ল, বলল, না দেখা হবে না।
আমি মনে মনে বললাম, নিশ্চয়ই দেখা হবে। আমার সাথে দেখা না হলেও আমার অন্য অস্তিত্বের সাথে দেখা হবে। আমি আবার আমার মাথার পেছনে হাত দিলাম, সেখানে ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসটিতে এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা। আমি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় লাল চুলের মানুষটি বলল, নিজে থেকে ইন্টারফেসটি খোলার চেষ্টা করো না আহাম্মক কোথাকার। মস্তিষ্কের সাথে লাগানো আছে–কিছু একটা গোলমাল হলে একেবারে পাকাপাকি অচল হয়ে যাবে। লোকটি মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, কে জানে সেটাই মনে হয় তোমার জন্যে ভালো?
আমি কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। লম্বা করিডর ধরে হেঁটে বড় একটা দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজাটি খুলে গেল। বাইরে পাথর ছড়ানো ছোট রাস্তা। রাস্তা শেষ হয়েছে একটি গেটের সামনে। গেটটি ঠেলে খুলে আমি বের হয়ে এলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে আবার আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, পুরাতন একটি বিশেষত্বহীন দালান, দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে অসহায় মানুষকে ধরে এনে তাদের মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশান ম্যাপিং করে রাখা হয়। আমার একটি অস্তিত্বকে ওরা তৈরি করে রেখেছে–সে কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে। আমার না দেখা সেই অস্তিত্বটির জন্যে আমি আমার বুকের ভেতরে এক ধরনের গভীর বেদনা অনুভব করতে থাকি।
আমি পুরাতন সেই দালানটাকে পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম। পাশাপাশি উঁচু ঘিঞ্জি দালান–পুরো এলাকাটিতে এক ধরনের মন খারাপ করা ভাব। মাথার উপর দিয়ে তীক্ষ্ণ শব্দ করে বাইভার্বাল উড়ে যাচ্ছে। রাস্তায় মানুষ, সাইবর্গ এবং এন্ড্রয়েড। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম কোথাও একটি গাছ নেই, একটু মাটি নেই, সভ্যতার নামে সবাই মিলে পৃথিবীটাকে কী নিষ্ঠুরভাবেই না পরিবর্তিত করে ফেলেছে। হেঁটে হেঁটে আমি নিজেকে ক্লান্ত করে ফেললাম আমার পকেটে হাত খুলে খরচ করার মতো ইউনিট নেই। তাই খুঁজে খুঁজে একটা পাতাল ট্রেন বের করতে হল। টিকিট কিনে আমি ছোট একটা ঘুপচি বগিতে চেয়ারে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে বসে থাকি। মাটির নিচে অন্ধকার গহ্বরের ভেতর দিয়ে ট্রেনটি সুপার কন্ডাক্টিং রেলের ওপর দিয়ে ভয়ংকর গতিতে ছুটে চলতে শুরু করে। বসে থাকতে থাকতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম আমার অস্তিত্বটি একটি ছোট ঘরের ভেতর আটকা পড়ে আছে, ঘরের ভেতর কয়েকটি বুনো কুকুর–তাদের মুখ দিয়ে সাদা ফেনা ঝরছে। আমার অস্তিত্বটি ঘরটির জানালার লোহার রড ধরে ঝুলে আছে, কুকুরগুলো হিংস্র চিৎকার করে আমার অস্তিত্বটিকে ধরার চেষ্টা করছে–পারছে না। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার অস্তিত্বটি কাতর গলায় আমার কাছে সাহায্য চাইছে কিন্তু আমি কিছু করতে পারছি না। এরকম সময়ে ট্রেনটি একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল, আমি আমার নিজের শহরে পৌঁছে গেছি। আমি সিট বেল্ট খুলে বের হয়ে এলাম। আমার চারপাশে অসংখ্য মানুষ, সাইবর্গ আর এন্ড্রয়েড ব্যস্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে–শুধু আমার কোনো ব্যস্ততা নেই।
মাটির নিচ থেকে উপরে উঠে দেখতে পেলাম চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমি এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করতে থাকি হঠাৎ করে নরম একটি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমে অচেতন হয়ে যাবার ইচ্ছে করতে থাকে। আমি শহরের উপকণ্ঠে আমার দুই হাজার তলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙে আমার ছোট খুপরির মতো ঘরটিতে এসে শরীরের কাপড় না খুলেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে কিন্তু আমার বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই।
এভাবে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম আমি জানি না। যখন আমার ঘুম ভেঙেছে তখন বাইরে রাত না দিন তাও আমি জানি না। আমি কোনোমতে বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে চোখে–মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে আমার শোবার ঘরে ফিরে এলাম। ভিডি মডিউলে১৭ একটা লাল বাতি জ্বলছে এবং নিবছে যার অর্থ এখানে আমার জন্য অসংখ্য তথ্য জমা হয়েছে। আমার পরিচিত মানুষ বলতে গেলে নেই এই তথ্যগুলোর বেশিরভাগ নানা ধরনের যন্ত্রপাতি থেকে এসেছে এর মাঝে কখনোই প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য থাকে না। আমি একটি বোতাম স্পর্শ করে সেগুলো মুছে দিতে গিয়ে কেন জানি থেমে গেলাম–ঠিক কী কারণ জানি না, আমি তথ্যগুলো দেখতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন কাজের মাঝে এক ধরনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডি মডিউলের বেশিরভাগ তথ্য সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়–পৃথিবীর যাবতীয় অর্থহীন দ্রব্য মানুষকে গছিয়ে দেওয়ার এক ধরনের অসহনীয় প্রতিযোগিতা ছাড়া সেগুলো আর কিছু নয়। তথ্যগুলোর মাঝে হঠাৎ করে অবশ্য একটি পরিচিত মানুষের একটি ভিডিও ক্লিপ পেলাম, জিগি নামের একজন বাতিকগ্রস্ত মানুষ হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে আমার প্রায় বুকের ওপর চেপে বসে চিৎকার করে বলল, কী খবর তোমার ত্রাতুল? তোমার কোনো দেখা নাই?
জিগি আবার অদৃশ্য হয়ে গেল, বাতিকগ্রস্ত এই মানুষটির যে আমার সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা আছে তা নয়–আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব বলতে গেলে একেবারেই নেই। জিগির সাথে আমার বন্ধুত্ব হওয়ার কথা নয়, তবুও একটি বিচিত্র কারণে তাকে আমার বন্ধু বলে মনে হয়। জিগির ভেতর যদি বিন্দু পরিমাণও শৃঙ্খলাবোধ থাকত তা হলেই তার প্রায় অস্বাভাবিক মেধাবী মস্তিষ্ক ব্যবহার করে একজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গণিতবিদ কিংবা বিজ্ঞানী হতে পারত। কিন্তু তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যাপারে এতটুকু কৌতূহল নেই–তার প্রতিভাবান মস্তিষ্ককে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের কাজে না লাগিয়ে এন্ড্রয়েড আর সাইবর্গের মেটাফাইল খুঁজে বের করার কাজে ব্যস্ত রেখেছে। আমি আরো কিছুক্ষণ ভিডি মডিউলের একঘেয়ে এবং অর্থহীন তথ্যগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম–ঠিক যখন ভিডি মডিউলটি বন্ধ করে দিচ্ছি তখন হঠাৎ করে একটি ভিডিও ক্লিপে আমার দৃষ্টি আটকে গেল। এলোমেলো চুল, বিষণ্ণ চেহারার একজন যুবকের ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে এসেছে, যুবকটি কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারপর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ত্রাতুল, আমি ভ্রাতুল।
আমি ভয়ানক চমকে উঠে তাকালাম, এলোমলো চুলের বিষণ্ণ চেহারার যুবকটিকে আমি চিনতে পারি নি–সে আসলে আমি। আমি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখতে পেলাম সে একবার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আবার ঘুরে তাকাল, কী ভয়ংকর শূন্য একটি দৃষ্টি–সেই দৃষ্টিতে আমার বুকের ভেতরে কী যেন হাহাকার করে ওঠে। সে ক্লান্ত গলায় বলল, আমাদের খুব বিপদ ত্রাতুল। আমার আর রিয়ার। সে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা কী করব বলবে তুমি?
আমি দেখতে পেলাম এলোমেলো চুলের বিষণ্ণ চেহারার যুবকটি–যে আসলে আমি, হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম, দেখতে পেলাম আমার হাত থরথর করে কাঁপছে।