ড. ব্যানার ও টনি স্টাক দুইজন পাগল বিজ্ঞানী ৷ কী ভাবছেন ? বিজ্ঞানী আবার পাগল হয় কী করে, তাই তো ? আরে পাগল বলতে মানসিক ভারসাম্যহীন বুঝায়নি ৷ এরা বিজ্ঞানের নেশায় মেতে থাকে সবসময় ৷ বিজ্ঞানের নতুন নতুন চমক আবিষ্কার করতে পাগল ৷ তাই তাদের পাগল বিজ্ঞানী বলতে বাধ্য হলাম ৷ তাদের সহকারী হিসাব সবর্দা তৎপর থাকে যারবেস ৷ যারবেসও বিজ্ঞানের একটি চমক ৷ যারবেস একটি পোগ্রাম অতঃপর একটি রোবটও বটে ৷ যারবেস টনি স্টাকের অন্যতম একটা আবিষ্কার ৷ যারবেসের কাছে রয়েছে এক’শ লোকের শক্তি আর মেধা ৷ যারবেস যেকোনো বড় জটিল সমস্যা মুহূর্তের মধ্যে সমাধান দিতে পারে ৷ আজকাল তারা তিনজন বিজ্ঞানের নতুন চমৎকার আবিষ্কারে হাত দিয়েছেন ৷ তারা এমন এক প্রকার কেমিক্যাল আবিষ্কার করতে চলেছে যেটা মানুষের শারীরিক শক্তিকে সাধারণের চেয়ে কয়েক’শ গুণ বাড়িয়ে দিবে ৷ আরেকটু বুঝিয়ে বলি, তারা আবিষ্কার করতে চলেছে এমন একটা কেমিক্যাল ভাইরাস যেটা মানুষের শরীরে প্রবেশ করানোর সাথে সাথে মানুষটির মধ্যে পশুর শক্তি চলে আসবে ৷ মানে শরীর ও চিন্তাধারা মানুষের কিন্তু শক্তি; বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, হাতি, নেকড়ে এই জাতীয় পশুর৷ তাও আবার একটা দুইটা পশু নয়, একই জাতীয় এক’শ পশুর শক্তি ৷ বিষয়টা এখন সারাদেশে তোলপাড় ৷
শহর থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে একটা গ্রাম ৷ গ্রামের নাম সুলতানপুর ৷ নামের মতোই এক প্রকার সুলতানীত্ব বিরাজ করে গ্রামটির মধ্যে ৷ যত দূর চোখ যায় চারদিকে সবুজ লাবন্য ঘেরা ফসলের জমি অার জমি ৷ এঁকে বেঁকে বয়ে চলে গ্রামের পথ ৷ অার রাস্তার দু’পাশ দিয়ে পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে অাছে সারি সারি অসংখ্য মেহগনি গাছ ৷ গ্রামের দু’পাশ বেয়ে বয়ে চলে ছোট ছোট দু’টি নদী ৷ গ্রামের মানুষের প্রাধান ও শখের কাজ হলো মাছ ধরা অার ফসলের জমি চাষাবাদ করা ৷ গাঁয়ের পথ ধরে চলতে গেলে এক অন্যরকম অনুভূতির কাজ করে মনের মধ্যে ৷ কিচিরমিচির কণ্ঠে পাখির গুণগুণ করা গান ৷ হলে হলে বয়ে যাওয়া মিষ্টি শীতল বাতাস এবং চারদিকে সবুজ শ্যামল ছায়া ঘেরা পটভূমি৷ এসব মিলিয়ে সত্যিই এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে মনে ৷ এই রকম প্রাকৃতিক প্রতিকূলে জন্ম জাহিদের ৷ মা খালেদা বেগম আর বাবা ইসহাক মিয়ার অাদরের একমাত্র ছেলে ৷ তাই অাদর সোহাগ ও ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না ৷ বাল্যকাল থেকেই অনেক দুরন্তপনা বিরাজ করত ছেলেটির মধ্যে ৷ জন্মের পর থেকে প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়েছিল তার তনু মন ৷ গাঁয়ের পথ দিয়ে ছোটাছুটি করা ৷ অানমনে পাখির মতো গুণগুণ করা ৷ নদীর পানিতে ঝাপ দিয়ে গোসল করা ৷ বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে দিন কাটানো ছিল তার নিত্যদিনের কাজ ৷
এক দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে জাহিদ ৷ টিভিতে নিউজ চলছে ৷ ড. ব্যানার আর টনি স্টাকের নতুন আবিষ্কারের প্রজেক্টটা ফেল করেছে ৷ টনি স্টাক সাংবাদিকদের ইন্টারভিউতে বলছে,
“আমরা আমাদের নতুন আবিষ্কারের অনেকটাই কাছে চলে গিয়েছিলাম ৷ কিন্তু ছোট্ট একটা ভুলের কারণে প্রজেক্টটা ফেল করেছে এবং একটা ভয়ানক রূপ নিয়েছে ৷ আমরা একটি মানুষের শরীরে নেকড়ের শক্তির আনার লক্ষ্যে আমাদের নতুন কেমিক্যাল ভাইরাসটা ইনজেক্ট করেছিলাম৷ মানুষটার মধ্যে নেকড়ের শক্তি এসেছে ঠিকই ৷ কিন্তু কেমিক্যালটাতে অতিরিক্ত গামা রিডিয়েশনের কারণে মানুষটা নিজের চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ৷ এখন সে পুরোপুরি নেকড়েতে পরিনত হয়ে গেছে ৷ বলতে পারেন নেকড়ে মানব ৷ নেকড়ের মতো মানুষদের আক্রামণ করছে ৷ শুধু তাই নয় যাকে কামড় দিচ্ছে সেও ঐ ভাইরাসটার শিকার হয়ে নেকড়ে মানবে পরিনত হচ্ছে ৷ আমাদের কাছে এই পর্যন্ত খবর এসেছে প্রায় চার হাজারের মতো লোক এই ভাইরাসের শিকার হয়েছে ৷ আক্রান্ত ব্যক্তি কামড় দেওয়ার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই এই ভাইরাসটা মানুষের শরীরে কাজ শুরু করে ৷ প্রথমে মুখ দিয়ে ফেনা বের হয় ৷ চোখগুলো ঘোলাটে হতে শুরু করে ৷ এভাবে ধীরে ধীরে পুরো গতিবিধি নেকড়েতে পরিনত হয়ে যায় ৷ আর মানুষদের উপর আক্রমণ শুরু করে ৷ আপনাদের আশেপাশে এমন কোনো ব্যাক্তিকে দেখলে সাত পাঁচ না ভেবে তাকে মেরে ফেলুন আর নিজেকে হেফাজতে রাখুন ৷ আমরা চেষ্টায় আছি এই ভাইরাসের এন্টিবায়োটিক তৈরি করার ৷ ইনশাআল্লাহ আমরা এতে খুব তাড়াতাড়ি সফলতা লাভ করবো ৷”
শহরে চলছে নেকড়ে মানবের আতঙ্ক, অপরদিকে গ্রামে নতুন বসতির আগমন ৷ নদীর বুকে সব হারিয়ে বাবুল মিয়া তার স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে সুমিকে নিয়ে বসতি গড়তে এসেছেন এই গ্রামে ৷ কোনো এক সুবাদে সুমির বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে জাহিদের নজর পড়ে সুমির দিকে ৷ বাসার সামনে দিয়ে যেতেই দেখল এক ভয়ংকর মায়াবী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে। চেহারা এতই উজ্জ্বল যে জাহিদের চোখ জ্বলছে তাকাতেই ৷ টানা টানা ভ্রূ, গাঢ় বাদামী রঙের মাছের মতো ছোট ছোট চোখ, চুল রেশমি সুতোর মালার মতো মাটি ছুইছুই করছে । গোলাপের পাপড়ীর মতো কোমল এক জোড়া ঠোঁট ৷ বাচ্চাদের মতো গাল দু’টো গুলুগুলু ৷ চিবুকে কালো তিল ৷ সব মিলিয়ে এত অপরূপ যে জাহিদের
বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো এমন মেয়ে মানুষও পৃথিবীতে থাকতে পারে ! জাহিদ ভাবছে হয়তো মেয়েটা স্বর্গ
থেকেই পালিয়েছে ৷ জাহিদের বিভ্রম কাটল মেয়েটির ডাকে,
“এই যে মিষ্টার, কী দেখছেন অমন করে ? মেয়ে মানুষ আগে কখনো দেখেননি ?”
জাহিদ একটু ইতস্তত করে বলল,
“মেয়ে মানুষ তো জীবনে অনেক দেখলাম, তবে ডানা কাটা পরী এই প্রথম দেখলাম ৷ তাই একটু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ৷”
সুমি ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি তুলে বলল,
“ওওও ! তাই বুঝি ?”
“হুমমম !”
“আমি সুমি ৷ আপনাদের এলাকায় নতুন এসেছি ৷”
“ওওও ! আচ্ছা ৷ আমি জাহিদ, ইসহাক মিয়ার ছেলে ৷ কোনো প্রয়োজন বা সমস্যা পড়লে জানাবেন, সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবো ৷”
এভাবেই শুরু হয় জাহিদ আর সুমির বন্ধুত্ব ৷ ধীরে ধীরে তারা খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠে ৷ খুব ভালোই বন্ধুত্ব চলছে দু’জনের।যখন যা কিছুই হয় সুমি আর জাহিদ দু’জনই একে অপরের সাথে আলাপ করে।একজন আরেকজনকে না দেখে একদিনও থাকতে পারে না।
কোনো এক কাজের সুবাদে সুমির বাবা বাবুল মিয়া শহরে গিয়েছিলেন ৷ ফিরে আসার আধ প্রহর পর তার মধ্যেও নেকড়ে মানবের লক্ষণ দেখা দেয় ৷ গ্রামের লোকজন নিজেদের বাঁচাতে বাবুল মিয়াকে মেরে ফেলেন ৷ তার মধ্যে জাহিদও ছিল একজন ৷ এর ফলে সুমি আর জাহিদের বন্ধুত্বের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হয় ৷ সুমি সবসময় গোমরামুখী থাকে ৷ জাহিদের সাথে বেশি কথা বলতে চাই না ৷ সবর্দা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে ৷ অন্যদিকে এতদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্কে থাকার ফলে জাহিদ অনেকটায় প্রেমে পড়ে যায় সুমির ৷ যার কারণে সুমির এই বিচ্ছেদ খুব কষ্ট দিচ্ছে জাহিদকে ৷ শেষে এমন অবস্থা হলো যে তাদের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় যায় অবস্থা । এই অবস্থায় জাহিদ আর সুমির বন্ধুত্ব
রাখাটাও বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রেম তো অনেক
দূরের কথা । কী করবে ভেবে পায় না জাহিদ। জাহিদের মা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন ছেলের মনের খবর, তিনি জাহিদকে সুমির সাথে সরাসরি সব মনের কথা বলার সায় দেন ৷ কিন্তু জাহিদ সুমিকে কিছু বলার সাহস
যোগাতে পারছে না মনে । ইদানীং এসবের চিন্তায় জাহিদ ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না ।
পরিশেষে ঠিক করলো, নদীর পাশে যে অপূর্ব জাগরণী ভূমি রয়েছে সেখানে নিয়ে গিয়ে সুমিকে মনের সব কথা বলে দিবে জাহিদ । জাগরণী বলার কারণ হলো এখানে কোনো মানুষ বেড়াতে গেলে সে প্রকৃতির সৌন্দর্যে এতই নিমগ্ন হয়ে যায় যে মনে হয় পুনঃ আবির্ভাব হয়েছে প্রাণের। “হুমমম ! এটাই ঠিক জায়গা ৷” জাহিদ ঠিক করল যে সুমিকে নিয়ে সেখানে ঘুরতে যাবে । মনের অব্যক্ত ভালোবাসার কথাটা বলতে পারলেই মনের হতাশাগুলো কিছুটা হলেও কমবে। সুমিও মেনে নিলো, কারণ হাজার হোক এক সময় তারা খুব ভালো বন্ধু ছিল ৷ একটি নির্দিষ্ট দিনেই লুকিয়ে তারা নদীর পাশে হাঁটতে গেল । হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা বলছে দু’জন ৷ কিন্তু জাহিদের মনে তোলপাড় চলছে ভালোবাসার কথাটুকু বলতে । কিছুতেই সাহস যোগাতে পারছে না জাহিদ ৷ প্রেমের পীড়া এত গভীর কেন ? প্রায় সন্ধ্যা হতে চলেছে। তা দেখে সুমি বলল,
“জাহিদ আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়। চল বাড়ির পথে যাই এবার।”
“সুমি,তোকে একটা কথা বলতে চাই। প্লিজ আমাকে একটু সময় দে ৷”
“আচ্ছা ঠিক আছে ৷ কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বল ৷”
“দেখ সেই প্রথম দিন থেকে তোকে দেখেই…” ৷ কথাটি আর শেষ করতে পারল না জাহিদ ৷ হঠাৎই তারা
শুনতে পায় কিছু একটা আসছে তাদের দিকে ৷
কয়েক মুহূর্ত পরেই গাছের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে এক নেকড়ে মানব । হিংস্র চাহনি, মুখ থেকে অনর্গল লালা ঝরছে ৷ এত ভয়ংকর দৃষ্টি যেনো
মানবজাতির অস্তিত্বই সে চায় না । গরগর করতে করতে সামনে এগোচ্ছে । এদিকে সুমি এতই ভয় পেয়েছে যে প্রায় অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা ৷ সুমিকে
ইশারায় দূরে সরে যেতে বলল জাহিদ। আরও এক মুহূর্ত নীরবতা । নেকড়ে মানবটি প্রস্তুতি নিচ্ছে জাহিদের উপর আক্রমণ করার ৷ জাহিদও তৈরি ৷ তারপরই নেকড়ে মানব আর জাহিদ একজন আরেকজনের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। জাহিদের কাছে অস্ত্র হিসাবে ছিল শুধুমাত্রই শুকনো একটা গাছের ডাল ৷ বিপরীতে শত নেকড়ের শক্তি নিয়ে সামনে নেকড়ে মানব । প্রথমেই এক থাবার মাধ্যমে জাহিদকে মাটিতে শুইয়ে দিল নেকড়ে মানবটি । জাহিদ শুকনো গাছের ডালটি নেকড়ে মানবের মুখে গুঁজে দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে নেকড়ে মানবের কামড় থেকে বাঁচার ৷ একদিকে শক্তিশালী অপর দিকে এত হিংস্র নেকড়ে মানব, এর আগে কখনো দেখেনি জাহিদ । সাথে সাথেই পেটে
লাথি দিয়ে সরিয়ে দিলো তার উপর থেকে নেকড়ে মানবটিকে । নেকড়ে মানবটা আবারও পাল্টা আক্রমণ করল ৷ এবার তার প্রকাণ্ড থাবায় দুই টুকরো হয়ে গেল ডালটি। সাথে সাথেই জাহিদ প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে নেকড়ে মানবটির মাথা চেপে ধরল । আর সুযোগ বুঝে ভাঙা ডালের একটা ধারালো টুকরো নেকড়ে মানবটির গর্দানে গুঁজে দিয়ে হত্যা করলো নেকড়ে মানবটিকে ৷
এতক্ষণ গাছের আড়াল থেকে দেখছিল সবকিছু সুমি ৷ দৌড়ে এসে কোনোমতে ধরে জাহিদকে টেনে তুলল। জাহিদ রক্তাক্ত আর অনেকটাই দূবল হয়ে পড়েছে ৷ সুমিকে সাথে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল জাহিদ ৷ কিছুদূর আসতেই জাহিদ বুঝতে পারল একটি জায়গা থেকে খুব বেশি রক্ত পড়ছে। সাথে সাথেই হাটুর দিকে তাকাতেই দেখল দুটি দাঁতের গভীর ক্ষত।কেমন মোহনীয় রূপ তৈরি করেছে ৷ গলগল করে গর্ত দুটি হতে ঝর্ণার মতো রক্ত বেরুচ্ছে । তা দেখে চিৎকার করে নিজের পরনে ফ্রকটা ছিড়ে ক্ষত জায়গাটিতে বেঁধে দিলো সুমি । আর ডাক্তার দেখাতে বলল ৷ জাহিদ সুমির কথায় কান না দিয়েই বাড়িতে চলে আসলো । বাড়ি ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না কী হয়েছে।লুকিয়ে কিছু ভেষজ ক্ষতস্থানে দিলেও বুঝা যাচ্ছে কোনো কাজ হবে না এতে । কাউকে বললেও বুঝে যাবে এটা নেকড়ে মানবের কামড়, তখন এই যন্ত্রণা থেকেও আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি হবে।
রাত হতেই প্রচণ্ড জ্বর উঠেছে জাহিদের ৷ জ্বরে কাতরাচ্ছে বিছানায় ৷ প্রচুর বিষক্রিয়া শুরু হয়েছে ৷ পায়ে মনে হয় কেউ হাতুড়ি দিয়ে বারবার আঘাত করে তার সব হাড় চুরমার করে দিচ্ছে । মুখ থেকে ফেনা ঝরছে ৷ তবুও কিছুই করার নেই। অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায়
কিলবিল করছে জাহিদের ৷ বারবার চোখে ভাসছে সেই নেকড়ে মানবটির হিংস্র মুখ । কেনই বা করতে গেল এসব, এক তুচ্ছ মেয়েটির জন্য ? এটার নামই কি তাহলে ভালোবাসা ? আবার এটাও ভাবছে যদি নেকড়ে মানবটিকে না মারত হয়তো সুমিকেও সে হারিয়ে ফেলত । না এখানে আর থাকা যাবে না ৷ যেকোনো মুহূর্তেই সে নেকড়ে মানবে পরিনত হতে পারে ৷ আর তার পরিবার ও প্রিয়জনদের ক্ষতি করতে পারে সে ৷ সে তার প্রিয় মানুষগুলোর ক্ষতি করতে পারে না ৷ কিছুতেই না ৷ তাই জাহিদ সিদ্ধান্ত নিলো অনেক দূরে চলে যাবে সে ৷ আর তাই করলো জাহিদ, রাতে আধারে হারিয়ে গেল জনমানবের আড়ালে ৷
সকাল হতেই ছেলেকে না দেখে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে খালেদা বেগম ৷ পরে সুমির কাছে জানতে পারলো সবকিছু ৷ ব্যাপারটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল পুরো গ্রামে ৷ গ্রামের লোকজন চারদিকে খোঁজাখুজি করছে জাহিদের ৷ দেখলেই মেরে ফেলা হবে জাহিদকে ৷
হঠাৎই দূর থেকে জাহিদ শুনতে পারছে সুমির আওয়াজ ৷
“জাহিদ ৷ জাহিদ ৷ কোথায় তুই ?”
আরেকটু মনযোগ দিয়ে শুনলো জাহিদ ৷ হুম কণ্ঠটা সুমির ৷ সে এখানে কী করছে ? আর আমি বা এখানে আছি তা জানলো কীভাবে ? সুমির সামনে গিয়ে বলল,
“কেন এসেছিস এখানে তুই ? চলে যা এখান থেকে ৷ যেকোনো সময় আমি নেকড়ে মানবের রূপ ধারণ করে তোর ক্ষতি করতে পারি ৷ তুই চলে যা এখান থেকে ৷ আমি চাই না ৷ আমার জন্য কারও কোনো ক্ষতি হোক ৷”
সুমি ততক্ষণে কেঁদে অস্তির ৷ কেঁদে কেঁদে বলল,
“আমি জানি, আমার কারণে তোর এই অবস্থা হয়েছে। জাহিদ ক্ষমা করে দে তুই আমাকে।”
জাহিদ কোনো কথা বলছে না।
“আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস, সেদিন আমি
বুঝে গিয়েছিলাম তোর মনের অব্যক্ত কথাগুলো । কিন্তু আমি তোকে আর আমার ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি। আমিও যে তোকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি ৷ শোন এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা নিরাপদ নয়।
তোকে নিয়ে এমন একটা জায়গায় পালাবো যেখানে কেউ আমাদের ধরতে পারবে না। তোর সাথে যদি মরতেও হয় তাতে আমি রাজি ৷”
“কোথায় যাবো আমরা ? লোকজন তো এতক্ষণে খুঁজছে আমাকে মেরে ফেলার জন্য ৷ জানি না আব্বু আম্মু কেমন করছে !”
“তুই চল আমার সাথে ৷”
তারা দৌড়াচ্ছে আপন গতিতে ৷ একটু পরেই তারা চলে এলো গ্রামের সীমান্তে । একটু অবাক হয়ে জাহিদ সুমিকে বলল,
“আমরা এখানে কী করছি সুমি ? কেন নিয়ে এসেছি তুই আমাকে এখানে ?”
জাহিদের প্রশ্ন শেষ হতে না হতে, সাথে সাথেই পেছন থেকে দু’জন লোক তাকে জড়িয়ে ধরল ৷ আর সাথে সাথেই শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলল জাহিদকে । জাহিদ চিৎকার করছে ।
“সুমি তুই এটা কী করলি ? ওরা আমাকে এভাবে বাঁধছে কেন ? সুমি তুই কি তাহলে বিশ্বাসঘাতকতা করলি ?”
“শোন জাহিদ, তুই যখন নেকড়ে মানবে পরিণত হবি তখন আর বাস্তবতা স্বাভাবিক থাকবে না।তুই সমাজের
জন্য বিপদজনক।এখন যেখানে যাচ্ছিস সেখানটা তোর জন্য এবং মানুষের জন্য নিরাপদ । স্বর্গ কি কম সুখের ?
তাছাড়া আমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নেব না, এটা তুই ভাবলি কী করে ? ভালোবাসার অভিনয়টা ছিল একটা সাজানো নাটক। আমি দুঃখিত জাহিদ ৷ পারলে ক্ষমা করে দিস আমায় ।”
জাহিদকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৷ আর জাহিদ চিৎকার করে বলছে,
“সুমি তুই এমন করতে পারিস না । তুই আমাকে ভালোবাসিস । আমি তোকে ভালোবাসি । এটা করতে
পারিস না তুই । আমি তো অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম ৷ কেন নিয়ে আসলি তুই আমাকে এখানে ৷ সুমি ! সুমি ! সুমি …….৷”
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল। চারতলা মনোরোগ বিভাগ। কেবিনে শুয়ে আছে জাহিদ । পাশেই
ডাক্তার সুমি, ডাক্তার মিত্রা ও ডাক্তার চৈতী। বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ।
“ডক্টর আমার ছেলের কী হয়েছে ? আমার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে তো ? এখন কেমন আছে সে ?”
আকুতির সাথে প্রশ্নগুলো করলেন জাহিদের মা ।
কেবিনের বাহিরে এসে ডাক্তার সুমি বলতে লাগলেন,
“আপনার ছেলে লাইকানথ্রোপিতে আক্রান্ত । এটি ক্লিনিক্যাল সিজোফ্রেনিয়ার একটি রূপ । আগে পাওয়া তথ্য মতে নেকড়ে মানব বা ওয়ারওল্ফদের প্রতি জাহিদের ছিল তীব্র নেশা ৷ সেটা হোক মুভি, বই কিংবা গেইমস থেকে । একসময় এতই আসক্ত হয়ে পড়ে যে নিজেকেই ভাবতে শুরু করে একজন নেকড়ে মানব । নিজে নিজেই সৃষ্টি করছে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি । খুব প্রখর কল্পনাশক্তি তার। তাকে হাই ডোজ ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। খুব রেয়ার রোগটি ৷”
খালেদা বেগম আবারও প্রশ্ন করলেন,
“এখন উপায় কী ? আমার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে তো ?” প্রশ্নগুলো শুনেই ঘাড় ঘুরিয়ে এক নজর জাহিদের দিকে তাকালেন সুমি ৷ খুব মায়াবী চেহারা ছেলেটার । দেখে মনেই হয় না এত বড় রোগ বাসা বেঁধেছে মনে । কৃত্তিমভাবে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ আপনার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ ৷” যদিও বা ডাক্তার সুমি জানে এই রোগের কোনো প্রপার ট্রিটমেন্ট নেই ৷ বিজ্ঞান এখনো এই রোগের ঔষধ আবিষ্কার করতে অক্ষম ৷