বিজ্ঞানী সফদর আলীর সঙ্গে আমার পরিচয় জিলিপি খেতে গিয়ে।আমার জিলিপি খেতে খুব ভালো লাগে। মুচমুচে জিলিপি থেকে ভালো খেতে আর কিইবা আছ? আমি তাই সুযোগ পেলেই কাওরানবাজারের কাছে একটা দোকানে জিলিপি খেতে আসি।আজকাল আর কিছু বলতে হয় না,দোকানি আমাকে দেখলেই একগাল হেসে বলে,’বসেন স্যার,আর দশ মিনিট।’ অর্থাৎ জিলিপি ভাজার শেষ হতে আর দশ মিনিট।দোকানের বাচ্চা ছেলেটা খবরের কাগজ দিয়ে যায়,আমি বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি।বিজ্ঞাপনে চোখ বোলাতে বোলাতে জিলিপি এসে যায়।খেয়ে আমাকে বলতে হয় কেমন হয়েছে,ভালো না হলে নাকি পয়সা দিতে হবে না। সেদিন ও তেমনি বসেছি জিলিপি খেতে।মোটে জিলিপি থেকে গরম ধোয়া উঠছে,আমি সাবধানে একটা নিয়ে কামড় দেবার চেষ্টা করছি,একটু অসাবধান হলেই জিভ পুড়ে যাবে।
তখন আমার সামনে আরেকজন এসে বসলেন;ছোটখাটো শুকনোমতন চেহারা,মাথার এলোমেলো চুল,মুখে বেমানান বড় বড় গোফ।চোখে ভারী চশমা, দেখে কেমন যেন রাগী রাগী মনে হয়।
শার্টের পকেটটি অনেক বড়,নানারকম জিনিষে সেটিভর্তি,মনে হল সেখানে জ্যান্ত জিনিষও কিছু একটা আছে;কারন কিছু একটা যেন সেখানে নড়াচড়া করছে। ভদ্রলোকটি জিলিপি অর্ডার দিলেন,আমার মতন নিশ্চয়ই জিলিপি পছন্দ করেন।জিলিপি আসার সাথে সাথে তিনি পকেট থেকে টর্চলাইটের মতো একটি জিনিষ বের করে করলেন,সেটার সামনে কয়েকটি ছুঁচালো কাটা বের হয়ে আছে। জিনিষটা নিয়ে তিনি তিনি একটা জিলিপি গেঁথে ফেলে কোথায় যেন একটা সুইচ টিপে দেন,সাথে সাথে ভিতরে একটা পাখা শোঁ শোঁ করে ঘুরতে থাকে,ভিতর থেকে জোরে জোরে বাতাস বের হয়ে আসে।
দশ সেকেন্ডে জিলিপি ঠান্ডা হয়ে আসে,সাথে সাথে তিনি জিলিপিটা মুখে পুরে দিয়ে তৃপ্তি করে চিবুতে থাকেন।আমি অবাক হয়ে পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলাম,আমার চোখে চোখ পড়তেই ভদ্রলোক একটু লাজুকভাবে হেসে বললেন,জিলিপি খেতে সময় নষ্ট করে কী লাভ?
সত্যি সত্যি তিনি সময় নষ্ট করলেন না,আমি দুটো জিলিপি খেয়ে শেষ করতে পারিনি তাঁর পুরো প্লেট শেষ।সময় নিয়ে তাঁর সত্যি সমস্যা রয়েছে;কারণ,হঠাৎ তাঁর শার্টের কোনো একটা পকেট থেকে এলার্ম বেজে উঠল,সাথে সাথে তিনি লাফিয়ে উঠে পানি না খেয়েই প্রায় ছুটে বের হয়ে গেলেন।যাবার সময় পয়সা পর্যন্ত দিলেন না,হাত নেড়ে দোকানিকে কী একটা বলে গেলেন,দোকানি ও মাথা নেড়ে খাতা বের করে কি একটা লিখে রাখল।
আমি বের হবার সময় দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম,লোকটা কে? দোকানি নিজেও ভালো করে চিনে না,নাম সফদর আলী।মাসিক বন্দোবস্ত করা আছে, বৃহস্পতিবার করে নাকি জিলিপি খেতে আসেন।মাথায় টোকা দিয়ে দোকানি বলল, মাথায় ছিট আছে। ছিট জিনিষটা কি আমি জানি না।কিন্তু মাথায় সেটি থাকলে লোকগুলো একটু অন্যরকম হয়ে যায়;আর ঠিক এই ধরণের লোকই আমার খুব পছন্দ।কে এক সাধু নাকি দশ বছর থেকে হাত উপরে তুলে আছে শুনে আমি পকেটের পয়সা খরচ করে সীতাকুন্ড গিয়েছিলাম।যখনই আমি খবর পাই কোন পীর হাতের ছোঁয়ায় এক টাকার নোটককে একশো টাকা বানিয়ে দিয়েছেন,আমি সেটা নিজের চোখে দেখে আসার চেষ্টা করি।এতদিন হয়ে গেল,এখনও একটা সত্যিকারের পীরের দেখা পাইনি,সবাই ভন্ড।আমার অবশ্য তাতে কোন ক্ষতি হয়নি। মজার মানুষ দেখা আমার উদ্দেশ্য,ভন্ড পীরের মত মজার মানুষ আর হয় না।
সফদর আলী যদিও পীর নন,কিন্তু একটা মজার মানুষ তো বটেই।তাই সফদর আলীকে আবার দেখার জন্য আবার আমি বৃহস্পতিবার সেই দোকানে গেলাম। গিয়ে একই টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। ঠিকই সফদর আলী সময়মতো হাজির।বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল। তাই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছেন।কিন্তু তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠি,চশমার কাঁচের উপর গাড়ির ওয়াইপারের মতো ছোট ছোট দুটি ওয়াইপার শাঁই শাঁই করে পানি পরিষ্কার করছে।দোকানের ভিতর ঢুকে কোথায় কি একটা সুইচ টিপে দিতেই ওয়াইপার দুটি থেমে গিয়ে উপরে আটকে গেল।সফদর আলী আমার দিকে তাকিয়ে একটু লাজুকভাবে হেসে কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন,বৃষ্টিতে চশমা ভিজে গেলে কিছু দেখা যায় না কিনা।
আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না,’কোথায় পেলেন এরকম চশমা?’
পাব আর কোথায়?নিজে তৈরি করে নিয়েছি। আমি তখনই প্রথম জানতে পারলাম,সফদর আলী আসলে একজন সখের বিজ্ঞানী।কথা একটু কম বলেন,একটু লাজুক স্বভাবের মানুষ,কিন্তু মজার মানুষ তো বটেই।আমি তাঁর কাপড়ের দিকে লক্ষ্য করে বললাম,একেবারে তো ভিজে গেছেন,ঠান্ডা লেগে যাবে। না,ঠান্ডা লাগবে না,বলে পকেটে আরেকটা কী সুইচ টিপে দিলেন।একটু পরেই তাঁর কাপড়জামা থেকে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যেতে থাকে,কিছুক্ষণের মাঝেই কাপড় একেবারে শুকনো। সফদর আলী পকেটে হাত ঢুকিয়ে কি একটা টিপে আবার সুইচ বন্ধ করে দিলেন।আমার বিস্মিত ভাবভঙ্গি দেখে আবার কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন,কাপড়ের সুতার মাঝে মাঝে নাইক্রোম ঢুকিয়ে দিয়েছি,যখন খুশি গরম করে নেয়া যায়।পকেটে ব্যাটারি আছে। সফদর আলী আবার জিলিপি অর্ডার দিলেন।আজকেও টর্চলাইটের মতো দেখতে সেই ঠান্ডা করার যন্ত্রট ব্যবহার করেছেন উনি।কিন্তু বোঝা যাচ্ছে খুব তাড়াহুড়ো নেই।আমি তাই আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম,প্রায়ই আসেন বুঝি এখানে?
না,শুধু বৃহস্পতিবার,ওই দিন ছুটি কি না। কোনো অফিস বৃহস্পতিবার ছুটি হয়, আমি জানতাম না,তাই একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,কী অফিস এটা যে বৃহস্পতিবার আপনার ছুটি? না,না,আমার ছুটি নয়।বৃহস্পতিবার আমি ছুটি দিই। কাদের ছুটি দেন?
এই,আমার এক ধরণের ছাত্রদের বলতে পারেন। সফদর আলী একটু আমতা আমতা করে থেমে গেলেন।ঠিক বলতে চাইছেন না,তাই আমি আর তাঁকে ঘাটালাম না। সফদর আলী খুব মিশুক নন,তবে কথাবার্তা বলেন।অনেক্ষণ ধরে তাঁর সাথে কথা হল।অনেক কিছু জানেন,আর মাথায় অনেক ধরণের পরিকল্পনা,তাই তাঁর কথা শুনতেই ভারি মজা। ব্যাঙের ছাতার চাষ করে কিভাবে খাদ্য-সমস্যা মেটানো যায় বা কেঁচো পুষে কিভাবে ঘরের আবর্জনা দূর করা যায় সে থেকে শুরু করে সংখ্যা কেন দশমিক,এ ধরণের ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ।
সংখ্যা ষোলভিত্তিক হলে নাকি কম্পিউটার দিয়ে কাজ কর সহজ হবে,আজকাল সব মাইক্রোপ্রসেসর নাকি ষোলো কিংবা বত্রিশ বিটের হয়।সেটার মানে কি আমি জানি না।সফদর আলী বলেছেন,আমাকে আরেক দিন বুঝিয়ে দেবেন।তিনি নিজে সবসময়ই ষোলভিত্তিক সংখ্যায় হিসেব করেন।তাই তিনি গোনেন খুব অদ্ভুতভাবে।সাত, আট,নয়ের পর দশ না বলে বলেন কুরা।তারপর কিলি,চিংগা,পিরম্ব,মিকা, ফিকার পরে নাকি আসে দশ।আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, তিনি যখন দশ বলেন,তার অর্থ নাকি ষোল।তিনি যখন বলেন একশো,তার অর্থ নাকি দুইশো ছাপ্পান্ন।ব্যাপারটি যে ফাজলামো নয় সেটি জেনেছি আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের প্রফেসরের সাথে কথা বলে,সত্যি নাকি এ ধরণের সংখ্যা হওয়া সম্ভব।
পরের বৃহস্পতিবারে আবার সফদর আলির সাথে দেখা। তাঁকে একটু চিন্তিত দেখ গেল।গিনিপিগের লোমে তেল হলুদ লেগে গেলে সেটা কীভাবে পরিষ্কার করা যায় বা লোম পুড়ে গেলে পোড়া গন্ধটা দুর কর যায় কীভাবে জানি কি না জিজ্ঞেস করলেন।খুব সঙ্গত কারনেই আমি সেটা জানতাম নআ,গিনিপিগের লোমে তেল হলুদ লাগতে পারে কিভাবে কিংবা পুড়ে যেতে পারে কিভাবে সেটা কিছুতেই আমার মাথায় এল না।তিনি কি শেষ পর্যন্ত গিনিপিগ রান্না করে খাওয়া শুরু করলেন নাকি?
আজ কথাবার্থা খুব বেশি জমল ন।কি যেন চিন্তা করে একটা কাগজে অনেকগুলো দাগ টেনে একটা দাগ আরেকটার সাথে জুড়ে দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখতে লাগলেন।আমি তাঁকে আর বিরক্ত করলাম না,আমার নিজেরও কাজ ছিল,তাই উঠে পড়ার উদ্যোগ করতেই সফদর আলী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি বিরিয়ানি রান্না করতে জানেন?’
‘আমি?বিরিয়ানি?’ আমি মাথা নেড়ে জানালাম, রাঁধতে পারিনা,শুধু খেতে পারি। সফদর আলীর মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেল দেখে বললাম,আমার বোন থাকে শান্তিনগরে,সে খুব ভালো কাচ্চি বিরিয়ানি রাঁধতে জানে।
সফদর আলী খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,আপনার বোনকে বলবেন একট কগজে লিখে দিতে? বুঝলেন কি না,করব যখন ভাল করেই করি। কী করবেন?
সফদর আলী আমতা আমতা করে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন,তাই আমিও আর কিছু বললাম না।জিজ্ঞেস করলাম,কবে দরকার আপনার বিরিয়ানি রেসিপি? কাল দিতে পারবেন?
কোথায় দেব?
এইখানে।
আমার তাঁর বাসাটা দেখার ইচ্চে,তাই বললাম,আপনার বাসাতেও নিয়ে আসতে পারি,আমার কোনো অসুবিধা নেই।
সফদর আলী একটু ইতস্তত করে রাজী হলেন।একটা কাগজে ঠিকানাটি লিখে দিলেন,শ্যামলীর কাছে কোথায় জানি থাকেন।
পরদিন আমি ঠিকানা খুঁজে সফদর আলীর বাসা বের করলাম।একটু নির্জন এলাকায় বেশ বড় একটা একতলা বাসা।দরজায় বেল টিপতেই ঘেউ ঘেউ করে একটা কুকুর ভয়ানক রাগী গলায় চিৎকার করে ডাকতে থাকে।আমি তাড়াতাড়ি দুই পা পিছিয়ে এলাম।সফদর আলী দরজাটা একটু ফাক করে মাথাটা একটু বের করে জিজ্ঞেস করলেন,এনেছেন?
আমি ভেবেছিলাম,আমাকে হয়ত ভিতরে গিয়ে বসতে বলবেন,কিন্তু তাঁর সেরকম ইচ্ছে আছে বলে মনে হল না। বদরাগী কুকুরটার ডাক শুনে আমার নিজেরও ইচ্ছে কমে এসেছে,তার হাতে কাগজটা দিয়ে চলে এলাম।আসার আগে দরজার ফাঁক দিয়ে একটু উঁকি মারার চেষ্টা করে মনে হল মেঝেতে ইঁদুরের মতো অনেকগুলো কি যেন ঘোরাঘোরি করছে।গিনিপিগের কথা বলছিলেন,তা-ই হবে হয়তো।
পরের বৃহস্পতিবার সফদর আলীকে খুব খুশি খুশি দেখা গেল।নিজে থেকে আলাপ শুরু করলেন,বললে,’বুঝলে, ইকবাল সাহেব,আমার কাজ প্রায় শেষ।এখন লবণ একটু কম হয়,কিন্তু এমনিতে ফার্স্ট ক্লাস জিনিষ।’
‘ কিসে লবণ কম হয়?’ ‘কেন,বিরিয়ানিতে!মনে নেই আপনি রেসিপি এনে দিলেন?’
ও! আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি
রাঁধছেন বুঝি?
‘মাথা খারাপ আপনার,আমি রাঁধব? রান্না করা আমার দু চোখের বিষ।’ ‘তা হলে কি ভাল বাবুর্চি পেয়েছেন নাকি?’ সফদর আলী হা হা করে হাসলেন,বাবুর্চি বলতেও পারেন ইচ্ছা করলে।গিনিপিগ বাবুর্চি!’
‘ মানে?’
‘ আমার রান্না করে দেয় গিনিপিগ বাবুর্চিরা।’
আমি গরম চা খাচ্ছিলাম,বিষম খেয়ে তালু পুড়ে গেল।মুখ হাঁ করে খানিক্ষণ বাতাস টেনে জিজ্ঞেস করলাম,কি বললেন,গিনিপিগেরা?
হু! সফদর আলী চোখ নাচিয়ে বললেন,এত অবাক হচ্ছেন কেন,ব্যাপারটা কঠিন কিছু নয়,একটু সময় লাগে আর কি আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সফদর আলী আমার সাথে টাট্টা করছিলেন কি না।এমনিতে অবশ্যি তিনি ঠাট্টা তামাশার মানুষ নন,কিন্তু তাই বলে গিনিপিগ রান্না করছে সেটা বিশ্বাস করি কিভাবে? সফদর আলী আমার অবিশ্বাসের দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করলেন,কম্পিউটার ে অনেক কঠিণ কঠিণ সমস্যার সমাধান হয় কি না? আমি মাথা নাড়ালাম,’হয়।’
‘ কিভাবে হয়?’ আমি জানতাম না,তাই চুপ করে রইলাম।সফদর আলী আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন,কম্পিউটার কখনোই একটা কঠিন সমস্যা একেবারে সমাধান করে না।আগে সেটাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে দেয়া হয়,তাকে বলে প্রোগ্রাম করা।প্রত্যেকটি ছোট ছোট অংশ আলাদাভাবে খুব সহজ,কিন্তু একত্রিতভাবে খুব কঠিন সমস্যার সমাধান হয়।রান্না করার ব্যাপারটাও তাই,পুরো রান্না ব্যাপারটা অনেক কঠিন,কিন্তু রান্না করাকে যদি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ফেলা হয়,তা হলে সেই ছোট ছোট অংশগুলো কিন্তু মোটেও কঠিন নয়;যেমন একটা ডেকচি চুলার উপরে রাখা বা ডেকচিতে খানিকট ঘি ঢালা বা ঘি-এর মাঝে তেজপাতা ছেড়ে দেয়া, এই ছোট্ট কাজগুলো যে কেউ করতে পারবে,একটু কষ্ট করে গিনিপিগকে শিখিয়ে দিলে একটা গিনিপিগও করতে পারবে।
সফদর আলী থামলেন।আর আমার খানিকটা মনে হল আমি বুঝতে পারছি তিনি কিভাবে গিনিপিগ দিয়ে রান্না করিয়ে নিচ্ছেন।আমার তখনও পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি,তাই সফদর আলী আবারও শুরু করলেন।, ‘ আমি করেছি কি,অনেকগুলো গিনিপিগ নিয়ে তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা জিনিষ করতে শিখিয়েছি।যেমন,একটা গিনিপিগ একটা ডেকছি তুলে চুলার উপরে তুলে দেয়,সে আর কিছুই পারে না।যখনই একটা ঘন্টা বাজে তখনই সে ঠেলে ঠেলে ডেকচি চুলার উপরে তুলে দেয়।সেটা সেখানো এমন কঠিন কিছু না-দু দিন এক ঘন্টা করে শেখাতেই শিখে গেল।এর পরের গিনিপিগটা শুধু চুলাটা জ্বালিয়ে দেয়।সেটা শেখানো একটু কঠিন হয়েছিল,প্রথম প্রথম লোম পুড়ে যেত।এখন সাবধান হয়ে গেছে,আর লোম পুড়ে না।চুলা ধরে যাবার পর তিন নাম্বার গিনিপিগ এসে ডেকচিতে খানিকটা ঘি ঢেলে দেয়,তারপরেই তার ছুটি।এরকম সব মিলিয়ে চিইংগাইশটা গিনিপিগ আছে।’
আমি বাধা দিয়ে বললাম,’চিচিংগাইশ মানে কি?’
,’ও, চিচিংগাইশ হচ্ছে দুই আর কিলি,তার মানে ষোলো দুগুণে বত্রিশ যোগ কিলি,তার মানে আপনাদের তেতাল্লিশ।
যাই হোক ওই তেতাল্লিশটা গিনিপিগ তেতাল্লিশটা ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে,সবগুলো যখন শেষ হয়,তখন চমৎকার এক ডেকচি বিরিয়ানি রান্না হয়ে যায়।’ সফদর আলী কথা শেষ করে হাসলেন। কিন্তু যদি গিনিপিগগুলো উল্টোপাল্টা করে ফেলে,ঘি গরম হওয়ার আগেই যদি ঘি ঢেলে দেয়? করবে না,একজন শেষ করার আগে আরেকজন শুরু করবে না। প্রথম গিনিপিগ তার কাজ শেষ করে দ্বিতীয়টার পেটে একটা খোঁচা দেয়,এই খোঁচা না পাওয়া পর্যন্ত দ্বিতীয়টা তার কাজ শুরু করবে না।
আমার তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না।সফদর আলী যেটা বলছেন,সেটা অসম্ভব হয়ত নয়।কিন্তু তাই বলে তেতাল্লিশটা গিনিপিগ হৈ চৈ করে কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করছে বিষয়টি কল্পনা করতেই আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার অবিশ্বাসের ভঙ্গি দেখে সফদর আলী বললেন,’ আপনার বিশ্বাস হল না? আচ্ছা আপনাকে দেখাচ্ছি-এই বলে তিনি বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে লেজ ধরে একটা নেংটি ইঁদুর বের করলেন;আমার বরাবরই সন্দেহ ছিল সফদর আলী পকেটে পকেটে করে জ্যান্ত কিছু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।ইঁদুরটা টেবিলে রাখামাত্র পাশের টেবিলের একজন চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল,সে ভাবছে খাবার থেকে ইঁদুর বেরিয়েছে। অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করা হল,কিন্তু সফদর আলী আমাকে আর দেখাতে পারলেন না।ইঁদুরটা পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, পরদিন বিকেলে তার বাসায় যেতে।আমাকে গিনিপিগের বিরিয়ানি রান্না করা দেখাবেন। পরদিন অফিসে গিয়ে শুনলাম জরুরি কাজে আমাকে এক্ষুণি চট্টগ্রাম যেতে হবে।অফিস থেকে সোজা এয়ারপোর্টে যেতে হল,বাসায় একজন খবর পৌছে দেবে। ভেবেছিলাম দু-তিন দিন লাগবে,কিন্তু ঝামেলার কারনে দুই সপ্তাহ লেগে গেল।ঢাকায় ফিরে এসে ভাবলাম সফদর আলীর সাথে দেখা করি।কিন্তু অফিসে ছিলাম না বলে কাজ এত বেড়ে গেল,শেষ হতে আর এক সপ্তাহ লেগে গেল।শেষ পর্যন্ত সময় করে সফদর আলীর বাসায় গিয়ে তাঁকে পেলাম না।বেল টিপতেই কুকুরটা এমন ভয়নকভাবে ঘেউ ঘেউ শুরু করল যে আমি আর অপেক্ষা করার সাহস
পেলাম না।জিলিপির দোকানে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সফদর আলী অনেকদিন হল সেখানে যান না।পরেও কয়েকবার তাঁর বাসায় গিয়েছি,তাঁর দরজায় চিঠি লিখে ঠিকানা দিয়ে এসেছি,কিন্তু তিনি আর যোগাযোগ করেন নি। আমাকে কয়েকদিনের ভিতর আবার খুলনা থেকে গেলাম রাজশাহী,সেখান থেকে বগুড়া হয়ে ঢাকা। ঢাকায় ফিরে এসেও প্রথম প্রথম অনেক ব্যস্ত ছিলাম;সপ্তাহখানেক পরে খানিকটা সময় পেয়ে ভাবলাম সফদর আলীর বাসা থেকে ঘুরে আসি।শ্যামলী আসার অনেক আগেই আমি বাতাসে বিরিয়ানির গন্ধ পেলাম।কাছাকাছি আসতেই মানুষের হৈ চৈ শুনতে পেলাম।আর কাছে গিয়ে দেখি,সফদর আলীর বাসার চারপাশে অনেক লোক বসে বসে বিরিয়ানি খাচ্ছে;গন্ধ শুঁকেই বুঝতে পারলাম আমার বোনের রেসিপি। লোকজন হাতে থালা-বাসন নিয়ে লাইন ধরে সফদর আলীর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না, এর মাঝেই দরজা একটু ফাক হয়ে সফদর আলী বের হয়ে এলেন,হাতে এক ডেকচি গরম বিরিয়ানি।লোকজনক ে বিরিয়ানি ভাগ করে দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন,আমি তাড়াতাড়ি তাঁকে ডাকলাম।সফদর আলী ঘুরে আমাকে দেখে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন;ছুটে এসে আমার হাত ধরে বললেন,ইকবাল সাহেব,তাড়াতাড়ি আসেন! আমার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে! সফদর আলীকে চেনা যায় না,চুল উষ্কখুষ্ক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি,চোখ ভিতরে গেছে।আমি বললাম কি হয়েছে আপনার?
ভিতরে আসেন,তা হলেই দেখবেন। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,আপনার কুকুর বেঁধে রেখেছেন তো? কুকুর? কিসের কুকুর?
সেই যে আপনার বাসায় বেল টিপলেই ঘেউ ঘেউ করে উঠে একটা কুকুর। ও! সফদর আলী দুর্বলভাবে হাসলেন,মানুষজনকে ভয় দেখানোর জন্য কুকুরের ডাক-টেপ করা আছে।বেল টিপতেই বেজে উঠে।কুকুর পাব কোথায় আমি? আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল।আমি সফদর আলীর সাথে ভেতরে ঢুকলাম,ভেতরে বেশ অন্ধকার।খানিক্ষণ লাগল অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে,তারপর আমি আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনাটি দেখতে পেলাম। ঘরের মাঝে সারি সারি গ্যাসের চুলা,তার মাঝে বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে,রান্না করছে শত শত গিনিপিগ! গিনিপিগগুলো ছোটাছোটি করছে,কেউ ঠেলে ঠেলে ডেকচি নিয়ে চুলায় তুলছে,কেউ পেয়াজ কাটছে,কেউ ঘি ঢালছে,কেউ নেড়ে দিচ্ছে,কেউ চাল ঢালছে,সে এক এলাহি কান্ড।ঘর বিরিয়ানির গন্ধে ম ম করছে।বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটি সামলে আমি ঘরের এককোনে গিয়ে গিনিপিগদের দেখতে লাগলাম।সফদর আলী দুর্বল গলায় বললেন, মহা বিপদে পড়েছি।
কী বিপদ?
দেখছেন না! দিনরাত গিনিপিগেরা শুধু বিরিয়ানি রান্না করে যাচ্ছে। কেন? আপনি না বলেছিলেন তেতাল্লিশটা গিনিপিগ,এখানে তো মনে হয় তেতাল্লিশ শো! তেতাল্লিশটা তো ছিল,কিন্তু মাঝে বাচ্চ হল সবার! আমার বাচ্চা বাড়ানোর ঔষধটা প্রয়োগ করে দেখছিলাম,তাতে অল্প সময়ে সবগুলোর নাতি পুতি হয়ে গেছে।সব মিলিয়ে প্রায় চারশো গিনিপিগ। মোটে চারশো? দেখে তো মনে হচ্ছে লাখখানেক! আপনাদের হিসাবে প্রায় একহাজার,আমার হিসাবে ষোলোভিত্তিক,তাই আমার একশো হয় দুশো ছাপ্পান্নতে। এই সবগুলোকে আপনি বসে বসে রান্না শিখিয়েছেন? মাথা খারাপ আপনার?বাচ্চাগুলো নিজে নিজে মা- বাবাদের দেখে দেখে শিখে নিয়েছে।সফদর আলী মাথা চুলকে বললেন,’এখন সবাই রান্না করতে জানে,আর মুশকিল হচ্ছে, এরা দিনরাত শুধু রান্নাই করে যাচ্ছে,দিনে ত্রিশ চল্লিশবার রান্না হচ্ছে।কিভাবে থামাই বুঝতে পারছি না।
কেন?
একশবার ডেকচিগুলো কেড়ে নিতে চেষ্টা করেছিলাম,সবাই মিলে আমাকে আক্রমণ করল। কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছি।
আমি গিনিপিগগুলো দেখেই বুঝতে পারলাম সমস্যাটি সহজ নয়,এতগুলো গিনিপিগ থামানো কঠিন।সবাই যদি একটু করে খামচে দেয়,শরীরের চামড়া উঠে যাবে। আমার হঠাৎ মনে পড়ল,সফদর আলী বলেছিলেন,তিনি প্রথমে একটা ঘন্টা বাজাতেন,তখন রান্না শুরু হয়।আমি জিজ্ঞেস করলাম,সফদর সাহেব,আপনার সেই ঘন্টাটি কোথায়?
ঐ যে তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।আশেপাশে কয়েকটা গিনিপিগ ঘোরাঘোরি করছে,মাঝে মাঝে একটা এসে ঘন্টা বাজিয়ে দেয়,আর নতুন রান্না শুরু হয়। আপনি তো বলেছিলেন ঘন্টাটা আপনি নিজে বাজাতেন? প্রথমে তা-ই বাজাতাম,আমাকে দেখে দেখে এখন নিজেরাই শিখে নিয়েছে।যখন খুশি বাজিয়ে দেয়। ইলেক্ট্রিক ঘন্টা বাজানোর খুব সুবিধে। আমি সাবধানে ঘন্টাটা তুলে নেয়ার চেষ্টা করতেই প্রায় শখানেক গিনিপিগ আমায় ঘিরে ধরল,আমি লাফিয়ে সরে এলাম।
সফদর আলী ছুটে এসে বললেন,’সর্বনাশ! এদের ঘাঁটাবেন না,মাংস শেষ হয়ে আসছে,আপনাকে কেটে বিরিয়ানির মাঝে দিয়ে দিবে।
আমি ঢোক গিলে বললাম,ঘন্টা বাজানোটা বন্ধ করলেই তো সব বন্ধ হয়ে যায়। ঘন্টাটা কোনোমতে সরিয়ে ফেললেই হয়। সফদর আলীর মুখ উজ্জল হয়ে উঠল,হাতে কিল দিয়ে বললেন,ঠিক বলেছেন!কী বোকা আমি,একবারও এই সহজ জিনিষটা মনে আসেনি। ইলেক্ট্রিক ঘন্টা এটা,প্লাগ খুলে ফেললেই হবে,ঘন্টাটা সরাতেও হবে না।সফদর আলী ছুটে গিয়ে প্লাগটা টেনে খুলে ফেললেন। সত্যি সত্যি কিছুক্ষনের মাঝে শুরু হওয়া নতুন রান্না বন্ধ হয়ে গেল।যেসব রান্না আগেই শুরু হয়েছিল,গিনিপিগেরা সেগুলো শেষ করে গুটিগুটি নিজেদের ঘরে ফিরে গেল। নিশ্চয়ই এরকমই ট্রনিং দেয়া হয়েছে।যে কয়টা গিনিপিগ ঘন্টা বাজানো শিখে এরকম দূর্গতির সৃষ্টি করেছে,শুধু সেগুলোই ঘুরাঘুরি করতে থাকে,একটু পরে পরে এসে ঘন্টা বাজানোর চেষ্টা করতে থাকে,কিন্তু প্লাগ খুলে নেয়ায় আর শব্দ হয় না।একসময় সেগুলোও ঘরে ফিরে গেলে সফদর আলী দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাসিমুখে ফিরে এলেন। ছয় ডেকচি বিরিয়ানি রান্না হয়ে আছে।আমরা সেগুলো বাইরে বিতরণ করে দিলাম।কয়েকজন জিজ্ঞেস করল,কাল কখন আসবে,সফদর আলী যখন বললেন আর আসতে হবে না-তারা বেশ অবাক হল।একজন তো রেগেই গেল-মনে
হল,সে নাকি দেশে চিঠি লিখে দিয়েছে-তারপরিবারের অন্য সবার আজ রাতে পৌঁছে যাবার কথা! সে এখন কি করবে সফদর আলীর কাছে জানতে চাইল,সফদর আলী কিছু বলতে পারলেন না।দরজায় তালা মেরে একটা রিকশা নিলেন,অনেক দিন জিলিপি খাওয়া হয় না,আজ জিলিপি খাওয়া হবে। শেষ খবর অনুযায়ী,সফদর আলী তাঁর একহাজার গিনিপিগকে জমি চাষ করা শেখাচ্ছেন। তাঁর বাসার পেছনে খালি জায়গা আছে,সেখানে নাকি তারা আলু,ফুলকপি,আর টমেটো লাগাচ্ছে! একটু বড় হলেই আমাকে দেবেন বলেছেন।আমি অপেক্ষা করে আছি। আজকাল সবজির যা দাম!
সমাপ্ত