শহরতলিতে ছোট একটা রেস্টুরেন্টে আমি কিছু খেয়ে নিলাম–এখানে ভদ্র কিংবা সচ্ছল মানুষরা আসে না। যারা আসে তাদের সবাই সমাজের বাইরের মানুষ অনেকেই মাদকাসক্ত। একটা বড় অংশ আছে যারা ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কে বড় ক্ষতি করে বসে আছে। অনেকেই চোখ ভালো করে খুলতে পারে না, হাত কিংবা পা নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাঁপতে থাকে। কথা জড়িয়ে আসে। ভালো একটা চিকিৎসা কেন্দ্রে কিছু দক্ষ চিকিৎসক রোবট দিয়ে এদের অনেককেই সারিয়ে তোলা সম্ভব কিন্তু এই মানুষগুলোর সে ব্যাপারে উৎসাহ নেই। অনেকের ধারণা তা হলে জোর করে তাদেরকে সাইবর্গে পাল্টে দেওয়া হবে। কোনো মানুষ–তার যত সমস্যাই থাকুক কিছুতেই সাইবর্গ হতে চায় না।
রেস্টুরেন্টে নিরিবিলি খেয়ে আমি আমার শেষ সম্বলের কয়েকটি ইউনিট দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে বের হয়ে এলাম। এই এলাকাটি সমাজবহির্ভূতদের এলাকা, চারদিকে আবছা অন্ধকার, আলোগুলো ভেঙে রাখা হয়েছে। আকাশের কাছাকাছি উত্তেজক পানীয়ের একটা বিজ্ঞাপন জ্বলছে এবং নিবছে, তার কিছু আলো এখানে ছড়িয়ে পড়েছে। দিনের বেলায় এই এলাকাটিকে অত্যন্ত নিরানন্দ এবং হতচ্ছাড়া দেখায় কিন্তু রাত্রিবেলায় আধো আলো এবং আধো অন্ধকারে এর মাঝে কেমন জানি এক ধরনের রহস্যের ছোঁয়া লেগেছে।
আমি রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে থাকা একজন মাদকাসক্ত মানুষকে পাশ কাটিয়ে কয়েক পা সামনে গিয়েছি, ঠিক তখন হঠাৎ করে একটি বাইভার্বাল নিঃশব্দে আমার পাশে নেমে এল। আমি কিছু বোঝার আগে তার গোলাকার দরজা খুলে যায় এবং এক জোড়া হাত আমাকে ধরে প্রায় হ্যাঁচকা টানে বাইভার্বালের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। প্রায় সাথে সাথে বাইভার্বালটি শূন্যে উঠে যেতে থাকে, আমি তুরণের প্রকৃতি দেখে বুঝতে পারি এটি খুব দ্রুত সরে যেতে শুরু করেছে।
আমি নিজের জীর্ণ পোশাকটিকে সমান করার চেষ্টা করতে করতে বললাম, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমাকে ডাকলে আমি স্বেচ্ছায় তোমাদের কাছে যেতাম।
বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলে একটি নিরানন্দ সাইবর্গ বসে আছে, ভেতরে দুজন মানুষ। ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় দুজনের একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। এক সময় পুরুষ এবং মহিলার শারীরিক পার্থক্যটুকু খুব চড়া সুরে প্রকাশ করা হত–আজকাল খুব তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা না করলে সেটি ধরা যায় তার কারণ কী কে জানে। আজ থেকে এক শ বছর বা এক হাজার বছর পরে কীহলে পুরুষ এবং নারীর পার্থক্য কি ঘুচে যাবে, নাকি পুরুষ এবং নারী ছাড়াও অন্য ধরুন প্রজন্মের সৃষ্টি হবে?
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বাইভার্বালের জানালা দিয়ে নিচে তাকালাম, আলোকোজ্জ্বল একটা বড় শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের যে সহজ সৌজন্যতা থাকা উচিত এদের মাঝে তা নেই। আমার সাথে কেউ একটি কথাও বলে নি, কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে কি কে জানে। তবুও আমি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাবে?
মানুষ দুজন চুপ করে রইল, ভেবেছিলাম হয়তো উত্তরই দেবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী। ভেবে মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, সেটা তুমি নিজেই দেখবে।
আমার বিনা অনুমতিতে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসা বেআইনি কাজ।
পুরুষ মানুষটি এবার কাঠকাঠ গলায় হেসে বলল, তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই। ইচ্ছে করলে তোমাকে আমি দরজা খুলে নিচে ফেলে দিতে পারি। কেউ কিছু জানবে না।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একটা এন্ড্রয়েড। কারণ একজন মানুষ কেউ জানবে না বলেই কখনোই আরেকজনকে খুন করে ফেলার কথা বলে না।
পুরুষ মানুষটি আমার কথা শুনে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, আমার দিকে তার মাথাটা এগিয়ে এনে দাতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি যদি একটা মানুষ হতে তা হলে এই কথা বলতাম না। তুমি হচ্ছ অকর্মণ্য, অপদার্থ, মাদকাসক্ত একজন ফালতু মানুষ। তুমি এই সমাজের কোনো কাজে আস না। তুমি দুপুরবেলায় নোংরা একটা ইঁদুরকে কোলে নিয়ে রাস্তায় পা ছাড়িয়ে বসে থাক।
আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, সেটাই হয়তো সমাজের প্রতি আমার দায়িত্ব। অকর্মণ্য, অপদার্থ, মাদকাসক্ত, ফালতু হয়ে বেঁচে থাকা–যেন আমাকে দেখে সমাজের অন্যরা সতর্ক হতে পারে। এই সৃষ্টি জগতে তেলাপোকারও একটা ভূমিকা আছে, তুমি জান?
পুরুষ মানুষটি ক্রুদ্ধ গলায় কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু মহিলাটি তাকে নিবৃত্ত করল। বলল, আহ্! কেন খামকা ঝামেলা বাড়াচ্ছ?
নিরাপত্তা বাহিনীর দুজন আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
বাইভার্বালটি একটা ছোট শহরের ওপর একবার পাক খেয়ে নিচে নেমে এল। একটা হ্রদ পার হয়ে ছোট একটা পাহাড়ের পাদদেশে পুরোনো একটা অট্টালিকার পাশে এসে এটি স্থির হয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা মাত্রই আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে নামানোর আগেই আমি নিচে নেমে এলাম। আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর দুজন সদস্য আমার পিছু পিছু হটতে থাকে। বাইরের একটা বড় দরজায় কিছু গোপন কোড এবং রেটিনা স্ক্যান করিয়ে আমাদের ভেতরে ঢোকানো হল। একটা ছোট করিডর ধরে হেঁটে বড় একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সুইচ টিপে ভারী দরজা খোলা হল–ভেতরে নানা বয়সী কিছু মানুষ, চোখের দৃষ্টি দেখেই বোঝা যায় এদের সবাইকে ঠিক আমার মতো করে ধরে আনা হয়েছে। মানুষগুলো কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকাল। আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু তার দরকার হল না।অত্যন্ত রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি আমাকে ঘরের ভেতরে ঠেলে দিপ্রায় সাথে সাথেই ঘরঘর করে ভারী দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়।
ভেতরের মানুষগুলো আমাকে এবং আমি ভেতরের মানুষগুলো যাচাই করে দেখতে শুরু করলাম। ঘরের ভেতর সব মিলিয়ে সাতজন মানুষ–দুজন মেয়ে এবং পাঁচজন পুরুষ। দুটি মেয়েরই চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতিস্থ, দেখে বোঝা যায় ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে মস্তিষ্কের সর্বনাশ করে বসে আছে। দুজন পুরুষকে মনে হল পেশাজীবী অপরাধী, চোখে–মুখে একটু বেপরোয়া ভাব এবং হাতের আঙুলগুলো অদৃশ্য একটি লেজার রাস্টার১২ ধরে রাখার ভঙ্গি করে নড়ছে। অন্য মানুষগুলোকে মনে হল জীবন সম্পর্কে উদাসীন, একজনের মুখে একটু মৃদু হাসি এবং তাকে দেখে মনে হল পুরো ব্যাপারটি দেখে সে ভারি মজা পাচ্ছে। ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে থাকা একটি মেয়ে ঘাড় বাকা করে একটা চোখ ঈষৎ খুলে বলল, তোমার কাছে কি বিভিচুরাস১৩ আছে?
বিডিচুরাসের মতো ভয়ংকর একটি মাদকদ্রব্য পকেটে নিয়ে কারো ঘোরার কথা নয়, কিন্তু মেয়েটি এই ধরনের সহজ যুক্তিতর্কের উপরে চলে গিয়েছে। ঈষৎ খুলে রাখা চোখটি বন্ধ করে অভিযোগ করার ভঙ্গি করে বলল, আমার স্টিমুলেটরটি নিয়ে গেছে।
পেশাজীবী অপরাধীদের একজন জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে টিটকারি দিয়ে বলল, বড় অন্যায় করেছে!
মেয়েটি তার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বিড়বিড় করে অনেকটা নিজের সাথে কথা বলতে থাকে। মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকা মানুষটি তার মুখের মৃদু হাসিকে একটু বিস্তৃত করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কেন এনেছে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।
তুমি কি কোনো অপরাধ করেছ?
এভাবে ধরে নিয়ে আসার মতো কোনো অপরাধ করি নি।
মানুষটি সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, তার মানে ছোটখাটো কিছু একটা করেছ।
তা করেছি। ট্রাকিওশানটা বের করে ফেলেছি।
উপস্থিত যারা ছিল তাদের প্রায় সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল। পেশাদার অপরাধীর মতো মানুষটি অদৃশ্য লেজার ব্লাস্টারের ট্রিগার ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তুমি ওস্তাদ মানুষ!
আমি তার কথায় কোনো উত্তর দিলাম না। মানুষটি তার ডান হাত দিয়ে গলায় পোচ দেবার ভঙ্গি করে বলল, কিন্তু ধরা পড়ে গেছ ওস্তাদ, এখন তুমি শেষ।
দ্বিতীয় পেশাদার অপরাধীটি বলল, তোমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটেকুটে নিয়ে নেবে।
কিংবা একটা বেকুব সাইবর্গ বানিয়ে ফেলবে।
কিংবা তোমাকে শীতল ঘরে নিয়ে রেখে দেবে। দ্বিতীয় পেশাদার অপরাধীটি দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, হয়তো তোমাকে ভিনজগতের মহাকাশের প্রাণীর কাছে বিক্রি করে দেবে।
আমি এই অর্থহীন কথোপকথনে যোগ দিলাম না আমি নিশ্চিত বাইরে থেকে আমাদের প্রত্যেকটি কাজকর্ম, অঙ্গভঙ্গি খুব যত্ন করে লক্ষ করা হচ্ছে, ঠিক কী কারণ জানি না, আমার মনে হল এই দলটির মাঝে নিজেকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলায় বিপদের ঝুঁকি আছে। আমি নীরবে এক কোনায় গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকা দার্শনিকের মতো মানুষষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই, এরা বেশ ভালো যত্ন করে। এখানকার খাবার খুব ভালো।
ভেতরে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। একটা নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাবার পর যখন হাল ছেড়ে দেওয়া হয় তখন হঠাৎ করে সময়ের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। আমাকে যখন ডেকে নেওয়া হল তখন আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছি–ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি যে আমি একটা বিশাল অরণ্যে হারিয়ে গেছি, যেদিকেই যাই সেদিকেই একটা বিশাল বৃক্ষ আমার পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার পোশাক ধরে খুব রূঢ়ভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে ঘুম থেকে তোলা হল, আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন মানুষ বলল, চলো।
কোথায় জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ হবে না বলে আমি কিছু জিজ্ঞেস করলাম না, নীরবে উঠে দাঁড়ালাম। আমি যখন ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম তখন অন্য মানুষগুলো এক ধরনের নিরুত্তাপ নিস্পৃহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাকে একটি লম্বা করিডর ধরে হটিয়ে ছোট একটি কিউবিকেলে নেওয়া হল। সেখানে আমাকে নগ্ন হতে হল এবং আমি বুঝতে পারলাম এক ধরনের আঁজালো জীবাণুনাশক দিয়ে আমাকে পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। আমার সমস্ত শরীরকে স্ক্যান। করা হল, নানা ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে আমার শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ঘুঁটিনাটি পরীক্ষা করা হল, জিনেটিকে কোডিং করে নেওয়া হল, মেটাবলিজমের হার নির্ধারণ করা হল এবং সবশেষে নিওপলিমারের একটি পোশাক পরিয়ে একটি বড় হলঘরে পৌঁছে দেওয়া। হল, সেখানে আমি প্রথমবার একজন সত্যিকারের মানুষ দেখতে পেলাম। মানুষটি একজন। কমবয়সী মেয়ে। তার সোনালি চুল এবং আকাশের মতো নীল চোখ। মেয়েটি সুন্দর করে হেসে বলল, আশা করছি তোমার কোনো অসুবিধে হয় নি।
আমি নিচু গলায় বললাম, হলেই সেটি নিয়ে কে মাথা ঘামাচ্ছে!
তোমাকে কী বলে ডাকব? তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–তোমার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, কিছু জান না বলেই তো আমাকে এনেছ। কী করবে করে ফেল–শুধু শুধু নামপরিচয় জেনে কী হবে?
মেয়েটির চোখে–মুখে এক ধরনের বিস্ময়ের ছায়া পড়ল, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আমার নাম জানা। আমি এখানকার চিকিৎসা কেন্দ্রের দায়িত্বে আছি।
আমার নাম ভ্রাতুল। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এটা আমার সত্যিকারের নাম।
মেয়েটি সুন্দর করে হেসে বলল, সত্যিকারের নাম না হলেও আমি কখনো জানব না।
মেয়েটির কথাবার্তায় এক ধরনের সহৃদয়তার ছোঁয়া পেয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কেন এনেছ?
মেয়েটি একটু বিব্রত হয়ে বলল, আমি সত্যিই জানি না। মাঝে মাঝেই আমাকে কিছু মানুষকে পরীক্ষা করে তার শারীরিক অবস্থার একটা রিপোর্ট দিতে হয়। এর বেশি আমি কিছু জানি না। ক্রানা নামের মেয়েটি ইতস্তত করে থেমে গেল–মেয়েটি নিশ্চয়ই আরো কিছু জানে কিন্তু আমাকে বলতে চাইছে না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমার সম্পর্কে কী রিপোর্ট দিয়েছ?
তুমি নীরোগ স্বাস্থ্যবান হাট্টাকাট্টা একজন যুবক।
এবং—
এবং কী?
এবং মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে একটি ট্রাইকিনিওয়াল বসানো সম্ভব।
মেয়েটি আমার কথা শুনে ভয়ানকভাবে চমকে উঠল, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তু–তু–তুমি কীভাবে জান?
জানি না। অনুমান করছি। আমাকে যেভাবে জীবাণুমুক্ত করা হল তাতে মনে হচ্ছে। সম্ভবত শরীরে কোনো অস্ত্রোপচার করা হবে। মাথার পেছনে মনে হচ্ছে খানিকটা জায়গায় একটু বেশি করে চুল কেটেছে। এরকম জায়গায় ট্রাইকিনিওয়াল বসায়। তাই অনুমান করছি।
মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–কাজেই আমাকে নিয়ে তোমরা যা। খুশি করতে পার। ভয়ংকর কোনো এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে আমার থেকে ভালো একজন মানুষ কোথায় পাবে? কারো কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই–একেবারে নিখুঁত একটি গিনিপিগ।
মেয়েটি নিচু গলায় বলল, শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে তুমি খুব ভুল করেছ ভ্রাতুল।
আমি মাথা নাড়লাম, তুমি ঠিকই বলেছ জানা। কিন্তু সেজন্যে আমার কোনো দুঃখ নেই–আমি জেনেশুনেই এই ভুলটা করেছি।
ক্রানা আমাকে যে কয়েকজন মানুষের কাছে পৌঁছে দিল তাদের চেহারা কঠোর এবং আনন্দহীন। অপারেশন থিয়েটারের মতো নানা ধরনের যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা ঘরের মাঝামাঝি একটি স্বচ্ছ ধাতব টেবিলে শুইয়ে আমার দুটি হাত এবং পা স্ক্র্যাপ দিয়ে বেঁধে ফেলল। এখানে আপত্তি বা প্রশ্ন করার মতো কোনো সুযোগ বা পরিবেশ নেই। একটা চিকিৎসক বরাবট আমার মাথাকে গোলাকার একটা টিউবে আটকে দেওয়ার সময় আমি মরিয়া হলে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী করছ?
আনন্দহীন চেহারার মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, একটু পরেই জানতে পারবে।
আমি মানুষটির চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে বললাম তোমার নাম কী?।
আমার প্রশ্ন শুনে মানুষটি খুব অবাক হল। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, নাম? নাম দিয়ে তুমি কী করবে?
কৌতূহল।
কৌতূহল সংবরণ কর যুবক।
আমার নাম ত্রাতুল।
তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–কাজেই তোমার নাম ত্ৰাতুল না হয়ে কোলি ব্যাক্টেরিয়া হলেও কিছু আসে যায় না।
আমি নিচু গলায় বললাম, কিন্তু আমি একজন মানুষ।
মানুষ? হঠাৎ করে নিরানন্দ চেহারার মানুষটি আনন্দহীন গলায় হাসতে শুরু করল।
মানুষটির ভব্যতাবিবর্জিত পুরোপুরি হৃদয়হীন আচরণটিতে আমি হঠাৎ করে এক ধরনের আকর্ষণ খুঁজে পেতে শুরু করলাম। চিকিৎসক রোবটটি যখন আমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করছিল আমি তখন ভেতরের মানুষগুলোকে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকি। হৃদয়হীন নিরানন্দ মানুষটির চেহারায় কোথায় যেন সরীসৃপের সাথে একটু মিল রয়েছে, হয়তো তার শীতল ভাবলেশহীন মুখ হয়তো উঁচু কণ্ঠার হাড় বা ফ্যাকাসে এবং বিবর্ণ মুখাবয়ব।
দ্বিতীয় মানুষটির অগোছালো চেহারা এবং চেহারার মাঝে এক ধরনের বিরক্তির ভাব পাকাপাকিভাবে লেগে আছে। মানুষুটির চুল লালচে এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তৃতীয় মানুষটি সম্ভবত মহিলা কিন্তু তাকে দেখে সেটি নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। চিকিৎসক রোবটটি যখন আমার মাথাটিকে বিশেষ গোলাকৃতি একটি হেলমেটের মতো যন্ত্রের মাঝে শক্ত করে আটকে ফেলার চেষ্টা করছিল তখন এই তিনজন মানুষ কয়েকটি ভিন্ন। ভিন্ন যন্ত্রের সামনে বসে কোনো একটি কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
একসময় সরীসৃপের মতো দেখতে নিরানন্দ চেহারার মানুষটি বলল, আমার সিস্টেম প্রস্তুত। পুরোটি চার্জ করা হয়েছে।
লালচে চুলের অগোছালো চেহারার মানুষটি এক ধরনের বিরক্তির ভাব নিয়ে বলল, আমিও প্রস্তুত। ডাটা সারিবদ্ধ করা হয়েছে।
মহিলা বলে যাকে সন্দেহ করছিলাম সে প্রথমবার মুখ খুলল, চিকিৎসক রোবটটিকে বলল, কাজ রু কর, ইলেনা। তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি এবারে নিঃসন্দেহ হলাম, মানুষটি আসলেই মহিলা।
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু বুঝতে পারলাম রোবটটি আমার মাথার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মাথার পেছনে শীতল কিছু একটা স্পর্শ করল এবং হঠাৎ করে সেখানে প্রচণ্ড শক্তিতে কিছু আঘাত করল, আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। হঠাৎ করে মনে হল আমার সমস্ত চেতনা বুঝি লোপ পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি চেতনা হারালাম না, মাথার পেছন দিয়ে কিছু একটা আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো শুরু করেছে। আমার দুটি হাত হঠাৎ করে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সমস্ত শরীরে আমি অপ্রতিরোধ্য এক ধরনের খিচুনি অনুভব করতে শুরু করলাম। আমার চোখের সামনে পরিচিত জগৎ হঠাৎ করে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। বিচিত্র কিছু নকশা, আশ্চর্য উজ্জ্বল কিছু রঙ চোখের সামনে খেলা করতে থাকে, সেগুলো নড়তে থাকে এবং মিলিয়ে যেতে থাকে, আমি উচ্চ কম্পনের কিছু শব্দ শুনতে থাকি এবং তার তীক্ষ্ণ ধ্বনি আমাকে অস্থির করে তোলে। হঠাৎ করে চারদিক নীরব হয়ে আসে, সেই ভয়ংকর নীরবতায় আমার সারা শরীর শিউরে ওঠে। আমি চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করি কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না, মনে হয় চারদিকে কুচকুচে কালো অন্ধকার।
আমি নিজের ভেতরে এক ধরনের গভীর বিষণ্ণতা অনুভব করতে থাকি, এক গভীর বিচিত্র হতাশা সমস্ত পৃথিবী, জগৎসংসার সৃষ্টি জগতের সবকিছুর প্রতি এক অতিমান এক ধরনের তীব্র দুঃখবোধে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করতে থাকে। হঠাৎ করে আমার মনে হতে থাকে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি। তাতেও কিছু আসে যায় না। এই জগৎসংসার, এই পৃথিবী, এই সৃষ্টি জগৎ বেঁচে আছে ধ্বংস হয়ে গেছে তাতেও কিছু আসে যায় না। আমি আমার সমস্ত চেতনাকে অদৃশ্য কোনো একটি অস্তিত্বের কাছে সমর্পণ করে গভীর এক ধরনের শূন্যতায় নিমজ্জিত হয়ে গেলাম।
গল্পের বিষয়:সাইন্স-ফিকশন